রবিবারের সকালে আরাম করে রবিবাসরীয় কাগজ পড়া মৃগাঙ্কর খুব শখের কাজ। সুযোগের অভাবে প্রায়শই সে শখ পূরণ হয় না। আজ সে বেশ আরাম করে আমেজটুকুকে উপভোগ করছিল। আকাশ পুরো কালো মেঘে ঢাকা, ঝির খির করে বৃষ্টি পড়ছে। হাল্কা করে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান চলছিল। মাধবীলতা বলল –
– এই, একটা কথা বলব, রাগ করবে না!
– বল, বল! তুমি তো আর ভীরু মাধবী নও – তোমার আবার দ্বিধা কেন?
– খুব মুড !! শোন, আমাকে না একবার একটু বেরোতে হবে – ঘণ্টা দু-একের জন্য।
– এই ওয়েদারে – খুব জরুরী দরকার নাকি!
– আমাদের ক্লাবের একটি সংবর্ধনা সভা আছে, সেই ব্যাপারে মীটিং। প্রেসিডেন্ট হঠাৎ করে সোমবার থেকে কদিন থাকবেন না, তাই আজই –। তোমার তো ভালই, তুমি গান শোন আর মনের আনন্দে কাগজ পড়ো না- জ্বালাবার কেউ নেই।
– আমারও কাজ আছে, একজন অতিথি আসছে – তুমি থাকলে একটু ভালো আপ্যায়ন হতো।
– ফ্লাস্কে চা রাখা আছে, রান্নাঘরেও প্রচুর স্ন্যাক্স। আর তাকে যদি আটকাতে পারো, তো একসঙ্গে লাঞ্চ করা যেতে পারে। বাই দ্য ওয়ে, কে তোমার সেই বিশেষ অতিথি –
– বিশেষ তো বটেই , – আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল মৃগাঙ্ক। হঠাৎ করে বেল বাজল – মাধবীলতা গিয়ে দরজা খুলল;-
– আরে তুমি, ও তুমি ই সেই বিশেষ অতিথি
– আসলে মৃগাঙ্কবাবু বলেছিলেন সকালে আসতে।
মৃগাঙ্ক এগিয়ে এলো – তুমি একটু বসো, লতা তুমি আর দেরী কোর না, বেরিয়ে পড়ো।
মাধবীলতা বেরোতে বেরোতে বলে গেলো – এই, ওকে ছাড়বে না কিন্তু, একসঙ্গে লাঞ্চ করব।
রেনকোটটা হ্যাঙারে টাঙ্গিয়ে দিল মৃগাঙ্ক। দরজা বন্ধ করে গানটা অফ করে দিল।
– আরে বেশ আরাম করে বস।
– হঠাৎ সক্কাল সক্কাল ফোন করে ডাকলেন, আর কেউ নেই – আমি একা –
– ইচ্ছে হল, আসলে মনটা খুব ভালো আছে –
– তার মানে কেস টা কি সলভ হয়ে গেছে?
– আমার তো সেরকম ই মনে হচ্ছে – সেটা কনফার্ম করার জন্যই তোমার একটু পরামর্শ চাই।
– বলুন না, কে করেছে কাণ্ডটা –
– আস্তে আস্তে বলছি। আচ্ছা তোমার কারুকে সন্দেহ হয়নি?
– দেখুন ঘটনাটা দেখে মনে হয় নিশ্চয় চেনাজানার মধ্যে – নাহলে এতটা সাহস!
