সবাই জানত শুধু ঐ বাড়িটায় কোনো প্যাঁচা থাকে না। বাড়িটার আধোঅন্ধকার চৌহদ্দির বাইরে জড়াজড়ি হয়ে থাকা ঝুপসি আম পেয়ারা আর বেলগাছের সবুজ ডালপালায় সন্ধে নামতে না নামতেই পাটকিলে বুটিবুটি প্যাঁচাদের ঠেক বসে যেত। কিছু প্যাঁচা বসত করত হাড়পাঁজরা বের করে ঠাঠা হাসতে থাকা বাড়িগুলোর ঘুলঘুলিতে, আর ঠাকুরবাড়ির চাতালের ডানদিকে ভেঙে পড়া ঘরগুলোর কুলুঙ্গিতে। আমাদের মতো টিনের ট্রাঙ্ক আর চটের পেটফোলা ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে আসা রিফিউজিরা পাড়াটার জমিখানাখন্দনালা জবরদখল না করলে প্রায় খন্ডহর হয়ে ওঠা গোটা সাত আট ইঁটের বাড়ি, মণ্ডলদের প্রতিষ্ঠিত চারচালা রাধামাধবের মন্দির, মন্দিরের চারপাশের কিছু টিনের চালাঘর আর মন্দিরের সামনে দিয়ে আদিগঙ্গার দিকে চলে যাওয়া শুঁড়িপথটুকু নিয়ে পাড়াটা ঘুমিয়েই থাকত। কিংবা জেগে থাকত ভাঙা পাঁচিলে সড়্সড়ানো হেলে সাপ, কন্টিকারি ঝোপের উটকো শেয়াল আর গোধূলিলগ্নে উড়ে আসা প্যাঁচাদের সাথে। কলকাতার উপকন্ঠে যখন কলোনির জমির জন্য রিফিউজি আর জমিদারদের নিয়মিত লাঠালাঠি, তখন আদিগঙ্গার কোলছোঁয়া প্যাঁচাদের এই পাড়া বিনা বখেড়ায় আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়েছিল।
মা বলত কোজাগরী লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে গেরস্তের ঘরের চালে লক্ষ্মীপ্যাঁচা বসলে গৃহস্থের মঙ্গল হয়। কিন্তু সোনাকাকা সে কথা মানতে চাইত না। সোনাকাকা আমাদের দেশের বাড়িতে ঠাকুর্দার পালিত অসংখ্য দূরসম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে একজন। বাবার ন্যাওটা সোনাকাকা দেশভাগের সময় আমাদের সঙ্গেই ইন্ডিয়ায় পালায়। পাঠক এতদিনে জেনে গেছেন যে আমাদের প্রজন্মের গল্পে সাধারণত: এরকম একজন সোনাকাকা বা রাঙাকাকা থাকবেনই থাকবেন। একটু মেয়েলি চালচলন, অল্পশিক্ষিত সোনাকাকা বলত প্যাঁচা হল সাক্ষাৎ শয়তানের দূত- নি:শব্দ পাখায় ভর দিয়ে উড়ে বেড়ানো খুনের দল। অথচ চোখ মটকে বসে থাকে যেন সাক্ষাৎ ব্রহ্মজ্ঞানী।
– পেচারে শিকার করতে দ্যাখস নি? সাইক্ষাৎ যমদূত। ভুলাভালা দেইখা লুকে ভাবে আহা রে লক্ষ্মীর বাহন। কিন্তু যখন আইয়া ধরব, কুনো নিস্তার নাই। খাটাইশ! খাটাইশ!”
