বেশ কিছুক্ষণ কান্নার পর চা খেয়ে একটু শান্ত হয়ে, সামলে নিয়ে মুখ খুলেছে দেবলীনা। —
– ছোটবেলা থেকেই আমার খুব প্রিয় লেখক আর্যশেখর। ওঁর ছোটদের লেখার হাত ও তো দারুণ। কিন্তু বাবা, কেন জানি কখনোই ওঁকে একদম পছন্দ করতেন না, – বলতেন ওর কোন মৌলিক কিছু লেখার ক্ষমতা নেই, নিশ্চয়ই কোথা থেকে ঝেড়ে দিয়েছে – খোঁজ নিলেই জানা যাবে। আমি রেগে যেতাম বাবার ওপর কিন্তু বাবা কিছু আর বলতেন না। বেশ বড় হয়ে বাবার কাছে ঘটনাটা শুনি। আমার বাবা সৌম্য ও আর্য একই স্কুলে পড়তেন। আর আপনি যা বলেছেন সেটা ও ঠিক, দুজনেই ঐ টিচারের সাথে পত্রিকা সম্পাদনা করতেন ওঁরা। একবার স্কুলের ওই ম্যাগাজিনের জন্য বাবার লেখা দুটি ছোট গল্প পড়ে মাস্টারমশাই খুব মুগ্ধ হন – বাবাকে বলেন গল্প দুটি একটু মডিফাই করে আলো ভাল হবে, – কি করতে হবে তাও বলে দিলেন। সেই সময় বাবা পরীক্ষার পড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, কিন্তু তার মধ্যেও সেটা কমপ্লিট করে ফেললেন। কথা ছিল কলকাতায় একটি পত্রিকায় পাঠানোর। আর্য তখন একটা বিশেষ কাজে কলকাতায় যাচ্ছিলেন, তাই আর ডাকে না পাঠিয়ে আর্যর হাতে পাঠিয়ে দেয়া হয় জমা করার জন্য। এইখানে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করলেন আর্যশেখর, গল্প দুটিকে উলটে পালটে বেশ একত্রিত করে তৈরি করে ফেললেন একটি অণু –উপন্যাস। জমাও দিলেন – কিন্তু নিজের নামে। ফিরে এসেও ব্যাপারটা সবার কাছে গোপন করে গেলেন। ইতিমধ্যে পরীক্ষায় পাশ করে দুজনেই চলে গেলেন কলকাতায় দুই কলেজে পড়তে – আর্যর আর্টস আর সৌম্যর সায়েন্স। বেশ কিছুদিন পর, যথাসময়ে লেখাটি প্রকাশিত হল – সেই সাহিত্য পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাতে। বেশ সাড়া ও পড়ল – কলেজের ছেলেদের কাছে শুনে আর লেখাটি পড়ে প্রিয় বন্ধুর এই বিশ্বাসঘাতকতায় জ্বলে উঠলেন তিনি। কোন কৈফিয়ত ও চাইলেন না বন্ধুর কাছে, কোন সম্পর্কও আর রাখলেন না। সাহিত্যের সঙ্গে সব বন্ধন ছিন্ন করে বৈজ্ঞানিক হয়ে গেলেন। আর কোনদিন বাংলাতে বিশেষ কিছু লেখেননি, অনেক লেখা লিখেছেন, ইংরাজিতে এবং সবগুলি ই বিজ্ঞান সংক্রান্ত। বেশ কয়েকবার তাঁর কাছে অনুরোধ এসেছে – ছোট বড় পত্রিকার তরফ থেকে, সহজ বাংলাতে আধুনিক বিজ্ঞানের কিছু লেখার জন্য। সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এবারে মৃগাঙ্ক মুখ খুললেন। –
– বাবার ওপর এই বিশ্বাসঘাতকতার বদলা নিতেই তুমি কি ওঁর কাছে যাওয়া শুরু করলে –
– ঠিক তা নয়। একটা অদম্য কৌতূহল ছিল – একজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের এরকম একটা পাস্ট থাকতে পারে – সেই মানুষটাকে জানার ইচ্ছে
