নিজের আবিষ্কৃত মাইন্ড রিডার যন্ত্রটি , গিনিকে তার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উপলব্ধি করিয়েছে। ছোট বেলায় মা হারানো মেয়েটা , এক অচেনা নারীর মধ্যে মায়ের মমতার সন্ধান পাওয়ায় , তার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব , এক অসম্ভব পরিতৃপ্তিতে ভরে উঠেছে , সেই স্বর্গী য় অনুভূতি ই তাকে এক নতুন ফর্মুলা তৈরীর অনুপ্রেরণা দিয়েছে । গিনির ব্যস্ত আঙ্গুল সেই ফর্মুলায় তৈরী নতুন যন্ত্রের শেষ স্ক্রু টা আটকে দিল । যন্ত্রটির বিশেষত্ব হল , হারানো জিনিস ফিরিয়ে দেওয়ার অলৌকিক ক্ষমতা, তবে সেই ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত , জন প্রতি যেকোনো একটি জিনিসই এটি ফিরিয়ে দিতে পারবে। এখন নতুন যন্ত্রটি প্রত্যাশা মত কাজ করবে কিনা আর যদি করেও তাতে কতটা সময় নেবে, তা পরীক্ষা সাপেক্ষ ।
মাইন্ড রিডার যন্ত্রটিকে হাতে নিয়ে বিছানায় তার প্রিয় কুকুর লজেন্সের পাশে শুয়ে পড়ল গিনি। লজেন্স তখন গিনির নতুন কিনে দেওয়া প্লাস্টিকের হাড় টা আপন মনে কামড়াতে ব্যস্ত , গিনি তার গায়ে হাত রেখে আদর করে বলল , “লজেন্স! তোর ভীষণ প্রিয় কোনো কিছু কি হারিয়ে গেছে ?” মাইন্ড রিডার যন্ত্র টা থেকে উত্তর ভেসে এলো , “গেছেই তো , তোর কিনে দেওয়া লাল বল টা । তুই যখন বাড়ি থাকতিস না , আমি তো ওটাকেই গিনি ভেবে জড়িয়ে শুয়ে থাকতাম । হতচ্ছাড়া লালুর বড় লোভ ছিল ওটার ওপর, আমার তো ওকেই বল লোপাটের পিছনে সবচেয়ে বেশী সন্দেহ হয় ।” গিনি দ্রুত বিছানা থেকে উঠে গিয়ে টেবিলে রাখা নতুন যন্ত্রের ‘ON’ বোতাম টা টিপে দিয়ে বলল, “লজেন্সের লাল বল ফিরিয়ে দাও প্রত্যাবর্তন ।” প্রত্যাশা মতই যন্ত্রটি সাথে সাথে লজেন্সের সারা শরীর ক্ষনিকের বৈদ্যুতিক আলো দিয়ে স্ক্যান করে নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল । এরপর শুধু ইচ্ছাপূরণের অপেক্ষা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করার নেই ।
পরদিন সকালে গিনি ঘুম থেকে উঠে দেখলো , লজেন্স তার সেই খেলনা হাড় টা নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে , ঘরের চারিদিকে তাকিয়েও লজেন্সের হারিয়ে যাওয়া বলের ফিরে আসার কোনো চিহ্ন গিনি দেখতে পেল না।
“না ! না ! এত তাড়াতাড়ি হার মানলে চলবে না” , নিজের মনেই বলে উঠলো সে । চটপট মুখ ধুয়ে ব্রেকফাস্টের টেবিলে গিয়ে বলল , ” মা ! তোমার কি কিছু হারিয়ে গেছে ?”
টেবিলে খাবার সাজাতে ব্যস্ত ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বলল , ” কই না তো ! কেন বলতো ? “
গিনি : “ভেবে বলো , এমন কিছু , যা তুমি ফেরৎ চাও , যা না পেলে তোমার জীবন অসম্পূর্ণ ।”
মা : “না আমার কিছু হারায়নি , স্বামী সন্তান নিয়ে সুখী পরিবার আমার , ওত চাই চাই করলে ভগবান রাগ করবেন যে! তা তুই বা হঠাৎ একথা জিজ্ঞাসা করছিস কেন ! লজেন্স নিশ্চই আবার কিছু মুখে করে নিয়ে গিয়ে তোর ঘরে রেখেছে !”