কিছু খারাপ লাগলেই সোনাকার বাঁধা লব্জ ছিল- “খাটাইশ, খাটাইশ।”
প্যাঁচা ছিল, আর চোর ছিল। চালচুলোহীন মানুষদের পাড়াতেও চোর আসত। দামী কিছু না পেলে কাপড় টাঙাবার দড়ি, পুরোনো গামছা, ফেলেদেওয়া তোরঙ্গ বা তোবড়ানো ঘটি- কিছু না কিছু একটা। এরকম কিছু খোয়া গেলে সোনাকাকা বলত- “পের্যাক্টিস করতাসইন”। পরীক্ষার আগে এক রাতে মেজদা আর বড়দা যখন অনেক রাত অবধি টেমি জ্বালিয়ে পড়াশুনো করছে, কোনো এক নিশিকুটুম আর অপেক্ষা করতে পারেন নি। ঘরের দেওয়ালে কেঁপে কেঁপে ওঠা দেওয়ালজোড়া আঁকাবাঁকা ছায়ার মধ্যে আর একটা ছায়া হাত কখন এসে ঢুকেছে দাদারা টেরই পায় নি। হঠাৎ মেজদার মাথায় অ্যাক বোম্বাই চাঁটি। বিশুদ্ধ কলকাত্তাইয়া জবানে দাদারা অমূল্য উপদেশ পেলেন- “অনেক পোড়িচিস। এবার সো গে যা!” এরপর “চোর আইসে গো” ইত্যাকার শোরের মধ্যে কুটুমটি ভাগলবা।
উদ্বাস্তুদের গল্পে টিনের চাল থাকে, আর ভূতের গল্পে থাকে প্যাঁচা। তাই এই গল্পে টিনের চাল আছে, প্যাঁচা আছে, আর আছেন প্যাঁচাবাবু। ঐ বাড়িটায় প্যাঁচা ছিল না কিন্তু এক প্যাঁচাবাবু ছিলেন। ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবিপরা গোলগোল চোখ খাঁড়ার মতো নাক এই বাবুটি সন্ধে হলেই ঐ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন। হাঘরে বাঙালদের ভদ্রলোকের সাথে কথা বলার মত আস্পর্ধা ছিল না। কিন্তু প্যাঁচাবাবু নামটা কোনোভাবে চালু হয়ে গোয়েছিল। আমাদের মত বাচ্চারা ঐ বাড়িটার আশেপাশে ঘুরঘুর করেছি কিন্তু ভিতরে ঢোকার সাহস পাই নি কোনোদিন। সন্ধের পর ঐ বাড়ির হাড়জিরজিরে খাঁচার সিলুয়েট শকুনের ডানার মত ওঁত পেতে থাকত। প্যাঁচাবাবু ছাড়া ঐ বাড়ির কোনো বাসিন্দাকে কোনোদিন দেখতে পাই নি।
রাধামাধবের মন্দিরের পুরুত ছিলেন রামকালী চক্রবর্তী। আমরা সরলমনে ডাকতাম রামজ্যাঠা। পুরুতগিরিটা সাইড বিজনেস, আসল ব্যবসা ছিল দুধের। নিজের টিনের চালের বাড়ির পাশে এক বড়গোছের খাটাল বানিয়ে ফেলেছিলেন। এক বৌ আর সাত মেয়ের সংসার চালাতেন ঐ দুধ বেচে। বিকেলবেলা সূর্য অস্ত যাবার আগে ঐ বাড়িটার ছায়া যেখানে শেষ হত, ঠিক সেখানে ছিল রামজ্যাঠাদের গোয়াল। তো সেই রামজ্যাঠার স্ত্রী রামজ্যাঠাইমা একদিন সন্ধেবেলা হাঁপাতে হাঁপাতে সোজা হাজির আমাদের রান্নাঘরে।
“ও বিনুর মা, শুনচো? কি অশৈরন কান্ড মাগো! এই দ্যাকো গাটা শিউরে শিউরে উটচে। আজ সন্দেবেলা দুধ দোয়াতে গিয়ে দেকি ঐ বাড়িটার একটা জানলা খোলা, ভেতরে আলো জ্বলচে। একটু এগিয়ে উঁকি মেরে দেকি এক ঘোমটাপরা বামুনবৌ কাজ কচ্চে। আমি তো এই পড়ি কি মরি করে দে দৌড় দিতে যাবো তো সে দেকি হাতছনি দিয়ে ডাকচে। সে আর কি বলব যেন পা দুটো ওখেনেই আটকে গেল। রোগামত অল্পোবয়িসি বৌটা জানলা থেকে মুক বের করে তোমাদের ভাষায় ফিস-ফিস্ করে বলে- “এদিকে আয়েন না, আমারে মাইরা ফালাইব”। কি অনাছিষ্টি কান্ড বাপু! আমার তো হাত পা এখনো কাঁপচে গো। এই ভরসন্দেবেলা। রাম রাম! (ফিস্ ফিস্ করে) আরও একটা জিনিষ দেখলুম গো বৌ। বাইরে গাছে এতগুনো প্যাঁচা থাগলে কি হবে, ঐ বাড়ির গাছগুনোতে একটাও প্যাঁচা বসে না।”
