প্রফেসর

মনুষ্য শরীরের উপস্থিতি টের পেয়েই স্বয়ংক্রিয় ভাবে খুলে গেল কাচের দরজা। যান্ত্রিক কণ্ঠে দরজার কাছে দাঁড়ানো রোবট বললো, ‘গুড মর্নিং ম্যাডাম।’
কোন জবাব না দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন নীলা সাবিহা, শীর্ষস্থানীয় অনলাইন দৈনিক নিউজ ডট কমের বিজ্ঞান বিষয়ক রিপোর্টার। কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা চলে গেলেন নিজের ডেস্কে। কয়েক সেকেন্ড পর ইন্টারকম বেজে উঠলো। নিউজ এডিটরের নাম্বার দেখে রিসিভার তুললেন নীলা।
‘গুড মর্নিং নীলা!’
‘গুড মর্নিং স্যার।’ বললেন নীলা।
‘কী ব্যাপার নীলা, অ্যানিথিং রং?’
‘নো স্যার, নাথিং রং।’
‘ভেরি গুড, শোন আজকের অ্যাসাইনমেন্টটা তো জেনেছো। দশটায় ইউনিভার্সিটি রেসিডেন্সিয়াল এলাকায় চলে যাবে।’
‘জি স্যার, আমি সময় মতই যাব।’ বললেন নীলা।
‘ভালভাবে সব কিছু করবে, বিষয়টার গুরুত্ব তো বুঝতেই পারছো, যাতে কোন ঘাটতি না থকে। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে তবে প্রফেসর আজিমের কাছ থেকে ইন্টারভিউয়ের সময় পাওয়া গেছে। আমরা তাকে নিয়ে একটি বিশেষ আয়োজন করতে চাই, যাতে তার জীবন, কর্মকাণ্ড ও গবেষণার সব দিক তুলে ধরা হবে। বিষয়টা মাথায় রেখ।’
‘জি স্যার, আমি চেষ্টা করবো।’
‘যাবার সময় অভিকে সঙ্গে নিয়ে যেও, ও তোমাকে সাহায্য করবে।’
‘ওকে স্যার।’
ইন্টারকমের রিসিভার রেখে দিয়ে রিভলবিং চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন নীলা। খবরটা শোনার পর থেকেই মনের কোণে কোথায় যেন একটা খুঁতখুঁতে ভাব কাজ করছে। পাত্তা দেয়নি। হয়তো বাবার কথা মনে পড়ছে তাই এমন হচ্ছে। এমন একটা কৃতিত্ব তো তার বাবারও হতে পারতো। শুধু পারতো নয়, হতোই হয়তো। ভাবনার সিঁড়ি বেয়ে অতীতে চলে গেলেন নীলা। ওর বাবা প্রফেসর আরেফিন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ্যা অনুষদের প্রধান। মহাকাশ নিয়ে গবেষণায় বেশ সুনাম অর্জনও করেছিলেন। আজ প্রফেসর আজিম যে ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীদের প্রেরিত সিগন্যাল রিসিভ করার সফলতা অর্জন করেছেন এটিও ছিল প্রফেসর আরেফিনের একটি গবেষণার বিষয়। প্রফেসর আজিম ভিনগ্রহের প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সফল হয়েছেন। দু’দিন পর প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে সেই ঐতিহাসিক কাজ শুরু হবে। ভাবছেন নীলা এই সফলতা তো তার বাবার হওয়ার কথা ছিল এবং অনেক আগেই। কিন্তু নিয়তি তা হতে দেয়নি। কোন কিছু না জানিয়ে একদিন হঠাৎ উধাও হলেন নীলার বাবা প্রফেসর আরেফিন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তার কোন হদিস মেলেনি। পুলিশও কিছু করতে পারেনি। তখন দশ বছরের নীলা বাবার কাজ সম্পর্কে এত কিছু না জানলেও বাবার আচার-আচরণ দেখে বুঝতে পারতেন শীঘ্রই তার বাবা বড় কোন