– গিয়ে কি দেখলে – একেবারে অন্যরকম না খুব হতাশ হলে
– একেবারেই অন্য রকম। সব নর্মাল হয়ে আসছিল। তারপর যখন নিজের জীবনের ভিত্তিতে ঐ উপন্যাসটির কথা শুনলাম, হঠাৎ করে খুব রাগ হল। মনে হল নিশ্চয়ই নিজের সাহিত্য শুরুর গল্প ফাঁদবেন, নিজের ছোট বেলার বড় বড় কথা লিখে আর কুকর্মটিকে চেপে-
এবার দেবলীনার গলায় আবার কান্নার সুর, গলা ভার ভার, বিষণ্ণতার আভাস –
– কিন্তু আমি হেরে গেলাম, বুঝলেন, মানে উনি আমাকে হারিয়ে দিলেন-
– একটু বুঝিয়ে বলবে- ঠিক ধরতে পারলাম না।
দেবলীনার চোখে জল – রুমাল বার করে চোখটা মুছে নিয়ে বলল –
– পড়তে গিয়ে দেখলাম, উনি অক্ষরে অক্ষরে স্বীকার করে নিয়েছেন নিজের ভুলকে। ক্ষমা ও চেয়ে নিয়েছেন তাঁর জীবনের প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী সেই বন্ধুটির কাছে। তারপর থেকেই ভুগতে লাগলাম অসম্ভব অপরাধবোধে – বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। বারেবারে শুধু আপনার কথাই মনে পড়ছিল। আপনার ফোনটা পেয়েই-
– লেখাটা কোথায়! আমাকে কখন দেবে?
– আমি সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছি। আমার মনে কি রকম একটা অস্থিরতা ছিল – তাই সকালে আপনার ফোনটা পেয়েই কিরকম বুঝতে পারলাম – ‘খেলা শেষ’-
কথা শেষ না করেই ব্যাগ থেকে বার করে দিল একটা মোটা কভার
– এবারে একটু বললেন, কিভাবে জানলেন
– আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট বন্ধুটি খুব সাহায্য করেছে। তুমি কিন্তু খুব বুদ্ধি খাটিয়েছিলে, – আর্যশেখরের বাড়ির পুরনো শারদীয়া পত্রিকা ভরে দিয়ে – ব্রিফকেস না খুললে বোঝা যাবেনা। এটা ও প্রায় নিশ্চিত ছিলে উনি থানা পুলিশ করবেন না – বাড়ী সার্চ তো দূরের কথা-
– সার্চ করলেও পাওয়া যেত না – শুক্রবারই তো আমি ব্যাগের মধ্যে নিয়ে আসি।
– ওই পত্রিকাটি এবং ব্রিফকেসটা আমি ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট কে দিয়ে পরীক্ষা করাই – কিছু পাইনি, সবেতেই হরিহর আর আর্যর ই ছাপ ছিল।
– আসলে ফিংগারপ্রিণ্টের কথাটা মাথায় ছিল, রুমাল ইউস করেছিলাম।
– তাই ভেবেছিলাম। মনে আছে, তোমাদের নিজের হাতে করে বাড়ীর এড্রেস আর ফোন লিখিয়েছিলাম। তাতে করে তোমাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে যখন কিছু হল না, শুরু করলাম মনের মধ্যে খুঁজতে।
– মনের মধ্যে খোঁজা, ঠিক বুঝলাম না-
– মানে এতক্ষণ যেটা বললাম। কি হতে পারে মোটিভ। চলে গেলাম ওঁর অতীতে। তন্ন তন্ন করে সার্চ করা হল কলেজ আর স্কুল জীবন। কিছু পাওয়া গেল না। হঠাৎ ওঁর পুরনো ইন্টারভিউ এর একটা রেফারেন্স পেলাম। সেখানে স্কুল জীবনের উল্লেখ আর বাংলার টিচার। ব্যাস, হিয়ার উই আর!!
