প্রবাসীর দিনলিপি-০২

আগে যা হয়েছে: বহরমপুরের পরিমল সমাদ্দার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী পাওয়ার পর চাকরিতে যোগ দেওয়ার অপেক্ষা করছিল। ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তার চাকরির যোগ দানের সময় টা পিছিয়ে যায়। রুদ্র, তার এক বন্ধু অঙ্কে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অনুভাদেবী পরিমলকে একই কাজ করতে বললেন। পরিমল তাঁর কথা মেনে নেয়। কনিকাদেবী তাকে সমর্থন করলেন।
বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: এই রচনার সমস্ত চরিত্র বাস্তব। জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তিবিশেষের সাথে কোনরকম সামঞ্জস্য সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত। নিরাপত্তার কারণে কিছু নামধাম বদলে দেওয়া হলো।
রুদ্রর কাছে সমস্তকিছু খুঁটিয়ে শুনে পরিমল বুঝতে পারল যে তার এখন কী কী করণীয়।
১) জিআরই এবং টোয়েফল পরীক্ষায় ভালো স্কোর।
২) বেশকিছু ইউনিভার্সিটি নির্বাচন করা এবং সেখানে নিজের সিভি পাঠিয়ে যাচাই করা যে তারা ওর ব্যাপারে আগ্রহী কি না। সোজা বাংলায় কানেকশন বাড়ানো।
৩) রেকমেন্ডশন লেটার( অন্তত তিন-চারটে), কিছু স্বনামধন্য ব্যক্তির থেকে নেওয়া। যারা কিনা আবার পরিমলকে মোটামুটি ভাবে চেনেন।
৪) নির্বাচিত ইউনিভার্সিটি গুলোয় আবেদন করা।
৫) টাকার ব্যবস্থা করা।
এই শেষোক্ত বিষয়টি পরিমলকে বেশ ভাবিয়ে তুললো। বেসরকারী কলেজে গত চার বছর পড়াশুনো করার দরুন বাবার গচ্ছিত অর্থের একটা বড় অংশ আগেই খরচা হয়ে গেছিল {এখানে বলে রাখা ভালো যে এই পুরো ব্যাপারটি বেশ খরচসাপেক্ষ। পরীক্ষা দুটিতে ফর্ম ফিলাপ করতে প্রায় ১৬,০০০। অতঃপর আবেদন করার সময় সবমিলিয়ে অন্তত ৩০,০০০(পরিমল ৬-৭ টা জায়গায় আবেদন করবে ঠিক করেছিল)। এছাড়া কিছু এমনি খরচ তো আছেই। সবমিলিয়ে প্রায় হাজার পঞ্চাশেক}.  সে ঠিক করল বাড়ি ফিরে অঙ্কের টিউশন পড়ানো শুরু করবে। এতে অর্থালাভ যেমন হবে, তেমনই জিআরই পরীক্ষার অঙ্কের চর্চাটাও হবে। বেশকিছু ছাত্র-ছাত্রী জুটিয়ে ফেলল সে। ব্যারনের বই কিনে অর্বাচীন ইংরেজি শব্দের সাথে পরিচিতি বাড়াতে শুরু করলো। ছোটবেলা থেকেই তাকে ইংরেজি সাহিত্য পড়তে শিখিয়েছিলেন অনুভাদেবী। এছাড়া নিয়মিত ইংরেজি খবরের কাগজ পড়া, CNN ও BBC তে খবর শোনা, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সাথে ইংরেজিতে কথা বলে জড়তা কাটানোর চেষ্টা- সবই চলছিল। রুদ্র তাকে ইউনিভার্সিটি নির্বাচন এবং রেকমেন্ডশন লেটারের ব্যাপারে সাহায্য করতে রাজি হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় ড: শঙ্কর চন্দ্র ঘোষ ওদের কিছু অঙ্কের কোর্স পড়িয়েছিলেন। তাঁর সাথে যোগাযোগ করে পরিমল, রুদ্রের মাধ্যমে। তিনি সানন্দে