পুঁই মাচা-৪র্থ অংশ–বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর গল্প

দিন দুই-পরের কথা। সকালে উঠিয়া সহায়হরি উঠানে বাতাবিলেবু গাছের ফাক দিয়া যেটুকু নিতান্ত কচি রাঙা রৌদ্র আসিয়াছিল, তাহারই আতপে বসিয়া আপনমনে তামাক টানিতেছেন। বড়মেয়ে ক্ষেত্তি আসিয়া চুপি চুপি বলিল— বাবা, যাবে না? মা ঘাটে গেল… .
সহায়হরি একবার বাড়ির পাশে ঘাটের পথের দিকে কী জানি কেন চাহিয়া দেখিলেন, পরে নিম্নস্বরে বলিলেন—যা শিগগির শাবলখানা নিয়ে আয় দিকি!–কথা শেষ করিয়া তিনি উৎকণ্ঠার সহিত জোরে জোরে তামাক টানিতে লাগিলেন এবং পুনরায় একবার কী জানি কেন খিড়কির দিকে সতর্কভৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। ইতিমধ্যে প্রকাণ্ড বাড়ি একটা লোহার শাবল দুইহাত দিয়া আঁকড়াইয়া ধরিয়া ক্ষেত্তি আসিয়া পড়িল—তৎপরে পিতা-পুত্রীতে সন্তপণে সম্মুখের দরজা দিয়া বাহির হইয়া গেল। ইহাদের ভাব দেখিয়া মনে হইতেছিল—ইহারা কাহারো ঘরে সিঁদ দিবার উদ্দেশ্যে চলিয়াছে।
অন্নপূর্ণ স্নান করিয়া সবে কাপড় ছাড়িয়া উনুন ধরাইবার জোগাড় করিতেছেন, মুখুয্যে বাড়ির ছোট খুঁকি দুর্গা আসিয়া বলিল-খুড়ীমা মা বলে দিলে, খুড়ীমাকে গিয়ে বল মা ছোঁবে না, তুমি আমার নবান্নটা মেখে আর ইতুর ঘটগুলো বার করে দিয়ে আসবে?
মুখুয্যে-বাড়ি ও-পাড়ায়—যাইবার পথের বা-ধরে একজায়গায় শেওড়া, বনভাট, রাংচিতা, বনচালতা গাছের ঘন বন । শীতের সকালে একপ্রকার লতাপাতার ঘন গন্ধ বন হইতে বাহির হইতেছিল। একটা লেজ-ঝোলা হলদে পাখি আমড়াগাছের এ-ডাল হইতে ও-ডালে যাইতেছে।
দুর্গা আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল-খুড়ীমা, খুড়ীমা ঐ যে কেমন পাখিটা—পাখি দেখিতে গিয়া অন্নপূর্ণ কিন্তু আর একটা জিনিস লক্ষ করিলেন। ঘন বনটার মধ্যে কোথায় এতক্ষণ খুপ খুপ্‌ করিয়া একটা আওয়াজ হইতেছিল.কে যেন কী খুঁড়িতেছে…দুর্গার কথার পরেই হঠাৎ সেটা বন্ধ হইয়া গেল। অন্নপূর্ণ সেখানে খানিকক্ষণ থমকিয়া দাড়াইলেন, পরে চলিতে আরম্ভ করিলেন। তাহারা খানিকদূর যাইতে-না-যাইতে বনের মধ্যে পুনরায় খুপ খুপ্ ‌শব্দ আরম্ভ হইল।
কাজ করিয়া ফিরিতে অন্নপূর্ণার কিছু বিলম্ব হইল। বাড়ি ফিরিয়া দেখিলেন, ক্ষেত্তি উঠানের রৌদ্রে বসিয়া তেলের বাটি সম্মুখে লইয়া খোপা খুলিতেছে। তিনি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চাহিয়া দেখিয়া রান্নাঘরে গিয়া উনুন ধরাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। মেয়েকে বলিলেন-এখনও নাইতে যাসনি যে, কোথায় ছিলি এতক্ষণ?