আমার মায়ের কাছে আসাটা স্বাভাবিক ছিল কারণ তিন ছেলে আর ন্যালাখ্যাপা দেওরকে নিয়ে আধজঙ্গলের মধ্যে অসীম সাহসের সাথে ভদ্রমহিলা সংসার চালাতেন। বাবা থাকতেন শ্যামবাজারের বাসায়। কিন্তু মায়ের ধাতে কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি লাফালাফির ব্যাপারটাই ছিল না। অতএব ভূতের বাড়ির এইরকম প্রবল সম্ভাবনাময় উপস্থিতিকেও মা প্রায় অগ্রাহ্যই করলেন।
“আপনারই বা এই ভরসন্ধেবেলা উঁকিঝুঁকি মারা কেন দিদি? আর ওদিকে যাবেন না। সাপখোপও তো থাকতে পারে। পাড়ার লোকরে বলেন। দেখেন তারা কি বলে।”
এদিকে সোনাকাকা পুরো ব্যাপারটা সরেজমিনে তদন্ত করতে যাওয়ার জন্য লাফালাফি শুরু করলে মা তার খ্যাপা দেওরকে লাগালেন আর এক ধমক।
“আফনের খায়া দায়া কাম নাই? বাড়িত বইয়া থাহেন। এঙ্গো উজায় ব্যাঙ্গো উজায়, খইয়া পুটি কয় আমিও উজাই।”
পাড়ার লোকে আর বলবেন কি? এমনিতেই ঐ বাড়ির দিকে কেউ পা মাড়াত না, এবং সন্ধেবেলা ঘোমটাপরা মহিলা দেখার পর সর্বজনীনভাবে সাব্যস্ত হল বাড়িটা ভুতুড়ে। কিন্তু কিছু মাসের মধ্যেই টের পাওয়া গেল বাড়িটা ভুতুড়ে হতেই পারে, কিন্তু মহিলা আদৌ ভূত নন। অন্তত: তিনজন মহিলাকে ডেকে জানলার ফাঁক দিয়ে উনি কথা বলেছেন এবং তার মধ্যে আমাদের পাশের বাড়ির ধনাজ্যাঠার স্ত্রীর সাথে কথা হয়েছে ভর দুপুরবেলা। ধনাজ্যাঠার স্ত্রী এটাও দেখে নিয়েছিলেন যে ভদ্রমহিলার জলজ্যান্ত একটা ছায়া আছে। শাড়িতে ঢাকা পায়ের পাতা না দেখতে পাওয়ায় চেকলিস্টের একটা পয়েন্ট যদিও বাকি থেকে গিয়েছিল। তবে ছায়ার থেকে আরও সরেস প্রমাণ পাওয়া গেল আরও দেড় মাস পরে, কোজাগরী পূর্ণিমার দিন।
দোল পূর্ণিমার নিশি মলয় নির্মল আকাশ।
ধীর ধীরে বহিতেছে মলয় বাতাস।।>
দেশের বাড়ি থেকে পালাবার পর সেদিন আমাদের বাড়িতে প্রথম লক্ষ্মীপূজা। আয়োজন সামান্য কিন্তু তাও প্রসাদ পাওয়ার জন্য আমাদের তর সইছে না। ঘরের মধ্যে ধূপধুনো, গরম খিচুড়ি আর তাজা নাড়ুর পাঁচমিশেলি গন্ধে আন্চান আমরা বাবা মাকে ঘিরে বসে আছি। বাবা শ্যামবাজারের বাসা থেকে এসে নিজেই পুজো করছেন। একমাত্র সোনাকাকা দোরগোড়ায় বসে বাইরের কাঁঠালগাছটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বাইরে চাঁদের গাল ফেটে ফিনকি দিয়ে বেরোনো জ্যোৎস্নার আলো সেদিন একটা মারকাটারি কান্ড বাঁধিয়েছে। অপার জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাওয়া আমগাছের ডালে একটা প্যাঁচার বাচ্চা করাতচেরা আওয়াজে মায়ের জন্য চেঁচিয়ে উঠল।
লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ।
করিতেছে নানা কথা সুখে আলাপন।।
খিদের চোটে, মৃদু হাওয়ায় আর একঘেয়ে পাঁচালির সুরে আমাদের চোখ তখন একটু একটু বুজে আসছে। এমন সময় একটা ভয়াবহ অমানুষিক আর্তনাদে পাড়ার সব টিনের চাল যেন ঝন্ঝনিয়ে উঠল। প্যাঁচাদের যাবতীয় চিৎকার গেল থেমে। পাড়ার সব বাড়ি থেকে লোকজন বেরিয়ে এসেছে, দৌড়াচ্ছে ঐ বাড়িটার দিকে। বাবাও পুজো ফেলে দৌড়ালেন। চাঁদের আলো ছাপিয়ে অন্য একটা হালকা সোনালী আলোয় ভরে যাচ্ছিল বাড়িটার পিছনের পাঁচিলটা। পাড়ার লোক গিয়ে দেখতে পেয়েছিল আগুনে ভরা শরীরটা আছড়ে পড়েছে মেঝের উপর। বাঁচাবার কোনো উপায়ই ছিল না। শুধু কোনোভাবে চুড়ির একটা টুকরো বেঁচে যাওয়াতে বোঝা গেল দেহটা কার হতে পারে।
এদিকে এই গোলমালে সোনাকাকাকে আর দেখতে পাই না। এমন গন্ডগোলে সোনাকাকার দৌড়ে না যাওয়াটা খুবই অস্বাভাবিক। আমি আর মেজদা খুঁজতে খুঁজতে দেখি সোনাকাকা কাঁঠালগাছটার পিছনে কোলকুঁজো হয়ে ছায়ার মত দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে শুনি হাপরের মতো নি:শ্বাস নিচ্ছে। মনে হল ভয় পেয়েছে। আমাদের দেখতে পেয়েই ফিস্ফিস্ করে উঠল- “খাটাইশ! খাটাইশ!” কাঁঠালগাছের ছায়ায় বুঝতে পারলাম না সোনাকাকার চোখের কোণে ওটা জোৎস্নার আলো চক্চক্ করছে কিনা।
পরের দিন পুলিশ আসতে দেখলাম, কিন্তু তারা কি করল বা কি করল না- আমাদের মত বাচ্চাদের সে সব জানবার সুযোগ ছিল না। বড়দের কথাবার্তায় জানতে পারলাম এই পাড়ার বেশির ভাগ বাড়ি জমিজিরেত হল জিতেন ঘোষালদের। জিতেন ঘোষালরা হুগলী জেলার সাবেকি ব্যবসায়ী পরিবার। শোনা যায় বসাক আর শেঠদের সাথে এনাদের ব্যবসার ভাগীদারি ছিল। জিতেন ঘোষাল নিজে আবার অসহযোগ আন্দোলনের সময় ছয় মাস জেল খেটে এসেছেন। তাই অতুল্য ঘোষদের সাথেও এই পরিবারের প্রভূত দহরম মহরম। এই ঘটনা ঘটার সাতদিনে পরে জিতেন ঘোষালরা সদলবলে এসে শান্তিস্বস্ত্যয়নের বিপুল আয়োজন শুরু করলেন। পাড়ার বাঙালরাও সেই মহাযজ্ঞে আমন্ত্রিত। সেই প্রথম বাড়িটায় ঢুকলাম। এত লোকজন হাঁকাহাঁকির মধ্যে বাড়িটার কোনো আলাদা আদল খুঁজে পাই নি। যে ঘরটায় আগুন জ্বলেছিল সেটা সেদিনও তালাবন্ধ। খট্খটে রোদ্দুরে ভরা দিনের বেলা প্যাঁচাও নেই, প্যাঁচাবাবুও নেই।
লক্ষ্মীর ব্রতের কথা বড় মধুময়।
প্রণাম করিয়া যাও যে যার আলয়।।
লক্ষ্মী ব্রতকথা হেথা হইল সমাপন।
মনের আনন্দে বল লক্ষ্মীনারায়ণ।।
