প্রবাসীর দিনলিপি-০৩

আগে যা হয়েছে: বাড়ির সমর্থনে চাকরিতে যোগ না দিয়ে পরিমল অঙ্কে উচ্চশিক্ষার কারণে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রুদ্র তাকে সাহায্য করে তথ্যাদির ব্যাপারে। সেইমত সে জিআরই পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষা দিয়ে ফেরার সময় মাতাল হয়ে সে নিজের পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলে। চারদিন পরে তার বাড়িতে গোয়েন্দা দপ্তর থেকে একটি  চিঠি আসে। চিঠির বয়ান অনুযায়ী সে ভবানীভবন পৌঁছয় কোন এক আবদুর রহিমের সাথে দেখা করতে।
বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: এই রচনার সমস্ত চরিত্র বাস্তব। জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তিবিশেষের সাথে কোনরকম সামঞ্জস্য সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত। নিরাপত্তার কারণে কিছু নামধাম বদলে দেওয়া হলো।
চায়ের ভাঁড়টা দোকানের সামনে রাখা ঝুড়িতে ফেলে পকেট থেকে গোল্ডফ্লেকের প্যাকেট টা বার করে রুদ্র। বাসে আসার সময় পরিমলকে ও বোঝাচ্ছিল ভয় না পাওয়ার জন্য। যদিও সে নিজেও জানত যে এটা কেবলই কথার কথা। “এই সময় এই রকম কথা বলতে হয়”, ইত্যাদি, ছোটবেলার শিক্ষা…। ইনফ্যাক্ট পাসপোর্ট অনেকেই হারিয়েছে, পরে আবার ডুপ্লিকেট করিয়েও নিয়েছে।  “কিন্তু, এই শালাকে চারদিনের মাথায় এখানে ডেকে পাঠালো কেন?” ভাবে সে। বাসে আসতে আসতে সে পরিমলকে বলছিল,
-‘ তেমন সিরিয়াস কিছু হলে ওরা তোকে চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠাত না, নিজেরাই চলে যেত।’
-‘ ধর আমাকে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করলো, তখন?’
-‘ তুই যা সোজা বাংলায় মনে আসবে বলবি। নিজে তো জানিস খারাপ কাজ কিছু করিসনি’
-‘ হু, আমি যা জানি, সেটা কি ওরা সহজে মেনে নেবে?’
-‘ চল না গিয়েই দেখি। হতেও তো পারে যে ওরা তোর পাসপোর্ট টা কোনভাবে পেয়ে তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডেকে পাঠিয়েছে।’
-‘ তুই শালা বাড়ি থেকে এই কথাই বলে যাচ্ছিস। এটা কি অঞ্জন দত্তের সিনেমা হচ্ছে?’
নিজে যতই বলুক না কেন রুদ্র ভালো করেই জানে আজ পরিমলের পাসপোর্ট ফিরে পাওয়া আর ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলে ইন্ডিয়ার চ্যাম্পিয়ন হওয়া একই ব্যাপার। এদিকে ছেলেটা গেছেও অনেকক্ষণ। নিছক অভ্যেসবশত একবার ফোনের দিকে চোখ বুলিয়ে নেয় সে। কিন্তু পরিমলের কোনো পাত্তা নেই।
-‘ ধুর শালা, ছোকরার কপালটাই খারাপ।’….সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ভাবল সে।
ভবানীভবনের তিনতলায় সিঁড়ির পাশে একটা ছোট ব্যালকনি আছে। কাঁচ দিয়ে ঢাকা, তাই হাওয়া আসে না। সেখানে দাঁড়ালে দূরে ন্যাশনাল লাইব্রেরির খানিকটা অংশ দেখা যায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে পরিমল ভাবছিল গত চারদিনের কথা। পরীক্ষা, বারে বসে মাতাল হয়ে পাসপোর্ট হারানো, কলকাতার থানায় জিডি করতে না পেরে বহরমপুরের থানায় করা, নতুন করে পাসপোর্ট করার সময়ই একটা অদ্ভুত চিঠি তাও আবার গোয়েন্দা দপ্তর থেকে। পুরো ব্যাপারটাই কিরকম তালগোল পাকানো। সর্বপরি এই গোয়েন্দা দপ্তর থেকে আসা চিঠিটা তাকে বেশ চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। প্রবাদ আছে “বাঘে ছুঁলে আঠেরো ঘা, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ।” আপামর বাঙালী জনসাধারণ যেকথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে এবং পরিমল ও  মোটেই তার ব্যতিক্রম নয়। আর তাই চিঠি পেয়ে সে ধরেই নিয়েছিল যে তার সাথে খারাপ কিছু হতে চলেছে। যদিও খারাপটা কি সে বিষয়ে তার কোনরকম ধারণা ছিল না। আর এখন তো পুরোটাই ভাগ্যের হাতে।
