আগে যা হয়েছে: পরিমল জিআরই পরীক্ষা দিয়ে ফেরার সময় পাসপোর্ট হারায়। গোয়েন্দা বিভাগ থেকে একটা চিঠি পেয়ে সে ভবানী-ভবন আসে আব্দুর রহিমের সাথে দেখা করতে। তিনি পরিমলকে তার পাসপোর্ট টি ফিরিয়ে দেন। বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: এই রচনার সমস্ত চরিত্র বাস্তব নয়। জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তিবিশেষের সাথে কোনরকম সামঞ্জস্য সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত। নিরাপত্তার কারণে কিছু নামধাম বদলে দেওয়া হলো।
-‘ কি রে, বাইরের দিকে তাকিয়ে কি এত ভাবছিস? সিটবেল্ট বেঁধে নে।’
-‘ তুমি কখন উঠলে ঘুম থেকে?’
-‘ মিনিট দশেক হবে, তুই কি রেস্টরুম যাবি? তাহলে এখুনি যা। প্লেন থেকে নেমে তোকে তো আবার অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে।’
-‘ ঝামেলা মানে?’
-‘ ইমিগ্রেশন এর লাইনটা শিকাগোয় বিশাল লম্বা হয়। তারপর তোকে তো আবার টার্মিনাল চেঞ্জও করতে হবে। যা যা, দেরী করিস নে।’
পরিমলকে বেরোতে দেওয়ার জন্য নিজের সিট্ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সৌগত। দিল্লী এয়ারপোর্ট এর স্মোকিং রুমে ওদের আলাপ হয়েছিল। বছর পাঁচেকের বড় সৌগত, পরিমলের থেকে। শিকাগোর কাছেই থাকে সে আপাতত। ঘটনাচক্রে প্লেনে ওদের পাশাপাশি সিট্ পরে গেছিল। পরিমলের এটা প্রথম আমেরিকা যাওয়া শুনে সৌগত ওকে জানলার ধারের সিট্ অফার করে। তারপর গত ১৪ ঘন্টায় অনেক আড্ডা মেরেছে দুজনে। কথায় কথায় পরিমল জানতে পারে, সৌগত বেশ কয়েক বছর আমেরিকায় রয়েছে। তার কাছে আমেরিকায় থাকার অভিজ্ঞতা শুনে নিজের মনের ছবির সাথে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল সে। বাস্তবিকই, দুটোর মধ্যে অনেক অনেক পার্থ্যক্য।
নিজের সিটে ফিরে এলো পরিমল। একটানা অনেকক্ষণ বসে থাকার কারণে পা দুটোয় যে জড়তার ভাবটা এসেছিল, সেটা কেটে গেছে। প্লেন এখন অনেকটাই নিচে। বিশাল শিকাগো শহরের আলোগুলো এখন অনেকটা স্পষ্ট। সৌগত তাকে লেক মিশিগানের কথা বলে। শিকাগো শহরের গা ঘেঁষে অবস্থিত এই লেক। পঞ্চলেকের অন্যতম এই লেক একমাত্র যার পুরোটাই আমেরিকার মধ্যে (বাকি চারটি লেক সুপিরিয়র, লেক ইরি, লেক অন্টারিও আর লেক হুরণ, এদের প্রতিটির কিছু অংশ কানাডার মধ্যে), আয়তনের দিক থেকে লেক সুপিরিয়রের পরেই এর স্থান। বিশাল এই লেক প্রায় ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার সমান। ক্লাস এইট এর ভূগোল বইতে যখন ওরা এইসব পরেছিল, তখন কেউই জানত না যে কোনদিন এদের চাক্ষুষ দেখার ও সুযোগ আসবে। পরিমল জানলা দিয়ে উঁকি মারছে দেখে সৌগত বলে,
-‘ এই অন্ধকারে কি এত বাইরে দেখছিস?’
