পোষা বিড়ালের কাঁটা— নূর কামরুন নাহার– প্রথম অংশ

শখের পোষা প্রাণীকে অনেকেই সুন্দর নামে ডাকেন। মিজানুর রহমান অথবা এ বাড়ির কেউ বিড়ালটাকে কোন নামে ডাকেন কিনা আমাদের জানা নেই। আমরা শুধু সময়ে অসময়ে মিজানুর রহমানের কোলে বিড়ালটাকে দেখি এবং দুই পা ভাঁজ করে ও যখন সোজা হয়ে বসে থাকে তখন আয় আয় চু চু করে ডাকতে শুনি। বিড়ালটাকে আমরা কখনো তার ছেলে পলাশের কোলে দেখি এবং কখনো মেয়ে মিতুর পড়ার টেবিলের ওপর বসে থাকতে দেখি।
এটি সাদা কালোর মিশ্রণে সাধারণ জাতের একটা বিড়াল। মিজানুর অবসরপ্রাপ্ত সাধারণ একজন স্কুল শিক্ষক। মিরপুরের সরকারী কোয়ার্টারে থাকতেন। তার অবসর জীবন শুরু হয়েছে আড়াইবছর। একবছর অবসর প্রস্তুতি ছুটিতে ছিলেন। এখন পুরোপুরি অবসর। স্কুল সার্টিফিকেট অনুযায়ী বয়স এখন ঊনষাট বছর ছয় মাস তিন দিন। অবসর গ্রহণের পর আদাবরে একটা ভাড়া বাসায় উঠেছেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন আগামী দুই মাসের মধ্যে বাসা বদল করবেন। ব্যক্তি হিসেবে তিনি বদরাগী, মেজাজী এবং অহংকারী। তার বেটে শরীরটা পোক্ত, পাটার মতো চ্যাপটা, মাংসল গোল দৃঢ় বাহু, খাটো মোটা ঘাড়, ঘন মোটা লম্বা চুলের ভ্রƒর নিচে মাঝারি দুটো সন্ধানী চোখ। একটা চোখ সামান্য ট্যারা। ঘাড়টা একটু বাঁকা করে হাত দুটো পেছনে রেখে তিনি হাঁটেন এবং সবকিছু দেখেনও ঘাড়টা একটু বাঁকা ও চোখ আড় করে।
মিজানুর বিলম্বে বিবাহিত। তার এক ছেলে এক মেয়ে। বিয়ে করছেন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পরিবারে। মিজানুরের মতোই তার স্ত্রীও বিলম্বে বিবাহিতা। তার দিনকাল এখন ভালো যাচ্ছে না। সাধারণত অবসরপ্রাপ্ত লোকদের দিনকাল এমনিতেই ভালো যায় না। তাদের দিন আর কি! মৃত নদী ! মিজানুরেরও তাই। তবে তার বিষয়টা আরো একটু জটিল। তিনি বিলম্বে বিবাহিত সুতরাং তার বাচ্চারা লেট প্রোডাকশন। তার একমাত্র ছেলে বড় সন্তান এখনও পড়াশোনা করে। মেয়েটাও পড়াশোনা করে। তার মিসেস স্বল্পভাষী, ঝুট ঝামেলাহীন মানুষ। বেঁটে এবং মোটা হবার কারণে ধীর গতি সম্পন্না। নানাবিধ শারীরিক অসুস্থতায় হয়রান থাকেন। শ্বশুরবাড়ির অবস্থা ভালো। বাড়ির অন্য মেয়ের জামাইরা বিরাট বিরাট চাকরি করে। দু একজনের বড় ব্যবসা। মিসেস মিজানুর স্কুল শিক্ষক স্বামী নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগেন। এ হীনম্মন্যতা দূর করার জন্য মিজানুর তার পরিবারে শ্বশুরবাড়ির জীবনমান বজায় রাখেন। সবমিলিয়ে তার সংসারের খরচের অংকটা বিশাল। এ রকম পরিস্থিতিতে তার অবস্থা বেশ জটিল ও কাহিল।
মিজানুর নিজেও অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান, ঐতিহ্যবাহী পরিবার তাদের। তার পিতা শিক্ষিত না হলেও দাদা শিক্ষিত ছিলেন। বাড়িতে আদব, কায়দা, শিক্ষা ছিলো। একান্নবর্তী পরিবার। চার ভিটায় চারটা ঘর, বড় বৈঠকখানা। গোয়ালে দ’ুতিনটা গাই, সারাবছর দুধের ব্যবস্থা। বছরকাবারি দুতিন জন লজিং মাস্টার। মটকা ভরা ধান। উত্তর ভিটার ঘরে সারা বছর অতিথি মেহমান। অবস্থাপন্ন সংসারের সব চিহ্ন আর রেওয়াজ নিয়ে সংসার ছিলো ফলবান বৃক্ষের মতো। ফলবান বৃক্ষ বিনয়াবনত থাকলেও মিজানুরের পরিবার ছিলো নাক উঁচু ও অহংকারী। শিক্ষা আদব কায়দা, অহংকারের সাথে মজ্জাগতভাবে তারা রপ্ত করেছিলো ক্ষুদ্রত্ব, সীমাবদ্ধতা, আমিত্বের বড়াই, গ্রাম্য ও পারিবারিক রাজনীতি। ফলে শিক্ষা ও কূপম-ূকতা দুটোই তারা ধারণ করেছিলো গভীরভাবে ।
