আমাদের রুপুনুনি যাওয়ার একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো একটা দৈত্য পিপীলিকাভূককে পাকড়াও করা, কারণ শুনেছিলুম এগুলোকে গায়ানার জঙ্গলের থেকে খোলা মাঠে ধরাটা অপেক্ষাকৃত সহজ।
তাই কারানাম্বো পৌঁছোবার পর তিন দিন ধরে আমরা পিঁপড়েখোর ছাড়া আর কিছু নিয়েই হ্যাজাইনি; শেষ অবধি ম্যাকটার্ক ভরসা দিলো যে সে ব্যাপারটা নিয়ে দেখছে। সেইমতো একদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পরপর একটি বেঁটেখাটো আমেরিন্ডিয়ানের আচমকা উদয় হলো, এদের চিরাচরিত নি:শব্দ ভঙ্গীতে। লোকটার ব্রোঞ্জরঙা মঙ্গোলীয় মুখের কালো, চেরা চোখদুটোয় একটা লাজুক চাউনি না থাকলে নির্ঘাৎ শয়তান বলে মনে হতো। পোশাকেও বিশেষ বাহুল্য ছিলো না; পরনে শার্ট আর প্যান্টের ধ্বংসাবশেষ, আর মাথায় একটা হাস্যকর ভেলভেটের টুপি। একজন দুর্ধর্ষ আদিম যোদ্ধার জায়গায় একে দেখে একটু হতাশই হলাম বলা চলে। তবে লোকটির মধ্যে বেশ সহজাত আত্মবিশ্বাস ছিলো, তাই একটু ভরসাও হলো।
ম্যাকটার্ক বললো, “এ হলো ফ্রান্সিস। ও জানে কোথায় পিঁপড়েখোর পাওয়া যায়।”
আমরা বোধহয় এলডোরাডোর সন্ধান নিয়ে আসা কোন লোককে দেখলেও এতটা খুশী হতাম না যতটা হলাম এই কথা শুনে। তারপর কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে বুঝে নিলাম যে ফ্রান্সিস সত্যিই জানে – তিন দিন আগেই ও একটা পিঁপড়েখোরকে দেখেছে; তবে সেটা এখনো সেখানে আছে কিনা, সেটা অন্য প্রশ্ন। ম্যাকটার্ক বললো, ফ্রান্সিস একবার গিয়ে দেখে আসুক, আর যদি সে-ব্যাটা এখনো আনাচে-কানাচে ঘুরঘুর করে, তাহলে এসে আমাদের জানাক। ফ্রান্সিস একগাল হেসে রাজী হয়ে গেলো। এবং পরদিন সকালে এসে জানালো যে পিঁপড়েখোরটা এখনো আগের জায়গাতেই আছে, এবং ও আমাদের পরদিন সেখানে নিয়ে যাবে।
“আমরা যাবো কী করে?” ম্যাকটার্কের থেকে জানতে চাইলাম।
“ঘোড়ায় চড়ে, আবার কী?” জবাব এলো। “জিপে গিয়ে লাভ নেই; সাভানা এপার-ওপার করতে জিপে সুবিধে হবে না।”
“ঘোড়ায় চড়তে পারো?” ববকে জি®’স করলাম।
“ইয়ে, মানে, ঘোড়ায় চেপেছি, যদি বলো,” বব বেশ ইতস্তত: করে বললো। “তবে সেটা খুবই শান্ত ছিলো।”
“হুঁ, শান্ত গোছের ঘোড়া হলে ম্যানেজ করে নেবো,” ম্যাকটার্ককে বললাম।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, শান্ত ঘোড়াই জোগাড় করবো,” ম্যাকটার্ক আশ্বাস দিলো, তারপর ফ্রান্সিসের সঙ্গে চলে গেলো ব্যবস্থা করতে। পরে জানালো, কাল সকালে ফ্রান্সিস ঘোড়া নিয়ে আমাদের জন্যে দু’মাইল দূরে একটা জায়গায় অপেক্ষা করবে। সেখান থেকে আমরা অসীম অজানায় পাড়ি দেবো।
সকালের সূর্যের সোনালী আলোয় দিগন্তবিস্তৃত ঘাসজমির ওপর দিয়ে আমাদের জিপ লাফাতে-লাফাতে চললো দূরের গাছের প্রান্তরেখার দিকে; ঐখানেই আমাদের রাঁদেভু। অদ্ভুত মোলায়েম নীল আকাশে অনেক ওপরে দুটো বাজপাখি ধীরে-ধীরে চক্কর কাটছিলো শিকারের খোঁজে। আতসবাজীর মতো রঙচঙে গঙ্গাফড়িংগুলো জিপের সামনে দিয়ে স্যাঁৎ-স্যাঁৎ করে উড়ে যাচ্ছিলো, আর জিপের চাকার অত্যাচারে ছিটকে ওঠা ধুলো আমাদের পিছনে রাস্তার ওপর মেঘের মতো লেপটে ছিলো। এরমধ্যে ম্যাকটার্ক ইÏ”ন আর বাতাসের আওয়াজ ছাপিয়ে চিৎকার করে আমাকে বলতে লাগলো,
“এই ইন্ডিয়ানটা… ফ্রান্সিস… ভাবলাম বলে দিই… একটু ছিটেল আছে… উত্তেজিত হয়ে পড়ে… ফিটের রুগী, মনে হয়… বলে, ওর মাথার ভেতর দুনিয়া ঘুরতে থাকে… আজকে হবে না হয়তো… তাও ভাবলাম বলে দিই… এমনিতে খুবই গোবেচারা অবশ্য।”
“গোবেচারা, এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত?” জিপের আওয়াজের ওপর দিয়ে আমিও গাঁক-গাঁক করে জি®’স করলাম।
“হ্যাঁ হ্যাঁ! একদম।”
“ব্যাপারটা কী?” বব পিছনের সিট থেকে জানতে চাইলো।
“ম্যাকটার্ক বলছে ফ্রান্সিস ফিটের রুগী।”
“কিসের?” বব চিৎকার করলো।
“ফিটের।”
“ফিটের?”
