পিন্টু ও একটি চশমা

ঘড়ির দিকে আরেকবার তাকালাম। প্রায় সাড়ে সাতটা। ইতিহাসটা নিয়ে বসেছি বটে, কিন্তু চোখদুটো খুব বেশিক্ষন বইয়ের পাতার দিকে থাকছে না। অন্যান্য দিন ইতিহাস পড়তে বসলে এই সময়ে রানা প্রতাপের চৈতক লাফ দিয়ে পেরিয়ে যায় দুই পাহাড়ের মধ্যের গভীর খাদ বা পৃত্থীরাজের ঘোড়া টগবগিয়ে পিছনে ফেলে দেয় পিছু নিয়ে আসা সৈন্যের দল নাহলে কখনো কখনো দুই দলে লেগে যায় প্রচন্ড লড়াই। যাদের কথা বইতে পড়ি, তাদের সব্বাইকে যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে গল্পের মত। আজকে শিবাজীর গল্প পড়ছিলাম। কি দারুনভাবে শিবাজী পালিয়ে যাবেন ফুলের টুকরিতে লুকিয়ে। কিন্তু সেই দৃশ্যটা সিনেমার মত চোখের সামনে ভেসে উঠছে না। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে পড়ায় মন নেই। আজকে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে যে আমি আর টুবলু দুজনেই বেশ কিছুটা চমকে গেছি। এমনিতে কোন ব্যাপারেই আমাদের জুড়ি মেলা ভার। আমরা খেলাধুলোয় চ্যাম্পিয়ন, কোন কিছুতে ভয়ও পাই না, পড়াশুনোয় যে একেবারে ধ্যাদ্ধেড়ে এমনও নয় কিন্তু তা সত্তেও এমন একটা ঘটনাবে যে আমরা এক্কেবারে চুপসে যাব, তা কক্ষনও  ভাবিনি। চোখ বারবার চলে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটার দিকে। আটটা কতক্ষনে বাজবে কে জানে?

এই সবের মূলে আছে বিন্তি, আমার পিসতুতো বোন। আমাদের চেয়ে এক ক্লাস নিচুতে পড়ে। ওকে দেখতে খুদে এইটুকুন হলে কি হবে, ওর চোখেমুখে কথার খই ফোটে। প্রতিবারই পিসিরা যখন ছুটিতে আমাদের বাড়ি আসে, তখন কিছু না কিছু করে আমাকে চমকে দেয়। এবারে আমি আর পিন্টু দুজনেই ঠিক করে রেখেছিলাম, যে বিন্তি যাই করুক না কেন, ওকে আমাদের টেক্কা দিতে দেওয়া চলবে না। সে গুড়ে বালি। আজকে বিকেলে খেলে যথারীতি নোংরা হয়ে ঘামে ভিজে আমরা বাড়ি ফিরছি, এমন সময় দেখি ও একটা অদ্ভূত চশমা পরে আমাদের বাগানে ঘুরছে – তাও আবার একা একা। অদ্ভূত বললাম এই কারনে, যে চশমাটা ওর চোখের তুলনায় বেশ বড় আর ওর তো চোখ খারাপ নয় যে চশমা পড়বে।

আমার বা টুবলুর কারোরই চশমা নেই। তাই একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, “কি রে, তুই অত্তবড় একটা চশমা নাকের ওপর চড়িয়েছিস কেন?”
এমনিতে বিন্তি খুব ছটফটে, হাসিখুশি। কিন্তু আজ সে মুখ গম্ভীর করে বলল, “তোরা বুঝবি না।”
বুঝব না? এই কথা শুনলে কার না রাগ হয়। আমি চোখের ঈশারায় একবার টুবলুর সাথে  কথা বলে নিলাম। তারপর কোন রকমে রাগ চেপে বললাম – “বুঝব না মানে? তুই আমার ছোটবোন হয়ে বুঝবি আর আমরা বুঝব না?”
-“না, মানে বুঝতে না পারলে আমায় বলতে আসিস না। এ অনেক জটিল ব্যাপার।”
-“তা শুনি কিরকম জটিল ব্যাপার?”
-“এ যে সে চশমা নয়। এটা স্পেকট্রোস্কোপ”

