
মহাবিশ্ব ও পৃথিবী এই মহা বিশ্বে রয়েছে লক্ষ কোটি গ্রহ নক্ষত্র। মেঘমুক্ত আকাশে মাথার উপর শুন্যলোকে তাকিয়ে দেখুন, বলুনতো কী দেখতে পান? হ্যাঁ, দিনে প্রচণ্ড তেজদীপ্ত সূর্য। রাতে ঝলমল মিটমিটে তাঁরার আলো। এইতো আমরা দেখি দিবানিশি। বাপও দেখেছেন। দাদা দেখেছেন। পরদাদা দেখেছেন, পূর্বপুরুষরা সবাই দেখেছেন। কবে থেকে ওদের শুরু আর কবে যে হবে শেষ, কেউ জানে না তা। একই পথে, একই নিয়মে ওরা চলছে তো চলছেই।
কে ওদের সৃষ্টি করেছেন? আপনি নিশ্চয়ই বলবেন, এক আল্লাহ ছাড়া আবার কে? হ্যাঁ তিনি গোটা বিশ্ব জগত সৃষ্টি করেছেন মাত্র ছয়দিনে। (দেখুন আল কুরআনঃ সুরা আরাফঃ ৪৫, সুরা ইউনুসঃ ৩, সুরা হুদঃ ৭, সুরা ফুরকানঃ ৫৯, সুরা সাজদাঃ ৪, সুরা কাহাফঃ ৩৮, সুরা হাদিদঃ ৪) ছয় দিনে মানে ছয়টি কালে। তিনিই গোটা বিশ্ব জগতের স্রষ্টা, শাসক ও পরিচালক। তিনিই সমস্ত ক্ষমতার উৎস।
মহা বিশ্বে এই যে লাখো কোটি গ্রহ নক্ষত্র, ওদের আবার ভিন্ন ভিন্ন পরিবার আছে। একেক পরিবারের অনেক অনেক সদস্য আছে। ওদের যে মোট কয়টি পরিবার আছে, আর একেক পরিবারে যে কতজন সদস্য আছে, সে কথা কেউ বলতে পারবে না। আমাদের এই পৃথিবীও কিন্তু একটা গ্রহ। একটি নক্ষত্র পরিবারের সদস্য।
এবার নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পেরেছেন, মহান আল্লাহর গোটা সৃষ্টিলোকের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশই মাত্র আমাদের এই পৃথিবী। তিনি এই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন মনের মত সুন্দর করে। সাজিয়েছেন অপরূপ সাজে।
এখানে শান্ত সাগর গতিমান। চঞ্চল নদী বহমান। পর্বতমালা শিরতুলে উঁকি মারে আকাশে। দিনে সূর্যের আলো। রাতে মিষ্টি হাসি চাঁদের। সবুজের বন। গাছের ছায়া। পাখির কলতান। ফুলের গন্ধ। ফলের সমারোহ। সবকিছু আছে অফুরান। নেই শুধু সেই—–।
প্রতিনিধি পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেই শুধু সেই মানুষ। সেই মানুষ, যার জন্যে এই পৃথিবীর সবকিছু বানিয়েছেন তিনি। (সুরা ২ আল বাকারাঃ আয়াত ২৯) তিনি পৃথিবীতে তাঁর নতুন প্রতিনিধি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। আর সিদ্ধান্ত নিলেন, মানুষ সৃষ্টি করে তাঁকেই পৃথিবীতে তাঁর নতুন প্রতিনিধি বানিয়ে পাঠাবেন। যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ। কে আছে তাঁর সিদ্ধান্ত নাড়াবার? তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের কথা ফেরেস্তাদের জানিয়ে দিলেন। বললেন, ‘‘হে ফেরেস্তারা, পৃথিবী নামের নতুন যে গ্রহটি আছে, সেখানে আমি এক নতুন প্রজন্মকে প্রতিনিধি নিয়োগ করবো।’’