“হ্যাঁ, ঐ আর কি… মাঝে মাঝে মাথায় চক্কর দেয়। তবে এমনিতে নাকি নিরীহ।”
“হে ভগবান!” অদ্ভুত বিষণ্ন গলায় বললো বব, তারপর শহীদের মতো মুখ করে সিটের ওপর ধপাস করে শুয়ে পড়লো চোখ বুঁজে।
আমরা গাছগুলোর কাছে পৌঁছে দেখলাম ফ্রান্সিস মাটিতে বসে আছে, আর তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়াগুলো, ব্যাজার ভঙ্গীতে। জিনগুলো দেখে বিশেষ আরামদায়ক মনে হলো না। আমরা জিপ থেকে নেমে ফ্রান্সিসের প্রতি একটু আড়ষ্ট দেঁতো হাসি হাসলাম। ম্যাকটার্ক শুভেচ্ছা-টুভেচ্ছা জানিয়ে এমন শব্দ করে জিপ ঘোরালো যে ঘোড়াগুলো তিড়িং করে পিছনের পায়ে লাফিয়ে উঠলো। ফ্রান্সিস তাদের ঠাণ্ডা করার পর আমরা এগোলাম। আমরা ঘোড়াগুলোর দিকে তাকালাম, ওরাও ফিরে তাকালো সমান সন্দেহপূর্ণ চোখে।
“তুমি কোনটা নেবে?” ববকে জি®’স করলাম।
“কোন তফাৎ পড়বে বলে মনে হয় না,” বব বললো। “তাও আমি বাদামীটা নেবো, ঐ যেটার এক চোখ একটু ট্যারা।”
সুতরাং আমার ভাগ্যে পড়লো একটা বিশাল ছেয়ে রঙের ঘোড়া যার বংশকৌলীন্যে খচ্চরের ভাগই বেশী বলে মনে হলো আমার। আমি যথাসাধ্য মিষ্টি গলায় ঘোড়াটাকে ডাক দিয়ে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, এবং সেও তিড়বিড় করে খানিকটা সরে গিয়ে আমাকে চোখ উল্টে সাদা দেখালো।
“লক্ষ্মী ছেলে,” ঘড়ঘড়ে গলায় বললাম, রেকাবে পা রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে-করতে।
“এটা ছেলে নয়, মেয়ে,” ফুট কাটলো বব।
কোনমতে তো ঘোড়াটার হাড়-বের-করা পিঠে গদীয়ান হয়ে বসলাম লাগাম পাকড়ে। ববের ঘোড়াটাকে তাও ভদ্র মনে হলো; সে ববের চড়বার সময়ে কোন ত্যাঁদড়ামো করলো না। কিন্তু বব জিনের ওপর থিতু হবার সঙ্গে সঙ্গে সেটা গুটিগুটি কিন্তু দৃঢ়প্রত্যয়ে পিছন দিকে হাঁটতে শুরু করলো। একটা কাঁটাঝোপে ঠেকে না গেলে ওটা ব্রাজিল অবধি ঐভাবেই হেঁটে যেতো বলে আমার বিশ্বাস। আপাতত যেটা হলো, সে-ব্যাটা আর এক পা নড়তে সাফ অস্বীকার করে দিলো।
ইতিমধ্যে ফ্রান্সিস তার নিজের কালো ঘোড়ায় চড়ে দিব্যি মেঠোপথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে আমি তাড়াতাড়ি আমার বাহনটিকে একই দিকে চালিত করলাম। ববের চেঁচামেচি ক্রমেই পিছনে আবছা হয়ে মিলিয়ে আসতে লাগলো। একটা মোড় ঘোরার পর বব আমাদের চোখের সীমানারও বাইরে চলে গেলো। অবশ্য একটু পরেই সে আমাদের নাগাল ধরে ফেললো; দেখি, ঘোড়াটা এমন একটা চাল নিয়েছে যেটা না-হাঁটা না-দুলকি, আর বব মুখটুখ লাল করে জিনের ওপর বসে একটা গাছের ডাল দিয়ে মাঝে মাঝে অবোলা জীবটার পশ্চাদ্দেশে ছপটি মারছে। আমি থেমে গিয়ে খুব আগ্রহের সঙ্গে ব্যাপারটা দেখতে লাগলাম।
“কীরম লাগছে?” বব পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রশ্নটা করলাম। বব অগ্নিবর্ষী দৃষ্টিতে ফিরে তাকালো।
“ব্যাপারটা… ঠিকই… থাকতো… যদি… হতভাগা… ঠিকভাবে… চলতো,” ঝাঁকুনির ফাঁকে-ফাঁকে উত্তর এলো।
“এক মিনিট, আমি পিছন থেকে ব্যাটাকে একটা চাঁটা লাগাই,” বললাম আমি।
পিছন থেকে মনে হচ্ছিলো যেন বব ও তার বাহন মিলে উদ্দাম ল্যাটিন স্টাইলে রাম্বা নাচছে। আমি আমার ঘোড়ার স্পিড বাড়িয়ে সামনের ঘোড়াটার ল্যাজের কাছাকাছি আসামাত্র হাতে লাগাম পাকিয়ে হেলে পড়লাম চাবকানোর জন্যে। এতক্ষণ অবধি আমার ঘোড়াটার আচরণে কোন গলদ ছিলো না, কিন্তু হতভাগার হঠাৎ কেন জানি না মনে হলো আমি ওকে চোরাগোপ্তা আক্রমণের মতলব এঁটেছি। ব্যস, আর যায় কোথায়? ব্যাটা সঙ্গে-সঙ্গে ফড়িঙের মতো একটা বিশাল লাফ মারলো। একঝলক দেখতে পেলাম ববের হতভম্ব মুখ তারপরেই লক্ষ্য করলাম আমি মেঠোরাস্তা দিয়ে উল্কাগতিতে ফ্রান্সিসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা পাশাপাশি আসামাত্তর ফ্রান্সিস ঘুরে তাকিয়ে একগাল হাসলো। তারপর নিজের ঘোড়ার প্রতি কী একটা বিড়বিড় করে লাগামে একটা ঝটকা দিলো, আর আমি বেশী কিছু বোঝার আগেই দেখলাম আমরা সমানতালে পথ ধরে উন্মত্তের মতো ছুটছি, আর ফ্রান্সিস গলার মধ্যে নানারকম বিকট আওয়াজ করে তার ঘোড়াকে আরো উৎসাহ দিচ্ছে।
“ফ্রান্সিস!” আমি আর্তনাদ করলাম। “এটা রেস নয়… আমি থামতে চাইছি… থামতে!”
আমাদের গাইড ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় নিলো, এবং বোঝার পর রীতিমত হতাশই হলো মনে হয়। খুবই অনিচ্ছুক ভঙ্গীতে সে ঘোড়ার রাশ টেনে ধরলো এবং, ভাগ্য ভালো বলতে হবে, আমার ঘোড়াটাও থামলো। বব নাচতে-নাচতে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ না দেওয়া অবধি আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম। এবার আমি একটা নতুন প্ল্যান করলাম : সবার সামনে ফ্রান্সিস, তারপর বব, তারপর আমি। এইভাবেই টুকটুক করে এগোতে লাগলাম আমরা।
রোদের তাত এখন বেশ গায়ে লাগছিলো, সাভানারও কোন শুরু-শেষ দেখা যাচ্ছিলো না। মাইলের পর মাইল সবুজ-সোনালী-বাদামী ঘাসবন, আর দিগন্তে বহুদূরে ফ্যাকাশে নীল পাহাড়ের রেখা। কোথাও কোন প্রাণের চিহ্নমাত্র ছিলো না; চলমান অস্তিত্ব ছিলো শুধু আমাদের (আর আমাদের ছায়াদের)। দু’ঘন্টা ধরে আমরা হাঁটুসমান ঘাসের ভিতর দিয়ে চলতেই থাকলাম, এবং পথপ্রদর্শক ফ্রান্সিসবাবু পুরো সময়টা চোখের ওপর টুপি টেনে ঝিমিয়ে গেলেন। একঘেয়ে দৃশ্য আর রোদের অত্যাচারে আমরাও ফ্রান্সিসের পথ বেছে নেওয়াই শ্রেয় মনে করলাম।