একটু থমকে গেলাম। স্টেথিস্কোপ, টেলিস্কোপ, পেরিস্কোপ শুনেছি। স্পেকট্রোস্কোপটা আবার কি? আমি আর টুবলু আবার চোখাচোখি করলাম। ও ও জানে না। কিন্তু একটু কটমট করে তাকালো, যার মানে হচ্ছে এত সহজে ব্যাপারটা মেনে নিলে চলবে না।
একটু ঢোক গিলে বললাম, “স্পেকট্রোস্কোপ আবার কি?”
-“সারাদিন মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াবি তো আর জানবি কি করে। এটা একটা যন্ত্র। এটা দিয়ে ভূত দেখা যায়”
টুবলু এতক্ষন চুপ করে ছিল। এবার একটু গাঁইগুই করে বললে, “ভূত বলে কিছু নেই।”
-“আচ্ছা, তাই নাকি? কে বলেছে যে ভূত নেই?”
টুবলু বলল, “বেশ তো, আছেই যদি তবে দে দেখি তোর চশমাটা, আমরাও দেখি।”
-“প্রথম  কথা এটা চশমা নয় একটা যন্ত্র। আর দ্বিতীয়তঃ তোদের চিল্লামিল্লিতে ভূত পালিয়ে গেছে।”
-“বাহ, তাহলে প্রমান হবে কি করে?”
-“প্রমান হবে। আজ রাত আটটায়।”
ঠিক কি করে প্রমান হবে জানতে চাইছিলাম, তার আগেই বিন্তি আর কিছু না বলে একছুটে বাড়ির মধ্যে পালাল।
টুবলু খানিক দাঁড়িয়ে, মাথা চুলকে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দেওয়ার আগে আমার দিকে ভ্যাবলার মত চাইল। এমনিতে আমাদের দুজনের মধ্যে ও-ই একটু বেশি ওয়াকিবহাল সব বিষয়ে। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি যে এবারে বেড়াতে এসেও বিন্তি বেশ একচোট নিয়ে গেল দেখে ও মনে মনে একটু দমে গেছে। আর কিছু না বলেই টুবলুও নিজের বাড়ির দিকে চলে গেল। ভাবখানা এই যে – “আমি তো আর রাত আটটার সময় এইখানে থাকতে পারব না। তুই কিন্তু চোখ কান খোলা রাখিস।” কিন্তু আমি তো আর সর্বজ্ঞ নই। এমনিতেই টুবলু পাশে না থাকলে আমার সাহস কমে আসে। এখানে অবশ্য সাহসের প্রশ্ন না। চোখা কান খোলা রাখতে হবে আর কি।

 

বাড়ি ঢুকে যথারীতি মার কাছে রোজকার বরাদ্দ একটু বকুনি খেয়ে হাত পা ধুয়ে পড়তে বসেছি। পিসিরা এসেছে বলে যে আমার পড়ার ছুটি তা নয়। মা’র কড়া শাসন – অন্ততঃ দুঘন্টা পড়তেই হবে, নইলে কপালে দুঃখ আছে। আগে যে কয়েকবার সে দুঃখ আমায় পেতে হয়েছে তা ভুলিনি। পিঠটা বেশ চড়চড় করে উঠেছিল। এখন পিসিরা এসেছে। এর মধ্যে বিন্তি যদি শোনে আমি মার খেয়েছি না পড়ার জন্য তাহলে যেটুকু প্রেস্টিজ আছে তার আর ছিঁটেফোটাও বাকী থাকবে না। কাজেই রোজকার মত টেবিল চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছি আর ভাবছি কি করে সময়টা কাটানো যায়। পড়ার জন্য বরাদ্দ এই দুঘন্টা শেষ হবে সাড়ে সেই আটটায়। মা গরম দুধের গ্লাসটা দিয়ে গেছে টেবিলে। সেটা ঠান্ডা হলেও শেষ হয়নি। আরো কিছুক্ষন পঁয়ষট্টি পাতায় আটকে রইলাম। ইচ্ছে করেই ইতিহাসটা নিয়ে বসেছি। কারন কেউ জিজ্ঞেস করলে তালে গোলে একটা কিছু বলে দেওয়া যায়। নিদেন পক্ষে আগের চ্যাপ্টারটাই বলে দেওয়া যাবে। অঙ্ক নিয়ে বসলে যদি খাতা সাদাই থেকে যায়, তাহলে মুশকিল।