– দ্যাটস দ্য রাইট পয়েন্ট। এখন সন্দেহের তীর যাদের দিকে তারা হল তোমরা পাঁচ বন্ধু আর আর্যশেখরের ভাইপো রজতাভ। কাজটা করতে গেলে যা যা দরকার তা হল, সুযোগ আর মোটিভ। সুযোগের কথায় পরে আসছি, কিন্তু কি মোটিভ থাকতে পারে – চুরি করে এই পান্ডুলিপি ছাপানোর চেষ্টা – উঁহু, আর্যর হাতের লেখা অনেক প্রকাশকের ই চেনা, ধরা পড়ে যাবে। চলবে না। আমি অনেক ভেবে চিনতে একটা জোরালো মোটিভ পেয়েছি!! সেটাই তোমার সঙ্গে ডিসকাস করতে চাই।
– পেয়েছেন!! কি, কি সেটা –
– একটা বা দুটো ও বলতে পারো। পাকে চক্রে লেখক মশাই কে বিপদে ফেলা –
– তার মানে কি ছাপতে না দেওয়া – মানে আটকে রেখে বিপদে ফেলা
– এবং পরে চাপ দিয়ে টাকা আদায় অর্থাৎ ব্ল্যাকমেল। আর্যর পক্ষে পুরনো খসড়া থেকে আবার লেখাটাকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসা অসম্ভব নয় কিন্তু কষ্টসাপেক্ষ ব্যাপার। তা ছাড়া প্রথমবারের স্বাদু লেখাটা দ্বিতীয়বারে নিরেস হয়ে যেতে পারে। সেই সুযোগে অপরাধীর পক্ষে ওঁর বা প্রকাশকের কাছে ধমকি দিয়ে বেশ কিছু টাকা আদায় করা কিন্তু শক্ত ব্যাপার নয়। প্রকাশক হয়তো সব কিছু প্ল্যান করে ফেলেছে, এখন সব কিছু বানচাল হলে মুশকিল। আর ধর ডিম্যান্ড যদি রিজনেবল হয়, প্রকাশকের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব নয়।
– দারুণ ধরেছেন তো! কিন্তু এরকম টাকার দরকার হতে পারে বলে মনে হয়?
– দ্যাখ, আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি তোমাদের বন্ধু-বান্ধবদের সকলেরই অবস্থা বেশ ভাল। কারোরই সেরকম কোন বদসঙ্গ বা নেশা নেই, আই মীন এরকম ডেসপারেট হতে গেলে যেরকম দরকার। একমাত্র রজতাভ র কেসটা –
– কি বলছেন কি! ওর নিজের জেঠু, ভীষণ শ্রদ্ধা করে, এমনকি বাবার চেয়েও বেশী।
– সেটা আমি জেনেছি। তবে কি জান, ওর বাড়ীর অবস্থা অতটা ভালো নয়। ওর বাবা মা, কিন্তু রজতের মত আর্যর ওপর অতটা শ্রদ্ধাশীল নয়। ওঁদের ধারণা, আর্যর যা ক্ষমতা সেই তুলনায় তাঁরা কোনদিনই আর্যর কাছে হেল্প পাননি। বাবা-মা র এই ধারণা কিন্তু ছেলে মেয়ে দের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া ধর যদি কোন ফ্যামিলি সিক্রেটের ব্যাপার থাকে যা বাইরের লোক বড় একটা জানে না – হাজার হোক অলমোস্ট আত্মজীবনী ই তো!
– তার মানে সত্যি রজতাভই। আশ্চর্য, একবার ও মনে হয়নি যে ও এরকম কাজ করতে পারে। জানেন, গতবার যখন উনি অসুস্থ হয়েছিলেন, কিরকম সেবা করেছিল।
– আরে আরে এখুনি কনক্লুড কোরো না। আমি একটা সম্ভাবনার কথা বলছিলাম মাত্র – যাকে বলে হাইপথিসিস। এটাকে ফার্ম আপ করতে গেলে অনেক তথ্য প্রমাণের এবং বিশ্লেষণের দরকার। আচ্ছা, তোমার কি মনে হয়, আপাত ভাবে যে রজতকে আমরা চিনি সেটা তার মুখোশ, আসলে সে সুযোগ খুঁজছিল প্রতিশোধ নেওয়ার – তার বাবা মা কে অবহেলার – এমনকি অসুখের সময় সেবা ও ভান, কাছে আসার আর বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা!-