-‘ না মানে, লেকটা দেখার চেষ্টা করছিলাম।’
-‘ সেটা এতক্ষণে আমরা পেরিয়ে চলে এসেছি। খেয়াল করিসনি বোধহয়।’
-‘ পেরিয়ে চলে এসেছি? অতবড় একটা লেক পেরিয়ে চলে এলাম আর আমি দেখতেই পেলাম না!’ বিস্মিত হয়ে ওঠে সে।
-‘ আরে এই অন্ধকারে নিচের সবই তো কালো দেখছিলিস, তাই খেয়াল করিসনি। তোর পরের প্লেন তো ৭:৩০ নাগাদ ছাড়বে। তখন ভালো করে দেখিস।
-‘ হুম।’
সৌগত পরিমলের অলক্ষ্যে একটু ছোট্ট করে হেসে নেয়। নিজে যখন সে প্রথমবার শিকাগো এসেছিল তখন এয়ারপোর্ট এ প্লেন ল্যান্ড করার পরেও সে ঘুমোচ্ছিল। পাশের এক সহযাত্রী তাকে ডেকে দেওয়ায় তার ঘুম ভাঙ্গে। সৌগত লেক মিশিগান দেখেছে অনেক পরে, যদিও পরিমল সেকথা জানে না। “বেচারার মন খারাপ হয়ে গেল বোধহয়”, ভাবে সে।
-‘ এই তোর পাসপোর্ট ফেরত পাওয়ার গল্পটা শেষ করার আগেই আমি ঘুমিয়ে পরলাম। তারপরে কি হলো?’
-‘ গল্প নয় মোটেই, সত্যি ঘটনা।’
-‘ ওই হলো, বেশ গল্পের মত সাজিয়ে গুছিয়ে বলছিলিস কিনা, তাই বললাম।’
-‘কতদূর শুনেছ তুমি?’
-‘ ওই তো, ভবানী ভবনে কার সাথে একটা দেখা করতে গেলি। দিয়ে তারপর কি হলো? পেয়ে গেলি নিশ্চয় ওটা ফেরৎ।’
-‘ হুম, রহিম বাবু মানে যার সাথে দেখা করতে গেছিলাম, তিনি ওটা আমাকে ফিরিয়ে দিলেন।’
-‘আর বাকি গুলো? মানে তোর ভোটার কার্ড বা ড্রাইভিং লাইসেন্স। সেগুলো পেলি?
-‘ নাহ, সেগুলো আর পাইনি। পরে ডুপ্লিকেট করিয়ে নিয়েছি।’
-‘ কিন্তু এই রহিমবাবু সেটা পেলেন কিভাবে?’
জবাবে পরিমল সৌগতকে যা বললো, তার সারমর্ম হলো এই। রহিমবাবু বারাসাতে থাকেন। ওনার অফিসের গাড়ি ওনার বাড়ি অব্দি যেতে পারে না, রাস্তার সংকীর্ণতার কারণে। উনি রোজ সকালে একটা রিকশা করে বড় রাস্তা পর্যন্ত আসেন। শনিবার সকালে ( পরিমল পাসপোর্টটা হারিয়েছিল শুক্রবার রাতে) রোজকার মত তিনি রিক্সায় উঠলে, রিকশাচালক ওনাকে গতরাত্রে বাস ডিপোর পাশে কুড়িয়ে পাওয়া পরিমলের পাসপোর্ট টা দেয়। অশিক্ষিত রিকশাচালকটির মনে হয়েছিল যে এই অশোকস্তম্ভের ছাপ দেওয়া কিম্ভুত দেখতে বইটা হয়ত কারো দরকারী জিনিস। রহিমবাবু যখন পরিমলকে ঘটনাটি বলেছিলেন তখন পরিমল চেয়েছিল বারাসাত গিয়ে সেই রিকশাওয়ালা কে খুঁজে বের করে তাকে পুরস্কৃত করতে। রহিমবাবুকে জানাতে তিনি বলেছিলেন,
-‘ তুমি হয়ত তাকে খুঁজে পাবে না। কারণ তাকে আমিও ভালো চিনি না। তবে এতে দুঃখ পেও না। জীবনে অনেক মানুষকে পরে সাহায্য করার সুযোগ পাবে। তখন তাদেরকে সম্পূর্ণ ভাবে সাহায্য কোর, সেটাই হবে তোমার আসল ঋণশোধ।’