এদিকে মুশকিল হচ্ছে আমার টেবিলে কোন ঘড়ি নেই। সেটা আছে পিছন দিকে, মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছি কটা বাজল। শেষ পনেরো মিনিট যেন কাটতেই চাইছে না।  মনে মনে ভাবছি কি করেই বা প্রমান হবে। বিন্তি আটটার সময় ঠিক কি করবে? আর যদি প্রমান করেই দেয় – তার মানে কি এই যে আমাদের বাড়ির চারপাশে জলজ্যান্ত সব ভূত ঘুরে বেড়াচ্ছে? আমরা তো আবার খালি চোখে ওদের দেখতে পাই না। তার মানে কি এরকম হতে পারে এই ঘুরে বেড়াচ্ছি আর একটা ভূতের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেল, তাহলে কি আমরা বুঝতে পারব? না কি পারব না? এতদিন কেটে গেছে কিন্তু আমরা ভূতেদের সম্পর্কে কত কম জানি। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে একবার জানলার বাইরের দিকে চোখ গেল। মনে হল অন্ধকারে কি যেন একটা নড়ে গেল। শিউরে উঠলাম। গল্পে যে বলে ভূত নাকি অন্ধকারেই থাকতে ভালোবাসে। ঐ ভূতুড়ে চশমার টানে ওরা এসে এই বাগানের গাছ গুলোতে জটলা পাকিয়েছে কিনা কে জানে? আবার একটা লেবু গাছও আছে। কথাটা ভাবতেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেমন যেন শিউরে উঠল একটু। ভূত আছে কি নেই সেই প্রমানটা না নিলেই নয়? উফফ! এই সময় যদি টুবলুটা পাশে থাকতো।

এমন সময় বারান্দার ঘড়িটায় ঢং ঢং করে আটটা বাজল।

শিবাজীর রাজ্যবিস্তার আর পড়া হল না। আরো খানিকক্ষন এদিক ওদিক করে বই ফেলে উঠে পড়লাম। বাইরের ঘরে আড্ডা বসেছে। বড়রা সবাই, বিন্তিও আছে সেখানে। আমিও পায়ে পায়ে সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। সবাই না না রকম কথা বলছে। কিন্তু সেদিকে আমার কান যাচ্ছে না। পিসেমশাই বলছিলেন যে বিন্তি কিরকম ভালো পড়াশোনা করছে, আবৃত্তিতেও প্রাইজ পাচ্ছে। এসব তো আমি জানিই। আমিও প্রত্যেক বছর এক আধটা প্রাইজ পেয়েই যাই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় – সেকথা কেউ তুললোই না।

