প্রবাসীর দিনলিপি-০১

বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: এই রচনার সমস্ত চরিত্র বাস্তব। জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তিবিশেষের সাথে কোনরকম সামঞ্জস্য সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত। নিরাপত্তার কারণে কিছু নামধাম বদলে দেওয়া হলো।
-” ও মা, কতক্ষণে পৌঁছব?”
-” এই তো এসে গেছি বাবা। আর একটু পরেই একটা বিশাল বড় এয়ারপোর্ট এ আমরা নামব।”
-“তুমি তো খালি একই কথা বলে যাচ্ছ। প্লেন টা তো নামেই না আকাশ থেকে। দূর…বাবা যে কখন আসবে।”
-” একটু ধৈর্য্য ধর খোকন, আচ্ছা তোমার ভিডিও গেমস টা কোথায় গেল?”
নিজের সিটে বসে সামনের মা-ছেলের কথোপকথন শুনছিল পরিমল। বছর ছয়েক বয়েস হবে খোকনের। হয়ত এটাই ওর প্রথম প্লেনে ওঠা। পরিমলের নিজের মনেও একই প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে অনেকক্ষণ থেকে। নিজের সামনের এলসিডি মনিটারটা যা বলছে, তাতে আর ঘন্টাখানেক এর মধ্যেই শিকাগো শহরে আমেরিকান এয়ারলাইনস এর প্লেনটা নামবে। অদ্ভূত একটা অনুভুতি হচ্ছিল পরিমলের। সেই শিকাগো। আপামর বাঙালী সমাজ যার নাম শুনলে এখনো রোমাঞ্চিত বোধ করে। ১৮৯৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর, বিড়বিড় করে পরিমল। জানলার দিকে চোখ ফিরিয়ে ভাবে,
 -”আর একটা ঘন্টা, তারপরেই…”
পরিমল শিকাগো আসার অপেক্ষা করুক। ইতিমধ্যে আমরা চটকরে তার ডায়রির কয়েকটা পেছনের পাতা পড়ে নিই।
 জীবন বড় অদ্ভুত। হয়ত সেকারণেই এত সুন্দর। ২০০৮ সালের ১৯শে অগাস্ট কেউ যদি বহরমপুরের পরিমল সমাদ্দার কে বলত,
-”ওহে কত্তা, একবছর পর আজ তুমি এখন শিকাগো এয়ারপোর্ট এ নামব নামব করচ, বুইলে।”,
তবে সেটা পাগলের প্রলাপ বলেই ভাবত পরিমল। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে। বাবা সামান্য বেতনে একটি আধা-সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরত। মা বাড়িতেই থাকেন। পরিমল ছাত্র হিসেবে মোটামুটি। তবে অঙ্ক করতে ভীষণ ভালবাসে। স্কুল এ পড়তে রাতের পর রাত জেগে খালি অঙ্ক করে যেত। ফল ও পেয়েছিল। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অঙ্কে ১৯৮ এবং চোখে একটি মাইনাস ২.৫ পাওয়ার এর চশমা। এহেন ছেলের ২০০৪ সালে একটি বেসরকারী কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পরার সিদ্ধান্তে শুভানুধ্যায়ীদের অনেকেই আশ্চর্য্য হয়েছিলেন। যথাসময়ে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ এর মাধ্যমে accenture নামক কোন এক আইটি সংস্থায় চাকরিও পায় সে। ২০০৮ সালে বি.টেক সম্পূর্ণ করে চাকরিতে ঢুকবে। দু-তিন বছর পর চাকরিসুত্রে বিদেশযাত্রা, আরো দু-তিন বছর পর সুন্দরী বউ..ইত্যাদি। কিন্তু বাইশ বছরের পরিমল সমাদ্দারের জীবনে কোনো কিছুই বাঁধাগতে হয়নি আজ পর্যন্ত। কলকাতায় পড়াশুনোর পালা শেষ করে চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগের সময়টুকু বাড়িতে কাটাবে, এমনটাই মনস্থির করে সে। সেইমত ২০০৮ সালের ২৫শে জুন তল্পিতল্পা গুটিয়ে সে বহরমপুরে ফিরে এলো। কিন্তু ঘটনাচক্রে ২০০৮ এ বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলো। এবং পরিমল এর চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময়টা বছর খানেকের জন্য পিছিয়ে গেল।