কনিষ্ঠ সন্তান হিসেবে মিজানুর পিতামাতা ও পরিবারের সকলের খুব আদরের ছিলো। সে ছিলো মায়ের প্রশ্রয়প্রাপ্ত সন্তান। কঠিন রক্ষণশীলতা, অসম্ভব গোয়ার, পর্যাপ্ত আত্মঅহংকার, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত অন্ধ ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠা মিজানুর মায়ের একান্ত ভক্ত ও ন্যাওটা ছিলো। একজন সাধারণ কুটিল গ্রাম্য বধূর সবটুকু নিয়েই জয়গুননেচ্ছা সংসার ও সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ ও বশে রাখায় পারদর্শী ছিলেন। একান্নবর্তী পরিবারে জয়গুননেছার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত ছিলো। বাড়ির পুত্রবধূদের প্রতি আচরণ ছিলো এমন যে সংসারে তারা অস্তিত্বহীন ও অদৃশ্য কোনো প্রাণী। জয়গুণনেছার নির্দেশ ও চুলচেরা হিসেবে চুলায় ভাতের পাতিল চড়তো। তার নির্দেশ ও সম্মতি ব্যতীত গৃহপালিত গাইয়ের একমুঠ খড় ধরারও কোন অনুমতিও ছিলো না কারো। পরিবারের প্রায় সব সদস্যই তার বাধ্য ছিলো। মিজানুর ছিলো মায়ের সবচাইতে অনুগত, অনুসারী আর আদরের। ভ্রাতৃবধূদের অবজ্ঞা এবং ভর্ৎসনায় সে মায়ের চাইতেও পারঙ্গমতা অর্জন করেছিলো। যা জয়গুননেছার যোগ্য উত্তরসূরি তৈরি নিশ্চিত করেছিলো।
সে রকম অনেক দিনে বাড়িতে খাবারের গড়াগড়ি থাকলেও বাড়ির বধূরা পাতিল কাচিয়ে পাতে দু’এক লোকমা ভাত উঠাতো। এবং জয়গুণনেছার মতে মেয়েলোকের আবার এত লাগে নাকি সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আধপেটা খেয়েও পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে বাধ্য হতো। শরীফ ও সম্ভ্রান্ত বধূ নির্বাচনে এ পরিবারের দৃষ্টি শকুনের মতোই তীক্ষè ছিলো, ফলে বধূরাও ভাল অবস্থাপন্ন এবং নামডাকওয়ালা পরিবারের ছিলো। কিন্তু জয়গুননেছার পরিবারে আগমনের পর তারা খুব সাধারণ ঘরের বলেই বিবেচিত হতো । তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা এবং অবহেলায় বাড়ির বধূর উপযুক্ত তুলনা ছিলো পায়ের স্যান্ডেল। স্যান্ডেল যেমন প্রয়োজনেই বদলে ফেলা যায় বধূও সেরকম প্রয়োজনে বদলে ফেলা সম্ভব বলে একটা ধারণা খুব কঠিনভাবেই চালু করা ছিলো।
মিজানুরের বাড়ির সীমানা ছিলো বিশাল। সেখানে ছিলো পাঁচঘর আশ্রিতা পরিবার। মেঘনার ভাঙ্গনে এরকম বেশ কিছু পরিবার ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হবার পর গ্রামের অবস্থাপন্ন গৃহস্থের বাসায় কোন রকম ঠাঁই করে নিয়েছিলো। গ্রামের অন্য অবস্থাপন্ন পরিবারের তুলনায় মিজানুরের বাড়িতেই ঠাঁই নেয়া পরিবারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিলো। পোষা প্রাণীর মতোই তারা বাড়িতে থাকতো এবং প্রভু ভক্তিতে লেজ নাড়তো। জয়গুননেছা তাদের অনুগত্যে লোভের কাঁটা ছড়িয়ে দিতেন। এ সকল আশ্রিত পরিবারের কাছে জয়গুন নেছা মায়ের আসনে আসীন ছিলেন। তাদের জন্য তার হাত প্রশস্ত ছিলো। সে সব দিনে মেঘনায় প্রচুর