ঘোষণাটি শুনে তাঁরা আঁতকে ওঠে। ফেরেস্তা কারা? হ্যাঁ, তাদেরাও আল্লাহর সৃষ্টি। তাঁর দাস। তাঁর সাম্রাজ্যের একান্ত বিনীত বাধ্যগত কর্মচারী। আল্লাহর নির্দেশে তাঁরা গ্রহ নক্ষত্র পরিচালনা করে। পানি, বাতাস, মেঘমালা পরিচালনা করে। জীবন মৃত্যু দান করে। তাঁরই নির্দেশে আরো করে হাজারো রকমের কাজ। মোট কথা তাঁরা তাঁর দাস কর্মচারী। দাসত্ব করা ছাড়া তাঁরা আর কিছু জানে না, বুঝে না। তাইতো তাঁরা প্রভুর বক্তব্যে ‘প্রতিনিধি’ শব্দটি শুনে আঁতকে ওঠে। কারণ এ শব্দটির মধ্যে ‘স্বাধীনতার’ গন্ধ আছে। আর স্বাধীনতা পেলে স্বেচ্ছাচারীতার আশঙ্কা থাকে। তাইতো তাঁরা বলে উঠলোঃ ‘‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকেও পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যে সেখানকার ব্যবস্থাপনায় বিপর্যায় সৃষ্টি করবে, আর করবে হানাহানি রক্তপাত? আপনার প্রশংসা আর গুনগান করার জন্যে তো আমরাই নিযুক্ত রয়েছি।’’
(সুরা ২ আল বাকারা-আয়াত ৩০) আল্লাহ তাঁদের বলে দিলেনঃ ‘‘আমি যা জানি, তোমরা তা জান না।’’
(সুরা ৬ আনয়ামঃ আয়াত ২, সুরা মুমিনুনঃ আয়াত ১২, সুরা সাজদাঃ আয়াত ৭) সৃষ্টি করলেন আদমকে, তারপর কি হল? তারপর তিনি সৃষ্টি করলেন প্রথম মানুষ। সৃষ্টি করলেন তাঁকে মাটি দিয়ে। (সুরা ২ আল বাকারাঃ আয়াত ৩০) মাটির দেহ তৈরি হয়ে যাবার পর তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন জীবন। তিনি হয়ে গেলেন এক জ্যান্ত মানুষ। আল্লাহ তাঁর নাম দিলেন ‘আদম’। তিনি আদমকে শুধু জ্যান্ত মানুষই বানান্ নি। বরং ‘‘খালাকাল ইনসান, আল্লামাহুল বাইয়ান’’-তাঁকে মানুষ বানালেন এবং কথা বলা শিখালেন। আদম পৃথিবীর সব মানুষের পিতা।
জ্ঞানী আদম তারপর মহান আল্লাহ ‘আদমকে সব কিছুর নাম শিখালেন’। (সুরা আল বাকারাঃ আয়াত ৩১) নাম শিখানোর মানে কী? নাম শিখানোর মানে পরিচয় শিখানো। গুনবৈশিষ্ট এবং ব্যবহার বিধি জানানো। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আদমকে সব কিছুর পরিচয় জানিয়ে দিলেন। জানিয়ে দিলেন ব্যবহার করার নিয়ম কানুন। প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করবার জন্যে এ শিক্ষা লাভ করার প্রয়োজন ছিল অনিবার্য।
এবার ফেরেশতাদের কাছে বললেনঃ ‘‘তোমরা যে ধারনা করেছিলে, তা যদি সঠিক হয়ে থাকে, তবে বলো দেখি এই জিনিসগুলির নাম।’’
(সুরা ২ আল বাকারাঃ আয়াত ৩১) কী করে বলবে তাঁরা? তাঁদের তো এগুলি সম্পর্কে কোন জ্ঞানই দেয়া হয় নি। তাঁরা বিনীত কয়ে বললো – ‘‘প্রভূ, ত্রুটিমুক্ত পবিত্র তোমার স্বত্বা। আমরা তো কিছুই জানি না। কেবলমাত্র তুমি যতটুকু শিখিয়েছ, ততটুকুই আমরা জানি। সমস্ত জ্ঞান ও বিজ্ঞতার মালিক তো তুমিই।’’
(সুরা ২ আল বাকারাঃ আয়াত ৩২) এবার তিনি আদমকে নির্দেশ দিলেন, ‘‘আদম, তুমি ওদেরকে এ জিনিসগুলির পরিচয় বলে দাও।’’ আদম (আঃ) সবগুলি জিনিসের পরিচয় তাঁদেরকে বলে দিলেন। (আল বাকারাঃ আয়াত ৩৩) আদমের প্রতি সাজদাবনত হবার হুকুম।
এই আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ফেরেশতারা যা সন্দেহ করেছিলো, তারই জবাব দেয়া হয়েছে। তাঁদের বুঝিয়ে দেয়া হল, মানুষকে কেবল ক্ষমতা আর স্বাধীনতাই দেয়া হবে না, বরং তাঁদের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা প্রয়োগের জন্যে জ্ঞানও দেয়া হবে।