গিনি : “আরে না না ! সে তোমায় পরে সব খুলে বলব ক্ষণ ,এখন আমায় একটু প্রতিমা মিসের বাড়ি যেতে হবে ।”
মা : “সে যা কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস । “
নতুন যন্ত্রটা হাতে নিয়ে প্রতিমা মিসের বাড়ির উদ্দ্যেশে বেরিয়ে গেল গিনি। প্রতিমা মিস গিনির সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষিকা, উনি না থাকলে, বিজ্ঞান কে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে , গিনির বোধহয় আর শেখা হত না। মিসের বাড়িতে কয়েকবার তার ছেলেকে গিনি দেখেছে । কাজের সুত্রে আমেরিকা নিবাসী ছেলের অনেক অনুরোধ সত্তেও মিস এই বাড়ি ছেড়ে বিদেশ যেতে রাজী না হওয়ায় ,শেষমেষ মায়ের জেদের কাছে হার মেনে খুব শিগগিরি পরিবার নিয়ে তার স্থায়ী ভাবে দেশে ফেরার কথা । স্কুলের বন্ধুদের মুখে গিনি শুনেছে , প্রতিমা মিসের একটি মেয়েও ছিল । ২৫ বছর আগে সেই ষোড়শী মেয়েটি ,হঠাৎ সকালে নিজের পছন্দের ভালবাসার হাত ধরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার আগে নিজের বাবা মায়ের জন্য রেখে গিয়েছিল ,একটি চিঠি আর বাকি জীবনে সীমাহীন কষ্টের কঠিন অভিশাপ। এতদিন এত কথার মধ্যেও মিসকে কখনো কাউকে সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়ের কথা বলতে গিনি শোনেনি ,তার মত মায়ের দুঃখ সইবার ক্ষমতা অতি বড় বিধাতার ভাগ্যলিখন কে যে অবলীলায় বিদ্রুপ করতে পারে , সেই নির্মম সত্যি ব্যক্ত করে মিসের মুখে নিরন্তর হাসি। তবুও সেই হাসির আড়ালে লোকানো ,বছর পুরনো কষ্ট , গিনির সংবেদনশীল মনের কাছে বার বার ধরা পড়েছে। মিসের অনুপস্থিতিতে সে মেয়ে যদি কোনদিন বাড়ি এসে বন্ধ তালা দেখে আবার ফিরে যায় , সেই ভয় ই যে মিসকে এ বাড়ি ছেড়ে কখনো কোথাও যেতে দেয়নি , তা আরো অনেকের মত গিনিও জানে । গিনির যন্ত্রটার অলৌকিক শক্তি কি পারবে সেই অভিশাপের যন্ত্রণার বদলে বৃদ্ধা মায়ের মুখে এক চিলতে হাসি ফিরিয়ে দিতে? “নিশ্চই পারবে”, ভিতর থেকে জবাব পেল সে ।
দরজার কলিং বেল টা বাজতে প্রতিমা মিস দরজা খুলে দিলেন , এত বয়সেও উনি কারোর উপর নির্ভর করতে পছন্দ করেন না , বিদেশ থেকে ছেলের পাঠানো এই অত্যাধুনিক স্বয়ং ক্রিয় হুইলচেয়ার টি ,তার মায়ের স্বনির্ভর থাকার ইচ্ছাপূরণে অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী।
প্রতিমা মিস হেসে বললেন , “ভেতরে আয় ! কেমন আছিস গিনি ? এতদিন বাদে বুঝি মিসকে মনে পড়ল !”
গিনি ভিতরে ঢুকে বলল : “কদিন আগেই তো এসেছিলাম , আমার ভুলোমনের রোগ টা আপনার থেকেই পাওয়া ।”
প্রতিমা মিস : “তোর আর আমার বয়স বুঝি এক ?”
গিনি :”এখন এক না হলেও , খুব তাড়াতাড়ি আমি আপনার বয়সে পৌঁছে যাবো ,আমার বয়স তো আর আপনার মত এক জায়গায় থেমে নেই !”