ঐ বাড়ির গল্প এখানেই থেমে যাওয়া উচিত ছিল। ডিসেম্বর মাস নাগাদ ঘোষালরা বাড়িটা ভেঙে ফেলার জন্য মিস্ত্রি লাগালেন। ঠিক এইসময় একদিন বিকেলবেলা আমরা ইস্কুল থেকে ফিরে হাত পা ধুচ্ছি, ঐ বাড়ির দিক থেকে একটা হৈ হট্টগোলের আওয়াজ ভেসে এল। অমনি আমরা তিন ভাই দে দৌড় দে দৌড়। প্রচুর লোক জড়ো হয়েছে বাড়িটার চারদিকে। রামজ্যাঠা, ধনাজ্যাঠা সবাই আছেন। মিস্ত্রিরা কাজ থামিয়ে বসে আছে। বড়দের উত্তেজিত মন্তব্য থেকে আবছা আবছা বুঝলাম যে চিলেকোঠা ভাঙতে গিয়ে মিস্ত্রিরা দেখে চিলেকোঠার মেঝেতে অসংখ্য ছোটো ছোটো কালো হয়ে যাওয়া হাড় পড়ে আছে। মিস্ত্রিরা ভয় পেয়ে কাজ বন্ধ করে মন্দির থেকে রামজ্যাঠাকে ডেকে আনে। সে যুগে মিডিয়াও নেই, যুক্তিবাদী সমিতিও নেই। অতএব অসম্ভব সব কাল্পনিক গল্প টিনের চালাঘরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ল। আবার পুলিশ এল, এবং জিতেন ঘোষাল এলেন সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে। গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর বৈঠক চলল তিন চার দিন ধরে। সেই বৈঠকে কি কথা হল আমাদের জানার সাধ থাকলেও সাধ্য ছিল না। এক সপ্তাহ বাদে আবার মিস্ত্রিরা কাজে লাগল। বাড়িটা এবার আস্তে আস্তে ভাঙাই পড়ল।
এই হৈ হট্টগোলের সময় বাবা জরুরী কাজে শ্যামবাজারের বাসায় কাজে আটকে ছিলেন। বাবার সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক খ্যাতির জন্য উদ্বাস্তু পরিবাররা বাবাকে একজন মুরুব্বি হিসেবে মান্যিগণ্যি করত। এইসব ঘটনার পরে বাবা যেদিন বাড়ি ফিরলেন সেদিন পাড়ার সবাই আমাদের বাড়িতে হাজির- “এইডা কি কান্ড ঘটল দ্যাহেন দেহি বিনোদদা! কতজনরে এইখানে কাইটা ফালায়া রাখসে কে জানে! পুলিশ তো জিতেন ঘোষের পাও চাটে। হ্যায়রা আর কি করব? একখান তদন্ত হওনের দরকার ছিল কিনা কন দেহি।” সব শুনেটুনে বাবা জিতেনবাবুকে একটা চিঠি লিখলেন। কংগ্রেসি মহলে বাবাকে সবাই চিনতেন বলে জিতেন ঘোষাল অন্যান্য উদ্বাস্তুদের মত বাবার কথাকে হেলায় উড়িয়ে দিতে পারত না। জিতেনবাবুর উত্তর এল। বাবা স্থানীয় থানার দারোগার সঙ্গে দেখা করলেন। যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পরে বাবা যেটা বললেন সেটা যৌক্তিক হলেও কেউই মন থেকে মেনে নিল না।
বাবা বললেন ঐ বাড়িটায় প্যাঁচা ছিল না বলে যে মিথটা চাউর হয়েছিল সেটা সম্পূর্ণ ভুল। প্যাঁচাদের আসল আড্ডাটা ছিল চিলেকোঠায় যেটা বাড়ির পিছনদিকে আড়াল হয়ে থাকায় পাড়ার লোক দেখতে পেত না। প্যাঁচাদের নাকি অপাচ্য খাবার মুখ দিয়ে বের করে দেবার একটা স্বভাব আছে। হাড়, লোম, পালক ইত্যাদি যা যা হজম করতে পারে না তা আবার বমি করে ফেলে দেয়। ঐ ফেলে দেওয়া খাবারকে বলা হয় “আউল পেলেট”। বহুদিন চিলেকোঠার ঘরে কারুর পা না পড়ায় ঐ প্যাঁচাদের মুখের বের করে দেওয়া হাড় জমে জমে ভুর হয়ে ছিল। ধনাজ্যাঠা বললেন-
-কিন্তু ঐ বামুন মেয়ে আর ঐ লোকটা? ঘোষালের পো কি কয়?