রাজি হন। ওনার সুত্রে দুই বন্ধুর আলাপ হয় টেক্সাস ইউনিভার্সিটির অঙ্কের বিভাগীয় প্রধান ড: লোকনাথ দেবনাথের সাথে। ড: দেবনাথের বাঙালী প্রীতির কথা জানতেন ড: ঘোষ। ফলে খুব সহজেই একটা সম্ভাবনা তৈরী হয়। ড: ঘোষ ওদের সাথে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তের আলাপ করিয়ে দেন। ইন্দ্রনীল ওনার ছাত্র। সে বছর দুয়েক আগে একই পদ্ধতিতে বাইরে চলে যায়। এরপর বাকি থাকে শুধু পরীক্ষাপর্ব।
শুক্রবার, ৩১শে অক্টোবর পরিমলের জিআরই পরীক্ষার দিন ছিল। রুদ্রর পরীক্ষা আগেই হয়ে গেছিল। পরিমল ভালই পরীক্ষা দেয় এবং মার্কস ও মন্দ পায়নি সে। ওরা প্ল্যান করেছিল যে পরিমলের পরীক্ষার পর এয়ারলাইন্স বারে (চাঁদনীতে যোগাযোগ ভবনের সামনে) মদ খাবে। ছ-পেগ করে রয়াল-স্ট্যাগ খাওয়ার পর(!!!) সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ দুই বন্ধু উল্টোডাঙা পৌঁছয়। রুদ্রর বাড়ি বাগুইআটির কাছে। সে বলে,
-‘ বস, এখনতো বাড়ি যাওয়া যাবে না।’
-‘হু, চ বিরাটি যাই। তমালের সাথে আড্ডা মেরে আসি। দশটা নাগাদ ফিরব।’
-‘ গ্রেট আইডিয়া। ঐ দ্যাখ, একটা বাস আসছে। তমালকে একটা ফোন লাগা।’
তমালের সাথে শ্রেয়স এবং আরো অনেকেই ছিল। রাত দশটা নাগাদ রুদ্র বলে,
-‘ এই চল বাড়ি যাই এবারে। এতক্ষণে মুখের গন্ধ কেটে গেছে।’
-‘ দাঁড়া, এই সিগারেটটা খতম করে উঠছি।’
পাশ থেকে ফুট কাটে শ্রেয়স,
-‘ফাইলটি নিও বাছা, নইলে…’
পরিমলের সাথে একটা নীল রঙের ফাইলে ওর সব ডকুমেন্টস ছিল। একটু হেসে সেটার দিকে হাত বাড়াল সে। তাই দেখে তমাল বলে ওঠে,
-‘ দেখি তোর পাসপোর্টের ছবিটা একবার। আমারটায় শালা নিজেকেই চিনতে পারি না।’
-‘সবার ই অমনি ছবি হয় ওতে।’
-‘দেখি তোরটা’
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফাইলটা খোলে পরিমল। ওপরে জিআরই পরীক্ষার কার্ড, কয়েকটা ব্যাঙ্কের কাগজ ইত্যাদি রাখা। ব্রাউন রঙের একটা ছোট প্যাকেট ছিল ওপরেই, যার মধ্যে পাসপোর্ট, ভোটার কার্ড ও ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল। ফাইলের মধ্যে কোথাও সেটা খুঁজে পায় না। সবকিছু বের করে আবার দেখে ভালো করে। নাহ, পুরো প্যাকেটটাই গায়েব হয়ে গেছে কোন এক অদ্ভুত কারণে।
-‘কিবে হারিয়ে ফেলেছিস নাকি মালকড়ি।’…পাগলের মত কাগজপত্র হাতড়াতে থাকা পরিমলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে রুদ্র। বোবা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে পরিমল।
-‘ কথা বলছিস না কেন? কোথায় তোর পাসপোর্ট?’
-‘জানি না।’
-‘জানিস না!!!শোন্ দেরী হচ্ছে, বাড়ি যেতে হবে। কাগজপত্র গুছিয়ে ফাইলে ঢোকা’
-‘রুদ্র, আমার পাসপোর্ট যে প্যাকেটে রাখা ছিল সেটা আমি খুঁজে পাচ্ছিনা কোথাও’…হাহাকার করে ওঠে পরিমল।