প্রতিমা মিস হেসে বললেন : “সেই ! আমার বয়স বাড়ছে না ! চোখ কানের শক্তি এমনি এমনি কমে আসছে , আমার বৈজ্ঞানিকের বুদ্ধির উপর ভালবাসার মরচে পড়েছে । “
গিনি একটু চুপ করে থেকে বলল : আচ্ছা মিস ! হঠাৎ যদি আপনার নিজের মেয়ে ফিরে আসে আপনি কি আমাকে ভুলে যাবেন ?
কথাটা শুনে প্রতিমা মিসের মুখে এক মুহুর্তের জন্য বিষাদের অন্ধকার ছায়া পড়ল, পরক্ষণেই চেনা হাসি ফিরিয়ে এনে বললেন , “তোর কথা আমাকে শ্মশানের আগুনও ভুলিয়ে দিতে পারবে না গিনি ,তুই একটু বস দেখিনি ,আমি তোর প্রিয় গুজিয়া নিয়ে আসি ।”
হুইল চেয়ার টা পিছনে ঘুরতেই গিনি নতুন যন্ত্রটা ব্যাগ থেকে বার করে বলল ,”প্রতিমা মিসের মেয়ে ওনাকে ফিরিয়ে দাও প্রত্যাবর্তন !” যন্ত্রের ভিতর থেকে একটা হালকা আলো বেরিয়ে দরজার কাছে চলে যাওয়া মিসের শরীর ছুয়ে আবার ফিরে এলো ।
গুজিয়া খেতে খেতে অনেক ক্ষণ গল্প করার পর , প্রতিমা মিসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু পথ যেতেই , গিনির সাথে তার বাবার ছোটবেলার বন্ধুর মেয়ে অনামিকা দিদির দেখা হয়ে গেল ,মেয়েটি তাকে জড়িয়ে ধরে বলল ,”কতদিন বাদে তোকে দেখলাম গিনি ! বাবার দিল্লী ট্রান্সফারের পর আমার আর কলকাতা আসাই হয়নি ,কলেজের পর ওখানেই চাকরি ,এবার ছুটি নিয়ে মায়ের সাথে মামাবাড়ি এসেছি,দেখা যখন হয়েই গেল , চল না কোথাও বসে গল্প করি।”
বয়সে ১০ বছরের বড় এই মেয়েটি ছোট থেকেই গিনির খুব প্রিয়,বছর চারেক তাদের দেখা না হলেও চেনা আন্তরিকতার স্পর্শে গিনির মন ভীষণ খুশীতে ভরে উঠলো । সামনের সি. সি.ডি তে কফি খেতে খেতে গিনি বলল ,”বাবা বলছিল তোমার আর জয়ন্ত দার নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
অনামিকা দিদি অল্প হেসে বলল ,” কাকু ঠিকই শুনেছিলেন রে , আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আবার ক্যানসেল হয়ে গেছে । “
গিনি : সেকি ! কেন ?
অনামিকা : জয়ন্তের সাথে আমার অনেকদিন ধরেই সমস্যা চলছিল রে , দুদিকের পরিবারের চাপে দুজনে বিয়েতে রাজী হয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু দিন দিন সমস্যা আরো জটিল হয়ে আসছিল , ওর মত নির্বিকার স্বভাবের ছেলের কাছে আত্মসম্মান জলান্জ্বলি দিয়ে ভালবাসার দাবিতে বার বার হাত পাতা আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না তাই এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যা মুহুর্তে আমার জীবনের সব কিছু বদলে দিয়েছে গিনি ! সবটা হয়তো জয়ন্তের দোষ ছিল না , আমিও শেষের দিকে খুব অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম । এখন সবসময় মনে হয় জানিস ,১২ বছরের পুরনো সম্পর্ক কে এভাবে শেষ করে দেওয়ার আগে আরো একটু সময় নেওয়া উচিত ছিল , সবকিছু হয়তো ততটা খারাপ ছিল না যতটা তখন মনে হয়েছিল ,আরো খানিকটা চেষ্টা করলে হয়তো এরকম টা হত না । যাক ওসব আর ভেবে লাভ নেই ..
