সেদিন ছিল চন্দ্রমাসের ২ রজব। ভোররাত্রি থেকেই আকাশ থেকে গরম পানির বর্ষণ শুরু হলো। আর মাটি ফেটে উঠতে লাগল ভীষণ ঠান্ডা পানি। উভয় পানির মিশ্রণ ঘটতেই শুরু হলো বাতাসের রুদ্র রোষ। সময় যতই অতিবাহিত হতে লাগল, বাতাস ও পানির প্রচণ্ডতাও তত বৃদ্ধি পেতে লাগল। অল্প সময়ের মধ্যেই মাটির উপর অনেক পানি জমে গেল। দুপুরের মধ্যেই শুষ্ক মরুভূমির উপর দিয়ে বয়ে যেতে লাগল প্রবল স্রোত।
ফলে হযরত নূহ (আঃ)-এর জাহাজ পানির উপর ভেসে উঠল। তখন কিছু লোক পানির মধ্যে সাঁতরে জাহাজের নিকটে আসার চেষ্টা করছিল, কিন্তু স্রোতের তীব্র আঘাতে তারা অন্যদিকে ভেসে গেল।
বালুময় শুষ্ক মরুভূমিতে এমন তেজস্বী স্রোতের ধারা বয়ে যাওয়া কোনো দিন রূপকথায়ও শোনা যায়নি। তাই হযরত নূহ (আঃ) জাহাজ তৈরি করার সময় দেশের নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সকলেই তাঁকে উপহাসের ভাষায় আলোচনা করত। কিন্তু যখন বাস্তব অবস্থা চোখের সামনে দেখা দিল, তখন তাদের জ্ঞান ফিরে এল। আল্লাহর নবীর প্রতি এবং তাঁর বাণীর প্রতি তখনই তাদের বিশ্বাস জাগ্রত হলো।
নবীর অনুসন্ধানে অনেকে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল, কিন্তু প্লাবনের গতি তখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। ফলে ঘর থেকে বেরিয়ে কেউই আর রেহাই পেল না। স্রোতের কঠিন আঘাতে মানুষ ছিটকে কে কোথায় চলে গেল—তার আর কোনো খোঁজ রইল না।
বাতাসের প্রচণ্ড আঘাতে সমস্ত গাছপালা উপড়ে স্রোতের টানে তীব্র গতিতে অজানা গন্তব্যে ভেসে যেতে লাগল। ঘর, দালান, প্রাসাদ—কিছুই অবশিষ্ট রইল না। একে একে সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
হযরত নূহ (আঃ)-এর পুত্র কেনান অতি উচ্চ এক পর্বতে গিয়ে আশ্রয় নিল। কিন্তু যখন পাহাড় ডুবে যেতে লাগল এবং পানি আরও উপরে উঠতে থাকল, তখন সে আল্লাহর নামে তাসবীহ পাঠ করতে শুরু করল। কিন্তু নিষ্ঠুর ঝড় তাকে রেহাই দিল না। বাতাসের এক প্রচণ্ড ঝাপটা এসে তাকে পাহাড়ের গায়ে আছাড় মেরে ফেলল। এতে তার মাথা ও শরীরের সমস্ত হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল। তার লাশ পানির স্রোতে ভেসে অজানা দেশে চলে গেল।
বড় বড় পর্বতগুলোর চূড়া ভেঙে ভেঙে পানিতে পড়তে শুরু করল। পৃথিবীর কোনো জীবজন্তুর অস্তিত্ব তো দূরের কথা, মাটিও স্থির থাকল না। সমগ্র পৃথিবী সমতলে পরিণত হলো। পৃথিবীর যেসব জীবজন্তু হযরত নূহ (আঃ)-এর জাহাজের বাইরে ছিল, কেউই রেহাই পেল না। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতমালার চূড়া থেকে চল্লিশ গজ পর্যন্ত পানি উঠেছিল। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটা যেন অতল সমুদ্রের মাঝে তলিয়ে গেছে।