ঘন্টাখানেক চলার পর মা এসে সবাইকে খেতে ডাকতে সব্বাই উঠে পড়ল। আমি আর বিন্তি পাশাপাশিই বসেছিলাম। ওকে জিজ্ঞেস করলাম যে কি রে প্রমানটা কি হল?
বিন্তি বললে, “প্রমানের আর কি আছে, সেটা তো প্রোফেসর শঙ্কুই করে দিয়েছেন। তবে আমি একটা ছোট্ট প্রমান দিচ্ছি তুই আজকে দুঘন্টা ধরে বসে কেবল পঁয়ষট্টি পাতা ওলোট পালোট করেছিস। কিচ্ছু পড়িস নি।” প্রোফেসর শঙ্কুর নামটা কোথাও যেন শুনেছি। পেটে আসছে মুখে আসছে না। আর ও জানলোই বা কি করে যে আমি পড়তে বসেও পড়িনি। সব মিলে কিন্তু কিন্তু করছি এমন সময় বাবা আমাদের কথা শুনতে পেয়ে বললেন, “কিসের প্রমান নিয়ে কথা হচ্ছে শুনি?”
বিন্তিটা এত পাজি দুম করে কথা পালটে ফেলে অন্য একদিন ইস্কুলে কি হয়েছে সেই ঘটনায় চলে গেল। আমি বেগতিক দেখে চুপ করে গেলাম। পড়ায় ফাঁকি মেরেছি এটা যত গোপন থাকে ততই ভালো। বাড়ি ঢুকে যথারীতি মার কাছে রোজকার বরাদ্দ একটু বকুনি খেয়ে হাত পা ধুয়ে পড়তে বসেছি। পিসিরা এসেছে বলে যে আমার পড়ার ছুটি তা নয়। মা’র কড়া শাসন – অন্ততঃ দুঘন্টা পড়তেই হবে, নইলে কপালে দুঃখ আছে। আগে যে কয়েকবার সে দুঃখ আমায় পেতে হয়েছে তা ভুলিনি। পিঠটা বেশ চড়চড় করে উঠেছিল। এখন পিসিরা এসেছে। এর মধ্যে বিন্তি যদি শোনে আমি মার খেয়েছি না পড়ার জন্য তাহলে যেটুকু প্রেস্টিজ আছে তার আর ছিঁটেফোটাও বাকী থাকবে না। কাজেই রোজকার মত টেবিল চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছি আর ভাবছি কি করে সময়টা কাটানো যায়। পড়ার জন্য বরাদ্দ এই দুঘন্টা শেষ হবে সাড়ে সেই আটটায়। মা গরম দুধের গ্লাসটা দিয়ে গেছে টেবিলে। সেটা ঠান্ডা হলেও শেষ হয়নি। আরো কিছুক্ষন পঁয়ষট্টি পাতায় আটকে রইলাম। ইচ্ছে করেই ইতিহাসটা নিয়ে বসেছি। কারন কেউ জিজ্ঞেস করলে তালে গোলে একটা কিছু বলে দেওয়া যায়। নিদেন পক্ষে আগের চ্যাপ্টারটাই বলে দেওয়া যাবে। অঙ্ক নিয়ে বসলে যদি খাতা সাদাই থেকে যায়, তাহলে মুশকিল।

এদিকে মুশকিল হচ্ছে আমার টেবিলে কোন ঘড়ি নেই। সেটা আছে পিছন দিকে, মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছি কটা বাজল। শেষ পনেরো মিনিট যেন কাটতেই চাইছে না।  মনে মনে ভাবছি কি করেই বা প্রমান হবে। বিন্তি আটটার সময় ঠিক কি করবে? আর যদি প্রমান করেই দেয় – তার মানে কি এই যে আমাদের বাড়ির চারপাশে জলজ্যান্ত সব ভূত ঘুরে বেড়াচ্ছে? আমরা তো আবার খালি চোখে ওদের দেখতে পাই না। তার মানে কি এরকম হতে পারে এই ঘুরে বেড়াচ্ছি আর একটা ভূতের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেল, তাহলে কি আমরা বুঝতে পারব? না কি পারব না? এতদিন কেটে গেছে কিন্তু আমরা ভূতেদের সম্পর্কে কত কম জানি। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে একবার জানলার বাইরের দিকে চোখ গেল। মনে হল অন্ধকারে কি যেন একটা নড়ে গেল। শিউরে উঠলাম। গল্পে যে বলে ভূত নাকি অন্ধকারেই থাকতে ভালোবাসে। ঐ ভূতুড়ে চশমার টানে ওরা এসে এই বাগানের গাছ গুলোতে জটলা পাকিয়েছে কিনা কে জানে? আবার একটা লেবু গাছও আছে। কথাটা ভাবতেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেমন যেন শিউরে উঠল একটু। ভূত আছে কি নেই সেই প্রমানটা না নিলেই নয়? উফফ! এই সময় যদি টুবলুটা পাশে থাকতো।

