অন্নপূর্ণা তেলে-বেগুনে জুলিয়া উঠিলেন-কেন, তোমাকে একঘরে করতে বেশিকিছু লাগে নাকি? তুমি কি সমাজের মাথা না একজন মাতব্বর লোক? চাল নেই চুলো নেই, এক কড়ার মুরোদ নেই, চৌধুরীরা তোমায় একঘরে করবে তা আর এমন কঠিন কথা কী? —আর সত্যিই তো এদিকে ধাড়ী মেয়ে হয়ে উঠল।… হঠাৎ স্বর নামাইয়া বলিলেন-হল যে পনেরো বছরের, বাইরে কমিয়ে বলে বেড়ালে কী হবে, লোকের চোখ নেই?…পুনরায় গলা উঠাইয়া বলিলেন না বিয়ে দেবার গা, না কিছু। আমি কি যাব পাত্তর ঠিক করতে।
সশরীরে যতক্ষণ স্ত্রীর সম্মুখে বর্তমান থাকিবেন, স্ত্রীর গলার সুর ততক্ষণ কমিবার কোনো সম্ভাবনা নাই বুঝিয়া সহায়হরি দাওয়া হইতে তাড়াতাড়ি একটি খিড়কী-দুয়ারের একটু এদিকে কী দেখিয়া হঠাৎ থামিয়া গেলেন এবং আনন্দপূর্ণস্বরে বলিয়া উঠিলেন-এসব কী রে? ক্ষেত্তি মা, এসব কোথা থেকে আনলি? ওহ! এ যে…
চৌদ্দ-পনেরো বছরের একটি মেয়ে আর দুটি ছোট ছোট মেয়ে পিছনে লইয়া বাড়ি ঢুকিল। তাহার হাতে একবোঝা পুইশাক, ডাটাগুলি মোটা ও হলদে হলদে, চেহারা দেখিয়া মনে হয় কাহারা পাকা পুঁইগাছ উপড়াইয়া ফেলিয়া উঠানের জঙ্গল তুলিয়া দিতেছিল; মেয়েটি তাহাদের উঠানের জঞ্জাল প্রাণপণে তুলিয়া আনিয়াছে। ছোট মেয়েদুটির মধ্যে একজনের হাত খালি, অপরটির হাতে গোটা দুই-তিন পুইপাতা জড়ানো কোনো দ্রব্য।
বড়মেয়েটি খুব লম্বা, গোলগাল চেহারা, মাথার চুলগুলো রুক্ষ ও অগোছালো-বাতাসে উড়িতেছে, মুখখানা খুব বড়, চোখদুটো ডাগর ডাগর ও শান্ত । সরু সরু কাচের চুড়িগুলো দু-পয়সা ডজনের একটি সেফটিপিন দিয়া একত্র করিয়া আটকানো। পিনটার বয়স খুঁজিতে যাইলে প্রাগৈতিহাসিক যুগে গিয়া পড়িতে হয়। এই বড়মেয়েটির নামই বোধ হয় ক্ষান্তি, কারণ সে তাড়াতাড়ি পিছন ফিরিয়া তাহার পশ্চাদ্বর্তিনীর হাত হইতে পুইপাতা জড়ানো দ্রব্যটি লইয়া মেলিয়া ধরিয়া বলিল-চিংড়ি মাছ বাবা। গয়া খুড়ীর কাছ থেকে রাস্তায় নিলাম, দিতে চায় না, বলে—তোমার বাবার কাছে আর দিনকার দরুন দুটো পয়সা বাকি আছে। আমি বললাম-দাও গয়া পিসি, আমার বাবা কি তোমার দুটো পয়সা নিয়ে পালিয়ে যাবে-আর এই পুঁই শাকগুলো- ঘাটের ধারের রায় কাকা বললে, নিয়ে যা…কেমন মোটা মোটা…
অন্নপূর্ণা দাওয়া হইতেই অত্যন্ত ঝাঁজের সহিত চিৎকার করিয়া উঠিলেন-নিয়ে যা, আহা কী অমর্তই তোমাকে তারা দিয়েছে…পাকা পুঁইডাটা কাঠ হয়ে গিয়েছে, দু-দিন পরে ফেলে দিত…নিয়ে যা… আর উনি তাদের আগাছা উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন-ভালোই হয়েছে, তাদের আর নিজেদের কষ্ট করে কাটতে হল না. যত পাথুরে বোকা সব মরতে আসে আমার ঘাড়ে …ধাড়ী মেয়ে, বলে দিয়েছি না তোমায় বাড়ির বাইরে কোথাও পা দিও না! লজ্জা করে না এ-পাড়া সে-পাড়া করে বেড়াতে, বিয়ে হলে যে চারছেলের মা হতে খাওয়ার নামে আর জ্ঞান থাকে না, না?… কোথায় শাক, কোথায় বেগুন, আর একজন বেড়াচ্ছেন কোথায় রস, কোথায় ছাই, কোথায় পাঁশ-ফ্যাল বলছি ওসব… ফ্যাল …
মেয়েটি শান্ত অথচ ভয়-মিশ্রিত দুষ্টিতে মা’র দিকে চাহিয়া হাতের বাঁধন আলগা করিয়া দিল, পুঁইশাকের বোঝা মাটিতে পড়িয়ে গেল। অন্নপূর্ণ বকিয়া চলিলেন-যা তো রাধী, ও আপদগুলো টেনে খিড়কির পুকুরের ধারে ফেলে দিয়ে আয় তো—যা, ফের যদি বাড়ির বার হতে দেখেছি, তবে ঠ্যাং যদি খোড়া না করি তো…
বোঝা মাটিতে পড়িয়া গিয়েছিল। ছোটমেয়েটি কলের পুতুলের মতোন সেগুলি তুলিয়া লইয়া খিড়কি অভিমুখে চলিল, কিন্তু ছোটমেয়ে অতবড় বোঝা আঁকড়াইতে পারিল না, অনেকগুলি ডাটা এদিকে-ওদিকে ঝুলিতে ঝুলিতে চলিল।… সহায়হরির ছেলেমেয়েরা তাহাদের মাকে অত্যন্ত ভয় করিত ।
পুঁই মাচা-৩য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।