অনামিকা দির চোখের কোণে জল লক্ষ্য করে গিনি বলল : জয়ন্ত দা যদি তোমার জীবনে ফিরে আসে তাহলে …
অনামিকা : জয়ন্তের সাথে আমার অনেকদিন যোগাযোগ নেই রে , যা চলে যায় ,তা যে আর ফিরে আসে না গিনি , সময়ও না , তার সাথে হারিয়ে যাওয়া মানুষজনও না । এখন উঠি রে , খুব ভালো লাগলো তোর সাথে দেখা হয়ে , এখনো ১৫ দিন আছি এখানে , যাওয়ার আগে আরেকবার দেখা করব তোর সাথে ।
গিনি অল্প হেসে বলল , “আচ্ছা !”
অনামিকা দিদি দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে গিনি যেই বলল , “অনামিকা দিদির জীবনে জয়ন্ত দা কে ফিরিয়ে দাও প্রত্যাবর্তন”, হাতের যন্ত্রটা স্বভাব মত অনামিকা নামের মেয়েটির গায়ে নিজের আলো ছুইয়ে ফিরে এলো ।
বাড়িতে ফিরে স্নান সেরে , দুপুরের খাবার খেয়ে , মা আর লজেম্সের সাথে একটু ঘুমিয়ে নিল গিনি । সন্ধ্যে বেলা পড়াশোনার চেষ্টা করলেও বইতে তার মন বসলো না । দেখতে দেখতে রাত হয়ে এলো , গিনির মনে হল ফর্মুলাটা বোধহয় কাজ করছে না , আবার নতুন করে ভাবতে হবে তাকে । বিছানায় লজেন্সের পাশে শুয়ে গিনি বলল ,”তোর বুঝি লাল বলটার কথা খুব মনে পড়ে লজেন্স ? তুই চিন্তা করিস না ,আমি তোকে ওইরকমই আরেকটা বল কিনে দেব ।”
লজেন্স মাথাটা গিনির হাতে রেখে ,থাবা দিয়ে তাকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল ।
সকালে ঘুম ভাঙতেই , রোজের মত ব্রেকফাস্টের টেবিলে গিয়ে বসলো গিনি ।তার সামনে প্লেট রেখে মা বলল , “আমি একটু আজকে রিনি দির বাড়ি যাবো , সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসবো । দুপুরের খাবার গুলো যেন প্লেটে ঢাকা না পড়ে থাকে গিনি !
গিনি হেসে বলল : আচ্ছা !
বেলা এগারটার দিকে গিনির ফোনটা বেজে উঠলো , ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো সুনন্দার কন্ঠস্বর ,”গিনি ! প্রতিমা মিস বেলভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি ! কাল রাতে হার্ট এটাক হয়েছে , অবস্থা ভালো নয় ,এখন কাউকে দেখা করতে দিচ্ছে না ।আমাদের বুলা মাসি তো প্রতিমা মিসের বাড়িতেও রান্না করে ,ওর থেকেই আজকে খবর পেলাম ,কাল দুপুরে নাকি মিসের মেয়ে নিজের স্বামীকে নিয়ে এতদিন পরে হঠাৎ এসে হাজির , কোনো রাখ ঢাক না করে সম্পত্তির সমান ভাগের দাবীতে উকিলের চিঠি ধরিয়েছে । মিসের শরীর বিশেষ ভালো ছিল না ,তার ওপরে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে চলা এই জোরজুলুম না নিতে পেরে , গতকাল রাত আট টার দিকে ওনার হার্ট এটাক হয় । ওই মেয়ের স্বামী নাকি ফন্দি আটছিল ,মিস হঠাৎ মারা গেলে তাদের কেস নাকি আরো অনেক সহজ হয়ে যাবে । বেগতিক দেখে বুলা মাসিই পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে , পাড়া প্রতিবেশীকে খবর দিতে সবাই এসে মিসকে নার্সিং হোমে নিয়ে যায় । ওনার ছেলেকেও খবর দেওয়া হয়েছে , আজকে রাত্রেই এসে পৌঁছানোর কথা ….”