আল্লাহ্ ফেরেশতাদের হুকুম দিলেনঃ ‘‘আদমের সামনে নত হও।’’ আল্লাহর নির্দেশে সবাই আদমের সামনে অবনতো হলো। (আল বাকারাঃ আয়াত ৩৪)
ইবলিসের কাণ্ড: কিন্তু ইবলিস অবনতো হতে অস্বীকার করলো। সে অহংকার করে বললোঃ ‘‘আমি আদমের চাইতে উত্তম। কারণ তুমি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছ। আর আদমকে তো মাটি দিয়ে তৈরি করেছ।’’ এভাবে ইবলিস তিনটি অমার্জনীয় অপরাধ করলো। সেঃ ১। আল্লাহর হুকুম অমান্য করলো, ২। অহংকার করলো এবং ৩। নিজেই নিজেকে উত্তম বলে ঘোষণা করলো। এই তিনটির চাইতে নিকৃষ্ট অসৎগুণ আর হয় না। সুতরাং আল্লাহ্ তাঁকে ‘‘অভিশপ্ত শয়তান’’ বলে আখ্যা দিলেন। বললেনঃ ‘তুই এখান থেকে নেমে যা। এখানে থেকে অহংকার করবার কোন অধিকার তোর নেই। যা, তুই বেরিয়ে যা। এখন থেকে তুই অপমানিত ও লাঞ্ছিতদেরই একজন।’’
(আল আরাফঃ আয়াত ১৩)
এবার সে সমস্ত কল্যাণ ও অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হল। আর ‘ইবলিস’ মানেই নিরাশ। কিন্তু সে অহংকার ত্যাগ করলো না। সে ভাবল, আদমের কারণেই তো আমি বঞ্চিত আর অভিশপ্ত হয়েছি। সুতরাং আদম ও আদমের সন্তানদের ক্ষতি করার জন্য আমি সর্বশক্তি নিয়োগ করবো। সে আল্লাহকে বললোঃ ‘আমাকে পুনরুথ্যান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন।’’
এই ‘অবকাশ দিন’ বলতে শয়তান আল্লাহর কাছে দুটি সুযোগ চাইলোঃ ১। কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকার সুযোগ এবং ২। আদম সন্তানদের পথভ্রষ্ট করার সুযোগ। ‘‘আল্লাহ্ বললেন- যা তোকে সুযোগ দিলাম।’’
(আল আরাফঃ আয়াত ১৫, সুরা আল হিজরঃ আয়াত ৩৭)
শয়তান বলল- ‘‘আদম সন্তানদের পথভ্রষ্ট করার জন্যে এখন থেকে আমি তোমার সরল সঠিক পথের বাঁকে বাঁকে ওঁৎ পেতে বসে থাকবো। সামনে পিছে, ডানে বামে, সব দিক থেকে আমি তাঁদের ঘিরে ফেলব। ফলে তাঁদের মধ্যে থেকে খুব কম লোককেই তুমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ পাবে।’’
(সুরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ১৬-১৭)
আল্লাহ্ বললেনঃ আমার বান্দাদের উপর তোর কোন প্রভাব প্রতিপত্তি চলবে না। তুই জোর করে তাঁদের সঠিক পথ থেকে ফেরাতে পারবি না। তুইতো পারবি কেবল চালবাজি করতে। মিথ্যা আশার লোভ দেখাতে। পাপের কাজকে চাকচিক্যময় করে দেখাতে। আর ভ্রান্ত পথের আকর্ষণ সৃষ্টি করতে। এই সুযোগই তো কেবল তোকে দেয়া হয়েছে। লোকদের জোর করে হেদায়েতের পথ থেকে গোমরাহির পথে টেনে নেবার ক্ষমতা তোকে দেয়া হয় নি। তবে যে সব মানুষ তোর প্রলোভনে পড়বে, আমি তাঁদেরকে আর তোকে দিয়ে জাহান্নাম ভর্তি করবো।
(ইসরাঃ আয়াত ৬২-৬৫, সুরা হিজরঃ আয়াত ৪২)
এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, যে সব মানুষ আল্লাহর হুকুম মেনে চলবে, শয়তান তাঁদের পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। সে ক্ষমতা শয়তানের নেই। শয়তান কেবল তাদেরই বিপথগামী করতে পারবে, যারা আল্লাহর হুকুম মেনে চলে না। কিংবা তাঁর হুকুম পালনে গাফলতি করে।
