প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী– প্রথম অংশ

বাইশে শ্রাবণ, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন। আর বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক আর্যশেখর রায়চৌধুরীর আবার সেদিন ই জন্মদিন । শুধু তাই নয়, সেই ভরা শ্রাবণের দিনে সমস্ত কলকাতা যখন রবীন্দ্রনাথকে বিদায় জানাচ্ছিল, তখনই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক অখ্যাত গ্রামে তাঁর জন্ম। এমন দিন বলে তাঁর মা বাবা আর ইংরাজি জন্মদিন না করে বাংলা তারিখটিকেই ছোটবেলা থেকে পালন করে এসেছেন। তিনি নিজে অবশ্য এসব পালনের একদমই পরিপন্থী, স্ত্রী অতসী যতদিন ছিলেন তিনি অবশ্য তাঁর শাশুড়ী মার কাছ থেকে শেখা এই দিনটিকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। তখন আবার ঘটা করে বেশ কিছু বন্ধু-বান্ধবদের ও ডাকা হত। অতসীর মৃত্যুর পর বন্ধই হয়ে গিয়েছিল একরকম। বছর তিনেক আগে আবার তাঁর গুটিকয় তরুণ অনুরাগী ও অনুরাগিণী ভক্তের কল্যাণে আবার শুরু হয়েছে ব্যাপারটা। তারাই এসে হৈ চৈ করে, খাবার দাবার আনিয়ে, গান টান করে বেশ মাতিয়ে রাখে। আর্যশেখর ও ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করতে শুরু করেছেন। সাধারনতঃ পরের রবিবারেই সকাল ও দুপুর মিলিয়ে বেশ একটা চিত্তাকর্ষক ব্যাপার হয়।
মোটামুটি পাঁচজনের একটি দল – সরিৎ, হেমন্ত, দেবলীনা, কিংশুক ও সরমা। আর্যশেখরের ভাইপো রজতাভ ও এসে হাজির হয়ে যায়। আরেকজন ও বিশেষ ভক্ত আছে – সি আই ডি ইন্সপেক্টর মৃগাঙ্ক বন্দ্যোপাধ্যায়। মৃগাঙ্ক ছিল ইংরেজি সাহিত্যের একনিষ্ঠ ছাত্র, পুলিশের কাজে জড়িয়েও তার সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা যায়নি, বরং বেড়েছে। ঠাট্টা করে বলে – ‘পরস্ত্রী সবসময়ে নিজের বঊএর চেয়ে বেশী সুন্দরী। মৃগাঙ্কর আরো একটি অসাধারণ গুণ – মুখে মুখে তার কাজের গল্প বলতে পারা। জন্মদিনের খাওয়া দাওয়ার পর গড়াতে গড়াতে মৃগাঙ্কর কেস হিস্ট্রি শোনার আকর্ষণ ও কিছু কম নয়। অবশ্য এবারে অন্য আরো একটি বিশেষ ব্যাপার ও আছে।
আর্যশেখর তাঁর প্রকাশককে ও ডেকেছেন। আজ তাঁর হাতে তুলে দেবেন একটি পাণ্ডুলিপি যেটা তাঁর মতে হবে তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। আত্মজীবনী লেখার সৎসাহস তাঁর নেই, এটা ভালো করেই জানেন তিনি। কজনেরই বা আছে এদেশে! বিদেশের সাহিত্যিক রা অকপটে তাঁদের জীবনের ভুল ভ্রান্তি তুলে ধরতে পারেন, এদেশে সে চল নেই। এছাড়া অন্য অনেক মানুষের জীবনও জড়িয়ে রয়েছে তাঁর জীবনের সঙ্গে। সবকথা প্রকাশ করলে নানা বিতর্কের সম্মুখীন হতে হবে। আর্যশেখরের পদ্ধতিটা একটু অন্য – নিজের জীবনের ওপর ভিত্তি করে উপন্যাস। তিনি অবশ্য আদপেই স্বীকার করবেন না, কিন্তু বাজারে এরকম একটি হালকা গুজব চালু করে খুব শক্ত নয়। যাদের বোঝার ঠিক বুঝবে কিন্তু বিতর্ক এড়ানো যাবে।
পাচক হরিহর তাঁর বহুদিনের সঙ্গী, বলা চলে তাঁর একমাত্র সহচর। বাড়ির সবকিছু সেই দেখা শোনা করে। এক কথায় বলতে গেলে সে এই বাড়ির –হর্তা, কর্তা, বিধাতা। একটু আগে সে মনে করিয়ে দিচ্ছিল –
– আপনার লোকজন কখন আসবে? একটু জলখাবারের বন্দোবস্ত করতে হবে তো
– আরে ব্যস্ত হচ্ছ কেন! সপ্তর্ষি তে তো বলে রাখা আছে-
– তা তো বলে রেখেছি, কিন্তু সব ছেলে ছোকরাদের টাইমের ব্যাপার – ঠিক মত না বললে গরম খাবার পাওয়া যাবেনা ।
– চিন্তা কর না, সরিৎ আর সরমা তো প্রথমেই আসে – ঠিক ব্যবস্থা করবে। ওরা এলেই –