গিনি ফোনটা কেটে দিয়ে ভেজা চোখে বিছানায় বসে পড়ল । এসবের জন্য তার নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছে , সে যে কেন বুঝতে পারেনি যে কিছু জিনিস, কিছু সম্পর্ক , চির তরে হারিয়ে যাওয়াই ভালো। যারা ভালবাসার মূল্য বোঝে না ,আত্মহননের কঠিন পণ করে ভালবাসা তাদেরই প্রানপনে জাপটে ধরে থাকে , এই নির্মম সত্যির এভাবে সামনে আসার কি খুব দরকার ছিল ! বৃদ্ধা মায়ের মুখে এক চিলতে হাসি ফিরিয়ে দেবার খেলায় ,সবকিছু আগের মত হয়ে যাওয়ার মিথ্যা আশাটাও , তার কাছ থেকে আজ কেড়ে নিয়েছে গিনি ! কিন্তু এ যে সে চায়নি , প্রত্যাবর্তন যে শুধু ফিরিয়ে দিতেই জানে, দিয়ে ফিরিয়ে নেওয়ার কৌশল শুধু যে ভগবানের আয়ত্তে । কথাটা মনে হতেই ঠাকুর ঘরে ছুটে গিয়ে মায়ের বসানো কৃষ্ণমূর্তি র সামনে হাত জোড় করে গিনি বলল , “প্রত্যাবর্তনের অভিশাপ ফিরিয়ে নাও ভগবান , প্রতিমা মিসের মৃত্যুর কারণ তার ভালবাসার বিজ্ঞান কে কিছুতেই হতে দিও না ।” গিনির অবিরাম চোখের জলে ভাবলেশ হীন পিতলের মূর্তির পা ভিজে যেতে লাগলো ।
হঠাৎ দরজার কলিং বেলের আওয়াজে চমকে উঠলো গিনি । চোখের জল মুছে দরজা খুলতেই দেখলো অনামিকা দিদি হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে । গিনিকে গতকালের মতই জড়িয়ে ধরে সে বলল , “সব ঠিক হয়ে গেছে গিনি ,কালকে তোর সাথে কথা বলে ফেরার পথে হঠাৎ জয়ন্তের সাথে দেখা হয়ে গেল ।’কাকতালীয়’ শব্দের ব্যবহার এখানে ঠিক পর্যাপ্ত নয় , কোনো এক মায়াবী শক্তির যাদুতেই বোধহয় এতদিন পরে জয়ন্তও আমার মত ছুটি নিয়ে কলকাতার বাড়িতে এসেছিল আর ঠিক ওই সময়েই পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা করে বাড়ির পথে এগোচ্ছিল ।আমরা চেষ্টা করেও কাল একে ওপর কে এড়িয়ে যেতে পারিনি । একসাথে সারা সন্ধ্যে কাটানোর পর , আমাদের মধ্যে অতীতের ভুল বোঝাবুঝির বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব নেই । ভালবাসা হারানোর পরই , তাকে ছাড়া জীবনের মূল্যহীনতা চোখে পড়লেও আর সকলের মতো সময়ের কাছে আমরাও খুব অসহায় ছিলাম রে ! ওই নির্বিকার স্বভাবের পিছনের সহজ মানুষটা কেই যে আমি ভালো বেসেছিলাম , দৈনন্দিন চাওয়া পাওয়ার জটিলতায় সেই সত্যিটা আমি নিজের অজান্তেই কখন যেন ভুলে গিয়েছিলাম ,তাই হয়তো জয়ন্তেরও মনে হয়েছিল যে ওর ওপর আমার অনুভূতি , ক্ষনিকের মতিভ্রম ছাড়া কিছুই নয় যা সারাজীবন দুটো মানুষকে একসাথে রাখার জন্য যথেষ্ঠ নয়। সব পাওয়ার আশায় কোনো কিছু হারানোই আর বাকি ছিল না,কালকের দিন টা না এলে ভাগ্যের পরিহাসের সাথে আপোষ করা ছাড়া আর হয়তো কোনো উপায়ই থাকত না। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না গিনি ! তুই হলি আমার লাকি চার্ম । তোকে ফোনে জানাতে কিছুতেই যে মন চাইল না , তাই এভাবে ছুটে এলাম ।
গিনি মুখে অল্প হাসি এনে বলল , “তোমরা খুব ভালো থাকো অনামিকা দিদি । ফেরৎ পাওয়া সম্পর্কের মুখ , স্মৃ তির আয়নায় চেনা লাগলে তার আনন্দ যে সীমাহীন হবে সেটাই প্রত্যাশিত কিন্তু সবার আর সে ভাগ্য কোথায় ! আমাকে এখনি একটু বেরোতে হবে অনামিকা দিদি,আমি সময় করে তোমাদের বাড়ি গিয়ে বাকি গল্প শুনব ক্ষণ ।
অনামিকা নামের মেয়েটি হেসে বলল , “আচ্ছা ! ঠিক আসিস কিন্তু , আমি এলাম এখন ।”