– সেটার সম্ভাবনা – ভীষণ কনফিউসড লাগছে।
– আমার ও! কারণ অন্য একটা জায়গাতে আবার গোলমাল –
– সেটা কি – অন্য কোন এঙ্গেল
– দ্যাটস রাইট। তোমরা পাঁচ বন্ধু আর রজতাভ – এরা সকলেই পাণ্ডুলিপির কথা জানতে। উঁহু, মাথা নেড় না, আমি এই ব্যাপারে কনফার্মড। পাক্কা খবর-
– আসলে উনি একবার রজতের সঙ্গে কথায় কথায় বলে ফেলেছিলেন, তারপর রজত সেটা –
– অর্থাৎ তোমরাও জানতে। জেনেও সবাই না জানার ভান করলে !! কিন্তু দ্যাখ, এই পয়েন্টটা কি আবার রজতের বিপক্ষে চলে গেলনা – তার যদি কুমতলব ই থাকে তাহলে সে সকলকে বলবে কেন। তাহলে কি রজত করেনি বা আসল মোটিভ টাকা নয়? অন্য কিছু মোটিভ থাকতে পারে –
– হয়তো রজত সন্দেহটা অন্য কারো দিকে ঘোরাতে চায় – ডিটেকটিভ গল্পে তো এরকম কতই দেখা যায়-
– ব্রিলিয়ান্ট!! কিন্তু তর্কের খাতিরে অন্য কোন মোটিভ ভাবা যেতে পারে কি
– অন্য মোটিভ , শত্রুতা করে ওনাকে বিপদে ফেলবে এরকম –
– খুব স্ট্রং মোটিভ কিন্তু। হয়তো একটু ইমম্যাচিওর – কিন্তু যাদের সুযোগ ছিল তাদের অর্থাৎ তোমাদের সকলের পক্ষেই ঝোঁকের মাথায় এই রকম একটা ইমম্যাচিওর কাজ করে বসা অসম্ভব নয়।
– কিন্তু কার সঙ্গে শত্রুতা থাকতে পারে – রজত কে ও তো বাতিল করে দিলেন –
– কারুকে বাতিল করিনি, আমরা শুধু বিভিন্ন সম্ভাবনাগুলিকে খতিয়ে দেখেছি। বর্তমান নয়, আমরা একটু অতীতে ফিরে যাই। আর্যশেখর স্কুলে থাকতেই লেখা শুরু করেছিলেন। উনি এবং ওনার এক ক্লাসমেট দুজনে ছিলেন একটি স্কুল ম্যাগাজিনের যুগ্ম সম্পাদক। বন্ধুটিও ভালোই লিখতেন, এমনকি ওঁদের বাংলা টিচারের মতে সেই সময় আর্যর চেয়ে তাঁর লেখার ধার এবং বুদ্ধিমত্তার ছাপ ছিল বেশী। কাল ঘটনাচক্রে ওনার গ্রামের সেই টিচারের কাছ থেকে ওঁদের একটা পুরনো ম্যাগাজিন যোগাড় করে এনেছি। তাতে দুজনেরই লেখা আছে। আরো মজার ব্যাপার কি জান, একটা ছবিও আছে – আর্যর, সেই টিচারের আর ও সেই বন্ধুর।
উঠে গিয়ে পত্রিকাটা নিয়ে এসে সেই ছবির পাতাটা খুলে দিল মৃগাঙ্ক। ছবিটা দেখিয়ে বলল –
– চিনতে পারছো –
একটু ইতস্তত করে উত্তর এল –
– এই তো আর্যর ছবি – যদিও একটু অস্পষ্ট, তবু বোঝা যাচ্ছে। এই বয়স্ক ভদ্রলোক কি টিচার-
– হ্যাঁ, আর ঐ বন্ধুর ছবিটা – খুব ভালো করে চেয়ে দ্যাখো – চেনা লাগছে কি!
– মা—নে – আমি কি করে ওনাকে চিনব –!!
– চেন কি চেন না – নো এমবিগুইটি – আনসার ইয়েস অর নো!!
মৃগাঙ্কর গলায় এখন পুলিশী কাঠিন্য। একরাশ ভেঙে পড়া কান্নার মধ্যে থেকে উত্তর এল –
– ইয়েস!!
স্বীকারোক্তি মৃগাঙ্কর গলাটা নরম করে দিল-
– পরের গল্পটা তোমার কাছে ই শুনব দেবলীনা। আমি চা আর স্ন্যাক্স নিয়ে আসছি। গেট রেডি!!