-জানি না। কিসু কয় নাই।
– হুঁ! যুক্তিটা ভালই খাড়া করস। কিন্তু তাও ঠিক ব্যাপারখান….
এই ঘটনার দুই মাস বাদে আমরা পাত্তাড়ি গুটিয়ে চলে আসি উত্তর শহরতলির বাসাবাড়িতে। আমাদের পড়াশুনারও অসুবিধে হচ্ছিল, বাবাও আর দুই বাসায় ক্রমাগত যাওয়া আসা সামলে উঠতে পারছিলেন না। সোনাকাকাও আমাদের সঙ্গেই চলে আসে। কোজাগরী পূর্ণিমায় প্যাঁচা দেখার স্বপ্নটা স্বপ্নেই থেকে গেল।
পরিশিষ্ট:
এই ষাট বছরেরও বেশি পুরোনো গল্পটা লিখে ওঠা হত না যদি না সেদিন বাড়ি পরিষ্কার করার সময় পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতাম। বাবার পুরোনো লেখাপত্র, মায়ের যাবতীয় প্রেস্ক্রিপশন, সোনাকাকার হোমিওপ্যাথির হাতবাক্সো- সব কিছু মিলে বেডরুমের উপরের লফ্ট্টা মাকড়সার জাল, ঝুল, তেলাপোকায় ভরে গিয়েছিল। সব নামিয়ে গোছাচ্ছিলাম- কোনটা ফেলার, কোনটা রাখার। সোনাকাকার হোমিওপ্যাথির বাক্সের গোল গোল খোপগুলোর একটা খোপে ব্রায়োনিয়া থার্টির শিশিটা দেখি একটা হলুদ কাগজ দিয়ে মোড়া। ফেলে দিতে গিয়ে হঠাৎ কি মনে হওয়ায় কাগজটার ভাঁজ খুললাম। নীল কালির লেখা অস্পষ্ট হতে হতে এখন প্রায় ধূসর, কাগজের অর্ধেকটা ছেঁড়া। আঁকাবাঁকা অক্ষরে অচেনা অপটু হাতে লেখা- “আমাকে যে আপনী বলেচিলেন”- ব্যাস্, ঐটুকুই। সেদিন রাতে বড়দাকে দিল্লিতে ফোন করলাম। বড়দা শুনে কিছুক্ষণ বেদম হাসল। মনে হল নিত্যসন্ধ্যার হুইস্কির গেলাসে চুমুক দেওয়ার শব্দ পেলাম। তারপর বলল- “কবিতাটবিতা না পড়লে এইই হয়। এত দেশবিদেশ ঘুরলি, মোটামোটা অঙ্কের বই পড়লি, কিন্তু তোর চোখটা খুলল না। মায়ের ভালো খোকা বিনু সেই বিনুই রয়ে গেলি। আমাগো ফেমিলিতে একখান পাজ্ল আছিল। তোরে হেই পাজ্লের ক্লুখান শোনাই। শোন্ –
“ডুবিয়াছিল নদীর ধার আকাশে অধোলীন
সুষমাময়ী চন্দ্রমার নয়ান ক্ষমাহীন
কী কাজ তারে করিয়া পার যাহার ভ্রুকুটিতে
সতর্কিত বন্ধদ্বার প্রহরা চারিভিতে
কী কাজ তারে ডাকিয়া আর এখনো, এই বেলা
হৃদয়পুরে জটিলতার ফুরালো ছেলেখেলা?”*
বড়দাটা আজকাল বড় বেশি ড্রিঙ্ক করছে- খাটাইশ একখান।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।