না খেয়ে দেয়ে , নার্সিং হোমে সন্ধ্যে অব্দি বসে থাকার পর ,ডাক্তার যখন বলল প্রতিমা মিস এখন সম্পুর্ন বিপদমুক্ত , গিনির স্বস্তির নিশ্বাসের সাথে বিজ্ঞান তার পাপের ভার থেকে মুক্তি পেল । কাল সকালের আগে মিসের সাথে কারও দেখা করা বারণ ,তাই অগত্যা বাড়ির পথ ধরলো গিনি। প্রচন্ড বৃষ্টিতে স্নান করে বাড়ি ঢুকে দেখলো মা এখনো ফেরেনি ।বাবার আসানসোল থেকে ফিরতে পরশু হযে যাবে , বাড়ি একদম ফাঁকা । লজেন্সের আদর সামলে ভিজে জামা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল গিনি ,তার ক্লান্ত মন আনমনা হয়ে গেল আকাশ পাতাল চিন্তায় । হঠাৎ ল্যান্ড ফোন টা বেজে উঠলো , গিনি ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে মায়ের গলা , “গিনি ! সারাদিন কোথায় ছিলি ? কতবার ফোন করেছি তোকে , ফোনটা বন্ধ রেখেছিলি কেন ? আচ্ছা শোন ! প্রচন্ড বৃষ্টিতে রাস্তায় আটকে পড়েছি ,জায়গাটা ভালো চিনিও না , সব যানবাহন বন্ধ হয়ে গেছে , সামনে নাকি বাজ পড়ে বড়সর দুর্ঘটনা হয়েছে , কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না ।মালতীকে বলেছি আমি না ফেরা পর্যন্ত ও আমাদের বাড়িতে থাকবে , আমার ফোনে বেশী চার্জ নেই….”
গিনি কিছু বলার আগেই লাইন টা কেটে গেল, মায়ের জন্য ভীষণ চিন্তায় আবার নম্বর টা ডায়াল করতেই বুঝলো মায়ের ফোন বন্ধ হয়ে গেছে । রাত বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টিও বেড়ে চলল । গিনি বাড়ি ফেরার পরে মালতী দি কে দেখেনি , বাইরে বাজ পড়ার শব্দে লজেন্সও ভয়ে লেজ গুটিয়ে শুয়ে আছে বিছানায় । মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছে গিনির , বাবার কাছে সে শুনেছে এরকমই এক জল ঝড়ের রাতে গাড়ি দুর্ঘটনায় তার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল , ২ বছরের গিনিকে সেই আতঙ্ক ছুতে না পারলেও আজ তার সারা শরীর ভয়ে অবশ হয়ে আসছে । এই বৃষ্টিতে একা রাতে মার যদি কোনো বিপদ হয় , তার নতুন মা ও যদি তাকে ছেড়ে। … “না না ! তা কিছুতেই হতে পারে না ” কথাটা বলেই এক অজানা ভয়ে টেবিলে রাখা যন্ত্রের কাছে গিয়ে গিনি বলল , “আমার মা কে বাড়ি ফিরিয়ে দাও প্রত্যাবর্তন !” যন্ত্রের আলো গিনিকে ছুয়ে বন্ধ হয়ে গেল ।
“এ কি করলি গিনি !” তার ভিতরের মেয়েটা আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠলো ! ” বিজ্ঞানের কাছে মা মানে তো রক্তের সম্পর্ক ! তুই তো নিজের অজান্তে নিজের মৃত মা কে ফেরৎ চেয়ে বসলি ! এখন বাকি হিসেব মেলাতে পারবি তো ?” এক প্রচন্ড ভয়ে গিনি দরদর করে ঘামতে লাগলো , সত্যিই তো ! মা বলে এখন যাকে জানে , সে তো তাকে জন্ম দেয়নি , প্রত্যাবর্তন যদি অলৌকিক শক্তিতে সত্যি তার নিজের মৃত মা কে ফেরৎ নিয়ে আসে তাহলে গিনির বর্তমান পৃথিবী যে মুহুর্তে লন্ড ভন্ড হয়ে যাবে।
মাথা ব্যথা টা আরো বাড়তে লাগলো , নিজেকে এত অসহায় এর আগে কখনো লাগেনি তার, বাইরের বিদ্যুতের চমকানি ভিতরের ভয় কে ক্রমান্বয় বাড়াতে লাগলো । দরজা খোলার হঠাৎ আওয়াজে চমকে উঠলো গিনি । ভয়ে চোখ বুজে বালিশ আঁকড়ে শুয়ে রইলো সে , ঘরের ভিতরে আসা পায়ের শব্দ আরো বেশী করে স্পষ্ট হয়ে এলো। ঘর জুড়ে সব শেষ হয়ে যাওয়ার আগের নিস্তব্ধতা। চোখ জুড়ে ঘুমের আবেশ নাকি সংজ্ঞা হীন হওয়ার পূর্বের সঙ্কেত !