এমন সময় বারান্দার ঘড়িটায় ঢং ঢং করে আটটা বাজল।

শিবাজীর রাজ্যবিস্তার আর পড়া হল না। আরো খানিকক্ষন এদিক ওদিক করে বই ফেলে উঠে পড়লাম। বাইরের ঘরে আড্ডা বসেছে। বড়রা সবাই, বিন্তিও আছে সেখানে। আমিও পায়ে পায়ে সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। সবাই না না রকম কথা বলছে। কিন্তু সেদিকে আমার কান যাচ্ছে না। পিসেমশাই বলছিলেন যে বিন্তি কিরকম ভালো পড়াশোনা করছে, আবৃত্তিতেও প্রাইজ পাচ্ছে। এসব তো আমি জানিই। আমিও প্রত্যেক বছর এক আধটা প্রাইজ পেয়েই যাই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় – সেকথা কেউ তুললোই না।

ঘন্টাখানেক চলার পর মা এসে সবাইকে খেতে ডাকতে সব্বাই উঠে পড়ল। আমি আর বিন্তি পাশাপাশিই বসেছিলাম। ওকে জিজ্ঞেস করলাম যে কি রে প্রমানটা কি হল?
বিন্তি বললে, “প্রমানের আর কি আছে, সেটা তো প্রোফেসর শঙ্কুই করে দিয়েছেন। তবে আমি একটা ছোট্ট প্রমান দিচ্ছি তুই আজকে দুঘন্টা ধরে বসে কেবল পঁয়ষট্টি পাতা ওলোট পালোট করেছিস। কিচ্ছু পড়িস নি।” প্রোফেসর শঙ্কুর নামটা কোথাও যেন শুনেছি। পেটে আসছে মুখে আসছে না। আর ও জানলোই বা কি করে যে আমি পড়তে বসেও পড়িনি। সব মিলে কিন্তু কিন্তু করছি এমন সময় বাবা আমাদের কথা শুনতে পেয়ে বললেন, “কিসের প্রমান নিয়ে কথা হচ্ছে শুনি?”
বিন্তিটা এত পাজি দুম করে কথা পালটে ফেলে অন্য একদিন ইস্কুলে কি হয়েছে সেই ঘটনায় চলে গেল। আমি বেগতিক দেখে চুপ করে গেলাম। পড়ায় ফাঁকি মেরেছি এটা যত গোপন থাকে ততই ভালো।

 

সকাল হতে না হতেই টুবলু এসে হাজির। উত্তেজনার চোটে ও ও নাকি কালকে এক্কেবারে পড়ায় মন বসাতে পারেনি। অঙ্কস্যার এসেছিলেন পড়াতে। তার কাছে দুটো বোকার মত ভুল করে মারও খেয়েছে। যা বুঝলাম তাতে ঘুমও বড় একটা হয়নি।
“প্রোফেসর শঙ্কু? তুই ঠিক শুনেছিস?”
“এক্কেবারে। কে বলতো তিনি?”
“আমার মনে হচ্ছে আমি একটা বইয়ে পড়েছি”
“কি পড়েছিস?”
“উনি মনে হয় একজন বৈজ্ঞানিক।”
“আমারও তাই মনে হয়। কোথাও যেন নামটা শুনেছি”
“কিন্তু তাই বলে ও জানলো কি করে যে তুই পড়তে না বসে ফাঁকি মেরেছিস”
“আরে সেটা আমি কি করে বলব, ওকে জিজ্ঞেস করলে হত না?”