কাজ শেষ করবেন। তার মধ্যে সবসময় একটা উত্তেজনা কাজ করতো। কিন্তু সে বড় কাজ আর শেষ হয়নি। তার আগেই তিনি নিরুদ্দেশ হলেন। তার কাজ সম্পর্কে কেউ আর জানতেও পারেনি। বড় হবার পর নীলা বুঝতে পেরেছেন বাবা হয়তো ভিনগ্রহীদের নিয়েই কোন গবেষণা করছিলেন। প্রফেসর আজিম নীলার বাবারই সহকর্মী ছিলেন। আজ তার এই সফলতার খবরে বাবার জন্য মনটা ডুকরে কেঁদে ওঠে। দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে নীলার চোখ বেয়ে।
‘গুড মর্নিং নীলা।’
হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পান নীলা। অভি দাঁড়িয়ে আছে সামনে। তাড়াহুড়ো করে সোজা হয়ে বসে টিস্যু নিয়ে চোখ মোছেন।
‘কী ব্যাপার নীলা, কী হয়েছে?’ অভি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করেন।
‘ও কিছু না, নস্টালজিয়া, তুমি তৈরি হয়ে এসেছো? আচ্ছা চলো।’ ব্যাগভর্তি ল্যাপটপটা হাতে নিয়ে টেবিল ছেড়ে বের হন নীলা। সাথে অভি।
গাড়িতে পাশাপাশি বসে অভি প্রশ্ন করেন নীলাকে, ‘তোমার কী হয়েছে বলো তো নীলা, সেই তখন থেকে দেখছি মন খারাপ।’ অভিও নিজউ ডট কমের একজন তরুণ রিপোর্টার।
‘এমনি।’ জবাব দেন নীলা।
‘এমনি! এমনি তো কারও মন খারাপ হতে পারে না। তাছাড়া এখন সময়টা আমাদের জন্য বিরাট এক গৌরবের। আর কয়েক দিন পরই সারা বিশ্ব শ্রদ্ধাভরে সালাম করবে আমাদের। আর এ জন্য যার অবদান আমরা যাচ্ছি সেই মহান ব্যক্তির ইন্টারভিউ নিতে। নিশ্চয়ই বড় কিছু হয়েছে, না হলে এ সময় তোমার মন খারাপ হতে পারে না।’
‘তুমি তো জান অভি আমার বাবাও একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনিও একই বিষয়ে গবেষণা করতেন। আজ কেন যেন বারবার বাবার কথা মনে পড়ছে।’ শুকনো গলায় বললেন নীলা।
‘হ্যা তাতো জানি, কিন্তু হঠাৎ তার কী যে হলো! সবই নিয়তি।’ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন অভি।
কেউ আর কোন কথা বললেন না। কতক্ষণ পর গাড়ি এসে থামলো একটি বাড়ির সামনে। লিফট বেয়ে উপরে উঠে একটি দরজায় বেল বাজালেন নীলা। ওদের পরিচয় জানতে চেয়ে একটি যান্ত্রিক কণ্ঠ ভেসে এলো। দরজার পাশের একটি জায়গায় নীলা ও অভি তাদের আইডি কার্ড পাঞ্চ করলেন। কয়েক মুহূর্ত পর দরজা খুলে গেল।
ভেতরে ঢুকতে একটি রোবট ওদের পথ দেখিয়ে বসার ঘরে নিয়ে গেল। কতক্ষণ পর রাশভারি চেহারার এক ভদ্রলোক এলেন ঘরে। দাঁড়িয়ে প্রফেসর আজিমকে নিজেদের পরিচয় দিলেন নীলা ও অভি। কিছু সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর নীলা ইন্টারভিউ শুরু করলেন। প্রফেসর আজিমের সাম্প্রতিক গবেষণার ইতিবৃত্ত, সফলতার কথা সব জেনে নিলেন। প্রফেসর আজিম বেশ উচ্ছ্বসিত তার নতুন সাফল্যে। বললেন, দীর্ঘ সাত বছর ধরে তিনি এ নিয়ে গবেষণা করছেন। অনেক সাধনার পর অবশেষে সাফল্য পেয়েছেন।
নীলা জানতে চাইলেন, কিভাবে যোগাযোগ সম্ভব হলো ভিনগ্রহের প্রাণীদের সাথে?