হঠাৎ চোখ খুলেই চমকে উঠলাম; দেখি, আমাদের আমাদের সামনে সমতল সাভানার মাঝখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে একটা ডিম্বাকৃতি গহ্বর দেখা যাচ্ছে যার পাশগুলো খুব হালকাভাবে নেমে গেছে নীচের দিকে – আর গহ্বরের কেন্দ্রে একটা নলখাগড়ায় ঘেরা হ্রদ, যার পাড়গুলো বেঁটে-বেঁটে ঝোপে ছাওয়া। হ্রদটার পাশ কাটিয়ে যখন যাচ্ছি, তখন মনে হলো গোটা পৃথিবী যেন হঠাৎ জেগে উঠেছে : একটা কেম্যান একটুও জল না কাঁপিয়ে মসৃণভাবে হ্রদে নেমে গেলো; দশটা জাবিরু সারস গম্ভীরভাবে হ্রদের ওপার দিয়ে মার্চ করে চলে গেলো, ঠোঁটের ডগায় দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে; ঝোপঝাড়ে অসংখ্য ছোটো-ছোটো পাখি ডানার ঝাপটানি আর ডাকাডাকিতে জায়গাটা সরগরম করে রেখেছিলো।
“বব, ঘুম থেকে উঠে জন্তুগুলোকে দেখো হে,” বললাম আমি।
বব টুপির নীচ থেকে একঝলক তাকালো, আর একটা জড়ানো “উঁ” বলে আবার ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেলো।
দুটো পান্না-সবুজ গিরগিটি আমার ঘোড়ার পায়ের ফাঁক দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো কোনদিকে দৃক্পাৎ না করে। একটা পুঁচকে মাছরাঙা গাছের ডাল থেকে হ্রদে ঝাঁপ দিয়ে নেমে আবার বাসায় ফিরে গেলো ঠোঁটে শিকার নিয়ে। সোনালী আর কালো গঙ্গাফড়িংরা ওড়াউড়ি করছিলো, নলখাগড়া আর হ্রদের চারদিকে মেঘের মতো ছেয়ে থাকা গোলাপী অর্কিডের মধ্যে দিয়ে। একটা ভাঙা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে ছিলো একজোড়া কালো শকুন; আমাদের প্রতি ওদের লোলুপ দৃষ্টিটা, বিশেষ করে আমাদের গাইডের মাথার ব্যামোর কথা ভেবে, আমার একদমই পছন্দ হলো না। আমরা হ্রদটাকে পাশ কাটিয়ে আবার সাভানার দিকে এগোলাম; পাখির ডাক ধীরে-ধীরে পিছনে মিলিয়ে গেলো। আবার সেই একঘেয়ে ঘাসের ভেতর দিয়ে ঘোড়াদের হাঁটার খসখস আওয়াজ। আমি ফের ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমার ঘুম ভাঙলো আমার ঘোড়াটা হট করে থেমে যাওয়ায়; দেখলাম ফ্রান্সিসেরও ঘুম ভেঙেছে, এবং তিনি ঘোড়ার পিঠে বসে নেপোলিয়নের কায়দায় চতুর্দিক পর্যবেক্ষণ করছেন। আমাদের সামনের জমিটা দেখলাম দাবার ছকের মতো সমতল; বাঁদিকের জমিটা ধীরে-ধীরে উঁচু হয়ে গেছে, ঢালের ওপর ঘাস আর ছোটো ঝোপের ছড়াছড়ি। আমি ফ্রান্সিসের পাশে এগিয়ে গিয়ে এই দৃশ্যর দিকে হাতের একটা ইশারা করলাম। মনে হচ্ছিলো উদ্দিষ্ট জায়গায় এসে পড়েছি।
“কী হলো?” শুধোলো বব।
“আমার মনে হচ্ছে ও এখানেই জানোয়ারটাকে দেখেছিলো।”
আমাদের বলা হয়েছিলো ফ্রান্সিস ইংরিজি বোঝে, এবং নি:সন্দেহে এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন ও আমাদের এই অভিযানের খুঁটিনাটি বাতলাবে। আমার চোখে চোখ রাখলো ফ্রান্সিস, এবং তুবড়ির মতো একগাদা শব্দ উগরে দিলো যেগুলোর মতো দুর্বোধ্য আওয়াজ আমি ইহজন্মে শুনিনি। একবার নয়, বারবার তিনবার ফ্রান্সিস শব্দগুলো আওড়ালো, আমিও শুনলাম – কিন্তু একবর্ণ বুঝতে পারলাম না। আমি ববের দিকে তাকালাম; সে এতক্ষণ নিজের জিনের ওপর ওঠবোস করে গায়ের ব্যাথা মারছিলো আমাদের কোন পাত্তা না দিয়ে।
“এই বব, তুমি একটা স্থানীয় ইন্ডিয়ান ভাষা জানো বলেছিলে না?”
“ইয়ে, হ্যাঁ। কিন্তু ওগুলো তো প্যারাগুয়ের ইন্ডিয়ান ছিলো, এখানে ঐ ভাষাটার চল নেই।”
“কিছু মনে আছে আদৌ?”
“হ্যাঁ, ঐ আর কি – ছিটেফোঁটা।”
“তাহলে একবার দ্যাখো না এ-ব্যাটা কী বলছে।”
“ও ইংরিজি বলছে না?” বব হাঁ হয়ে গেলো।
“আমার মাথায় কিস্যু ঢুকছে না এটুকু বলতে পারি। ফ্রান্সিস, আবার বলো তো হে!”
ফ্রান্সিস অত্যন্ত ব্যাজার মুখ করে পুরো বনটা আবার আওড়ালো; ববও ভুরু কুঁচকে মন দিয়ে শুনলো। শেষে বললো, “না:, আমিও কিস্যু বুঝলাম না। এটা আর যাই হোক, ইংরিজি নয়।”
আমরা হাঁ করে ফ্রান্সিসের দিকে চেয়ে রইলাম, সেও কৃপার দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চেয়ে রইলো। খানিক পরেই অবশ্য ওর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো, এবং নানারকম অঙ্গভঙ্গী ও কাঁইমাই আওয়াজ করে কোনমতে আমাদের কাছে ওর বক্তব্যটা বোঝাতে সমর্থ হলো। এই জায়গাতেই ও পিঁপড়েখোরটাকে দেখেছিলো। সেটা নিশ্চয়ই এখানেই কোথাও ঘুমিয়ে আছে (এটা বোঝাতে ফ্রান্সিস গালের পাশে দু’হাত জড়ো করে চোখ বুঁজে নাক ডাকার আওয়াজ করলো)। আমরা তিনজন একটু ছড়িয়ে গিয়ে একটা লাইন ধরে ঝোপঝাড় পেটাতে-পেটাতে এগোবো, যথাসম্ভব হট্টগোল করে।
আমরা সেইমতো একে অপরের থেকে তিরিশ গজ করে সরে গেলাম, আর ঘোড়ায় চড়ে ঐ উঁচু ঘাসের মধ্যে দিয়ে এগোতে লাগলাম, প্রচুর চিৎকার-চেঁচামেচি সহ। সত্যি বলতে কি, নিজেকে একটু বোকা-বোকাই লাগছিলো আমার। আমার ডানদিকে ফ্রান্সিস একাই একদল ডালকুত্তার মতো আওয়াজ করছিলো, আর আমার বাঁদিকে বব উদাত্ত কন্ঠে স্কটিশ লোকসংগীত গাইছিলো – যেকোন পিঁপড়েখোরের বিরক্তি উদ্রেক করার পক্ষে যথেষ্ট জোরে। এইভাবে আধমাইলটাক এগোনোর পর আমার রীতিমতো সন্দেহ হতে লাগলো এই তল্লাটে, এমনকি গোটা গায়ানাতেই, আদৌ কোন পিঁপড়েখোর আছে কিনা। আমার ভরাট গলাও ভেঙেচুরে দাঁড়কাকের মতো শোনাচ্ছিলো ততক্ষণে।