-‘ আচ্ছা ৩১৫ নং ঘরটা কোনদিকে?’ সামনে এক বেয়ারা কে জিজ্ঞেস করল সে।
-‘ সোজা চলে যান। ওই সামনে গিয়ে ডানদিকে।’
-‘ ধন্যবাদ।’
সেইমত পরিমল সমাদ্দার এসে পৌঁছলো আবদুর রহিমের ঘরের সামনে। বাইরে একটা পিতলের নেমপ্লেটে ভদ্রলোকের নাম খোদাই করা। লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে দরজায় নক করলো।
-‘ কাম ইন’ পাতলা অথচ স্পষ্ট স্বরে ভেতর থেকে কেউ বলে উঠলেন।
একটা ১০ বাই ১০ নিরাভরণ ঘর। মাঝে একটা টেবিল রাখা। বাঁয়ে একটা বুককেস, সুন্দর করে কিছু ফাইল সাজানো। ডানদিকের জানলা দিয়ে ন্যাশনাল লাইব্রেরি দেখা যাচ্ছে। টেবিলের ওপাশে যিনি বসে আছেন, তাঁকে দেখে শিক্ষক ছাড়া অন্য কিছু চট করে মনে আসবেনা।
-‘ ইয়েস, কি ব্যাপার।’
-‘ আমি পরিমল মানে আপনি আমাকে দেখা কর….মাফ করবেন, আপনিই কি আবদুর রহিম।’
-‘ ঠিক ধরেছ, আর তুমি হলে পরিমল, পরিমল সমাদ্দার। কি তাই তো।’
-‘ আপনি কি করে…..’
-‘ জানলাম? ভয় পেও না, বোস’…..সামনের চেয়ারটার দিকে ইশারা করেন উনি।
কোনমতে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়ে পরিমল। একরকম আত্মসমর্পণ করে চেয়ারের গর্ভে।
-‘ চিঠিটা আজকেই পেয়েছ নিশ্চয়ই, বেশ তাড়াতাড়ি চলে এলে দেখছি?
-‘ আমি আসলে কলকাতাতেই ছিলাম।’ অনেকটা সহজ হয়েছে এতক্ষণে পরিমল, ‘মায়ের কাছে চিঠির খবর পেয়ে চলে এলাম’
-‘ ভালো করেছ। তুমি হয়ত ভাবছ আমি তোমাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছি।’
বলতে বলতে টেবিলের ড্রয়ার খুলে কিছু একটা বের করেন রহিমবাবু, ডান হাতটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে উনি বললেন
-‘ এটা তোমার মনে হয়।’
সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালী অলৌকিকের প্রত্যাশায় দিন গোনে রোজ এবং সেই মহামুহুর্তে নিজেকে হারিয়ে ফেলে সে। নিজের মধ্যবিত্ততার কারণে সে খুঁজে পায়না ভাষা, নিজেকে প্রকাশ করার। অথবা বলা ভালো, তার প্রত্যাশা ছিলনা কখনো যে তার জীবনেও সে এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাবে, যতই সে স্বপ্ন দেখুক না কেন। তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুমিয়ে আছে দাসত্ব করার চির অভ্যেস, তাই সে প্রশংসা করে নীল আকাশের কিন্তু সেখানে ডানা মেলে উড়তে সে নিতান্ত অপারগ। এটা তার অক্ষমতা নয়, এটা তার পরিচয়।
রহিমবাবুর বাড়ানো ডানহাতে অশোকস্তম্ভের ছাপ দেওয়া কালচে নীল রঙের বইটার দিকে তাকিয়ে পরিমল সমাদ্দারেরও ঠিক একই অবস্থা হয়েছিল।
(ক্রমশ…)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

আবিষ্কার

১ ‘ টুবলু, টুবলু, টুবলু উ উ উ ‘ মার গলা, অনেকক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছি। …

সরল ও হাতি

সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে…

পুষুর দুঃস্বপ্ন

আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো মধুভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে পুষুর দু চোখ চকচকিয়ে উঠলো। ‘কি…