কলেজে পড়ার সময় রুদ্রর সাথে আলাপ হয়েছিল পরিমলের। রুদ্র ভালো কবিতা আবৃত্তি করে, বাংলা সাহিত্যে আগ্রহী, ক্যারম খেলতে ভালবাসে আর ভালবাসে অঙ্ক করতে। পরিমল কলকাতা ছাড়ার আগে এক আড্ডায় রুদ্র তাকে বলে যে সে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা যেতে চায়। এবং তার উচ্চশিক্ষার বিষয় হবে অঙ্ক। পরিমল তার কথা শোনে এবং যথারীতি পাত্তা দেয় না। এদিকে বহরমপুর ফেরার পর প্রায় এক মাস কেটে গেছে। সাধারণ বাঙ্গালীদের মত আলসেমী করে সময় কাটাতে পটু হয়ে উঠছে সে। এমন সময় তার জীবনে দুটি ঘটনা ঘটল। অনেক বছর পর পরিমল ভেবে দেখেছে যে সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনাগুলি তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেগুলি না হলে হয়ত আজ তার জীবনস্রোত অন্য খাতে বইত। রমেন ওর এক বহরমপুরের বন্ধু। কলকাতায় ওরা একই কলেজে পরত। ছুটিতে বাড়ি আসলে গঙ্গার ধারে একসাথে গল্পগুজব করত। সেই রমেন একসপ্তাহের মধ্যে চাকরিতে যোগ দেওয়ার ডাক পেয়ে হটাত করে বেঙ্গালুরু চলে গেল। দ্বিতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অনুভাদেবী বলে পরিমলের এক জেঠিমা আছেন। ইনি ও ইনার পরিবার বলতে গেলে পরিমলের জীবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। পরিমল এই মহিলাকে নিজের মায়ের মত শ্রদ্ধা করে। অনুভাদেবী একদিন পরিমলকে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। ওকে বোঝালেন যে এত কম বয়েসে চাকরিতে যোগ দিলে সে আর কখনো উচ্চশিক্ষায় মনোনিবেশ করতে পারবে না। পড়াশুনো করার কথাটা উনি জোর দিয়ে ভাবতে বললেন।
-” অঙ্কের ওপর আর অভিমান করে থাকিস না। রুদ্রকে একটা ফোন কর। “
-”কিন্তু জেঠিমা…-”
-”চুপ, আর একটাও কথা নয়। ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব স্বামী বিবেকানন্দকে কি বলেছিলেন, মনে করিয়ে দিতে হবে না নিশ্চয়।”
ভারাক্রান্ত মনে বাড়ি ফেরে পরিমল। সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারে না. ভোরের দিকে কী মনে করে সঞ্চয়িতা হাতে করে ছাতে গেল। পাতা উল্টোতেই  প্রথমে তার চোখে পড়ল,
…”অসীম যে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ,
    সীমা হতে চায় অসীমের মাঝে হারা।”
“lose yourself in the midst of infinity and the infinity will be yours.”… পরিমলের নিজেই একসময় লিখেছিল। আর কোনো দ্বিধা নয়। পূব আকাশ লাল হয়ে আসছে আসতে আস্তে আস্তে। সেই মুহুর্তে নিজের জীবনের অন্যতম কঠিন সিদ্ধান্তটি নিল সে। রুদ্রকে ফোন করার আগে মায়ের ঘরে গেল। মায়ের ঘুম ভাঙিয়ে সমস্ত কথা বলে একটা প্রনাম করলো। কণিকাদেবী ওর মাথায় হাত রেখে বললেন,
-”জয়ী হও”।
(ক্রমশ…)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

আবিষ্কার

১ ‘ টুবলু, টুবলু, টুবলু উ উ উ ‘ মার গলা, অনেকক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছি। …

সরল ও হাতি

সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে…

পুষুর দুঃস্বপ্ন

আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো মধুভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে পুষুর দু চোখ চকচকিয়ে উঠলো। ‘কি…