-‘মানে…আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ফাইলেই তো রেখেছিলি, কোথায় যাবে? ভালো করে দ্যাখ।’
তমাল আর শ্রেয়সও এগিয়ে আসে খুঁজতে। শ্রেয়স দৌড়ে গিয়ে পাশের দোকান থেকে একটা মোমবাতি নিয়ে আসে। তন্নতন্ন করে পুরো জায়গাটা খুঁজে ফেলে চারজনে। কিন্তু ব্রাউন রঙের কোনো প্যাকেট সেখানে দেখতে পায় না কেউই। আতঙ্কিত এবং নিজের ওপর বিরক্ত পরিমল হতাশায় পার্কের একটা বেঞ্চিতে ধুপ করে বসে পরে। রুদ্র এগিয়ে আসে তার কাছে,
-‘কি কি ছিল প্যাকেটের মধ্যে?’
-‘ পাসপোর্ট, ভোটার কার্ড আর আর…ড্রাইভিং লাইসেন্স ‘
শুওরের…….হারানোর আর জিনিস পেল না, মনে মনে পরিমলের মুন্ডুপাত করে রুদ্র।
-‘ বুঝতেই তো পারছিস, এখানে কোথাও ফেলিসনি, চাঁদনী থেকে বিরাটির মধ্যে কোথায় হারিয়েছিস, বলা অসম্ভব। এখন বাড়ি যাওয়া ছাড়া কোনো রাস্তা নেই। কাল সকালে থানায় যাব’
-‘ কিন্তু রুদ্র, তিন সপ্তাহ পর আমার টোয়েফল পরীক্ষা। পাসপোর্ট ছাড়া আমি পরীক্ষা দিতে পারব না।’
-‘ সেসব এখন ভাবিস না। কাল একবার পাসপোর্ট অফিস গিয়ে একটা ফর্ম নিয়ে আসবি, তারপর দেখা যাবে। এখন বাড়ি যাই চল।’
-‘ভাই শুনছেন, আপনি কি ব্যস্ত আছেন?’
সামনের সিটের ভদ্রমহিলার ডাকে সম্বিত ফেরে পরিমলের।
-‘আমাকে কিছু বলছেন?’
-‘ আপনার পায়ের কাছে খোকনের ভিডিও গেমস টা পড়ে গেছে। একটু দেবেন প্লিস?’
-‘ ও নিশ্চয়ই।’
হাত বাড়িয়ে গেমসটা তুলে খোকনের দিকে বাড়িয়ে দেয় সে।
-‘ ধন্যবাদ কাকু, মা বলছিল আমি নাকি সব হারিয়ে ফেলি খালি।’
ছোট্ট করে একটু হাসে পরিমল সমাদ্দার,
-‘ শুধু তুমি কেন, অনেক বড় বড় লোকেরাও অনেক সময় অনেক কিছু হারিয়ে ফেলে, অসাবধানে।’
পরেরদিন শনিবার, রুদ্র আর পরিমল দমদম থানায় জিডি করাতে গেল। ঘন্টাখানেক বসে থাকার পর অবশেষে ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেল।
-‘ কি হয়েছে?’ রুক্ষ গলায় এক মাঝবয়েসী অফিসার জিগ্গ্যেস করলেন।
-‘ স্যার, গতকাল আমি আমার পাসপোর্ট, ভোটার কার্ড ও ড্রাইভিং লাইসেন্স হারিয়ে ফেলেছি।’
-‘ মাথা কিনে নিয়েচ হারামজাদা, কোথায় হারিয়েছ?’
-‘জানি না স্যার’,
-‘ জানো না, তবে আগে সেইটা জেনে এস। এখানে আমার সময় নষ্ট কোর না।’
বেগতিক দেখে রুদ্র পাশ থেকে বলে ওঠে,
-‘ এয়ারপোর্ট এর কাছে হারিয়েছে স্যার।’
-‘ ইটা দমদম থানা বাপধন, যেখানে হারিয়েছ তার কাছের থানায় যাও। এখানে কিছু হবে না। নেক্সট….’
-‘ কিন্তু স্যার…..’
-‘ যা বলার বলে দিয়েছি বাপু, এখন মানে মানে কেটে পর তো দেখি। কিরে ছগন, মিন্টুর দোকানে একবার যা বাবা, একটু চা-সিগারেট ছাড়া র চলছে না।’
থানা থেকে বেরিয়ে আসে দুই বন্ধু।
-‘ এখন কি উপায়?’
-‘ তুই আগে বাড়িতে ফোন করে সবটা জানা। তারপর চল এয়ারপোর্ট থানা থেকে একবার ঘুরে আসি।’