আদম ও হাওয়া জান্নাতে: তারপর কি হল? – তার পর মহান আল্লাহ্ শয়তানকে লাঞ্ছিত করে তাড়িয়ে দিলেন। আর আদমকে থাকতে দিলেন জান্নাতে। প্রথমত আদম ছিলেন একা। তারপর আল্লাহ্ আদমের (পাঁজরের হাড়) থেকে তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করলেন। (আন নিসাঃ আয়াত ১)
এবার তিনি আদমের কাছে কিছু নির্দেশ পাঠালেন। বললেনঃ ‘‘হে আদম, তুমি আর তোমার স্ত্রী দুজনেই জান্নাতে থাকো। যা খুশি ইচ্ছামত খাও। তবে শুনো ঐ যে গাছটি, সেটির কাছেও যেও না। সেটির ফল খেও না। খেলে জালিমদের মধ্যে গণ্য হবে।’’
(আল বাকারাঃ আয়াত ৩৫)
বাবা আদম আর মা হাওয়া দারুন সুখে জান্নাতে থাকতে লাগলেন। কী চমৎকার জায়গা জান্নাত। সুখ আর আনন্দের অন্ত নেই এখানে। কিন্তু আদম হাওয়ার এই আনন্দ, এই সুখ শয়তানের সহ্য হয় না।
শয়তানের প্রতারণা:
সে ভাবলো, আদমের কারণে তো আমার এই লাঞ্ছনা। যে করেই হোক, আমি যেমন আল্লাহর হুকুম অমান্য করে লাঞ্ছিত হয়েছি, সেরকমভাবে আদমকে দিয়েও আল্লাহর হুকুম অমান্য করাতে হবে। তখন সেও হবে আমার মতো লাঞ্ছিত ও অপদস্থ।
শয়তান প্রতারণা করলো:
আদম ও হাওয়া তখন পর্যন্ত শয়তানের ধোকা প্রতারণা সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতা লাভ করেননি। এই সুযোগে শয়তান খুব ভালো মানুষের বেশে এসে তাঁদের ধোঁকা দিল। সে বললোঃ ‘‘তোমাদের প্রভূ তোমাদের এই গাছের নিচে যেতে নিষেধ করেছেন কেন জান? আসলে এই গাছের ফল খেলে উচ্চ মর্যাদা লাভ করা যায়। ফেরেশতা হওয়া যায়। তাছাড়া চিরদিন বেঁচে থাকা যায়। তোমরা যেন আবার ফেরেশতা না হয়ে বস, যেন চিরকাল বেঁচে না থাকো, সে জন্যই তোমাদের প্রভূ এ গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছেন।’’ সে কসম করে বললোঃ ‘‘আমি তোমাদের ভালো চাই’’। এভাবে সে দুজনকেই তার প্রতারণার জালে বন্দী করে ফেললো। (আল আরাফঃ আয়াত ২০-২২)
অভিশপ্ত ফল খাওয়ার পর:
তাঁরা দুজনেই নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে বসলেন। আল্লাহর নিষেধের কথা ভুলে গেলেন তাঁরা। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে তাঁরা অমান্য করে বসলেন মহান আল্লাহর নির্দেশ। সাথে সাথে তাঁদের জান্নাতি পোশাক খসে পড়লো। তাঁরা গাছের পাতা দিয়ে নিজেদের লজ্জা আবৃত করতে থাকেন। এসময় আল্লাহ্ পাক তাঁদের দিকে বললেন- ‘‘আমি কি তোমাদের নিষেধ করিনি এ গাছটির কাছে যেতে? আমি কি তোমাদের বলিনি শয়তান তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন?’’ (আল আরাফঃ আয়াত ২২)
আদম ও হাওয়ার অনুতাপ:
আদম ও হাওয়া দুজনেই তাঁদের ভুল বুঝতে পারলেন। চরম অনুতপ্ত হলেন তাঁরা। অপরাধবোধ তাঁদের ভীষণ ব্যাকুল করে তুললো। কান্নায় ভেঙে পড়লেন তাঁরা। অনুতপ্ত মনে কাতর কণ্ঠে তাঁরা ফরিয়াদ করলেন প্রভূর দরবারেঃ ‘‘ওগো প্রভূ, আমরা তো নিজেদের উপর অবিচার করে বসেছি। এখন তুমি যদি আমাদের ক্ষমা না করো, আমাদের প্রতি রহম না করো, তবে তো আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো।’’
(সুরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ২৬)
আল্লাহ ক্ষমা করে দিলেন তাঁদের:
তাঁদের এই আন্তরিক অনুশোচনা ও তওবা আল্লাহ কবুল করলেন। (আল বাকারাঃ আয়াত ৩৭) ফলে আদম ও হাওয়া শয়তানের প্রতারণার জালে আবদ্ধ হয়ে যে অপরাধ করে ফেলেছিলেন, মহান আল্লাহ্ তা মাফ করে দিলেন। তাঁরা পুনরায় আগের মত নিষ্পাপ হয়ে গেলেন।
শয়তান ও আদমের ভিন্নতর পরিস্থিতি:
এখানে একটি জরুরি বিষয় বুঝে নেয়া দরকার। সেটা হলো, প্রথমে আমরা দেখেছি, ইবলিস আল্লাহর হুকুম অমান্য করে অভিশপ্ত হয়েছে। আর এখানে দেখলাম, আদম (আঃ) এবং তাঁর স্ত্রীও আল্লাহর হুকুম অমান্য করলেন। কিন্তু তাঁরা রয়ে গেলেন নিষ্পাপ ও আল্লাহর প্রিয়, এর কারণ কি? – এর কারণ হল,
১। শয়তান আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছে বুঝে শুনে ইচ্ছাকৃতভাবে,
২। সে নিজেকে বড় মনে করেছে,
৩। সে নিজেকে উত্তম মনে করেছে,
৪। সে অহংকার করেছে,
৫। সে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেছে,
৬। এই অপরাধের জন্যে সে মোটেও অনুতপ্ত হয়নি এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি।
অন্যদিকে আদম (আঃ) ও তাঁর স্ত্রী হাওয়া:
১। ইচ্ছাকৃতভাবে বুঝে শুনে আল্লাহর হুকুম অমান্য করেননি,
২। তাঁরা বিদ্রোহও করেননি,
৩। তাঁরা অহংকারও করেননি,
৪। তাঁরা সচেতনভাবে মূলত আল্লাহর একান্তই আনুগত্য ছিলেন,
৫। তাঁরা অপরাধ করেছেন শয়তানের ধোঁকায় পড়ে,
৬। তাঁরা ভুল বুঝবার সাথে সাথে অনুতপ্ত হন। আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
খেলাফতের দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীতে এলেন আদম:
এভাবেই আদম (আঃ) আল্লাহর দাস ও খলিফা হবার মর্যাদা রক্ষা করেন। আল্লাহ্ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হন। তাই আল্লাহ্ তাঁর মূল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ইচ্ছা করলেন। অর্থাৎ তিনি আদম (আঃ) কে পৃথিবী নামক তাঁর প্রতিনিধি বানিয়ে দিলেন। কারণ এ জন্যই তো তিনি তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন। মাঝখানে কিছুদিন জান্নাতে রেখে একটা পরীক্ষা নিলেন মাত্র। এ পরীক্ষার মাধ্যমে আসলে এক বিরাট অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন হজরত আদম (আঃ)। প্রতিনিধি বানিয়ে পাঠাবার কালে, মহান আল্লাহ্ তাঁকে বলে দিলেনঃ ‘‘যাও পৃথিবীতে অবতরণ করো। তোমার শত্রু শয়তানও সেখানে যাবে। সেখানে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমরা বসবাস করবে। সেখানে তোমাদের জীবন সামগ্রীরও ব্যবস্থা আছে। সেখানেই তোমাদের বাচতে হবে। সেখানেই তোমাদের মরতে হবে। আবার সেখান থেকেই তোমাদের বের করে আনা হবে, পুনরুত্থিত করা হবে।’’ (আল আরাফঃ আয়াত ২৪-২৫)
এ প্রসঙ্গে তিনি হজরত আদম (আঃ) কে আর বলে দিলেন, ‘‘আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে জীবন পদ্ধতি যাবে। যে আমার দেয়া জীবন পদ্ধতির অনুসরণ করবে, তাঁর কোন ভয় থাকবে না। থাকবে না, কোন দুঃখ, কোন বেদনা।’’ অর্থাৎ সে অনায়াসে আবার জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং চিরকাল সুখে থাকবে। (আল বাকারাঃ আয়াত ২৮)