হঠাৎ ফ্রান্সিস একটা উত্তেজিত হুঙ্কার দিয়ে উঠলো, আর পরমুহূর্তেই আমি দেখতে পেলাম ওর ঘোড়ার আগে-আগে একটা কালো রঙের জানোয়ার ঘাসের মধ্যে দিয়ে প্রাণপণে ছুটছে। আমি আমার ঘোড়া ঘুরিয়ে সেইদিকে ছুটলাম, ববকেও সঙ্গে আসার ডাক দিয়ে। আমার ঘোড়াটা ঘাসের চাপড়া আর খানাখন্দ টপকে উন্মাদের মতো দৌড়োতে লাগলো। জানোয়ারটা এর মধ্যে ঘাসের থেকে বেরিয়ে একটা খোলা জমির ওপর দিয়ে ছুটছিলো, তাই আমি দেখতে পেলাম সেটা একটা পিঁপড়েখোরই বটে – এবং চিড়িয়াখানায় দেখা যে-কোন পিঁপড়েখোরের থেকে আয়তনে বড়ো। জন্তুটা ছুটছিলো অসম্ভব দ্রুতবেগে, চোঙার মতো মুণ্ডুটা দোলাতে-দোলাতে আর ঝাঁকড়া ল্যাজটাকে পতাকার মতো তুলে। ফ্রান্সিস ধাওয়া করতে-করতে ওর ল্যাসোর পাক খুলতে লাগলো। আমিও ইতিমধ্যে লম্বা ঘাসের থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু আমার ঘোড়াটাকে পিঁপড়েখোরটার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সেটার হঠাৎ মনে হলো আমাদের উদ্দিষ্ট প্রাণীটি বিশেষ সুবিধের নয়। এবং এটা ভেবে নিয়ে সে অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে উল্টোদিকে ছুট লাগালো। আমি কোনমতে (এবং প্রচুর পরিশ্রমের পর) ওটাকে ঠিক দিকে চালাতে সক্ষম হলাম, কিন্তু তাও সোজাসুজি নয় – একটা বিশাল চক্কর দিয়ে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই দেখলাম ফ্রান্সিস জানোয়ারটার পাশাপাশি এসে ওটার মুণ্ডু তাগ করে ল্যাসো ছুঁড়লো। টিপ ঠিক না হওয়ায় ল্যাসোটা আটকালো না, আর পিঁপড়েখোরটাও একটা কান্নিক মেরে আবার লম্বা ঘাসের দিকে ছুট দিলো। ফ্রান্সিস যতক্ষণে দাঁড়িয়ে পড়ে তার ল্যাসো গুটিয়ে তুলছিলো, ততক্ষণে ওর শিকার প্রায় ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে আর কি! আমার অনিচ্ছুক বাহনটির সাহায্যে আমি পিঁপড়েখোরটিকে এই কাজটি করার থেকে আটকালাম; সেটা আবার খোলা মাঠের দিকে ফিরলো, আমিও ছুটলাম সমানতালে।
পিঁপড়েখোরটা ফোঁসফোঁস-ঘোঁৎঘোঁৎ করতে-করতে মাঠের ওপর দিয়ে ছুটছিলো বেঁটে-বেঁটে পায়ে রোদে পোড়া জমিতে আওয়াজ তুলে। ফ্রান্সিস ইতিমধ্যে আমাদের ধরে ফেলেছিলো; ও এবার ল্যাসোটাকে দু-তিন পাক ঘুরিয়ে ছুঁড়লো, আর সেটাও মোক্ষমভাবে পড়লো জন্তুটার শরীরের সামনের দিকে। ফাঁসটা কোমরের কাছে আসামাত্র ফ্রান্সিস সেটাকে টেনে আঁট করে দিলো। নিমেষের মধ্যে ফ্রান্সিস ঘোড়া থেকে নেমে পড়লো, আর জানোয়ারটাও দড়িসমেত তাকে হ্যাঁচড়াতে-হ্যাঁচড়াতে টেনে নিয়ে চললো। ববকে ঘোড়া ধরতে বলে আমিও নেমে পড়ে ফ্রান্সিসের সঙ্গে হাত লাগালাম। জন্তুটার ঝাঁকড়া লোমশ শরীরে আর খাটো পাগুলোতে অসম্ভব শক্তি থাকার ফলে আমাদের দুজনকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হলো স্রেফ ওটাকে দাঁড় করাতে। ঘর্মাক্ত ফ্রান্সিস ঘুরে তাকিয়ে আমার পিছনদিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে একটা চিৎকার দিলো; আমি পিছন ফিরে দেখলাম একশো গজ দূরে একটা নি:সঙ্গ ছোটো গাছ। হাঁপাতে-হাঁপাতে আমরা পিঁপড়েখোরটাকে সেদিকে টেনে নিয়ে চললাম। গাছটার কাছে পৌঁছে আমরা ক্রুদ্ধ জানোয়ারটাকে দড়ির আরেক পাক দিয়ে বাকি দড়িটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধলাম। শেষ গিঁটটা যখন মারছি, তখন ফ্রান্সিস উপরদিকে তাকিয়েই একটা ভর্ত আওয়াজ করে উঠলো। চমকে তাকিয়ে দেখি, আমার মাথার ঠিক দু’ফুট উপরে ফুটবলের সাইজের একটা বোলতার চাক, যেটার সমস্ত বাসিন্দা প্রচণ্ড বিরক্তভাবে চাকের বাইরে বেরিয়ে এসেছে। পিঁপড়েখোরটার লাফঝাঁপে গাছটা ঝড়ের দাপটের মতো দুলছিলো, এবং বেশ বোঝা যাচ্ছিলো সেটা বোলতাগুলোর একদমই মন:পূত হচ্ছে না। ফ্রান্সিস আর আমি নি:শব্দ দ্রুতগতিতে পিছোতে লাগলাম। আমাদের পিছোতে দেখে পিঁপড়েখোরটা বন্দীদশা থেকে মুক্ত হবার প্রচেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়ে বিশ্রাম নেওয়া মনস্থ করলো। গাছটা দুলুনি থামালো, বোলতাগুলূ শান্ত হলো।
আমরা এবার ঘোড়াগুলোর কাছে ফিরে গিয়ে পিঁপড়েখোরটাকে বন্দী করবার সব সর”¡ম নামালাম : দুটো বড়ো বস্তা, একবাণ্ডিল শক্তপোক্ত টোয়াইন সুতো, আর কয়েকগাছি মোটা দড়ি। এগুলোর সঙ্গে ফ্রান্সিসের একটা খুনিয়া ছুরি নিয়ে আমরা আবার গাছটার দিকে এগোলাম। যথাস্থানে পৌঁছে দেখি, পিঁপড়েখোরটা ততক্ষণে দড়ি-ফড়ি খুলে ফেলে খোলা মাঠের দিকে মহানন্দে পা বাড়িয়েছে। ফ্রান্সিসকে বোলতা-সঙ্কুল গাছটার থেকে ল্যাসোটা খুলতে পাঠিয়ে দিয়ে আমি হাতের দড়িতে একটা ফাঁস মারতে-মারতে জানোয়ারটাকে পায়ে হেঁটে ধাওয়া করলাম। জন্তুটার কাছাকাছি পৌঁছে আমি ওর মাথা তাগ করে আমার অপটু ল্যাসোটা ছুঁড়লাম। সেটা ফসকালো। আবার ছুঁড়লাম, এবং আবার ফসকালো। এইভাবে খানিকক্ষণ চললো; বুঝতে পারলাম, আমার এই অত্যধিক মনোযোগে জন্তুটা য্ৎপরোনাস্তি বিরক্ত হচ্ছে। ব্যাটা হঠাৎ থেমে পড়ে আমার দিকে ঘুরে পিছনের দু’পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আমিও দাঁড়িয়ে পড়ে ওকে মাপতে লাগলাম, বিশেষ করে ওর সামনের পায়ের ভীষণদর্শন ছ’ইÏ’ নখগুলোকে। জন্তুটা লম্বা নাক কাঁপিয়ে নি:শ্বাস ফেললো, কুৎকুতে চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি ওটার পাশ দিয়ে গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করলাম, ওটাও আমার দিকে মুখ করে নখ উঁচিয়ে ঘুরতে লাগলো। আমি একবার ল্যাসোটা ছোঁড়ার তাল করেছিলাম, কিন্তু হতভাগা তাতে নখ-ফখ বাগিয়ে এমন খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠলো যে আমি বাধ্য হয়েই ও ম্ৎলব বাতিল করে ফ্রান্সিসের জন্যে অপেক্ষা করে রইলাম। মনে-মনে এটাও ভাবছিলাম যে একটা জন্তুকে চিড়িয়াখানার খাঁচার ভিতরে দেখা আর সেটাকে একগাছা দড়ি দিয়ে ধরবার চেষ্টা করার মধ্যে কতো তফাৎ! একটু পরে দূরে তাকিয়ে দেখি ফ্রান্সিস তখনো বোলতাদের মনোযোগ আকৃষ্ট না করে গাছের গায়ের থেকে ল্যাসো খুলতে ব্যস্ত।