– আসলে এই ঘটনাটা যখন ঘটে সেই এক মিনিট আমার কোন কন্ট্রোল ছিল না। হেমন্ত আর রজত বাইরের বারান্দায় গল্প করছিল। চোখের সামনে ব্রিফকেসটা এবং তাতে চাবি ঝুলছে দেখে আমি খুলতে যাই। খুলে দেখি – ম্যানাস্ক্রিপটা। এরপর আর সামলাতে পারিনি।
– একটাই ক্ল্যু ছিল, খুব ভালো করে পরীক্ষা করে দেখা গেছে ব্রিফকেস এর চাবির গোছা তে তোমার হাল্কা ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে।
– তাই !! ও, মনে পড়েছে । প্রথমে চাবিটাতে হাত দিয়ে ফেলেছিলাম – কিন্তু তারপর রুমাল দিয়ে সব কিছু করেছিলাম। রুমালটা দিয়ে চাবিটা ও মুছেছিলাম।
– যাকে বলে মুছেছিলে তবু মোছনাই, জানায়ে গেলে তাই। এটা তোমার প্রথম অপরাধ খুব গুরুতর ও হতে পারত। অনুতাপের কথা অবশ্য বিবেচ্য।
সামনে রাখা ফোনটা কে স্পীকার মোডে দিয়ে ডায়াল করল মৃগাঙ্ক-
– হ্যালো-
– আমি মৃগাঙ্ক বলছি। উদ্ধার হয়েছে –
– হয়েছে, কি করে – আর্যশেখরের গলার স্বস্তি ও উত্তেজনা একসঙ্গে স্পীকার ফোন পেরিয়েও দেবলীনার কানে পৌঁছচ্ছিল
– আপনি ই তো বলেছিলেন – শুধু উদ্ধার – নো পাবলিসিটি! তাই আমাকেও বলতে হচ্ছে – নো এক্সপ্ল্যানেশন, শুধু উদ্ধার।
– বিলক্ষণ! আই স্টিক টু দ্যাট!!
– আসলে যে কাজটা করেছে, সে নিজেই খুব অনুতপ্ত – ঝোঁকের মাথায় করে বসে-
– মৃগাঙ্ক, সে যে ফিরিয়ে দিয়েছে তাতেই সব মাফ। কখন দেখা হচ্ছে!
– সন্ধেবেলায়, চা এর সময়। দুপুরে ওটা পড়ে ফেলতে চাই -আপত্তি আছে !!
– ছি, ছি, কি যে বলো।
দেবলীনা কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালো-
– আর কে কে জানবে?
– আমার একটাই সমস্যা। মাধবীই আমাকে অতীতের আইডিয়া টা দেয়। ইন ফ্যাক্ট, স্কুলের টিচারের ব্যাপারটাও ওর দেখা সেই ইন্টারভিউ থেকে জানতে পারা-
– নিশ্চয়ই। কিন্তু আর অন্য কেউ-
– আমাকে আর্য বারে বারে বলেছেন – ‘নো পাবলিসিটি’! কাজেই আমি চাইলেও তোমাকে কোন শাস্তি দিতে পারবো না। তোমার বন্ধুরা জানবে এক অজানা ক্যুরিয়ারে এসে হাজির হয়েছে লেখাটা। কিন্তু দেবলীনা, এই ছোট অপরাধ আর তার থ্রিল কিন্তু সাংঘাতিক – এরাই ভবিষ্যতে বড় অপরাধের রাস্তা তৈরি করে।
মৃগাঙ্ক উঠে দাঁড়ালো, নাটকীয় ভঙ্গীতে ফুটবলের রেফারীর মত হাতটা উঠিয়ে বলল-
– ইয়ু আর শোন ‘দ্য ইয়েলো কার্ড’!
– আই একসেপ্ট, থ্রিল আমার হয়নি, অনুশোচনা হয়েছে – আই উইল নেভার সি এনাদার ইয়েলো কার্ড! – ইটস আ প্রমিস!!
ছাড়া পাওয়ার আনন্দে কান্না আর বাঁধ মানলো না। মৃগাঙ্ক উঠে গিয়ে সিডি প্লেয়ার টা আবার চালিয়ে দিল- বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু দেবব্রত র গলায় যেন ঘরের মধ্যে আবার বৃষ্টি নেমে এল –
বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান —
দুজনে চুপচাপ গান শুনতে শুনতে মাধবী লতার প্রতীক্ষা করতে লাগলো!