অতঃপর এয়ারপোর্ট থানা। সেখানেও পরিমলের জিডি নিতে রাজি হয়না তারা। উল্টে এক অফিসার তাকে প্রশ্ন করেন, কি এমন পরীক্ষা যেখানে পাসপোর্ট ছাড়া ঢুকতে দেয়না। পরিমল বুঝতে পারে না তার এখন কি করা উচিত। রুদ্র তাকে বলে, পাসপোর্ট অফিস থেকে একটা ফর্ম নিয়ে আসতে। দু চোখে অন্ধকার নিয়ে পরিমল একটা ডালহৌসিগামী বাসে উঠে পড়ে।
অনুভাদেবীর ছেলে অরিন্দম তখন সিউরীর এসডিও। পরিমলের কাছে সমস্ত শুনে ওর মা তখুনি অরিন্দমকে ফোন করলেন। অরিন্দম সব শুনে পরিমলকে সেদিনই বহরমপুরে ফিরে আসতে বলল। বহরমপুর থানায় তার কিছু চেনাশুনো আছে। এখানে জিডিটা হয়ে যাবে। পাসপোর্টের ফর্ম নিয়ে রবিবার সকালে বাড়ি পৌঁছলো সে। ঘটনাচক্রে অরিন্দম সেদিন বহরম্পুরেই ছিল। তার সাথে পরিমল দেখা করে সে বলল,
-‘ তুই আজ বাড়ি যা। রেস্ট নে। কাল সকালে থানায় চলে যাস, পাসপোর্টের একটা জেরক্স কপি নিয়ে। আমি অশোককে বলে রেখেছি।’
-‘ ধন্যবাদ দাদা, আমি মানে কি যে করব….’
-‘ আরে ঠিক আছে। ‘
 শেষ পর্যন্ত বহরমপুর থানায় পরিমল জিডি করতে পারল। খোঁজ নিয়ে জানলো, কলকাতায় পাসপোর্ট অফিসে হাজার পাঁচেক টাকায় দু সপ্তাহে পাসপোর্ট পাওয়ার একটা ব্যবস্থা আছে। মঙ্গলবার সকালে সে আবার কলকাতা গেল। রুদ্রর বাড়িতে বসে দুপুরবেলা সে পাসপোর্টের ফর্ম টা ফিলআপ করছে। তার ফোন বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখে মা ফোন করছেন,
-‘ বলো মা। ‘
-‘ শুভ, তোর নামে এখুনি একটা চিঠি এসেছে বাড়িতে।’
-‘ কিসের চিঠি? কে পাঠিয়েছে?’
-‘ আবদুর রহমান বলে কেউ একজন, ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট, ভবানী ভবন থেকে।’
-‘ ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট, ভবানী ভবন….কি লেখা আছে?’
-‘ তোকে দেখা করতে বলেছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তুই কোথায় আছিস এখন?’
-‘ বাগুইআটি, রুদ্রের বাড়িতে।’
-‘ এখুনি বেড়িয়ে পড়। হয়ত এটা তোর পাসপোর্ট সংক্রান্ত কিছু।’
ফোন রেখে রুদ্রকে পুরোটা খুলে বললো সে। তখুনি বেরিয়ে পড়ল দুজনে। ভবানীভবনের সামনে যখন পৌঁছলো, তখন বেলা আড়াইটে প্রায়। জিজ্ঞেস করে জানলো যে আবদুর রহমান ৩১৫ নং ঘরে বসেন।
-‘ আমি বাইরে আছি, ঐ চায়ের দোকানটায়। তুই যা, দেখা করে আয়।’
-‘ ঠিক আছে।’
রুদ্রকে পেছনে রেখে পরিমল পা বাড়াল সামনের সিঁড়িগুলোর দিকে।
(ক্রমশ…)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

আবিষ্কার

১ ‘ টুবলু, টুবলু, টুবলু উ উ উ ‘ মার গলা, অনেকক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছি। …

সরল ও হাতি

সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে…

পুষুর দুঃস্বপ্ন

আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো মধুভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে পুষুর দু চোখ চকচকিয়ে উঠলো। ‘কি…