ক্ষেত্তি তাড়াতাড়ি উত্তর দিল—এই যে যাই মা, এক্ষুনি যাব আর আসব। ক্ষেত্তি স্নান করিতে যাইবার একটুখানি পরেই সহায়হরি সোৎসাহে পনেরো-ষোলো সের ভারী একটা মেটে আলু ঘাড়ে করিয়া কোথায় হইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং সম্মুখে স্ত্রীকে দেখিয়া কৈফিয়তের দৃষ্টিতে সেইদিকে চাহিয়াই বলিয়া উঠিলেন-ওই ও-পাড়ার ময়শা চৌকিদার রোজই বলে-কর্তা-ঠাকুর, তোমার বাপ থাকতে তবু মাসে মাসে এদিকে তোমাদের পায়ের ধুলো পড়ত, তা আজকাল তো তোমরা আর আসো না, এই বেড়ার গায়ে মেটে আলু করে দেখেছি, তা দাদাঠাকুর বরং…
অন্নপূর্ণ স্থিরদৃষ্টিতে স্বামীর দিকে চাহিয়া বলিলেন-বরোজপোতার বনের মধ্যে বসে খানিক আগে কী করছিলে শুনি?
সহায়হরি অবাক হইয়া বলিলেন-আমি না আমি কখন? কক্ষনো না, এই তো আমি…সহায়হরির ভাব দেখিয়া মনে হইতেছিল তিনি এইমাত্র আকাশ হইতে পড়িয়াছেন।
অন্নপূর্ণ পূর্বের মতোই স্থিরদৃষ্টির স্বামীর দিকে চাহিয়া বলিলেন—চুরি তো করবেই, তিন কাল গিয়েছে এক কাল আছে, মিথ্যা কথাগুলো আর এখন ৰোলো না …আমি সব জানি। মনে ভেবেছিলে আপণ ঘাটে গিয়েছে আর কী…দুর্গার মা ডেকে পাঠিয়েছিল, ও-পাড়ায় যাচ্ছি, শুনলাম বরোজপোতার বনের মধ্যে কী সব থুপ খুপ্‌ শব্দ. তখনই আমি বুঝতে পেরেছি, সাড়া পেয়ে শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। যেই আবার খানিকদূর গোলাম আবার দেখি শব্দ…তোমার তো ইহকালও নেই, পরকালও নেই, চুরি করতে ডাকাতি করতে, যা ইচ্ছে করো, কিন্তু মেয়েটাকে আবার এর মধ্যে নিয়ে গিয়ে ওর মাথায় খাওয়া কিসের জন্যে?
সহায়হরি হাত নাড়িয়া, বরোজপোতায় তাহার উপস্থিত থাকার বিরুদ্ধে কতকগুলি প্রমাণ উথাপন করিবার চেষ্টা করিতে গেলেন; কিন্তু স্ত্রীর চোখের দৃষ্টির সামনে তাহার বেশি কথাও জোগাইল না বা কথিত উক্তিগুলির মধ্যে কোনো পৌর্বাপর্ষ সম্বন্ধেও খুঁজিয়া পাওয়া গেলে না।…
আধঘণ্টা পরে ক্ষেন্তি স্নান সারিয়া বাড়ি চুকিল । সম্মুখস্থ মেটে আলুর দিকে একবার আড়চোখ চাহিয়াই নিরীহমুখে উঠানের আলনায় অত্যন্ত মনোযোগের সহিত কাপড় মেলিয়া দিতেছিল।
অন্নপূর্ণ ডাকিলেন—ক্ষেত্তি এদিকে একবার আয় তো, শুনে যা…
মায়ের ডাক শুনিয়া ক্ষেত্তির মুখ শুকাইয়া গেল-সে ইতস্তত করিতে করিতে মা’র নিকট আসিলে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন—এই মেটে আলুটা দুজনে মিলে তুলে এনেছিস না?

 

পুঁইমাচা পঞ্চম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!