হযরত নূহ (আঃ) তাঁর সঙ্গী-সাথী ও জীবজন্তুদের নিয়ে জাহাজে নিরাপদে অবস্থান করছিলেন। জাহাজ নিজ গতিতে কোথায় চলছিল, যাত্রীরা তার কোনো খবরই রাখত না। জাহাজ অধিকাংশ সময় বায়তুল্লাহর চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে তাওয়াফ করছিল। আল্লাহ তায়ালা এই বিভীষিকাময় তুফান ও প্লাবনের মধ্যেও সেই জাহাজকে নিরাপদ রেখেছিলেন। যাত্রীরা এই ভয়াবহ প্রলয়ের ভেতরেও নিরাপদে ছিলেন এবং বাহিরের অবস্থার কিছুই টের পাননি।
একসময় জাহাজের ভেতরে ময়লা-আবর্জনা জমে খুব নোংরা হয়ে গেল। তখন হযরত নূহ (আঃ) হাতির মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে জাহাজ পরিষ্কার করার নির্দেশ দিলেন। হাতি তার সুড়ের সাহায্যে বাহিরের পানি এনে জাহাজ ধুয়ে ময়লা-আবর্জনা বাইরে ফেলতে শুরু করল। এভাবে সে পুরো জাহাজটি পরিষ্কার করে দিল।
ইবলিস জাহাজের মধ্যে কয়েক মাস আত্মগোপন করে ছিল। একদিন তার মাথায় কুবুদ্ধি এলো—সে শূকরের কাছে গিয়ে তার নাকে হাত বুলিয়ে সুড়সুড়ি দিল। শূকর তখন জোরে হাঁচি দিল, আর সাথে সাথেই তার নাকের ভেতর থেকে ইঁদুর বেরিয়ে এলো। ইঁদুরগুলো দৌড়ে জাহাজের নিচতলায় গিয়ে কাঠ কাটতে শুরু করল।
ইবলিসের উদ্দেশ্য ছিল—ইঁদুর দিয়ে জাহাজে ছিদ্র করিয়ে দিলে তাতে পানি ঢুকে জাহাজটি তলিয়ে যাবে। এ খবরটি কবুতর গিয়ে হযরত নূহ (আঃ)-এর কাছে জানাল। তখন হযরত নূহ (আঃ) পশুদের এলাকায় এসে জিজ্ঞেস করলেন, “ইঁদুর এসেছে কোথা থেকে?”
শূকর উত্তর দিল, “হুজুর! ইবলিস এসে আমার নাকে সুড়সুড়ি দিলে আমি জোরে হাঁচি দিই, আর তখনই আমার নাক থেকে কয়েকটি ইঁদুর বেরিয়ে আসে। ইবলিস পৃথিবীতে বসে কয়েক দিন আগে ছোট ছোট কয়েকটি ইঁদুরছানা আমার কানে গুঁজে দিয়েছিল। মনে হচ্ছে, সেই ইঁদুরগুলিই আমার নাক দিয়ে বেরিয়ে গেছে।”
হযরত নূহ (আঃ) তখন বললেন, “ইবলিস আমার অনুমতি ছাড়া জাহাজে উঠল কীভাবে?”
ইবলিস জবাব দিল, “হে আল্লাহর নবী! আমি আপনার আদেশ ছাড়া জাহাজে উঠিনি। আপনি যখন আপনার পুত্র কেনানকে জাহাজে উঠতে শেষবারের মতো বলছিলেন, তখন তাকে গালির ছলে বলেছিলেন—‘উঠ, শয়তান! জাহাজে উঠ।’ তখন আমি আপনার সেই কথাটিকে নিজের প্রতি নির্দেশ মনে করে জাহাজে উঠে পড়ি। অতএব আমাকে অবৈধভাবে প্রবেশকারী বলতে পারবেন না।”
হযরত নূহ (আঃ) ইবলিসের এই কৌশলী কথার কোনো জবাব দিতে পারলেন না।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্লাবন-২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।