পৌরাণিক এক পাখির কথা

তোমরা কি জানো ‘পৌরাণিক’ শব্দটির মানে কী? প্রাচীন হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থের নাম পুরাণ। এই পুরাণে যেসব জিনিসের কথা উল্লেখ আছে তাদেরই বলা হয় পৌরাণিক। তবে এর একটি অন্য অর্থও আছে, অনেক প্রাচীন কোনো বিষয় যেমন ধরো, গল্প, লোককথা ইত্যাদির অংশকে পৌরাণিক বলা হয়।

তোমাদের আজকে যে পাখিটির কথা বলব সেটি একটি পৌরাণিক পাখি, নাম হুদহুদ। কেউ আবার একে বলে মোহনচূড়া, কেউবা কাঠকুড়ালি নামে চিনে। তবে এর নামের প্রসঙ্গে একটু পরে যাই। আগে বরং বলি কেন এরা পৌরাণিক পাখি। বিভিন্ন দেশের অনেক প্রাচীন ইতিহাসেই এই পাখিটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই যেমন, প্রাচীন পারস্যে এই পাখিকে সততার প্রতীক হিসেবে দেখা হত। তবে ইউরোপে একে চোর পাখি নামেই সবাই ডাকে। এমনকি কুরআন-এও পাখির নাম উল্লেখ রয়েছে। মুসলমানদের হযরত সুলাইমান (আঃ) নামে একজন নবী ছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, উনি পশু পাখির ভাষা বুঝতে পারতেন। উনার একটি পোষা হুদহুদ পাখি ছিল, নাম ছিল ইয়াফুর। এই ইয়াফুরের মাধ্যমে অন্য রাষ্ট্রের দরকারি খবর-খবরা নিয়মিত সুলাইমান (আঃ) এর কাছে চলে আসত।

হুদহুদ বা মোহনচূড়া পাখির মাথায় খুব সুন্দর একটা ঝুঁটি আছে, ঝুঁটিটি হলদে-বাদামি পালকের, চূড়াটি কালো। মজার কথা হল রেগে গেলে পাখিটি ঝুঁটি প্রসারিত করে, তখন পাখিটিকে দেখতে সবচেয়ে সুন্দর লাগে। তখন দূর থেকে মনে হয় মাথার ওপর ফুল ফুটে আছে। পাখিটির দৈর্ঘ্যে প্রায় ২৫-৩২ সে.মি. পর্যন্ত লম্বা হয়, সম্পূর্ণ পাখা মেলা অবস্থায় দৈর্ঘ্য ৪৪-৪৮ সে.মি. পর্যন্ত লম্বা হয়। ওজন ৬৫ গ্রাম হয়ে থাকে। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারা প্রায় একই রকম। বাদামি শরীর রঙের, পিঠ, ডানা ও লেজে সাদা কালো ডোরাকাটা দাগ। এদের মুখ, গলা ও বুক কমলা-পীতাভ বা লালচে-কমলা। মোহনচূড়ার ঠোঁট লম্বা, কিছুটা বাঁকা এবং কালচে রংয়ের। দেখলে কাস্তের কথা মনে পরে যাবে তোমার। এই ঠোঁট যে শুধু দেখতে কাস্তের মতো তাই না, এর কাজও কাস্তের মতোই। মোহনচূড়া তার ঠোঁট দিয়ে নরম মাটিতে খাবার খুঁজে বেড়ায়।

ওদের খাবার কী জানো? নরম মাটিতে লুকিয়ে থাকা শুঁয়োপোকা, কেঁচো, ফড়িং, উইপোকা, ঝিঁঝিঁ পোকাসহ বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়। মোহনচূড়াকে প্রায়ই দেখা যায় নির্জন নদীর পাড়, আবাদি ও পতিত জমি, খোলা শুকনো মাঠ ইত্যাদি জায়গায়। সেখানে ওরা একা একা অথবা জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। মোহনচূড়ার সবচেয়ে দারুণ বিষয় হচ্ছে ওদের গোসল করা। এমনিতে তো ওরা পানিতেই গোসল করে অন্য সবার মতো। কিন্তু যদি পানি না পায় তখন ধুলোবালিতে হুটোপুটি খেয়েই গোসল সেরে নেয়।

শুরুতেই বলেছিলাম পাখিটির নাম নিয়ে বিস্তারিত কথা বলব। হুদহুদ বা মোহনচূড়া পাখির নানান নামের পেছনে নানান কাহিনী আছে। যেমন পৌরাণিক কাহিনীটি তো তোমরা শুনেই ফেললে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Upupa epops, ইংরেজিতে এই পাখিকে ডাকা হত, Eurasian Hoopoe। এর শ্রেণিবিন্যাস থেকে জানা যায় পাখিটি ইউপুপিডি পরিবারের অন্তর্গত ইউপুপা গণের মাঝারি আকারের দুর্লভ পাখি। গ্রাম বা এলাকা ভেদে পাখিটিকে অনেক নামেই ডাকা হয়। তবে, পাখিটির নাম মোহনচূড়া নামটি দিয়েছেন কথাসাহিত্যিক বনফুল। মজার বিষয় হচ্ছে কথা সাহিত্যিক বনফুলের নামটি কিন্তু উনার ছদ্মনাম। উনার প্রকৃত নাম বলাইচাদ মুখোপাধ্যায়।

এত কিছু বলা হল অথচ এটাই বলা হয়নি এই হুদহুদ বা মোহনচূড়া পাখির আবাস কোথায়? পৃথিবীতে ‘হুদহুদ’ বা Upupidae পরিবারের পাখির দুটি প্রজাতি রয়েছে। একটি প্রজাতি বাস করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকায়। আর অন্য প্রজাতিটির দেখা মেলে আমাদের বাংলাদেশে। এরা আবার দেশের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে দলগত ভাবে বিচরণ করে। ১০ থেকে ২০টি পাখি একত্রে বিচ্ছিন্ন একটি দল গঠন করে খাদ্যের সন্ধানে অথবা বাসা বানানোর জন্য স্থান বদল করে থাকে।

তুমি যদি এদের দেখতে চাও তবে গ্রামাঞ্চলের কোনো জলাশয়ের পাড়ে অপেক্ষা করতে পারো। দেখবে মাথায় সুন্দর একটা ঝুটি নিয়ে মোহনচূড়া কাদা খুঁচিয়ে বেড়াচ্ছে নয়ত ধুলোয় হুটোপুটি খাচ্ছে।

সুলতান মাহমুদের দাড়ি

মাকড়শা বানর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *