পুপাই আজ একটা গল্প লিখে ফেলেছে। বাবা, মা, দাদুভা্ই, দিয়া, ঠাম্মা, দাদু, মাসি, পিসি, কাকু, কাকি সবাই উদগ্রীব পুপাইয়ের গল্প শোনার জন্য। পুপাই বিজ্ঞান আর অংকে বেশ ভালো। কিন্তু পদ্য, গদ্য লিখতে বললেই সে পড়ে মহা ফ্যাসাদে। দুটো, তিনটে পেনসিল ভেঙ্গে, গালে টোকা মেরে, মাথায় গোঁত্তা মেরেও যখন পুপাইয়ের গল্প বেরোয় না, তখন পুপাইয়ের কাঁদা ছাড়া আর কোনওই গত্যন্তর থাকে না। তার চোখ থেকে বড়ো বড়ো জলের ফোঁটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মা ছুটে আসেন কাজ ফেলে। পুপাইয়ের চোখের জল দেখলেই মার বুক ধরাস্, ধরাস্, মন কেমন কেমন। মা পুপাইকে কোলে বসিয়ে, চোখ মুছিয়ে বলেন, “পুপাইসোনা কেঁদোনা। লেখো, আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার।” বাবার আবার অফিসে যাবার তাড়া। বাবা বুঝলেন, বেগতিক্। এখন মার আর ছেলের সোহাগে, তাঁর রান্নাটা না হয়ে যায় বানচাল্। তাড়াতাড়ি সামাল দিতে তিনি বলেন, “লেখো। বৃষ্টি নামেনি এখনোও। নামবে নামবে করছে।“ মাসির আবার বাংলায় ভারী দখল। কারণে অকারণে ভারী ভারী বাংলা শব্দ ব্যবহার করতে তিনি ভালোবাসেন। পুপাইয়ের কান্না দেখে তিনি সাহায্যে এগিয়ে এলেন। “পুপাই, লেখো। বজ্রগম্ভীর স্বরে আকাশ কম্পিত।“ পিসির আবার খুব গানের বাই। পিসি তার ববকাট্ চুলে দোলা তুলে বললেন, “মেঘমল্লারে লেগেছে ঝঙ্কার।” দাদু, দিয়া, মা, বাবা, পিসি, মাসি, কাকু, কাকি সবার লেখাতে সমৃদ্ধ হয়ে পুপাই দিগ্বীজয়ী হাসি নিয়ে গল্প ঝোলাতে পুরে রোজ ইস্কুলে যায়।
সেই পুপাই আজ দুইদিন ধরে দরজা বন্ধ করে লিখছে। শুধুই লিখছে। বড় বড়, মোটা মোটা, ভারী ভারী বই দেখছে, আর গল্প লিখছে। মাথায় নাকি তার জব্বর প্লট এসেছে। তাই সে দুইদিন ধরে কানে পেনসিল্ গুঁজে, চোখের চশমা নাকের ডগায় এনে, মাথার চুল এলো্মেলো করে সে ক্রমাগতই লিখে চলেছে। একনাগাড়ে। অবিশ্রান্তভাবে। শুধু মাঝে মাঝে তার যখন খিদে পাচ্ছে, দরজাখানা হাল্কা খুলে “মা” বলে ডাক দিচ্ছে। মা শশব্যস্ত হয়ে প্লেট ভর্ত্তি খানকয়েক লুচি, গোটাদুই রসগোল্লা, আর খান পাঁচেক বেগুনভাজা দরজার ফাঁক দিয়ে চালান করে দিচ্ছেন। দশটা নয়, পাঁচটা নয়, একটাই ছেলে তাঁর। গল্প লেখা কি সোজা কথা? বুদ্ধি দিয়ে, মগজ দিয়ে লেখা! খালি পেটে আর যাই হোক, গল্প লেখা যায় না। পুপাইয়ের তাই পৃথিবীজোড়া খিদে আর মার অনবরত খাবার সাপ্লাই। বাবা এতে বেশ বিরক্ত। হঠাৎ করেই তাঁর প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের প্রতি মার নজর কমতি। বাকিরা মানে মা, পিসি, মাসি, কাকু, কাকি সবাই অবশ্য উদ্বিগ্ন, অধীর পুপাইয়ের কখন গল্প লেখা হয়! তার গল্প শোনার জন্য।
এদিকে পুপাইয়ের থেকে পাঁচবছরের ছোট বোন তুতাইয়ের ভারী মজা! চার পাচঁদিন ধরে দাদা ঘরের দরজা দিয়ে গল্প লিখতে শুরু করা ইস্তক্, তার ওপর সবাই কেমন আগ্রহহীন। সবাই দাদাকে নিয়েই ব্যস্ত। দাদার জন্য সবাই ভেবে ভেবেই সারা! এই আচমকা স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে তার ভারী আমোদ। নানারকম কৌতূহল নিবারণের চেষ্টায় সে তাই সদাই ব্যস্ত। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে সে একেবারেই নারাজ। যেমন, তার দৃষ্টি এখন একটা ছোট্ট মরা পোকাতে নিবদ্ধ। সে লুচি, মাংস খেয়েছে। মাছ, ভাত খেয়েছে। ললিপপ্, লজেঞ্চুস্ খেয়েছে। কিন্তু পোকা সে কখনোও খায়নি। খুউব গভীর মনোসংযোগে সে মরা পোকাটাকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষন করে। তার নির্জীবতা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে টুপ করে দুটো ঠ্যাং ধরে মুখে পুরে দেয় সে। পরক্ষণেই তিক্ত স্বাদে বিরক্ত হয়ে থুঃ থুঃ করে মাটিতে অবশিষ্টাংস ছুঁড়ে ফেলে। অন্যসময়ে এই অনাবশ্যক কৌতূহলে তার নির্ঘাৎ শাস্তি প্রাপ্তি ছিল। কিন্তু আজ মাসি, পিসি, কাকি, কাকু সবাই ব্যাপারটা নিরীক্ষণ করেও উপেক্ষা করলো। কারণ এখন সবাই উদ্বিগ্ন, সবার মনই উচাটন। দাদা নাকি একটা গল্প লিখছে। দুইদিন ধরেই দাদা লিখে চলেছে। সে দাদার ঘরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যখন এসব কার্য্যকলাপে ব্যস্ত, ঠিক তখনই সবাইকে চমকে দিয়ে বন্ধ দরজা ঠেলে তার দাদা পুপাই বেড়িয়ে এল। চুল এলোমেলো, উস্কোখুস্কো। চশমা নাকের ডগায়। ভারী লাল খাতা তার ডান হাতে, বাঁ হাতে কালো কলম। আঙুলে কালো কালির ছাপ। দাদা বাঁ হাতে লেখে। অনেক চেষ্টা করেও দাদার বাঁ হাতে লেখা বন্ধ করা যায়নি। দাদার মুখে একগাল হাসি। মা, কাকা, পিসি, মাসি, দাদুভাই, দিয়া সবাই ছুটে এলেন। হইহই, রইরই করে। সবার চোখেই এক প্রশ্ন, গল্প লেখা শেষ হলো? হলো তোমার গল্প লেখা? বাবা শুধু চশমাটা নাকের ডগায় এনে, আড়চোখে তাকিয়ে আবারোও কাগজ পড়ায় মনোনিবেশ করলেন। মা ছুটে এসে একটা মোড়া টেনে বসে বললেন, “পুপাইসোনা, গল্প পড়ো। আমরা শুনি।” পুপাই মার পাশের চেয়ারে বসে চশমার ফাঁক দিয়ে সবাইকে একবার দেখে নিলো। গল্প লেখা তো আর যে সে কথা নয়! রীতিমতো গোটা দশেক মোটা মোটা ভারী ভারী বই পড়ে, চার-পাঁচখানা পেনসিল ভেঙ্গে, গোটাদুই খাতায় লিখে, পড়ে, কেটে সে শেষ পযযন্ত একটা জুতসই গল্প লিখেছে।
সবার মনোযোগ না থাকলে তার লেখাটা বাতুলতা, পড়াটা অনাবশ্যক। পুপাই চারদিক নিরীক্ষণ করে যখন বুঝলো যে সবাই মনযোগী, এমনকি তার পাঁচ বছরের ছোট বোনটাও যখন এক হাতে তার চুল ধরে আর আরেকহাতে চারটে আঙুল মুখে পুরে গভীর মনযোগ সহকারে তার দিকে তাকিয়ে আছে, পুপাই বুঝলো, সময় এখন প্রশস্ত। সে পাতা উল্টে, গলা খাঁকারি দিয়ে গল্প পড়তে শুরু করলো, “এক ছিলো কচ্ছপ। তার নাম কচ্ছপ। কচ্ছপ থাকতো তার মা, বাবা, আর বোনের সঙ্গে সমুদ্রের ধারে। বালির মধ্যে গর্ত্ত খুঁড়ে, একটা গর্ত্তের মধ্যে। মাঝেমাঝে তার যখন খিদে পায়, সে বেড়িয়ে আসে, খায়, আকাশের দিকে চায়, তারপর ঢুকে পড়ে গর্ত্তে আবার। কচ্ছপের পৃথিবীতে থেকে থেকে ঘেন্না ধরে গেছে। সে তাই চাঁদে যেতে চায়। শুনেছে চাঁদে গেলে তার ওজন কমে যাবে – আর যা খুশী করতে পারবে। কিন্তু আজ বাইরে এসে দেখে, আকাশের মুখ ভার। বৃষ্টি নামবে নামবে করছে। চাঁদের দেখা আর মেলেনি। তাই কচ্ছপের মন ভাল নয়। তার স্বপ্ন দেখার ব্যাঘাত ঘটেছে আজ। কচ্ছপ শুনেছে চাঁদের পাহাড়ের কথা। সেই পাহাড়ে এখনোও কোনও কচ্ছপ থাকেনি। চাঁদের পাহাড়ের গল্প শুনে তার ভারী লোভ সেই পাহাড় দেখার। আর তাছাড়া, সে চাঁদে গেলে, সেখানে কোনও কচ্ছপের এই প্রথম যাওয়া হবে। মানুষের মধ্যে চাঁদে প্রথম গেছিলেন নীল আর্মষ্ট্রং এবং এডুইন অল্ড্রিন্। আ্যপেলো ১১ তে, উনিশশো উনসত্তরে। সেদিন তাঁরা প্রায় তিন ঘন্টা ধরে হেঁটেছিলেন চাঁদে। সেসময় রিচার্ড নিক্সন ছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। নীল আর্মষ্ট্রং ওহায়োর ওয়াপাকোনেটাতে উনিশশো ত্রিশ সালে জন্মেছিলেন। উনি কোরিয়ান যুদ্ধে যোগদানের পর, কলেজের পড়া শেষ করে এখনকার নাসাতে যোগদান করেন। নীল আর্মষ্ট্রং এর খুব ছোট থেকেই উড়োজাহাজ সম্পর্কে কৌতুহল ছিল। তিনি মাত্র ষোল বছর বয়সেই ছাত্র পাইলটের লাইসেন্স অর্জন করেছিলেন। রাত্রি দশটা ছাপান্নতে আর্মষ্ট্রং চাঁদে পদার্পণ করে বলেছিলেন, ‘মানুষের জন্য ছোট পদক্ষেপ। কিন্তু সমগ্র মানুষ প্রজাতির জন্য বিশাল উত্তরণ।’ এই সমগ্র মানুষ প্রজাতির উদ্ভাবন হোমোস্যাপিয়েনস্ থেকে, যার সূচনা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে। কচ্ছপ চুক্ চুক্ করে এসবই ভাবছিল। মানুষের আগমন দুশো হাজার বছর আগে। কচ্ছপের তিনশো পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর আগে। অথচ মানুষেরা চাঁদে চলে গেলো। আর কচ্ছপেরা এই পৃথিবীর মাটিতেই খেয়ে, ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল জীবন। এখনও মাটিতে গর্ত খুঁড়ে তাকে থাকতে হয়। এসব ভাবতে ভাবতে কচ্ছপ আবারোও আকাশের দিকে তাকিয়ে তার বাসাতে ঢুকে গেলো একরাশ বিরক্তি নিয়ে। মাটির নীচে গিয়ে মনে খুব দুঃখবোধ নিয়ে সে তার খোলশের ভিতরে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে চাঁদের দেশের চাঁদের পাহাড়ে চলে গেল।”
পুপাই তার গল্প শেষ করে চশমাটাকে আলতো টোকা মেরে নাকের ডগায় তুলে সবার দিকে গর্বিত মুখে তাকালো। মন তার প্রশংসাপ্রাপ্তির আশায় বড়োই বিচলিত। মাসি, মেসো, কাকু, কাকি, পিসি, পিসে সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন, “বাহ্। পুপাইসোনা কি দারুণ হয়েছে তোমার লেখা!” মনে মনে তারা যখন গল্পের সারমর্ম বোঝার চেষ্টা করছিলেন, তখন বাবা হঠাৎ গলা খাঁকারি দিয়ে মার উদ্দেশ্য বললেন, “ভাত বাড়ো। আমি স্নানে চললাম। অফিসে আমার আজ আবার জরুরী কাজ আছে।“ মুখে তাঁর প্রশান্তি। মনে তাঁর শান্তি। আপদ শেষ। এবারে তাঁর যত্ন আবারও খানিকটা হবে। মা অবশ্য দমবার পাত্র নন একেবারেই। মা বললেন, “পুপাই সোনা, খাবে চলো।” এ তো আর যাহোক তাহোক গল্প নয়। এই গল্পে মাটি আছে, আকাশ আছে, চাঁদ আছে, দেশ আছে, আমেরিকা আছে, আফ্রিকাও আছে। আবার মানুষও আছে, কচ্ছপ আছে, নীল আর্মষ্ট্রংও আছেন। মা মনে মনে ভাবলেন, এতো কিছু নিয়ে গবেষণা করে লেখা তো আর সোজা, সরল কাজ নয়। মা তাই আলগোছে, সস্নেহে পুপাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “কি খাবে পুপাইসোনা? তোমার জন্য খানচারেক রসগোল্লা, দুখানা সন্দেশ, তিনখানা জিবেগজা, লুচি আর হালুয়া রেখেছি। চলো সোনা খাবে চলো।” পুপাইয়ের মুখে বিশ্বজয়ীর হাসি। মার পিছু পিছু সে গর্বিত পদক্ষেপে চলে যেতে যেতে তার বোন তুতাইয়ের উদ্দেশ্যে বু্ড়ো আঙুল আর মধ্যমাতে টুসকি দেওয়ার মত একটা ভঙ্গী করলো। দুভাইবোনের এই সাঙ্কেতিক আলাপন আর কেউ না দেখলেও, পুপাইয়ের বোন তুতাই বাঁ হাতের তর্জনীতে চুল পাকিয়ে, ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা মুখে ঢুকিয়ে তার গোলাপী ফ্রকে ঝাপটা মেরে শুধু বললো, “ফুঃ।”