‘তোমরা তো জানো ভিনগ্রহে যে বুদ্ধিমান প্রাণী আছে সে কথা আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেই নিশ্চিত হওয়া গেছে। এরপর থেকেই বিভিন্নভাবে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন তাদের সাথে যোগাযোগ করতে। এতদিন আমরা আমাদের সিগন্যাল মহাকাশে প্রেরণ করতে পারলেও মহাকাশ থেকে কোন সিগন্যাল রিসিভ করতে পারিনি। কিছু বিচ্ছিন্ন সিগন্যাল রিসিভ করলেও তাতে ছিল না কোন অর্থপূর্ণ মেসেজ। সেসব সিগন্যাল নিয়ে অনেক গবেষণা করেও আমরা তার অর্থ বের করতে পারিনি।’
‘এবার তাহলে কিভাবে সম্ভব হলো?’ জানতে চাইলেন নীলা।
‘এবার আমি সম্পূর্ণ নতুন একটি পদ্ধতিতে কাজটি করেছি। আমি আগেই বুঝতে পেরেছি যে শুধুমাত্র যন্ত্র দিয়ে ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। কারণ ওদের বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তি আমাদের চেয়ে অনেক উঁচু স্তরের।
‘তাহলে?’
‘এ জন্য আমি মানুষের মস্তিষ্ককে ব্যবহার করেছি। মানুষের মস্তিষ্ক যন্ত্রের চেয়ে কয়েক লক্ষ গুণ শক্তিশালী।’
‘কার মস্তিষ্ককে ব্যবহার করেছেন!’ বিস্ময় নীলার কণ্ঠে।
সেটা বুঝতে পেরে প্রফেসর আজিম বললেন, ‘না না ভয় পাবার কিছু নেই, আমি অন্য কারও নয় আমার নিজের মস্তিষ্ককেই ব্যবহার করেছি। মস্তিষ্ক ঠিক নয়, মস্তিষ্কের কোডিং আর কী। এর মাধ্যমে সফল হয়েছি ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ করতে। এবং ওদের মেসেজ রিসিভ করতে। আগামী পরশু আমরা সরাসরি ওদের সাথে যোগাযোগ করবো, যেটা স্বয়ং প্রেসিডেন্ট উদ্বোধন করবেন।’
এরপর অভি প্রফেসর আজিমের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে কিছু প্রয়োজনীয় কথা জেনে নিলেন। পুরো সাক্ষাৎ জুড়েই প্রফেসরকে বেশ উৎসাহী মনে হলো। শেষে নিজেই বললেন, ‘এসো তোমাদের সেই সিস্টেমটা দেখাই।’
দুটো রোবটকে নির্দেশ দিতেই তারা কিছু যন্ত্রপাতি এনে প্রফেসর অজিমের সামনে রাখলো। একটি সুইচে চাপ দিতেই পাশের দেয়ালে একটি মনিটর জীবন্ত হলো। এরপর কিছু বাটন টিপে একটি প্রোগ্রাম চালু করলেন। শুরুতে একটি পাসওয়ার্ড চাইলো প্রোগ্রামটি। নীলার কাছে প্রফেসরকে একটু বেশিই উত্তেজিত মনে হলো। কয়েকটি বাটন টিপে পাসওয়ার্ড দিলেন। মনিটরে তাকিয়ে আছেন নীলা ও অভি। কিন্তু খুললো না প্রোগ্রামটি। রং পাসওয়ার্ড লেখা একটি সিগন্যাল এলো সেখানে। দু’জনেই চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন প্রফেসর আজিমের দিকে। ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন তিনি। বললেন, ‘স্যরি, ভুল করে আমার পিসি’র পাসওয়ার্ড দিয়ে ফেলেছি, বুঝতেই পারছো। এত বড় সাফল্যে একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছি।’