কথার মাঝখানেই কলিং বেল বেজে উঠল। আর্য বলে উঠলেন-
– ঐ এল বোধহয়!
হরিহর দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল তারা দুজন। এই সময়টুকুর জন্য কি যে প্রতীক্ষা করে থাকা!বুকের মধ্যে কিরকম যেন একটা আলোড়ন হয় এত বয়সেও। এসেই দুদ্দাড় করে যোগাড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেল। বসার ঘরে ঠিকঠাক কেক কাটার বন্দোবস্ত, সকলে বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য ঢালা বিছানার সুব্যবস্থা, একটু গান আর আবৃত্তির জন্য মিউজিক সিস্টেমের ব্যবস্থা – সব পাক্কা!
নটা নাগাদ এসে গেল বাকি কজন, মৃগাঙ্ক আসতে আসতে প্রায় সাড়ে নটা। প্রকাশক ভদ্রলোক আসার পরই শুরু হয়ে গেল কেক আর চা পর্ব।
এসব শেষ হওয়ার পর একটু গলা ঝাড়া দিলেন আর্যশেখর।
– তোমাদের সকলকে একটা ছোট্ট খবর দেওয়ার আছে। অমিতাভবাবু অর্থাৎ নালন্দা প্রকাশনীর অমিতাভ দত্তকে দেখে তোমাদের একটু অবাক হতে দেখেছি। আসলে এবারে আজকের দিনে ওনাকে ডাকার একটা কারণ আছে – সেটা ওনার হাতে আমার একটা বিশেষ লেখা তুলে দেওয়ার জন্য। সাধারণতঃ তোমরা তো জান আমার সব লেখাই বই হিসেবে প্রকাশ পাওয়ার আগে কোন না কোন পত্রিকাতে ধারাবাহিক বা এমনি প্রকাশ হয়ে থাকে। এইবারের লেখাটি কিন্তু তা নয়।
অমিতাভ বাবু এবার যোগ করলেন –
– আসলে স্যারকে অনেকদিন ধরে বলছিলাম, একটা এক্সক্লুসিভ কিছু লেখা দেওয়ার জন্য, এতদিনে উনি সাড়া দিলেন। এই উপন্যাসে ওনার নিজের জীবনের অনেকটা ছায়া আছে-
আর্য বাধা দিলেন-
– আরে তা নয়, উপন্যাসের চরিত্রে অনেক সময় জীবনের আদল থাকতেই পারে, তা বলে এটা কখনোই আমার আত্মজীবনী নয়।
কিংশুক বলে উঠল –
– স্যার, আমাদের একবার দেখাবেন না – আমি স্বচক্ষে কোনদিন বিখ্যাত লেখকের পাণ্ডুলিপি দেখিনি!
আর্যর মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল –
– ঠিক আছে, তোমাদের যদি খুব ইচ্ছে করে – কিন্তু বেশীক্ষণ নয়। উলটে পালটে দেখে এক্ষুণি ফেরত দিতে হবে।
সবাই হৈ হৈ করে উঠল। সকলের প্রায় প্রতিনিধিত্ব করে সরমা বলে উঠল,
– নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, একবার হাত দিয়ে একটু টাচ করে দেখতে চাই পাণ্ডুলিপি, এই রকম একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকা –
আর্য এবার হরিহরকে ডাকলেন –
– যাও তো ওপরের ঘর থেকে নিয়ে এস তো আমার ব্রিফকেস টা!!
সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল হরিহর। হাতে ব্রিফকেস। সেটা খুললেন আর্য, ওপরের ডালাটা খুলতেই শরীর কেঁপে উঠল –
– একি!!
ছুটে এসে তাঁকে ধরলেন মৃগাঙ্ক, চেয়ারে বসিয়ে ব্রিফকেস টার দিকে তাকিয়ে দেখলেন – পান্ডুলিপি নয়, তাঁদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে একটি দশ বারো বছরের পুরনো শারদীয়া পত্রিকা।

গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!