আমাদের আলোচনা হচ্ছিল বাগানের এক কোনে। খানিক বাদে বিন্তিকেও সেদিকে আসতে দেখা গেল। আমি একটু গলাটা পরিষ্কার করে বললাম, “আচ্ছা, কালকে তুই কি করে জানলি যে আমি পড়ায় ফাঁকি দিচ্ছিলাম?”
বিন্তি অম্লান বদনে বলল, “আমাকে ভূতটা এসে খবর দিয়ে গেল যে”
টুবলু বলল, “কি খবর দিল?”
“এই যে তুই অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের কাছে মার খেলি বা পিন্টু পড়তে বসেছে বটে কিন্তু আদপে পড়ছে না”
“বটে, তা ভূতে আজকাল এইসব খবর দিয়ে বেড়াচ্ছে বুঝি? তাদের আর কোন কাজ নেই?”
“কাজ থাকবে না কেন? তবে ভালো করে ডেকে বললে তারা এইসব করে দিয়ে যায়”
“বেশ তো তা আমাদের একবার চশমাটা দেখা না বাপু। তাহলেই তো সব গোল মিটে যায়”
“উঁহু, সে হওয়ার নয়। চশমাটা আমাকে গিয়েই প্রোফেসর শঙ্কুর কাছে ফেরত দিতে হবে। উনি আমাকে বিশ্বাস করে জিনিসটা দিয়েছেন বটে। তার মানে এই নয় যে আমি সব্বাইকে দেখিয়ে বেড়াব। যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি ওনাকে কি বলব?”
আমরা দুজনেই ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “প্রোফেসর শঙ্কুকে তুই চিনিস নাকি?”
“কেন চিনব না? সারা পৃথিবীর লোক ওনাকে চেনে। উনি এত বড় বৈজ্ঞানিক। আবিষ্কারক। কত দেশ বিদেশের লোক তো ভারতে আসেই কেবল ওনার সাথে দেখা করার জন্য”
আমি বললাম, “তা তোর সঙ্গে কোথায় দেখা হল?”
“কোথায় আবার, গিরিডিতে। উনি তো ওখানেই থাকেন। লোকজনের সঙ্গে বেশী মিশতে চান না। নিরিবিলি পছন্দ করেন। সেবার আমরা যখন গেলাম সেদিন উশ্রী নদীর ধারে মর্নিং ওয়াক করার সময় দেখা হয়ে গেল। আলাপ হওয়ার পর উনি এই যন্ত্রটা আমাকে কদিনে জন্য দিলেন।”
এরপর কিছু কথা বলা চলেনা। বিন্তির সঙ্গে আমাদের সন্ধি হয়ে গেল। আমরা দেখলাম আমরাও ওর কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারছি। এইসব বলে বন্ধু মহলে তাক লাগিয়ে দেওয়ার অনেক সুযোগ আছে। তাছাড়া বিন্তি বলে গেল ওর কাছে নাকি প্রোফেসর শঙ্কু একটা ফর্মুলা দিয়েছেন – সেটা দিয়ে অদৃশ্য হওয়ার ওষুধ তৈরী করা যায়। কয়েকটা কেমিকাল লাগে, তবে ও আমাদের বলে যাবে। তারপর সেটা তৈরী করে নিতে হবে। কয়েকটা দিন হইহই করে কাটল। আর সত্যিই বিন্তি কাগজে করে আমাদের ফর্মুলাটা লিখে দিয়ে গেল।

 