‘ইটস ওকে।’ বললেন অভি।
আবার পাসওয়ার্ড দিতে শুরু করলেন প্রফেসর। মনিটরের দিকে তাকালেন অভি। নীলা কী মনে করে প্রফেসর আজিমের হাতের দিকে তাকালেন। মনের অজান্তেই চোখ অনুসরণ করলো তার আঙুলগুলো। পাশাপাশি বসা তাই বুঝতে অসুবিধা হলো না প্রফেসরের আঙুলগুলো কোন কোন অক্ষরের ওপর চাপ দিল।
‘এবার খুলে গেছে।’ অভি বললেন। নীলার সে দিকে কোন খেয়াল নেই। একইভাবে চেয়ে রইলেন বাটনগুলোর দিকে। কিছু একটা যেন মেলাতে চেষ্টা করলেন মনে মনে। পেয়েও গেলেন। মুহূর্তে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ড দিয়ে। যা দেখলেন তাকি সত্যি! যদি সত্যি হয় তাহলে কি….। নিজের মনে ভাবনাটা চেপে তাকালেন মনিটরের দিকে। কাউকে কিছু বুঝতে দেয়া যাবে না। প্রফেসর তার প্রোগ্রামটার বিভিন্ন বিষয় একে একে বলে যাচ্ছেন আর মুগ্ধ হয়ে তা শুনছেন অভি। নীলার মাথায় কিছুই ঢুকলো না। দেখা শেষ করে দ্রুত বিদায় নিলেন প্রফেসর আজিমের বাসা থেকে। বাইরে এসে অভি বললেন, ‘কী ব্যাপার নীলা, এত তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে এলে যে?’
‘হঠাৎ মাথাটা ধরেছে তাই।’ আর কোন কথা না বলে গাড়িতে উঠলেন নীলা।
পরদিন সকালে ইউনিভার্সিটির ভিসি’র কাছে গেলেন নীলা। প্রফেসর আরেফিনের মেয়ে শুনে খুবই খাতির করলেন তিনি। আফসোস করলেন তার হঠাৎ নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে। ওদের পরিবারের খোঁজ খবর নিলেন। এরপর নীলা তার সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে প্রফেসর আজিমের ব্যাপারে কিছু কথা জানতে চাইলেন। নিজের মনের কথাটা গোপন রাখলেন। সাংবাদিক হিসেবে প্রফেসর আজিমের খাঁজ নেয়াতে ভিসিও কিছু সন্দেহ করতে পারলেন না। তিনি বললেন, ‘হঠাৎ করে গত সাত-আট বছর ধরে প্রফেসর আজিমের মহাকাশ গবেষণার দিকে ঝোঁক সৃষ্টি হয়। এরপর সে একে একে কিছু সাফল্যও পেতে থাকে। এখনতো রীতিমত বিশ্বখ্যাত হওয়ার অপেক্ষায়।’
‘এর আগে মানে পেশাগত জীবনের শুরুতে কি তিনি মহাকাশ বিষয়ে গবেষণা করতেন।’ নীলা জানতে চাইলেন।
‘না আগে খুব একটা লক্ষ্য করিনি।’ ভিসি বললেন।
‘একটু মনে করে দেখুন তো স্যার, আমার বাবা যখন এই বিষয়ে কাজ করতেন তখন কি প্রফেসর আজিম এ বিষয়ে কাজ করতেন?’
‘না তা করতো না, তবে তোমার বাবাকে মাঝে মাঝে সাহায্য করতো তার কাজে।’
‘তার উল্লেখযোগ্য কোন গবেষণাকর্ম আছে বাবা নিখোঁজ হবার আগে?’