আল্লাহ আরো বলে দিলেনঃ ‘‘তবে যারা আমার জীবন পদ্ধতি অমান্য করবে আর মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে আমার আয়াতকে, চিরদিন তাঁদের আগুনে ফেলে রাখবো। তাঁরা তাঁদের চির শত্রু অভিশপ্ত শয়তানের সাথে অনন্ত জীবন জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে।’’
(আল বাকারাঃ আয়াত ২৯)
এভাবে পৃথিবীর জন্যে সৃষ্টি করা মানুষ হজরত আদম (আঃ) –কে আল্লাহ্ তাঁর খলীফা ও নবী বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে থাকেন। আদম (আঃ) তাঁর সন্তানদেরকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে শিখান। শয়তানের ধোঁকা প্রতারণা সম্পর্কে সতর্ক করেন। তাঁর শয়তানের বিরোধী সংগ্রাম করেই জীবন কাটান। আদম (আঃ) ছিলেন পৃথিবীর প্রথম মানুষ। তিনিই ছিলেন পয়লা নবী।
হজরত আদম (আঃ) এর গুণাবলী:
তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী, ভদ্র ও রূচিবান। ছিলেন উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী। ছিলেন অত্যন্ত সঞ্জমশীল, আল্লাহভীরু ও আল্লাহর প্রতি আত্মসমপির্ত। পোশাক ছিল তাঁর ভূষণ। এইসব মহান গুণাবলীর অধিকারী একজন সভ্য মানুষের মাধ্যমেই পৃথিবীতে শুরু হয় মানুষের শুভযাত্রা। আমরা এবং আমাদের আগের ও পরের সমস্ত মানুষই হজরত আদম (আঃ) এর সন্তান।
কুরআনের উল্লেখ:
মহান আল্লাহ্ বলেনঃ ‘‘হে মানুষ, তোমাদের প্রভূকে ভয় করো। তিনিইতো তোমাদেরকে একটি মাত্র প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর থেকেই তাঁর জুড়ি তৈরি করেছেন। আর তাঁদের দুজন থেকেই বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছেন অসংখ্য পুরুষ আর নারী।’’ (আন নিসাঃ আয়াত ১)
কুরআনে উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয়:
জেনে রাখুন, শেষ করবার আগে কয়েকটি জরুরি কথা জানিয়ে দেই। জেনে রাখলে কাজে আসবে। কুরআন মাজীদে:
১। আদম (আঃ) এর নাম উচ্চারিত হয়েছে পঁচিশবার।
২। আট স্থানে মানুষকে আদমের সন্তান বলা হয়েছে।
৩। ইবলিস শব্দটি উল্লেখ রয়েছে এগারো বার।
৪। ৮৮ বার শয়তান শব্দের উল্লেখ হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ বার এক বচনে আর আঠারো বার বহুবচনে। আল্লাহদ্রোহী মানব নেতাদেরকেও কুরানে শয়তান বলা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বলা হয়েছে।
৫। নিম্নোক্ত সুরাগুলোতে হজরত আদম (আঃ) এর ইতিহাস আলোচনা করা হয়েছে: সুরা আল বাকারা, আল আরাফ, বনি ইসরাইল, আল কাহাফ, তোয়াহা, আল হিজর, সোয়াদ।
হজরত আদম (আঃ) এর জীবন কথা থেকে স্লোগান:
হজরত আদম (আঃ) এর জীবন কথা থেকে আমরা এই স্লোগান নিতে পারিঃ ‘‘আল্লাহর হুকুম মানতে হবে, শয়তানের পথ ছাড়তে হবে। জান্নাতে মোদের যেতে হবে, শয়তানের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।’’