এর মধ্যে আবার দেখি পিঁপড়েখোরটা ল্যাজের ওপর থেবড়ে বসে পড়ে গম্ভীরভাবে নাক থেকে ঘাসের টুকরো ঝাড়তে লেগেছে। আমি লক্ষ্য করলাম, প্রত্যেকবার ফোঁস করার সাথে-সাথে ওর মুখ থেকে সুতোর মতো লালা গড়িয়ে পড়ে মাকড়সার জালের মতো শুকিয়ে ঝুলছে। জন্তুটা যখন মাঠের মধ্যে দিয়ে ছুটছিলো, তখন এই লালা গড়িয়ে মাটিতে পড়ে ঘাস-কুটোর সঙ্গে জড়িয়ে গেছিলো। এবার ও যখন রাগের চোটে মাথা ঝাঁকাচ্ছিলো, তখন ঐ লালা আর ঘাসের সুতোগুলো ছিটকে উঠে ওর নাক আর কাঁধে আঠার মতো লেপটে যাচ্ছিলো। এখন ব্যাটার মনে হলো, এই যুদ্ধবিরতির ফাঁকে নিজেকে পরিষ্কার করে নেওয়া যায়। প্রথমে নিজের লম্বা ধূসর নাকটাকে মন দিয়ে সাফসুফ করে ও মাটিতে কাঁধ ঘষে-ঘষে মুছতে লাগলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে অবিকল পোষা কুকুরের মতো একটা গা-ঝাঁকানি দিয়ে এমন নিশ্চিন্ত গদাইলস্করি চালে দূরের লম্বা ঘাসের দিকে হাঁটা লাগালো যেন ওর জীবনে ল্যাসোধারী মনুষ্যদের কোন অস্তিত্বই নেই। এই মুহূর্তে ফ্রান্সিস হাঁপাতে-হাঁপাতে এসে আমার সঙ্গে যোগ দিলো; আমরা আবার জানোয়ারটাকে ধাওয়া করলাম। আমাদের আসতে শুনে ও আবার থেমে বসে পড়ে আমাদের দিকে হতাশভাবে চেয়ে রইলো। আমরা দুজন থাকায় পাল্লা আমাদের দিকেই ভারী ছিলো; তাই আমি যতক্ষণ ওর মনোযোগ আকৃষ্ট করে রাখলাম, ফ্রান্সিস ততক্ষণে গুঁড়ি মেরে ওর পিছনে গিয়ে আবার ওকে ল্যাসোর ফাঁসে আটকে ফেললো। জন্তুটা আবার উর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে লাগলো, আমাদের ল্যাজে বেঁধে। আধঘন্টা ধরে আমরা সাভানার মধ্যে দিগ্বিদিকে ছুটে বেড়ালাম, কিন্তু শেষ অবধি আমরা জন্তুটাকে দড়িতে-দড়িতে একেবারে জড়িয়ে ফেলতে সক্ষম হলাম। তারপর ওকে মাটিতে ফেলে এমনভাবে আগাপাশতলা বাঁধলাম যাতে ওর একটুও নড়বার ক্ষমতা না থাকে। তারপর ওকে সবচেয়ে বড়ো বস্তাটায় পুরে মাটিতে বসে আনন্দের সঙ্গে সিগারেট ধরালাম।
কিন্তু অত:পর আমাদের আরেকটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হলো : আমাদের বস্তাবন্দী পিঁপড়েখোরটিকে পিঠে নিতে সবকটি ঘোড়াই সাফ অস্বীকার করে দিলো। ওদের ভয় পাওয়ারও যথেষ্ট কারণ ছিলো; আমরা যতবার বস্তাটাকে ঘোড়াগুলোর কাছে নিয়ে যাচ্ছিলাম, পিঁপড়েখোরটা প্রত্যেকবার রীতিমতো জোরে সাপের মতো হিসহিস আওয়াজ করে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করছিলো। অবশেষে ফ্রান্সিস বললো একমাত্র সমাধান হলো আমি আগে-আগে ওর ঘোড়াটাকে নিয়ে হাঁটবো আর ও পিছন-পিছন আসবে বস্তাটা পিঠে নিয়ে। আমার একটু সন্দেহ হচ্ছিলো ও পারবে কিনা, কারণ জন্তুটা রীতিমতো ভারী আর কারানাম্বো ওখান থেকে প্রায় আট-ন’ মাইল দূর। তাও আমি ওকে বস্তাটা পিঠে তুলতে সাহায্য করলাম, এবং দুজনে হাঁটা লাগালাম। ফ্রান্সিস বীরের মতো বোঝাটা বইছিলো, দস্তুরমতো গলদ্ঘর্ম হয়ে; এবং বস্তাবন্দী জীবটিও সর্বশক্তি দিয়ে ছটফট করে ওর কাজে যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিলো। মধ্যাহে্ণর সূর্যের রোদ ততক্ষণে অসহ্য হয়ে উঠেছিলো, এবং আমাদের ঘাম শুকোনোর মতো একফোঁটাও বাতাস বইছিলো না। ফ্রান্সিস আপনমনে বিড়বিড় করতে শুরু করলো। একটু পরে দেখি ও প্রায় প’¡শ গজ পিছনে পড়ে গেছে। এইভাবে আধমাইলটাক যাওয়ার পর বব পিছনে ঘুরে তাকালো।
“ফ্রান্সিসের কী হয়েছে?” অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে জি®’স করলো বব।
আমি ঘুরে দেখি ফ্রান্সিস বস্তাটাকে মাটিতে নামিয়ে সেটার চারপাশে গোল হয়ে ঘুরছে আর দু’হাত আস্ফালন করে জন্তুটার উদ্দেশ্যে তর্জন-গর্জন করছে।
“আমার কেমন জানি মনে হচ্ছে ওর মাথার ভেতর দুনিয়া ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে,” বললাম আমি।
“কী?”
“ওর ফিটের ব্যামো চাগাড় দিলে নাকি এরকমটাই হয়।”
“সব্বোনাশ!” বললো বব। “তুমি এখান থেকে বাড়ি ফেরার রাস্তা চেনো আশাকরি?”
“না, চিনি না। যাইহোক, তুমি এক সেকেন্ড ওর ঘোড়াটা ধরো তো! আমি গিয়ে দেখি কী হলো।”
ফ্রান্সিস যেখানে পিঁপড়েখোরটার সঙ্গে একতরফা বার্তালাপ চালাচ্ছিলো, সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। আমার আগমনে ফ্রান্সিস একটুও বিচলিত হলো না; এমনকি ঘুরেও তাকালো না। ওর মুখভঙ্গী এবং হাত-পা ছোঁড়া দেখে আমি আন্দাজ করলাম ও ওর মাতৃভাষায় পিঁপড়েখোরটার চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করছে। ওর ভর্ৎসনার বিষয়বস্তুটি অবশ্য একটুও উদ্বিগ্ন না হয়ে ওর দিকে নির্লিপ্তভাবে চেয়ে নাক দিয়ে বুড়বুড়ি কাটছিলো। শেষ অবধি (বোধহয় আর ভাষা খুঁজে না পেয়ে) ফ্রান্সিস চুপ করে গিয়ে আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
“সমস্যাটা কী, ফ্রান্সিস?” মিষ্টি গলায় জি®’স করলাম আমি; সম্পূর্ণ আলঙ্কারিকভাবে, কারণ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিলো সমস্যাটা কী। ফ্রান্সিস দম নিয়ে আমার প্রতি আবার একপ্রস্থ বিজাতীয় শব্দ আওড়ালো। আমি মন দিয়ে শুনলাম, কিন্তু একটা শব্দই বুঝতে পারলাম – “ড্রাফ্ট্বল’, যেটা আমাদের বর্তমান সমস্যার সঙ্গে কোনভাবে যুক্ত বলে আমার আদৌ মনে হলো না। খানিকক্ষণ এই কষ্টকর কথোপকথনের পর আমি বুঝতে পারলাম ফ্রান্সিস যেটা করতে চাইছে সেটা হলো : কেউ একজন পিঁপড়েখোরটাকে পাহারা দিক, আর বাকি দু’জন ঘোড়ায় চড়ে আউটস্টেশনে (এটা দূর দিগন্তে একটা ফুটকির মতো দেখা যাচ্ছিলো) গিয়ে এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ‘ড্রাফ্ট্বল’টি নিয়ে আসুক। আউটস্টেশনে ইংরিজিনবিশ কেউ থাকতে পারে এই আশায় আমি রাজি হয়ে গেলাম, এবং ফ্রান্সিস আর আমি ধরাধরি করে জন্তুটাকে একটা ঝোপের ছায়ায় নিয়ে গেলাম। তারপর আমি ববের কাছে গিয়ে ওকে পুরো ব্যাপারটা বোঝালাম।
“বব, তোমাকে এখানে পিঁপড়েখোরটার সঙ্গে থাকতে হবে। ফ্রান্সিস আর আমি ঐ আউটস্টেশনে গিয়ে একটা ড্রাফ্ট্বল নিয়ে আসছি।’
“একটা ড্রাফে্ট্বার্ড?” অবাক হয়ে বললো বব। “কোন দু:খে?’
“ড্রাফে্ট্বার্ড না রে বাবা, ড্রাফ্ট্বল!’ আমি শুধরে দিলাম।
“সেটা আবার কী? খায় না মাথায় দেয়?’
“আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। কিছু একটা যানবাহন হবে মনে হয়।’
“এটা তোমার প্ল্যান, না ফ্রান্সিসের?’
“ফ্রান্সিসের। ওর বক্তব্য অনুযায়ী এটাই একমাত্র উপায়।’
“সে নাহয় হলো, কিন্তু এই ঘোড়াড্ডিম ড্রাফ্ট্বলটা কী?’
“বললুম তো, আমি ভাষাবিদ্নই; ঠেলাগাড়ি হবে হয়তো। যাকে্গ, আউটস্টেশনে অন্য লোকও থাকবে নিশ্চয়ই, দরকার পড়লে তাদের সাহায্য নেওয়া যাবে।’
“হ্যাঁ, আর ততক্ষণে আমি হয় তেষ্টায় মারা যাবো, নয় ঐ জানোয়ারটা নখ দিয়ে আমার পেট চিরে দেবে,’ ব্যাজার গলায় বললো বব। “কি দুর্দান্ত প্ল্যান মাইরি!’
“ধুর, যত বাজে কথা! জানোয়ারটা আগাপাশতলা বস্তাবন্দী হয়ে আছে, আর আমি আউটস্টেশন থেকে তোমার জন্যে জল নিয়ে আসবো।’
“যদি তুমি আদৌ আউটস্টেশনে পৌঁছূ, তবে না! ফ্রান্সিসের যা অবস্থা দেখছি, ও তোমাকে চারদিন হাঁটিয়ে ব্রাজিল অবধিও নিয়ে যেতে পারে। যাকে্গ, আমি নাহয় আবার তোমার জন্তুসংগ্রহের খাতিরে নিজেকে বলিদানই করলাম।’
ফ্রান্সিস আর আমি যখন এগোচ্ছি, বব পিছন থেকে চেঁচিয়ে বললো, “আমি তোমাকে আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই, আমি গায়ানায় এসেছিলাম ছবি আঁকতে, একটা নোংরা পিঁপড়েখোরের আয়া হতে নয়… আর জল আনতে ভুলো না কিন্তু!’
ঐ আউটস্টেশন অবধি যাত্রাটা আমি আর কোনদিন মনে করতে চাই না। ফ্রান্সিসের ঘোড়া ছুটলো উল্কাগতিতে এবং আমারটাও, বোধহয় বাড়ি ফিরছে এই ভেবে, সমানতালে পাল্লা দিয়ে গেলো। মনে হচ্ছিলো অনন্তকাল ধরে চলছি, কিন্তু অবশেষে কুকুরের ডাক শুনতে পেলাম, এবং খানিক পরে আমরা একটা লম্বাটে একতলা সাদা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম, যেরম বাড়ি আমি এর আগে শুধু কাউবয় ফিল্মেই দেখেছি। একজন হাসিখুশী বৃদ্ধ আমেরিন্ডিয়ান বেরিয়ে এসে আমাকে স্প্যানিশ ভাষায় স্বাগত জানালেন। আমি বোকার মতো একগাল হেসে ভদ্রলোকের পিছন-পিছন বাড়িটার ভেতরে ঢুকলাম। ঘরটার নীচু দেওয়ালের ওপর দুটো জংলি গোছের ছোকরা আর একটি পরমাসুন্দরী যুবতী বসেছিলো। একটা ছোকরা আখ কেটে-কেটে মাটিতে ফেলছিলো, আর তিনটে ন্যাংটো বাচ্চা সেগুলো কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছিলো। আমি একটা কাঠের বে®’ বসলাম, মেয়েটি আমাকে এক কাপ কফি এনে দিলো। আমি যতক্ষণ সেটা তারিয়ে-তারিয়ে খাচ্ছি, ততক্ষণ বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমার সঙ্গে ইংরিজি আর ভাঙা-ভাঙা স্প্যানিশে কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন। একটু পরে ফ্রান্সিস ফিরে এসে আমাকে বাইরে মাঠে নিয়ে গিয়ে একটা বিশাল ষাঁড়ের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলো।
“ড্রাফ্ট্বল(draft-bull),’ ষাঁড়টাকে দেখিয়ে বললো ফ্রান্সিস।
ষাঁড়টাকে যতক্ষণ জিন-লাগাম পরানো হচ্ছিলো, ততক্ষণ আমি ভেতরে গিয়ে আরো কফি খেলাম। তারপর ঘোড়ায় ওঠার আগে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের থেকে ববের জন্য এক বোতল জল নিয়ে নিলাম। বিদায় নিয়ে যখন গেটের থেকে বেরোচ্ছি, তখন ফ্রান্সিসকে জি®’স করলাম, “ড্রাফ্ট্বুলটা কই?’
ফ্রান্সিস কোন কথা না বলে সামনের দিকে আঙুল তুললো; দেখলাম, ষাঁড়টা সাভানার ওপর দিয়ে ধবড়-ধবড় করে দৌড়োচ্ছে, আর তার পিঠে বসে আছে ফ্রান্সিসের বৌ, তার লম্বা ঘন কালো চুল হাওয়ায় উড়িয়ে।
আমরা দুজন একটা শর্টকাট নিয়ে ষাঁড়টার আগেই ববের কাছে পৌঁছে গেলাম। এসে দেখি, সবকিছু ঘেঁটে ঘ’ : পিঁপড়েখোরটা কোনভাবে নিজের দুটো সামনের পায়েরই বাঁধন খুলে ফেলে তারপর বস্তাটাও ছিঁড়ে ফেলে হামাগুড়ি দিয়ে আদ্ধেক বেরিয়ে এসেছে। আমরা যখন পৌঁছোলাম তখন সে আধছেঁড়া বস্তাটাকে লুঙ্গির মতো পরে গোল হয়ে চক্কর কাটছিলো, এবং বব সেটাকে প্রাণপণে ধাওয়া করে যাচ্ছিলো। জন্তুটাকে আবার একটা নতুন বস্তার মধ্যে ভরে আমি ববকে জলের বোতলটা দিলাম, আর ববও জল-টল খেয়ে আমাদের খুলে বললো কেসটা কী। আমরা ওর চোখের সীমানার বাইরে যাওয়ার পরপরই ওর ঘোড়াটা (যেটা ও নিশ্চিত ছিলো একটা ঝোপের সঙ্গে বাঁধা আছে) কেটে পড়ার তাল করে। অবশ্যই ববের এতে মত ছিলো না। তাই বব ঘোড়াটাকে প্রিয়সম্ভাষণ করতে-করতে ওটার পিছনে মাঠময় ছুটে বেড়ায়, এবং শেষ অবধি ওটাকে পাকড়াও করে ফিরে এসে দেখে যে পিঁপড়েখোরটা বস্তা ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে মন দিয়ে দড়িদড়া খোলায় ব্যস্ত। অগ্নিশর্মা বব কোনমতে সেটাকে বস্তায় পুরে দেখে ঘোড়াটা আবার কেটে পড়েছে। এই ব্যাপারটা মোটামুটি অনেকক্ষণ ধরে চলে; একটা সময় ঘটনাপ্রবাহে একটু বৈচিত্র্য আনার জন্য একপাল লংহর্ন গরু এসে ববের কাণ্ডকারখানা খুবই তাচ্ছিল্যভরে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। বব বললো যে গরুগুলোকে নিয়ে ওর মাথাব্যাথা ছিলো না, কিন্তু পালটায় ষাঁড়ের ভাগ বেশী দেখে ও একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছিলো। যাইহোক, শেষ অবধি গরুগুলো চলে যায়, আর ববও নতুন উদ্যমে পিঁপড়েখোরটাকে ধাওয়া করতে থাকে। অত:পর রঙ্গম®’ আমাদের প্রবেশ।
“তোমরা খুবই ভালো সময়ে এসে পড়েছো,’ বললো বব। “এরকম আর কিছুক্ষণ চললে আমার মাথার মধ্যেও দুনিয়া ঘুরতে শুরু করতো।’
ঠিক সেই মুহূর্তে ফ্রান্সিসের বৌ অকুস্থলে এসে পৌঁছলো। দূর থেকে আগত ষণ্ডবাহিনীকে দেখে ববের তো চক্ষু চড়কগাছ!
