প্রফেসর ঝমলু ও ভূত

মিসরের আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী সম্মেলন থেকে ফেরার সময় পুরোনো একটি বইয়ের দোকানে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে হঠাৎই পেয়ে যাই বইটা। প্রাচীন মায়ান ভাষায় লেখা। বইয়ের নাম বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, অশরীরী আত্মা ও তাকে দেখার উপায়। দেশে ফিরেই খবর দিয়ে ডেকে এনেছি আমার বন্ধু, প্রাচীন ভাষাবিশারদ আমির আলীকে। সাত দিন সাত রাত ধরে একটানা কাজ করার পর আজ পুরো অনুবাদ শেষ হয়েছে। সকালে চলে যাওয়ার আগে আমির আলী আমাকে বলে গেছে, যদি ভূতের দেখা পাই, তাহলে অবশ্যই যেন তাকে জানাই। সে ভূতের সঙ্গে বসে একটু সুখ-দুঃখের আলাপ করবে। এটা নাকি তার অনেক দিনের শখ। আমিও তাকে আশ্বাস দিয়েছি, যদি ভূতের দেখা পাই তাহলে অবশ্যই তাকে জানাব এবং সুখ-দুঃখের আলাপ করার সুযোগ করে দেব।
আজ সারা দিন গেছে ভূত দেখার সরঞ্জাম জোগাড় করতে। টিকটিকির ডিম, কালো মহিষের লাল লোম, ব্যাঙের ছাতা, আমগাছে জন্মানো কাঁঠালের কষ, এ রকম আরও সাতাত্তর রকমের জিনিস। টিকটিকির ডিম আছে কি না এবং থাকলে সেটা দেওয়া যাবে কি না, এমন প্রশ্ন যখন আমি আমার পাশের বাসার ভদ্রলোককে করেছি, তিনি এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়েছেন যেন পাগলের সঙ্গে কথা বলছেন। আমিও কিছু মনে না করে চুপচাপ চলে এসেছি। শুধু আসার সময় তাঁর বাগানে কয়েকটা ‘বাম্পার বড়ি’ ফেলে দিয়ে এসেছি। আগামী দুই দিনের মধ্যেই ভদ্রলোকের বাগানে ঘাসের এমন বাম্পার ফলন হবে যে ভদ্রলোকের ঘাম ছুটে যাবে।
এ রকম আরও হাজারটা ঝামেলার পর সব জিনিস জোগাড় করতে পেরেছি। বইয়ের নিয়ম অনুযায়ী সবগুলো মিশিয়ে ল্যাবরেটরিতে আগুনের হালকা আঁচে রেখে দিয়ে মনে মনে মন্ত্র আওড়াচ্ছি তিন ঘণ্টা ধরে। বইয়ে বলা আছে, এই মিশ্রণ থেকে যে ধোঁয়া বের হবে, তা অশরীরী আত্মাকে আকৃষ্ট করবে এবং মন্ত্রের ডাকে সে চলে আসবে। যদিও আমার এসবে কোনো বিশ্বাস নেই, তারপরেও একবার চেষ্টা করে দেখছি। যদি দেখা পেয়ে যাই তাহলে তো ভালোই হবে। আমির আলীর মতো একটু সুখ-দুঃখের আলাপ করে নেওয়া যাবে।
মন্ত্র পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল করিনি। ঘুম ভাঙল কলবেলের শব্দে। চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠে প্রথমেই তাকালাম মিশ্রণটার দিকে। দেখি অনেক আগেই আগুন নিভে গেছে। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আজ রাতে আর ভূত দেখা হলো না। মন খারাপ করেই দরজা খুললাম। দেখি মুখে বিশাল এক হাসি নিয়ে আমার বন্ধু আমির আলী দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই বলে উঠল—
‘হে হে! ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?’
আমির আলীর মতো ঘুমপাগল মানুষকে এত রাতে দেখে আমি বেশ অবাক।
‘তুমি এত রাতে এখানে কী করছ?’
আমির আলী চেহারায় তেলতেলে ভাব এনে বলল, ‘হে হে! তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করল তাই চলে এলাম। রাগ করোনি তো? এক কাজ করো। ভালো এক কাপ চা খাওয়াও। চা খেয়েই চলে যাব।’
এবার আমি একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম। আমির আলী চা খাবে, এটা তো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। সে মনে করে চা পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ পানীয়। ছোটবেলায় সে একবার চায়ে চুমুক দিয়েছিল, ব্যস। তার চা খাওয়া এই পর্যন্তই। আমি বড় বড় চোখ করে প্রশ্ন করলাম, ‘আমির আলী, তুমি ঠিক আছো তো? তুমি চা খাবে?’
আমির আলী চেহারায় তেলতেলে ভাব রেখেই বলল, ‘কেন? আমার কি চা খেতে ইচ্ছে করে না? তোমরা যখন চুকচুক করে চা খাও, তখন আমার কী যে ভালো লাগে! মন চায় এক গামলা চা খেয়ে ফেলি।’
আমির আলীর মুখে এ রকম গদগদ কথা শুনে আমি অভ্যস্ত নই। হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে বললাম, ‘চলো, তোমাকে ফাটাফাটি চা খাওয়াচ্ছি।’
ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আমির আলী পুরো চার কাপ চা খেল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। চা খাওয়া শেষে যাওয়ার আগে বলে গেল, আমার এ ঋণ সে জীবনেও শোধ করতে পারবে না। তাকে বিদায় দিয়ে আমিও হাজারটা বিষয় চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম। ভূতটুত যা দেখার কাল দেখা যাবে।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই ফোন করলাম আমীর আলিকে। এত রাতে বাসায় গেছে একটু খোঁজ নেওয়া দরকার। সে ফোন রিসিভ করেই চিৎকার করে উঠল, ‘ঝমলুউউউ!! কেমন আছো? ভূত দেখেছি? স্যরি, রাতে তো আর খোঁজ নেওয়া হলো না…’
তার কথা শুনে আমার চোখ কপালে। একটু রাগী গলায় বললাম, ‘সে কী! গভীর রাতে আমার বাসায় চা খাওয়ার কথা ভুলে গেছো?’
প্রশ্ন শুনে সে রীতিমতো আহত হলো। মন খারাপ করে বলল, ‘ঝমলু, আমি নাহয় একটু বেশি খাই। তাই বলে আমাকে চা খাওয়ার অপবাদ দিলে? তাও আবার ঘুম ফেলে, গভীর রাতে! তুমি এই কথা বলতে পারলে? যাও, তোমার সঙ্গে আর কথা বলব না।’
এতটুকু বলেই সে খটাস করে ফোন রেখে দিল। আমার মাথা তখন বনবন করে ঘুরছে। আমি কি তাহলে ভুল দেখলাম? আমি নাহয় ভুল দেখতে পারি কিন্তু চায়ের কাপ? সেগুলো তো এখনো আধোয়া রয়ে গেছে। এসব চিন্তা করতে করতেই ছুটে চলে এলাম ল্যাবরেটরিতে। টেবিলের ওপর রাখা বইটা নিয়ে পাতা ওল্টাতে শুরু করলাম। একেবারে শেষের পাতায় লেখা একটা লাইনে চোখ আটকে গেল। সেখানে লেখা, ‘এই বইটার কাছাকাছি যে সবচেয়ে বেশি থাকবে, অশরীরী আত্মা তার রূপ নিয়েই দেখা দেবে।’

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!