
এক গ্রামে এক কাঠুরে বাস করত। সে সারাদিন কাঠ কাটত আর সন্ধ্যার পর তা বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে, সেই অর্থ দিয়ে নিজের খরচ মেটাত। বাবা মা মারা যাওয়ায় এবং বিয়ে থা না করায় সংসারে সে একাই ছিল। ইচ্ছে ছিল, কিছু টাকা জমলে সুন্দরী একটা মেয়ে দেখে সে বিয়ে করবে। প্রতিদিন কাঠা কাটত আর ভাবত, এই বিরক্তিকর জীবন আর ভালো লাগে না। কবে যে একটা বিয়ে করবে আর সারাদিন পরিশ্রম করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বউয়ের মায়াভরা চেহারা দেখে সব ভুলে যাবে। (বোকা কাঠুরে জানত না যে, বউ হচ্ছে কাল নাগিনী।
বউরা খালি পারে সাপের মত ফোসফোস করতে নতুবা কিচ্ছু হলে সাপের মত মোচড়ামুচড়ি করতে। জানলে বউয়ের মায়াভরা চেহারা না দেখে, সারাদিন রাত বনে বনে খালি কাঠ কেটে বেড়াত। যাই হোক, আমরা গল্পে ফিরে যাই) কাঠুরে কাঠ কেটে কেটে তা বাজারে বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা জমালো। আর কিছু টাকা হলেই সে ঘরটা সুন্দর করে করতে পারবে। আর তারপর আর কিছু টাকা হলে, সুন্দর একটা মেয়ে দেখে একটা বিয়ে করে ফেলবে। এখনো যে বিয়ে আসছেনা, তা নয়। বিয়ে আসছে, কিন্তু বাড়িটা আরেকটু সুন্দর করতে পারলেই আরেকটু ভালো যায়াগায় বিয়ে করা যাবে। কবে টাকা জমবে কবে বিয়ে করবে। তার আর দেরি সহ্য হচ্ছিল না। মনে মনে ভাবত ইস! যদি মাটির নিচে অনেক টাকার একটা কলস পেত! কত্ত মজা হত! কিন্তু সে কি আর হয়? প্রতিদিনের মত সেদিনও বিষণ্ণ মনে বনে গেল কাঠ কাটতে।
গাছ কাটা শেষ করে সে যখন গাছের গুড়িটা তুলছিল মাটির নিচ হতে, তখনই হঠাৎ ঠং করে একটা আওয়াজ হল। সে ভাবল খাইছে! কলসি কি পেয়েই গেলাম নাকি? কিন্তু না, ঐটা কলসি ছিল না। ঐটা ছিল পুরানো একটা ছোট্ট এবং নষ্ট একটা প্রদীপ। প্রদীপ দেখে তার মেজাজই খারাপ হয়ে গেল। ছুড়ে ফেলে দিতে গিয়েও তার পরক্ষনেই মনে হল, আরে এটা আবার ‘আলাদীনের’ সেই ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ নয়তো? বুকে ধুকধুকানি নিয়ে প্রদীপটা নিয়ে ঘষতে লাগলো। এবং তাকে অবাক করে দিয়ে, সেটা থেকে সত্যি সত্যিই ধোয়া বের হতে লাগলো। কাঠুরেতো যারপরনাই অবাক! এবং যা হবার তাই হল, প্রদীপ থেকে একটা দৈত্য বের হয়ে এল। দৈত্য এসেই আমাদের শোনা সেই গল্পের মতই হো হো হো করে হাসতে লাগলো। দৈত্য’র হাসি শুনে কাঠুরের ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার দশা। কাঠুরে প্রদীপ ফেলে দিল এক দৌড়। কিন্তু নিমিষেই দৈত্য তার সামনে এসে দাঁড়াল। দৈত্য বলে উঠল, ‘ভয় পেও না’ আমি এই প্রদীপের দৈত্য। আমি দীর্ঘ পাঁচ হাজার বছর যাবত এই প্রদীপে বন্দি। তুমি আমাকে মুক্ত করেছ।
বল তুমি কি চাও। আমি তোমার তিনটি ইচ্ছে পুরন করব” এইবার কাঠুরে কিছুটা আশ্বস্ত হল। সে বলল ‘ও আচ্ছা তাই বল, তুমি সেই দৈত্য? আমি ভাবলাম কি না কি! আচ্ছা যাই হোক, তুমি আমার তিনটি ইচ্ছে পুরন করবে তো? ঠিক আছে আমার প্রথম ইচ্ছে হল- আমাকে এই বনের ঠিক মাঝখানে খুব সুন্দর এবং মজবুত দেখে দুইটা বাড়ি করে দাও। ‘জো হুকুম’ দৈত্য সাথে সাথে তার আদেশ পালন করল। সত্যি সত্যি বনের মাঝে ২টা সুন্দর বাড়ি দেখা যেতে লাগলো। ‘আমার ২য় ইচ্ছে হল, এই দুইটা বাড়ি হতে যে কোন একটা বাড়ি তুমি শুধু টাকা দিয়ে ভরে দাও, যাতে করে আমি সারাজীবন খরচ করেও এই টাকা শেষ করতে না পারি’ কাঠুরে