পুঁই মাচা-৫ম অংশ–বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর গল্প

ক্ষেত্তি মা’র মুখের দিকে একটুখানি চাহিয়া থাকিয়া একবার ভূপতিত মেটে আলুটার দিকে চাহিল, পরে পুনরায় মা’র মুখের দিকে চাহিয়া লইল, তাহার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল, কিন্তু মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না।
অন্নপূর্ণ কড়া সুরে বলিলেন-কথা বলছিল নে যে বড়? এই মেটে আলু তুই এনেছিস কিনা?
ক্ষেত্তি বিপন্ন-চোখে মা’র মুখের দিকেই চাহিয়াছিল, উত্তর দিল-হ্যা।
অন্নপূর্ণ তেল-বেণ্ডনে জ্বলিয়া উঠিয়া বলিলেন–পাজি, আজ তোমার পিঠে আমি আস্ত কাঠের চেলা ভাঙব তবে ছাড়ব, বরোজপোতার বনে গিয়েছ মেটে আলু চুরি করতে সোমন্ত মেয়ে, বিয়ের যুগ্যি হয়ে গেছে কোন কালে, সেই একগলা বিজন বন, তার মধ্যে দিনদুপুৱে ৰাঘ লুকিয়ে থাকে, তার মধ্যে থেকে পরের আলু নিয়ে এল তুলে যদি গোসাইরা চৌকিদার ডেকে তোমায় ধরিয়ে দেয়? তোমার কোন শ্বশুর এসে তোমায় বাচাত? আমার জোটে খাব, না-জোটে না-খাৰ, তা বলে পরের জিনিসে হাত? এ মেয়ে নিয়ে আমি কী করব, মা?
দু-তিনদিন পরে একদিন বৈকালে ধুলামাটি মাখা হাতে ক্ষেত্তি মাকে আসিয়া বলিল-মা মা, দেখবে এসো…
অন্নপূর্ণা গিয়া দেখিলেন, ভাঙা পাচিলের ধারে যে ছোট খোলা জমিতে কতকগুলা পাথরকুচি ও বন্টিকারীর জঙ্গল হইয়াছিল, ক্ষেত্তি ছোটবোনটিকে লইয়া সেখানে মহাউৎসাহে তরকারির আওলাত করিবার আয়োজন করিতেছে এবং ভবিষ্যসম্ভাবী নানাবিধ কাল্পনিক ফলমূলের অগ্রদূত-স্বরূপ বর্তমানে কেবল একটিমাত্র শীর্ণকায় পুঁইশাকের চারা কাপড়ের ফালির গ্রস্থি-বন্ধনে বন্ধ হইয়া ফাসি হইয়া যাওয়া আসামির মতোন উর্ধ্বমুখে একখণ্ড শুষ্ক কঞ্চির গায়ে ঝুলিয়া রহিয়াছে। ফলমূলাদির অবশিষ্টগুলি আপাতত তার বড়মেয়ের মস্তিষ্কের মধ্যে অবস্থিতি করিতেছে, দিনের আলোয় এখনও বাহির হয় নাই।
অন্নপূর্ণ হাসিয়া বলিলেন, দূর পাগলী, এখন পুঁইডাটার চারা পোতে কখনো বর্ষাকালে পুততে হয়। এখন যে জল না-পেয়ে মরে যাবে।
ক্ষেত্তি বলিল-কেন, আমি রোজ জল ঢালব?
অন্নপূর্ণা বলিলেন-দাখ, হয়তো বেঁচে যেতে পারে। আজকাল রাতে খুব শিশির হয়।

খুব শীত পড়িয়াছে। সকালে উঠিয়া সহায়হৰি দেখিলেন, তাহার দুই ছোটমেয়ে দোলাই গায়ে বাঁধিয়া রোদ উঠিবার প্রত্যাশায় উঠানে কাঠালতলায় দাড়াইয়া আছে। একটা ভাঙা বুড়ি করিয়া ক্ষেত্তি শীতে কাঁপতে কাঁপতে মুখুয্যেবাড়ি হইতে গোবর কুড়াইয়া আনিল। সহায়হরি বলিলেন–হা মা ক্ষেত্তি, তা সকালে উঠে জামাটা গায় দিতে তোর কী হয়? দেখ দিকি, এই শীত ।
-আমি দিচ্ছি বাবা, কই শীত, তেমন তো…
—হ্যা, দে মা, এক্ষুনি দে-অসুখ-বিসুখ পাচরকম হতে পারে বুঝলি নে?–

সহায়হরি বাহির হইয়া গেলেন, ভাবিতে ভাবিতে গেলেন, তিনি কি অনেকদিন মেয়ের মুখে ভালো করিয়া চাহেন নাই? ক্ষেত্তির মুখ এমন সুশ্ৰী হইয়া উঠিয়াছে।
জামার ইতিহাস নিম্নলিখিতরূপ
বহু বৎসর অতীত হইল, হরিপুরের রাসের মেলা হইতে সহায়হরি কালো সার্জের এই আড়াই টাকা মূল্যের জামাটি ক্রয় করিয়া আসেন। ছিড়িয়া যাইবার পর তাহাতে কতবার রিপু ইত্যাদি করা হইয়াছিল, সম্প্রতি গত বৎসর হইতে ক্ষেত্তির স্বাস্থ্যোন্নতি হওয়ার দরুন জামাটি তাহার গায়ে হয় না। সংসারের এসব খোঁজ সহায়হরি কখনও রাখিতেন না। জামার বর্তমান অবস্থা অন্নপূর্ণারও জানা ছিল না—ক্ষেত্তির নিজস্ব ভাঙা টিনের তোরঙ্গের মধ্যেই উহা থাকিত ।
পৌষ-সংক্রাত্তি। সন্ধ্যাবেলা অন্নপূর্ণ একটা কাসিতে চালের গুঁড়া, ময়দা ও গুড় দিয়া চটকাইতেছিলেন-একটি ছোট বাটিতে একবাটি তেল। ক্ষেত্তি কুরুনির নিচে একটা কলার পাতা পাড়িয়া এক মালা নারিকেল কুরিতেছে। অন্নপূর্ণ প্রথমে ক্ষেত্তির সাহায্য লইতে স্বীকৃত হন নাই, কারণ সে যেখানে সেখানে বসে, বনে-বাদাড়ে ঘুড়িয়া ফেরে, তাহার কাপড়চোপড় শান্ত্রসন্মত ও শুচি নহে। অবশেষে ক্ষেত্তি নিতান্ত ধরিয়া পড়ায় হাতপা ধোয়াইয়া ও শুদ্ধ কাপড় পরাইয়া তাহাকে বর্তমান পদে নিযুক্ত করিয়াছেন।
ময়দার গোলা মাখা শেষ হইলে অন্নপূর্ণ উনুনে খোলা চাপাইতে যাইতেছে, ছোটমেয়ে রাধা হঠাৎ ডান হাতখানা পাতিয়া বলিল-মা, ঐ একটু…

পুঁইমাচা ৬ষ্ঠ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!