আমরা দুজনে খেলার মাঠে পিঠে পিঠ টেকিয়ে বসেছিলাম। আজকে মাঠে এসেও খেলিনি।

একটু আগেই বাবাইদাদার কাছে গিয়েছিলাম ফর্মুলাটা নিয়ে। বাবাইদা ডাক্তারি পড়ছে কলকাতায় গিয়ে। আমরা ভাবছিলাম যদি দু একটা করে কেমিকালগুলো এনে দিতে পারে, কিংবা অন্ততঃ যদি উপায়টা বাতলে দিতে পারে। বাবাইদা কাগজটা দেখে আমাদের মুখের দিকে খানিকক্ষন তাকিয়ে তারপর হো হো করে হেসে উঠল। সে হাসি আর থামতেই চায় না। তারপর বললে , “বাবুইয়ের ডিমের সঙ্গে এক্সট্র্যাক্ট অফ গরগনাস? হো হো হো!”
আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি দেখে বাবাইদা খুলে বললো, “ওরে গাধা, প্রোফেসর শঙ্কুর বই থেকে টুকে এনেছিস এইসব? উনি কি আর সত্যি বিজ্ঞানী? উনি তো গপ্পের বিজ্ঞানী রে।”
আমি বললাম, “আমার পিসতুতো বোন যে ওনার সঙ্গে দেখা করে এই ফর্মুলা পেয়েছে বলল?”
“ওরে গাধা কি আর সাধে বলি? তোদের স্রেফ বোকা বানিয়েছে একটা পুঁচকে মেয়ে।”

সেই থেকে আমরা দুজনেই বেশ মুষড়ে পড়েছি। টুবলু অনেকক্ষন চুপ করে বসেছিল। এবার হঠাৎ তুড়ি মেরে লাফিয়ে উঠে বললে, “এইবারে বুঝেছি!”
আমি চমকে বললাম, “কি বুঝেছিস রে?”
“আরে সেদিন চমকে গিয়ে আমরা এক রকম ধরেই নিয়েছিলাম যে বিন্তি ভূতের কাছ থেকে জানতে পেরেছে আমরা সেদিন কি করছিলাম। এখন বুঝতে পেরেছি আসলে কি হয়েছে। মনে আছে তুই আমাকে বলেছিলি যে সেদিন কি যেন একটা জানলার সামনে দিয়ে চলে গেল?”
“হ্যাঁ, কিছু একটা হবে, কেন?”
“আরে ওটা বিন্তিই ছিল, নইলে আর জানলো কি করে যে তুই কত পাতায় কি পড়ছিলিস?”
এতক্ষনে ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল। তার মানে আগাগোড়াই আমাদের বোকা বানিয়েছে। কিন্তু তাহলে টুবলুর ব্যাপারটা ও জানল কি করে? টুবলুকে জিজ্ঞেস করতে বলল, “আরে ওটা স্রেফ আন্দাজে ঢিল। সেদিন বিকেলেই বলতে বলতে আসছিলাম না আজকে আবার অঙ্ক স্যার আসবেন? আর ও নিশ্চয় সেটা শুনে নিয়েছিল। এমন একটা গল্প আমাদের শোনালো যে জানতোই পড়ায় আমাদের মন বসবে না। তাহলে এটা আন্দাজ করা আর কি এমন মুশকিল যে স্যারের হাতে ধোলাই খেয়েছি। আর তারপর এক ফাঁকে এসে জানালা দিয়ে দেখে গেল তুই কি পড়ছিস।”
আমিও ব্যাপারটা বুঝে ঘাড় নাড়লাম।

চশমাটাও তিনতলার ঘরে পাওয়া গেছে। সেটা নেহাতই একটা পুরনো চশমা। ভূত টুত দূরে থাক, এমনিই কিছু দেখা যায় না। যাইহোক, প্রথমে ভেবেছিলাম একটা কড়া চিঠি লিখে এক হাত নেবো। কিন্তু শেষমেষ টুবলুই বুদ্ধিটা দিল। বলল, “আমরা যে এক্কেবারে বেকুব বনেছি সেটা আবার লিখে বসিস না যেন। বরং এইরকম লেখ যে তোর কাছ থেকে ফর্মুলাটা পেয়ে দারুন লাভ হয়েছে, আমরা অদৃশ্য হয়ে এখানে দারুন মজা করে বেড়াচ্ছি।” সেই মতই চিঠিটা লিখতে শুরু করেছি। যে কোন দিন পোস্ট করে দিলেই হল।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!