“ওটা ক্কী?’ মন্ত্রমুগ্ধ কন্ঠে জি®’স করলো বব। “তুমিও দেখতে পাচ্ছো নিশ্চয়ই ওটাকে?’
“হে সখা, ওটিই সেই বিখ্যাত ড্রাফ্ট্বল, যা আমাদিগকে এই নরকযন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি দেবে।’
বব ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে চোখ বুঁজলো।
“আমি আজকে এক জীবনের পক্ষে যথেষ্ট ষাঁড় দেখে নিয়েছি। আমি পিঁপড়েখোরটাকে ঐ দানবটার পিঠে চাপাতে সাহায্য করতে পারলাম না, সরি। আমি এই যে শুলাম, একেবারে তোমরা গুঁতো-টুতো খেয়ে মরে যাওয়ার পর উঠে নিশ্চিন্তে একা-একা বাড়ি যাবো।’
তাই ববকে বাদ দিয়ে আমরা বাকি তিনজন মিলে ক্রুদ্ধ পিঁপড়েখোরটাকে ষাঁড়টার পিঠে চাপালাম। তারপর আমরা আবার আমাদের ঘোড়ার পিঠে চড়ে কারানাম্বোর দিকে রওনা দিলাম। সূর্যটা শেষবারের মতো দূর পাহাড়ের মাথায় ঝলসে উঠে সাভানাময় একটা মায়াবী সবুজ গোধূলি ছড়িয়ে দিয়ে অস্ত গেলো। আধো-অন্ধকারে গর্তের প্যাঁচারা একে অপরকে ডাকছিলো, আর হ্রদটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একজোড়া সাদা ইগ্রেটকে জলের ওপর দিয়ে উঙ্কÄল উল্কার মতো উড়তে দেখলাম। আমাদের শরীর আর বইছিলো না। ঘোড়াগুলূ মাঝেমধ্যে হোঁচট খাচ্ছিলো। আকাশে একটা-দুটো করে তারা ফুটে উঠতে লাগলো; আমরা ঘাসের মধ্যে দিয়ে উদ্দেশ্যবিহীনের মতো চলতেই থাকলাম। নখের ফালির মতো চাঁদ উঠলো; সেই আলোয় রূপোলী ঘাসের মধ্যে চলমান ষাঁড়টাকে কিম্ভূতকিমাকার প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো লাগছিলো। আমি জিনের ওপর ঝাঁকুনি খেতে-খেতে ঝিমোচ্ছিলাম। ববের ঘোড়াটা থেকে-থেকে হোঁচট খাচ্ছিলো, আর সেই ঝাঁকুনির চোটে জিনের সামনের উঁচু কাঠটা ওর পেটে এসে লাগায় বব দু-চারটে খিস্তি দিয়ে উঠছিলো।
খানিক পরে আমি খেয়াল করলাম সামনে গাছের ফাঁক দিয়ে একটা আবছা আলেয়ার মতো এই-আছে-এই-নেই আলো দেখা যাচ্ছে। আকাশের তারাগুলোর তুলনায় সেটাকে রীতিমতো নিÖপ্রভই লাগছিলো।
“বব! মনে হচ্ছে ওটা আমাদের জিপের আলো,’ বললাম আমি।
“ঈশ্বর করুণাময়!’ উত্তেজিত গলায় বলে উঠলো বব। “এই হতচ্ছাড়া ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে পারলে বাঁচি।’
জিপের আলোটা উঙ্কÄল হয়ে ওঠার সাথে-সাথে আমরা ওটার ইÏ”নের আওয়াজও শুনতে পেলাম। জিপটা গাছগুলোকে বেড় দিয়ে এসে আমাদের ওপর হেডলাইট ফেলে থামলো। আমরা ঘোড়া থেকে নেমে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে ওটার দিকে এগোলাম।
“কাজ হলো?’ অন্ধকার থেকে ম্যাকটার্কের গলা শুনতে পেলাম।
“পেল্লায় একটা মদ্দাকে ধরেছি,’ ঘ্যাম নিয়ে বললাম আমি।
“আর দিনটা দারুন কেটেছে!’ বললো বব।
ম্যাকটার্ক হেসে উঠলো। আমরা বসে খানিকক্ষণ ধূমপান করলাম; অবশেষে হেডলাইটের আলোয় দৈত্যাকার ষাঁড়টাকে আসতে দেখা গেলো। ওটার পিঠের থেকে পিঁপড়েখোরটাকে নামিয়ে জিপের ভেতর রাখা হলো একগাদা বস্তা দিয়ে বানানো একটা বিছানার ওপর। আমরাও ওটার পাশেই চড়ে বসলাম। ঘোড়াগুলোকে এর আগেই সাভানায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো, কারণ আমরা জানতাম ওরা নিজেদের বাড়ির পথ চেনে। এদিকে জিপটা চলতে শুরু করার সঙ্গে-সঙ্গে পিঁপড়েখোরটা জেগে উঠে ছটফট করতে লাগলো। আমি ওর লম্বা নাকটাকে বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরলাম, ওটা জিপের ধাতব গায়ে গুঁতো খেলে ও নি:সন্দেহে মারা যাবে এই ভয়ে।
“ওটাকে রাখবে কোথায়?’ জি®’স করলো ম্যাকটার্ক।
এটা এতক্ষণ আমার মাথাতেই আসেনি। আমার এবার মনে পড়লো আমাদের কাছে কোন খাঁচা নেই, এবং চটজলদি একটা বানাবার মতো কাঠও নেই। এবং এই তল্লাটে কাঠ জোগাড় করাও সম্ভব না। কিন্তু আপাতত এই দুশ্চিন্তাও আমাকে দমাতে পারলো না।
“কোথাও একটা বেঁধে রাখলেই হবে,’ হালকা চালে বললাম আমি।
ম্যাকটার্ক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
বাড়িতে পৌঁছে আমরা জন্তুটাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দড়িদড়া-বস্তা সব খুললাম। তারপর ম্যাকটার্কের সাহায্যে একটা দড়ির বকলস বানিয়ে সেটা ওর কাঁধে ফিট করলাম। এটার সঙ্গে একটা লম্বা দড়ি জুড়ে সেটাকে উঠোনের একটা বড়ো গাছের সঙ্গে বাঁধলাম। জন্তুটাকে সে-রাত্রে জল ছাড়া আর কিছু খেতে দিলাম না, কারণ আমার প্ল্যান ছিলো ওটাকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বিকল্প খাদ্যে অভ্যস্ত করানো, আর আমার মনে হয়েছিলো ওকে একরাত না খাইয়ে রাখলে এটা করতে সুবিধে হবে।
একজন পশুসংগ্রাহকের পক্ষে সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটা হলো পশুদের বিকল্প খাদ্যে অভ্যস্ত করানো। এটার প্রয়োজন হয় যখন এই পিপীলিকাভূকের মতো কোন পশু ধরা পড়ে, যার স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস খুবই সীমিত; সেটা হতে পারে কোন একটা বিশেষ পাতা বা ফল, বা একটি বিশেষ প্রজাতির মাছ বা ওরম কিছু। পশুটাকে ইংল্যান্ডে পৌঁছনোর পর এই খাদ্যগুলো দেওয়া প্রায় অসম্ভব বললেই চলে; তাই সংগ্রাহককে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব জন্তুটিকে এমন কিছু খাবারে অভ্যস্ত করে তুলতে হয়, যেটা চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের পক্ষে যোগাড় করা সম্ভব। কিছু জন্তুর ক্ষেত্রে এটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ অনেক সময়েই বিকল্প খাদ্যটি পশুটির সহ্য না-ও হতে পারে; সেটার থেকে অসুস্থতা, এমনকি মৃত্যু ঘটাও অসম্ভব না। কিছু জন্তু আবার খুবই গোঁয়ার হয়, এবং বিকল্প খাদ্যটি সোজাসুজি প্রত্যাখ্যান করে; তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায়ান্তর থাকে না। কোনগুলো আবার প্রথমবার থেকেই বিকল্পটা পছন্দ করে রীতিমতো হ্যাংলার মতো খেতে থাকে। কখনো-কখনো একই প্রজাতির দুটো জন্তু সম্পূর্ণ আলাদা ব্যবহার করে।