সকালে গিনির যখন ঘুম ভাঙ্গলো, মার কোলে তার মাথা । মা তাকে আদর করে বললেন , ” এখন আর একটুও জ্বর নেই ,ভ্যাগিস বৃষ্টি থামার অপেক্ষা না করে হেঁটে হলেও আমি ভোর রাতে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম ,না হলে যে আমার মেয়েটার কি হত ! মালতীকে আমি আজই ছাড়িয়ে দেব , মিথ্যেবাদী কোথাকার ! “
গিনি মায়ের চেনা মুখটা দেখে স্বস্তির নিঃ শ্বাস ফেলে বলল : আমার বুঝি জ্বর হয়েছিল ?
মা : তা নয়তো কি ! আমি এসে দেখলাম , তোর গা আগুনের মত গরম । জ্বরের ঘোরে কিসব আবোল তাবোল লিখেছিস দ্যাখ ,আমি তো মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না , টেবিলের উপরে পাতাটা রাখা ছিল ।
মায়ের হাতের সাদা পাতাটা হাতে নিয়ে গিনি এক নিঃশ্বাসে লেখাটা পড়ল ,
“ফিরে আসার সময় যে নির্দিষ্ট, গিনি ! তা পেরিয়ে গেলে সময় নিজে হাতে সে দরজা বন্ধ করে দেয় , অলৌকিক শক্তি বলে জোর করে নিয়মের অবমাননা করলেও , সে শক্তি যে অন্যের অধিকৃত নিজের সবকিছু ফিরিয়ে দিতে অক্ষম ! “
লেখাটার ধরন গিনির সাথে মিললেও , গিনি বুঝতে পারলো এটা তার নিজের লেখা নয় ,মায়ের কোল আঁকড়ে ধরে , চোখের জলে অজানা কারো যন্ত্রণা উপলব্ধি করলো গিনি।
লজেন্সের হঠাৎ উল্লাসে চমকে উঠলো মা ও গিনি দুজনেই , লাল বলটা মুখে নিয়ে সোফার উপরে পাগলের মত লম্ফ ঝম্পের পর বিছানায় উঠে গিনিকে অবিরাম আদর করে চলল সে,তার চোখে মুখে বিশ্ব জয়ের আনন্দ । গিনি লজেন্সের কানের সামনে মুখ এনে বলল, “কোথায় পেলি এটা ? “
“রিঙ্কু দের বাড়ির গুদামে , শুধু শুধুই লালুকে সন্দেহ করছিলাম জানিস গিনি ! রিঙ্কুর হতচ্ছাড়া মানুষ ভাইটা লালুর চেয়ে অনেক বেশী লোভী ,আমি ভালো করেই জানি ও কখন স্কুল থেকে ফেরে , কালুদার গ্যাং কে বলে ওর জন্য জবর কামড়ের না ব্যবস্থা করিয়েছি তো আমার ‘লজেন্স চৌধুরী’ নাম বদলে ‘তুলসী গাছ চৌধুরী’ রাখিস !”
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।