-‘ নাহ তোর কপাল আছে, পাসপোর্ট হয়ত অনেকেই কোনো না কোনো ভাবে অবধি কিন্তু চারদিনের মাথায় সেটা ফিরে পাওয়া, তাও আবার এইভাবে, এটা অবিশ্বাস্য। গুল মারছিস নাতো ভাই?’ খানিকটা বঙ্কিমী কন্ঠে বলে ওঠে সৌগত।
-‘ ঠিকই বলেছ, গুলই বটে।’
-‘ আরে আমি মজা করছিলাম ভাইটি। দ্যাখ এবার আমরা ও-হেয়ার এয়ারপোর্ট এ নামছি।
সৌগতর কথা শেষ হতে না হতেই পরিমল অনুভব করলো যে ফ্লাইট এর চাকা মাটি ছুঁয়েছে। তার মানে সে সত্যি সত্যি এখন আমেরিকার মাটিতে। তথ্যটা উপলব্ধি করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো পরিমলের। সৌগত তার বিহ্বলতা বুঝে ওপর থেকে তার ব্যাগ নামিয়ে পরিমলকে ধরিয়ে দিয়ে বলল ওর পেছন পেছন আসার জন্য। অদ্ভূত একটা ঘোরের মধ্যে সৌগতর পেছন পেছন প্লেন থেকে নেমে এলো পরিমল। নিজের মনের অনুভুতিটা নিজেই সে খুব একটা ভালো বুঝতে পারছিল না। অনেকটা জীবনে প্রথম বার চুমু খাওয়ার মত। অসম্ভব ভালো লাগছে এদিকে এরপর কি করতে হবে জানে না। সৌগত তাকে বললো,
-‘ শোন এয়ারপোর্ট এর শোভা পরে দেখিস। পা চালা, নয়তো লাইনের পেছনে পরে গিয়ে পরের প্লেনটা মিস করবি।’
-‘যাচ্ছি যাচ্ছি।’
-‘ আর বাড়িতে ফোন করতে চাইলে আমার ফোন থেকে করতে পারিস।’
-‘ ঠিক আছে. তুমি আগে করে নাও।’
বলতে বলতে ওরা চলে এলো ইমিগ্রেশন এর লাইনের পেছনে।
-‘আচ্ছা সৌগতদা, ইমিগ্রেশন জিনিসটা কি খুব চাপের? মানে….’
-‘ভয় পাচ্ছিস নাকি? কোনো ব্যাপার নয়। কাগজপত্র দেখাবি। ওরা দু-একটা সাধারণ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে। ব্যস।’
-‘কিন্তু অনেককে শুনেছি ঢুকতে দেয় না। এখান থেকেই বাড়ি পাঠিয়ে দেয়, না মানে ইন কেস ধরো….’
-‘ এই, আজেবাজে চিন্তা করিস না তো। আমি যাচ্ছি আগে। পাসপোর্ট, I-২০ নিয়ে রেডি থাক।’
সৌগত এগিয়ে গেল সামনের অফিসার এর দিকে। এক মুহুর্তের জন্য পরিমল অনুভব করলো একদম অচেনা একটা মহাদেশে ও সম্পূর্ণ একা। কেউ দেখার নেই, কেউ বলবে না এটা করা উচিত আর সেটা নয়। নিজের জীবনের দায়িত্ব এখন থেকে সম্পূর্ণ তার নিজের। এতবড় দায়িত্ব সে কখনো পালন করেনি বা পালন করার কথা উপলব্ধি করেনি। ভাবতে ভাবতেই দেখল বাঁ দিকের এক কালো মহিলা ইমিগ্রেশন অফিসার তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। উত্তেজনা দমিয়ে রাখার চেষ্টা করতে করতে, ধীর পায়ে, পরিমল এগিয়ে গেল তার দিকে।
-‘First time here?’
