সাবার্বান ট্রেনে চড়ার অভ্যাস একেবারেই নেই। কিন্তু ক্যানিং পেরিয়ে যে গ্রামে আর্যশেখরের আদিবাড়ী সেখানে যেতে গেলে ট্রেনই সুবিধে। উলটো দিকে বলে ট্রেন ফাঁকা ও রয়েছে। ট্রেনে বসে জানলার বাইরে মেঘলা আকাশ দেখতে দেখতে অনেক কিছু চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। সুচেতনাকে ফোন করে সাহায্য করতে বলেছিল। ইন্টরভিউ এর টেপটা দেখা সম্ভব হয়েছে।
ঐ সাক্ষাৎকারটিতে তিনি তাঁর সাহিত্য জীবনের একেবারে গোড়ার দিকের কিছু কথা বলেছিলেন। কৈশোরে তাঁর গ্রামের এক মাস্টারমশাই তাঁর সাহিত্যজীবনের সূচনা করেন। বলতে গেলে তখনই এই সাহিত্য প্রেমের বীজটি উপ্ত হয়। গ্রামের নামটি জানার পর মৃগাঙ্কর কিছু আর অসুবিধে হয়নি। হালকা পুলিশী তদন্তে স্কুলের ঠিকানা আর মাষ্টার মশাইয়ের বাড়ীর ঠিকানা ও পাওয়া গেছে। মৃগাঙ্কর সাহিত্য আর সাহিত্যিক প্রীতি মোটামুটি সুবিদিত। কাজেই আশা করা যেতে পারে কেউ কোনরকম সন্দেহ করবে না। এখন দেখা যাক, মাষ্টার মশাই কোনরকম সাহায্য করতে পারেন কিনা। কথায় বলে – যেখানে পাইবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই । ষ্টেশনে নেমে, বাস বদল করে আর তারপর রিক্সা করে স্কুলের কাছে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে দশটা। একটু খোঁজাখুঁজি করতেই পাওয়া গেল রথীন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর বাড়ী।
লাস্ট ডিসেম্বরে একটা স্ট্রোক হওয়ার পর বাড়ীতে বন্দী থাকতে হচ্ছে ভদ্রলোককে। মৃগাঙ্কর পুলিশী পরিচয় গোপন আছে, তিনি আর্যশেখরের একজন ভক্ত। কাছাকাছি অফিসের কাজে এসেছিলেন, টিভি ইন্টারভিউ তে রথীনবাবুর কথা জানতে পেরে দেখা করতে এসেছেন। আলাপ করে খুব খুশী হলেন ভদ্রলোক-
– আর্য আমাকে এখন ও মনে রেখেছে! বুঝলেন ঐ ইন্টারভিউ টা আমিও দেখেছি। আসলে গত বেশ কমাস ধরে ছেলে পড়ানো, আড্ডা, তাস সবই বন্ধ। – টিভি টাই একমাত্র সঙ্গী। বুঝলে না ভাই, তখনকার দিনে ছেলেদের ধরনধারণ ই অন্য রকম ছিল।
– উনি তো বলেন ওঁর সাহিত্য জীবনের গোড়াপত্তন আপনার অনুপ্রেরণাতে সম্ভব হয়েছিল।
– আরে না না, প্রতিভা ওর ছিল ই। সেটাকে ই একটু উসকে দেওয়া আর কি! জানেন, ওরা দুই বন্ধু ছিল, দুজনেই ভাল লিখত। আমার ও বয়সটা অন্যান্য শিক্ষকদের তুলনায় কম ছিল। প্রায় আমাদের তিনজনের প্রচেষ্টাতেই একটা দেওয়াল পত্রিকা ও বার করেছিলাম আমরা। মুশকিল হল, সেই ছেলেটির নাম ও আমি ভুলে গেছি। স্কুলে তো আমরা ওদের দুজনকে আর্য আর অনার্য বলে ডাকতাম। ওদের সংস্পর্শে এসে আমার ও কিছু নতুন সাহিত্য ভাবনা আসতে শুরু করল।
– সে তো বটেই, ভালো ছাত্রদের পড়ানোর একটা আলাদা আনন্দ আছে।
– আরো কি বলুন তো, এখানে ভালো ছাত্রও তো কম, তার ওপর একসঙ্গে দুজন-। মজার কথা কি জানেন, সেদিন হঠাৎ আমার নাতি একটা বহু পুরনো স্কুল ম্যাগাজিন বার করল অপরের ঘর থেকে। পুরনো সব লেখা, দেখি আর্যর ও লেখা আছে তাতে। টেবিলের তলায় রয়েছে ম্যাগাজিনটা –
হাতে নিয়ে ম্যাগাজিনটা উলটে পালটে দেখছিল মৃগাঙ্ক। পিছনের দিকে কটি ছবিও ছাপা আছে। হঠাৎ চোখ পড়ল ছবিতে। – আরে আর্যর ছবি না !
– দেখুন তো ছবিটা, আপনিও রয়েছেন মনে হচ্ছে
ভারী চশমাটা এডজাস্ট করলেন রথীনবাবু –
– এক্কেবারে, ঠিক! পুরনো ছবি তো আর আমাদের গ্রামের ফটোগ্রাফারের তোলা, কিন্তু তাও বেশ বোঝা যাচ্ছে। আরে, আরে এই তো সেই অনার্য দেখ তো ভাই, নাম টা নীচে লেখা আছে কিনা-
ম্যাগাজিনটা থেকে নামটা পড়ে শোনাল মৃগাঙ্ক রথীনবাবুকে –
– ঠিক ঠিক!
– আচ্ছা, এই ম্যাগাজিনটা আমি একটু রাখতে পারি!
– নিশ্চয়ই, তবে ফেরৎ পাঠালে খুব খুশী হব।
কথা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল মৃগাঙ্ক। ফেরার সময় ট্রেনে জানলার ধারে বসে ম্যাগাজিনটা পড়ে শেষ করে ফেলল। মোবাইলে একটা ফোন করল হৃষীকে-
– তোকে আর একটা কথা বলার ছিল!
– বলে ফেল।
ফোনে কয়েকটা জরুরী নির্দেশ দিতে দিতে শিয়ালদহ স্টেশন এসে গেল।