দৈত্য’কে উদ্দেশ্য করে বলল। ‘যথা আজ্ঞা’ বলে তার এই ইচ্ছেও পুরন করে দিল ‘প্রদীপের দৈত্য’। কাঠুরে আবারো বলে উঠল “আমার তৃতীয় এবং সর্বশেষ ইচ্ছে হল, এই গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে আমার বউ করে দাও”। ‘তবে তাই হোক’ বলে তার এই ইচ্ছেটাও পুরন করে দিল দৈত্য। সবকিছু দেখে খুশিতে নাচতে লাগলো কাঠুরে। তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না এতকিছু বাস্তবে হচ্ছে। সে তার হাতে চিমটি কেটে দেখতে লাগলো, আসলেই এটা বাস্তব কি না। দেখল, এটা আসলেই বাস্তব। কাঠুরে যখন এইসব ভাবছিল, তখনিই দৈত্য কথা বলে উঠল। ‘কাঠুরে, নিয়মমত আমি তোমার তিনটি ইচ্ছে পুরন করেছি, এবার তুমি আমার ১টা ইচ্ছে পুরন করে দাও’। দৈত্য’র কথা শুনে কাঠুরের ভাবনার লাগামে টান পরল। সে জিজ্ঞেস করল ‘কি ইচ্ছে?’। দৈত্য বলল ‘এই দৈত্য’র জীবন আর ভালো লাগে না। আমায় তুমি মানুষ করে দাও’। এই শুনে কাঠুরে হাসতে লাগলো আর হাসতে হাসতে বলল ‘ধুর…তাই কি হয় নাকি? দৈত্য তো দৈত্য’ই। সে আবার মানুষ হয় কেমন করে?’ এবার দৈত্য একটু রেগে গেল, ‘কেমন করে হয় তা তো জানিনা, তবে তুমি আমায় মানুষ করে দিবে এইটাই জানি’ দৈত্য আরও বলল, ‘আমি যখন এই প্রদীপের ভেতর বন্দী ছিলাম, তখনই মনে মনে পন করেছিলাম, যে আমাকে উদ্ধার করবে তার মনের তিনটি ইচ্ছে আমি পুরন করব এবং বিনিময়ে তাকেও আমার ১টি ইচ্ছে পুরন করতে হবে। আমি তোমার তিনটি ইচ্ছে পুরন করেছি এবার আমার সেই ১টি ইচ্ছে হচ্ছে আমি মানুষ হব’’।
কাঠুরেও এবার রেগে গিয়ে বলল ‘আমিতো প্রদীপের দৈত্যর গল্প পরেছি। কই গল্পের বইয়েতো এমন কিছু লিখা ছিল না। সেখানে শুধু লিখা ছিল প্রদীপের দৈত্য মানুষের ৩টি ইচ্ছে পুরন করে চলে যাবে। সেখানেতো বলা ছিল না যে দৈত্যের ইচ্ছেও পুরন করতে হবে”। এবার দৈত্য বলল ‘দেখ কাঠুরে, গল্পে সবকিছু বলা থাকে না। আর তাছাড়া মানুষের জীবনটাতো আর গল্প নয়, এটা বাস্তব” কাঠুরে এবার ভয় পেয়ে গেল। কাঠুরে বলল, ‘দেখ এটা সম্ভব নয়। মানুষের পক্ষে কোন দৈত্য’কে মানুষ করা সম্ভব নয়’। দৈত্য চিৎকার করে উঠল ‘অসম্ভব, আমি হচ্ছি এই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দৈত্য। আমার মত এক শক্তিশালী দৈত্যকে এক মানুষ এই প্রদীপের ভেতর বন্দী করেছে। সুতরাং মানুষের শক্তি আমার চেয়েও বেশী। আর তাছাড়া, মানুষের-ই-তো ভালো জানার কথা কেমন করে মানুষ হয়, তা না হলে সে নিজে কেমন করে মানুষ হল?” কাঠুরে অনেক করে বোঝাতে লাগলো এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু বোকা দৈত্য কোনভাবেই বুঝল না। তার মানুষ হবার ইচ্ছে পুরন করতে না পারার অপরাধে কাঠুরেকে মেরে সেখানেই ফেলে রাখল। তারপর মিলিয়ে গেল বাতাসে। কাঠুরের লাশ পরে ছিল বনের মাটিতে।
তার ঠিক কয়েক ফুট দুরেই ছিল দৈত্যর করে দেয়া তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন একটি সুন্দর বাড়ি এবং সেই ছোট্ট একটি সুন্দরী বউ। কাঠুরের দেহের সাথে তার স্বপ্নের ফারাক ছিল মাত্র কয়েক ফুট। কিন্তু এত কাছে থেকেও তার স্বপ্ন ধরার ক্ষমতা ছিল না। কারন, তার দেহে প্রান ছিল না। যারে ভেবে দিন কেটে যায় মনের গহীন ঘরে, যার আশাতে মনের ভেতর সুখের বৃষ্টি ঝরে। তবু কেন যে সে হারিয়ে যায়, যায় না ধরা তারে যা পাখি উড়ে যা রে, দেখলে বলে দিস তারে, আমি থাকবো বসে তার পথ চেয়ে এই নদীর কিনারে।