মাছ ছিলো, উঠোনো টাল করে মাছ রাখা হোত এবং বড় কড়াইয়ে রান্না করা হতো। উদ্বৃত্ত মাছ দিয়ে বানানো হতো শুঁটকি। জয়গুন নেছা অকাতরে তাদের দিতেন মেঘনার মাছ, গাছের আমের সত্ত্ব, বরইয়ের সত্ত্ব, শুঁটকি মাছ, ঢাকা ও করাচি থেকে ছেলে ও মেয়েদের নিয়ে আসা ফল-ফলাদি ও বিস্কিটের শেষাংশ। এসবের বিনিময়ে তারা জয়গুন নেছার গুণকীর্তন আর বন্দনা করতো, নিরঙ্কুুশ ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে টিকে থাকার জন্য প্রার্থনা জানাতো।
বাড়ির বউদের চোখের সামনেই জয়গুন নেছার এ উদারতা প্রদর্শনের মহড়া চলতো। তারা আড়ালে-আবডালে বউদের অসতর্ক ছোটখাটো ভুল, সামান্য ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ জয়তুন নেছার কানে দিয়ে আরো কাছের ও প্রাণের মানুষের পরিণত হতো। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বৌদের এরকম অসহায় অবস্থার জন্য মনে মনে দুঃখ করলেও প্রকাশ্যে তারা ছিলো জয়গুননেছার একান্ত সমর্থক। মুখের উপর কোন প্রকার রা করার সাহস তাদের কারোরই ছিলো না। জয়গুন নেছার বিরাগভাজন হয়ে নিজেদের ক্ষতি করার মতো বোকামিও তারা করতো না। সে সমস্ত দিনে মিজানুরদের বাড়িতে এইসব আশ্রিত মানুষ ছাড়াও বহু মানুষের পাত পড়তো, অসংখ্য মানুষ ওদের দানায় ধন্য হয়ে যেতো। জায়গীর থাকা মাস্টার, মসজিদের হুজুর, দূর গ্রামের যাত্রীর খাবারের পাতও মিজানুরদের বাড়িতেই বেশি হতো। জয়গুন তাদের খাবার বৈঠকখানায় পাঠাতেন। কাউকে কাউকে বেশ তমিজের সাথেই খাওয়ানো হতো। এরকম আদরের আপ্যায়নে তুষ্ট হয়ে কেউ কেউ উচ্চৈঃস্বরে জয়গুনের প্রশংসা ও দোয়া করতেন। এবং মায়ের দীর্ঘ জীবন কামনা করতেন।
জয়গুননেছার শেষ সময়ে ছেলেরা তাকে শহরে এনেছিলো। সেজো ছেলের কাছে থাকতেন তিনি। সে ব্যবস্থা ছিলো অত্যন্ত সুব্যবস্থা। বিশাল সরকারী কোয়ার্টারে তিনি থাকতেন এবং সপ্তাহের প্রায় দিনই তার কোন না কোন অনুগত বাধ্য, মাতৃভক্ত ছেলে তাকে দেখতে আসতেন। তার জন্য নিয়ে আসতেন মৌসুমী ফল, তালমিশ্রি এবং বিভিন্ন খাবার। এ সময় থেকেই জয়গুননেছার নাতি-নাতনীরা দেশের বাইরে বিদেশে অবস্থান শুরু করেছে। তারাও তার জন্য নরম বিছানা, তুলতুলে জুতা, পশমী চাদর, কার্ডিগানসহ নানা উপহার সামগ্রী পাঠাতেন। জয়গুন দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। একেবারে বিয়ের বয়স ফুরিয়ে বিয়ে করা মিজানুরের বউও দেখে যেতে পেরেছিলেন। মিজানুর প্রায় প্রতিদিনই ভাইয়ের বাসায় মাকে দেখতে আসতেন এবং মাঝে মাঝে ভাইয়ের বাসায় অবস্থান করতেন। সে সময়ও তিনি পারিবারিক রাজনীতির কূটচাল চালতেন এবং অতীতের নানা ঘটনা, ক্রটি-বিচ্যুতি নিয়ে মায়ের সাথে আলোচনা করতেন। সে আলোচনা হতো দীর্ঘস্থায়ী এবং নদীর স্রোতের মতো বহমান।
জয়গুননেছার মৃত্যুর পর সে সব দিনের প্রতি অহংবোধ ও বিফল ব্যথা পোষণ ছাড়া পিতৃভূমির সাথে এ পরিবারের সম্পর্ক একবারেই ছিন্ন হয়ে যায়। নদী ভাঙ্গনে ধুয়ে যায় পুরোনো ভিটা। ফসলী জমির ওপর করা নতুন ভিটেতে গাছপালাহীন পোড়ো বাড়ির মতো পুরোনো একটা ঘর দাঁড়িয়ে থাকে ন্যাড়া হয়ে।

গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দুঃখিত!