পিঁপড়েখোরটার বিকল্প খাদ্যটির ফর্মুলা ছিলো : তিন পাঁইট দুধ, দুটো কাঁচা ডিম, এক পাউন্ড গরুর মাংসের কিমা আর তিন ফোঁটা কড লিভার অয়েল মিলিয়ে-মিশিয়ে একটা ঘ্যাঁট। পরদিন ভোরবেলা আমি এটা তৈরি করে কাছাকাছি একটা উইঢিবি ভেঙে দুধের ওপর কয়েকমুঠো উইপোকা ছড়িয়ে দিলাম। তারপর বাটিটা নিয়ে গেলাম পিঁপড়েখোরটার কাছে।
জন্তুটা গাছের তলায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে ছিলো, চামরের মতো ল্যাজটা দিয়ে আগাপাশতলা ঢেকে। এই জন্তুগুলোকে চিড়িয়াখানায় দেখলে এদের ল্যাজের উপকারিতার কোন ধারনাই করা যায় না : খোলা সাভানায় এরা যখন ঘাসঝোপের মধ্যে ল্যাজমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে, তখন ঝড়বৃষ্টিতেও এদের কোন ক্ষতি করতে পারে না। আমাকে আসতে শুনে ওটা চমকে ঘোঁৎ করে উঠলো, ল্যাজটা পিছনে গুটিয়ে দু’পায়ে উঠে দাঁড়ালো রণং দেহি মূর্তিতে। আমি বাটিটা ওর সামনে রেখে মনে-মনে প্রার্থনা করলাম যাতে ব্যাটা বেশি ঝামেলা না করে, তারপর একটু পিছিয়ে গিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম কী হয়। জন্তুটা বাটিটার কাছে গিয়ে শব্দ করে কানাটা শুঁকলো। তারপর দুধের মধ্যে নাকের ডগাটা ডুবিয়ে লম্বা ধূসর সাপের মতো জিভটা দিয়ে সপাসপ্পুরো মিক্সচারটা চেটে উড়িয়ে দিলো। বাটিটা ফাঁকা না করা অবধি ওটা একবারও থামলো না, আর আমিও মুগ্ধ আনন্দে হাঁ করে পুরো ব্যাপারটা দেখে গেলাম।
পিপীলিকাভূকরা সেই প্রজাতির জীব যাদের কোন দাঁত থাকে না; তার বদলে এদের প্রকৃতিদত্ত লম্বা জিভ আর আঠালো লালা এদের খাবার খেতে সাহায্য করে। জিভটার গড়ন অনেকটা মাছি ধরার আঠাকাগজের মতো। তাই ওটা যখন এক-একবার জিভটা মুখের ভেতর টেনে নিচ্ছিলো, তার সঙ্গে একদলা করে দুধ-ডিম-কিমাও ঢুকে যাচ্ছিলো। এই কায়দাটা অপেক্ষাকৃত কষ্টকর হলেও বাটিটা খালি করতে ওর বেশি সময় লাগলো না; আর তারপরেও ব্যাটা খানিকক্ষণ ধরে বাটিটা শুঁকলো, কিছু পড়ে আছে কিনা দেখার জন্যে। তারপর আবার গাছের নিচে শুয়ে পড়ে ল্যাজ দিয়ে নিজেকে মুড়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো। ওটাকে নিয়ে তারপর থেকে আমকে একবারও কোন ঝামেলা পোয়াতে হয়নি।
জর্জটাউনে ফেরার কয়েক সপ্তাহ পরে আমরা অ্যামোসের (পিঁপড়েখোরটাকে ঐ নামই দিয়েছিলাম আমরা) জন্যে একটি সঙ্গিনী যোগাড় করলাম। এক সকালে দু’জন ছিপছিপে সুবেশ ভারতীয় একটা ঝকঝকে গাড়িতে চড়ে এসে আমাদের জি®’স করলো আমরা একটা বারিম (দৈত্য পিপীলিকাভূকের স্থানীয় নাম) চাই কিনা। আমরা হ্যাঁ বলার পর ওরা শান্তভাবে গাড়িটার বুট খুললো, আর আমরা অবাক হয়ে দেখলাম ভেতরে একটা প্রাপ্তবয়স্ক মাদী পিঁপড়েখোর শুয়ে আছে। জাদুকরদের টুপি থেকে খরগোশ বের করার মতৈ ঘটলো পুরো ঘটনাটা। জন্তুটা রীতিমতো বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিলো, সারা গায়ে বেশ কিছু কাটাছড়াও চোখে পড়লো; আমাদের একটু সন্দেহই হচ্ছিলো যে ওটা বাঁচবে কিনা। কিন্তু প্রাথমিক চিকিৎসা ও অনেকটা জলপানের পর ওটা বেশ সুস্থভাবেই আমাদের ঘোরতর আক্রমণ করলো, এবং আমরাও বুঝলাম একে অ্যামোসের সঙ্গে আলাপ করানো যেতে পারে।
অ্যামোস তখন গাছের নীচে একটা বড়োসড়ো খোঁয়াড়ে বাস করছিলো। আমরা যখন খোঁয়াড়টার দরজা খুলে ওর ভাবী বধূর লম্বা নাকটা ঢুকিয়ে দিলাম, ও তাকে এমনই অভদ্রের মতো আওয়াজ আর নখের আস্ফালন করে অভ্যর্থনা জানালো যে আমরা তাড়াতাড়ি মেয়েটিকে বের করে নিতে বাধ্য হলাম। তারপর আমরা খোঁয়াড়টার মাঝখানে একটা বেড়া দিয়ে সেটাকে দুভাগে ভাগ করে বর-বৌকে পাশাপাশি খুপরিতে রাখলাম। ওরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে একে অপরকে দেখতে ও শুঁকতে পাচ্ছিলো; আমাদের আশা ছিলো যে কিছুদিন ধরে শুঁকে-টুকে অ্যামোস তার সঙ্গিনীর প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে উঠবে।
মাদীটা প্রথমদিন বিকল্প খাদ্যটা খেতে সাফ অস্বীকার করে আমাদের রীতিমতো চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলো। ও এমনকি খাবারটা চেখেও দেখলো না। পরদিন আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো; আমি সকালের খাবার দেওয়ার সময় অ্যামোসের বাটিটা মাঝখানের বেড়ার একদম গায়ে ঠেলে দিলাম। মাদীটা যেই মুহূর্তে অ্যামোসকে খেতে দেখলো (এবং শুনলো), অমনি ব্যাপারটার তদন্ত করতে এগোলো। অ্যামোসকে তারিয়ে-তারিয়ে খেতে দেখে ও বেড়ার ফাঁক দিয়ে লম্বা জিভটা ঢুকিয়ে ওর বাটিতে ভাগ বসালো। দশ মিনিটের মধ্যে দু’জনে মিলে চেটেপুটে বাটি পরিষ্কার করে ফেললো। এইভাবেই আমরা প্রত্যেকদিন নবদম্পতিকে এক বাটি থেকে খাবার ভাগ করে খেতে দেখলাম। শেষ অবধি মাদীটা নিজের বাটি থেকেও খেতে শিখলো, কিন্তু ওর মন পড়ে থাকতো অ্যামোসের বাটি থেকে ভাগ বসানোতে।
সস্ত্রীক অ্যামোসকে লিভারপুলে নামিয়ে দেওয়ার পর ওদের যখন গাড়িতে চড়ে চিড়িয়াখানার উদ্দেশ্যে চলে যেতে দেখলাম, তখন আমার মনে ওদের ঠিকভাবে নিয়ে আসতে পারার জন্যে গর্বই হচ্ছিলো, কারণ পিপীলিকাভূকদের বন্দীদশায় বাঁচিয়ে রাখা খুবই কঠিন কাজ।