‘না সে রকম কিছু নেই, তার সব কাজইতো গত কয়েক বছরে।’ বললেন ভিসি
=====2================
‘না সে রকম কিছু নেই, তার সব কাজইতো গত কয়েক বছরে।’ বললেন ভিসি।
আর কথা বাড়ালেন না নীলা। ভিসিকে ধন্যবাদ দিয়ে বের হয়ে এলেন তার অফিস থেকে। গাড়িতে উঠে সোজা চললেন জাতীয় বিজ্ঞান পরিষদে। ঢুকলেন রেকর্ড উইংয়ে। খোঁজ নিলেন সময়ের সবচেয়ে আলেচিত বিজ্ঞানী প্রফেসর আজিম সম্পর্কে। রেকর্ডে দেখা গেল প্রফেসর আজিম সাত-আট বছরে হঠাৎ করেই শীর্ষ বিজ্ঞানী হিসেবে আবির্ভূত হন। এর আগে তার কোন গবেষণা কর্মের রেকর্ড নেই বিজ্ঞান পরিষদে। বের হয়ে গেলেন নীলা। চললেন পুলিশ স্টেশনে। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে খুলে বললেন তার সন্দেহের কথা। সব শুনে পুলিশ অফিসার বললেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া এতবড় একজন ব্যক্তিত্বের নামে তিনি মামলা নিতে পারবেন না। কোন প্রমাণ জোগাড় করতে পারলে তবেই মামলা নেবেন।
নীলা বললেন, ‘ঠিক আছে আমিও মামলা করতে চাই না। আমি এসেছি ডায়েরি করতে। পরবর্তীতে কোন প্রমাণ জোগাড় করতে পারলে তবেই মামলা করবো।’
এবার পুলিশ অফিসার রাজি হলেন। তবে শর্ত দিলেন এ ডায়েরির কথাও গোপন রাখতে হবে। কারণ এতে প্রফেসর আজিমের সম্মানহানি হতে পারে।
রাজি হলেন নীলা।
পরদিন সকাল। জাতীয় বিজ্ঞান পরিষদের কনফারেন্স রুমে প্রেসিডেন্টসহ সব বড় বড় কর্তা উপস্থিত। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও আছেন। নিউজ ডট কমের তরুণ রিপোর্টার নীলা সাবিহাও আছেন তাদের মধ্যে। প্রেসিডেন্টের সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পর শুরু হল প্রফেসর আজিমের অভূতপুর্ব আবিষ্কার মহাজাগতিক প্রাণীদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের কাজ। প্রফেসর আজিম তার কাজ শুরু করলেন। দেয়ালে বড় মনিটরে আটকে আছে সবার চোখ। কয়েকবার চেষ্টার পর একটি মহাজাগতিক সিগন্যাল ধরা পড়লো মনিটরে। অদ্ভুত ভাষায় দুই-তিনটি শব্দ লেখা। দশর্কদের মধ্যে হাততালি পড়ে গেল। সুপার কম্পিউটার নিকম্পের মাধ্যমে সেই ভাষাটা অনুবাদ করা হল। এবার মনিটরে লেখা উঠলো ‘স্বাগতম প্রফেসর আরেফিন।’
প্রফেসর আজিম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন শুরু হল। তাড়াহুড়ো করে আরেকটি সিগন্যাল প্রেরণ করলেন প্রফেসর আজিম। আরেকটি মেসেজ এলো প্রতি-উত্তরে। নিকম্প সেটা অনুবাদ করতেই মনিটরে ভেসে এলো ‘মানবজাতিকে আমাদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা, প্রফেসর আরেফিন।’
মেরুদণ্ড সোজা হয়ে গেল নীলার, যা করার এখনই করতে হবে। দ্রুত উঠে রুমের বাইরে গেলেন। ফোন করলেন অফিসারকে। বললেন, ‘প্রফেসর আরেফিনকে হত্যার দায়ে এখনই প্রমাণসহ গ্রেফতার করা যাবে প্রফেসর আজিমকে।’ বলে আবার হল রুমে প্রবেশ করলেন নীলা। ঢুকে দেখলেন দর্শকদের উদ্দেশে কথা বলছেন প্রফেসর আজিম। ইতোমধ্যে মনিটর থেকে তার প্রোগ্রামটি বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি বললেন, উপস্থিত ভদ্রমহোদয়গণ, সামান্য কিছু কারিগরি ত্রুটির কারণে মহাজাগতিক মেসেজের ভুল তথ্য আসছে। আসলে প্রায় দশ-বারো বছর আগে আমার সহকর্মী প্রফেসর আরেফিন মহাজাগতিক এই প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছেন, তাই তারা এটাও প্রফেসর আরেফিনের সিগন্যাল মনে করেছে।’
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন নীলা। প্রফেসর আজিমকে বললেন, ‘কিন্তু আপনি তো বলেছেন আপনার মস্তিষ্কের কোডিং করে এই যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। তাহলে তারা কিভাবে প্রফেসর আরেফিনের নাম বলবে?’