-‘Yes Mam.’
-‘may I see your documents please. And stand clear in front of the camera’
-‘ok you are good. please proceed to the customs. Next’
-‘Have a good day’
ভদ্রমহিলা একটু চমকে গিয়ে পরিমলকে প্রতি-সম্বোধন করলেন। অপ্রত্যাশিতকে আলিঙ্গন করা সবসময় কঠিন। পৃথিবীর প্রতি প্রান্তে এর উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সৌগত অপেক্ষা করছিল পরিমলের জন্য। ওকে আসতে দেখে সে বলে উঠলো,
-‘ ওয়েলকাম টু দ্য ল্যান্ড অফ অপরচুনিটি। কেমন লাগছে?’ আলতো করে হাসলো পরিমল,
-‘ তোমার ফোন টা একবার দেবে? বাড়িতে একবার জানিয়ে দিই।’
-‘ নিশ্চয়। এই নে। আর অন্য কোথাও ফোন করার থাকলেও করতে পারিস।’
-‘ নাহ, শুধু বাড়িতে।’
-‘ চল আমরা আসতে আসতে কাস্টমস এর দিকে হাঁটতে থাকি।’
ফোন নম্বর ডায়াল করতে করতে পরিমল বলল,
-‘ তুমি তো এখান থেকেই চলে যাবে, তাই না।’
-‘ ঠিক। কিন্তু তুই চিন্তা করিস না। নিজে নিজে একটা অচেনা জায়গা এক্সপ্লোর করার মজাই আলাদা।’
-‘হুম। হ্যালো মা,…’
কনিকাদেবীর উত্কন্ঠা মিটিয়ে সৌগতদাকে ফোনটা ফিরিয়ে দিল পরিমল। সৌগত তাকে বলল টার্মিনাল চেঞ্জ করতে হবে। একটা বিনা-চালকের ট্রেন রয়েছে। সেটা তাকে টার্মিনাল ২ অব্দি নিয়ে যাবে। তারপর গেট খুঁজে অপেক্ষা। ট্রেনটা যেখানে আসবে, সেই অব্দি পরিমলকে পৌঁছে দিল সৌগত। এখান থেকে সে চলে যাবে তার নিজের পথে। পরিমলকে নিজের ফোন নম্বর দিয়ে সৌগত বলল যেকোনো রকম দরকারে নির্দ্বিধায় ফোন করতে। নিবিড় ভাবে আলিঙ্গন করলো দুজনে নিজের নিজের রাস্তায় চলে যাওয়ার আগে।
টার্মিনাল ২ এর নির্দিষ্ট গেট এর সামনে পৌঁছে পরিমল দেখল তার হাতে ঘন্টা দুয়েক সময় রয়েছে। শিকাগোয় তখন আসতে আসতে সূর্য উঠছে। পরিমল যেখানে অপেক্ষা করছিল, সেই গেটের পাশে একটা বিরাট কাঁচের দেওয়াল ছিল। শিকাগো এয়ারপোর্টটা দেখা যাচ্ছিল অনেকখানি আর দেখা যাচ্ছিল নীল আকাশ, ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় যেটা হারিয়ে যাচ্ছে ঘোলাটে কুয়াশার আড়ালে।
সেই কাঁচের দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আমেরিকায় নিজের প্রথম সূর্যোদয় দেখতে দেখতে পরিমল অনেকদিন পর নিজের পাশে কুর্চির অনুপস্থিতি অনুভব করলো, আন্তরিকভাবে।
(ক্রমশ…)