নীলার প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন প্রফেসর আজিম। কিছু বলতে পারলেন না। নীলা আবার বললেন, ‘আমরা জানতে চাই এই আবিষ্কারটি কি সত্যিই আপনার নাকি অন্য কারও?’
‘এই মেয়ে কী সব ফালতু কথা বলছো তুমি!’ চটে গেলেন প্রফেসর আজিম। ‘আমার নয় তো কার?’
‘না এটি আপনার আবিষ্কার নয়।’ এবার আরও চড়ে গেল নীলার গলা। প্রেসিডেন্টের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মহামান্য স্যার, এই লোকটি আমাদের সবাইকে ধোঁকা দিচ্ছে। এই আবিষ্কারটি মূলত দশ বছর আগে নিখোঁজ হওয়া বিজ্ঞানী প্রফেসর আরেফিনের। আমি নীলা সাবিহা, তার একমাত্র কন্যা। বিশ্বাস না হলে দেখুন এই প্রোগ্রামটি লগ ইন করার পাসওয়ার্ডটি আমার বাবা আমার নামেই দিয়ে ছিলেন। এবং আমি সন্দেহ করছি আমার বাবার নিখোঁজ হওয়ার জন্য প্রফেসর আজিমই দায়ী।’
বিস্ফোরিত চোখে নীলার দিকে তাকালেন প্রফেসর আজিম। যেন ভূত দেখছেন। প্রেসিডেন্ট একবার নীলার দিকে আর একবার প্রফেসর আজিমের দিকে তাকালেন।
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট। প্রফেসর আজিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘প্রফেসর, এই মেয়েটি যা বলছে তা কি সত্যি?’
‘না স্যার, বিশ্বাস করুন একদম মিথ্যা কথা। সব ষড়যন্ত্র স্যার।’
‘আপনার প্রোগ্রামটি লগ ইন করার পাসওয়ার্ডটি আমাদের বলুন তো, তাহলে আমরা বুঝবো যে সেটা আপনার প্রোগ্রাম।’
‘আসলে স্যার… স্যার …’ কথা খুঁজে পেল না প্রফেসর আজিম।
প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘তার মানে এই মেয়েটি যা বলছে সব সত্যি!’
এ সময় মঞ্চের কাছে এগিয়ে এলেন পুলিশ অফিসার। প্রেসিডেন্টকে স্যালুট করে বললেন, ‘স্যার প্রফেসর আরেফিনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় প্রফেসর আজিমকে সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করে ইতোমধ্যেই আমাদের কাছে একটি ডায়েরি করা হয়েছে।’ সাথে সাথে প্রফেসর আজিমকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন প্রেসিডেন্ট।
পরদিন দেশ-বিদেশের সব সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হলো প্রফেসর আজিম, তবে নায়ক নয় খলনায়ক হিসেবে। পুলিশ রিমান্ডে প্রফেসর আজিম স্বীকার করেছেন যে, প্রফেসর আরেফিনকে হত্যা করে তার মস্তিষ্ক কোডিং করেই মহাজাগতিক প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ সৃষ্টি করেছেন। এ ছাড়া প্রফেসর আরেফিনের মস্তিষ্কের কিছু সেল নিজের মস্তিষ্কে রিপ্লেসমেন্টও করেছেন, যার কারণেই তার হঠাৎ এতবড় বিজ্ঞানী হয়ে ওঠা।
খবরটা পেয়ে নিজের ডেস্কের ওপর ঝুঁকে পড়ে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন নীলা। অভি এগিয়ে গেলেন সান্ত্বনা দিতে। ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলেন নিউজ এডিটর।
(সমাপ্ত)

দুঃখিত!