
মাঝরাতে হুট করেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল পিদিমের। নাঁকি সুরে কান্নার আওয়াপ আসছে কোথেকে?পাশের বাড়ির বিড়ালটা?ওর কান্না অবিকল পিদিমের ছোট ভাই তুতুনের মতো। গত মাসে তুতুনের বয়স দুই পেরিয়েছে। খুব একটা গা না করে পিদিম পাশ ফিরে শুলো। চোখটা বন্ধ করতে যাবে এমন সময় কোত্থেকে যেন এক উটকো গন্ধ নাকে এসে লাগলো। বাজার থেকে বাবা যখন মাছ কিনে কুটতে দেয়, সেই গন্ধের সঙ্গে লোনা ধরা পুরোনো বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে শ্যাওলার যে ভিজে ভিজে গন্ধ পাওয়া যায়- সেটার মিশেলে একটা গন্ধ। মাছ খুব একটা পছন্দ না পিদিমের। মাছের গন্ধ তো নয়ই। রাস্তার পাশের নালাটায় আবার কিছু পঁচেছে – এই ধরে নিয়ে জানালাটা বন্ধ করতে যাবে, ঠিক এমন সময়েই নাঁকি কান্নার পাশাপাশি পিদিমের কানে এলো কাশির খকখক শব্দ।
এবার আওয়াজটা এলো পিদিমের পড়ার টেবিলের সামনে রাখা চেয়ার থেকেই! ক্লাস টুতে পড়া পিদিমের স্কুলে সাহসী হিসেবে সুনাম আছে। একবার খালি হাতেই তুষ্টির চুলে এসে পড়া উড়ুক্কু তেলাপোকা ধরে ফেলেছিল সে। খুব বেশি ভয় না পেয়ে পা টিপে টিপে ঘরের বাতিটা জ্বালিয়ে ফেললো সে। এবারে যা দেখলো, তাতে ভয় না পেয়ে উপায় নেই। পেট মোটা, ইয়া বড় ল্যাজের সারা গায়ে খাঁজকাটা জলপাই রঙের এক মস্ত কুমির বসে আছে চেয়ার জুড়ে। মুখে যে দাঁতের বহরটা ভালোই, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে লম্বা চোয়ালের ধারালো পাশটুকু দেখে। শরীরের তুলনায় ছোট ছোট চার পায়ের ওপরের দুটি হাতের মতোই ব্যবহার করছে সে। ডান হাতে একটা রুমাল ধরে হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে কুমির বাবাজি। নিজের ঘরে জ্বলজ্যান্ত কুমির দেখে ততক্ষণে ভয়ে কাঠ পিদিম। ময়লা মতো রুমালটা দিয়ে ফোৎ করে কুমিরটা নাক ঝাড়তেই সম্বিত ফিরলো পিদিমের। ঢোক গিলে কয়েক পা এগুলো দরজার দিকে।
আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দাটা পেরোলেই বাবা-মায়ের ঘর। ওদের গিয়ে ডাকলেই তো হয়! পা টিপে টিপে পিদিমকে পালাতে দেখেই কিনা কে জানে, ঘড়ঘড়ে একটা আওয়াজ তুলে কুমিরটা বলে উঠলো, ‘পিদিম, ও পিদিম! কোথায় যাও?’ সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লো পিদিম। কুমির, তাও আবার কথা বলে! নাহ, এর তো একটা হেস্ত নেস্ত করতেই হচ্ছে! বুকে যতোটা সম্ভব সাহস এনে পিদিম কুমিরের দিকে এগিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কে? এখানে কি?” “কী জ্বালা! দেখতেই পাচ্ছো আমি একটা কুমির।” “তা তো বুঝলাম। কিন্তু তোমার তো থাকার কথা নদীতে। ঢাকা শহরের এই ইটের বিল্ডিংয়ে এলে কী করে?” “সে বিরাট গল্প। বাঁশখালি নদীর লঞ্চে যখন উঠলাম, ভয়ে সবাই পানিতে ঝাঁপ দিল! এরপরও অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে বুড়িগঙ্গায় ঠেকলাম। ওমা, সদরঘাটে কেউ দেখি কখনও কুমির দেখেনি! সবাই দিগ্বিদিক ছুট! তারপর কত হল্লা করে, হাঙ্গামা চুকিয়ে তোমাদের বাসায় এসে পৌঁছালাম, সে আর কি বলবো!” “ তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু কেন এলে এতো ঝামেলা করে? আমাদের গিলে খেতে বুঝি?” “ধুত্তোরি! তাই যদি পারতাম, তবে কি আর ফোঁস ফোঁস করে কাঁদি? পোড়া কপাল আমার। দিন দশেক হল সামনের পাটির চারটা দাঁতে ভীষণ ব্যাথা। না পারছি কিছু কামড়ে ধরতে, না পারছি এই ব্যাথা সহ্য করতে।
এদিকে না খেতে পেয়ে কেমন শুকিয়ে গেছি, এই কদিনেই দেখো!” কুমিরের ইয়া মোটা পেটের দিকে তাকিয়ে সেরকম কিছু অবশ্য মনে হলো না পিদিমের। তবুও বললো, “আমার মায়ের কাছে এসেছো? সে ডেন্টিস্ট। তোমার দাঁত সারিয়ে দেবে, তাই?” “হঁ্যা! সে আশাতেই তো আসা। এই দেখ দাঁতের কী অবস্থা!” চোঙার মতো মুখটা হাঁ করতেই সামনের দিকের হলদে দাঁতগুলো চোখে পড়লো পিদিমের। “ইশ! কী অবস্থা দাঁতের! নিশ্চয়ই দাঁত মাজোনি? আর এতো দেখছি পোকার আড্ডাখানা। অনেক বেশি চকলেট খাও বুঝি?” “চকলেট? ওয়াক থু! ওসব মিষ্টি মিষ্টি ছোট ছোট জিনিস কেউ খায়? আমরা খাই নদীর বোয়াল, চরের বালিহাঁস, আর লাল লাল কাঁকড়া। কপাল মন্দ থাকলে ব্যাঙ আর ইঁদুরেও দিন চলে যায়। “ইঁদুর?! ছি ছি ছি। ওটা কেউ খায়? পাশের বাড়ির মিনিটাও তো ইঁদুর কেবল খেলার জন্যই ধরে। খায় না মোটেও। তোমার ঘেন্না লাগে না?” “ঘেন্না? কেন? খাবারে আবার ঘেন্না কিসের? আমরা তো সব খাই! তুমি যদি কেবল জানতে, মোটা মোটা ইঁদুরের টসটসে রসালো মাংস কত মজাদার–” “থাক থাক, হয়েছে। আর বলতে হবে না।
শুনেই তো বমি আসছে। এরকম করে সবকিছু খাও দেখেই তো এত্তো মোটা তুমি!” “মোটা? কই? আমার ওজন তো মোটে সাড়ে আটশ কেজি। লম্বায়ও আমি বেশি নই। মোটে সাড়ে পাঁচ ফিট। আমার দাদার বাবাকে যদি দেখতে, তবে বুঝতে বিশাল বপু কাকে বলে! তার সাড়ে ছয় ফিট লম্বা শরীরের ওজন ছিল দেড় হাজার কেজি!” শুনতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল পিদিমের। “ওরে বাবা! উনি তো তাহলে কুমিরদের জগতের নীল তিমি ছিলেন!” “তবে আর বলছি কি? সত্যিই বাঁশখালি তীরের গর্ব ছিলেন আমার দাদার বাবা। বেঁচেও ছিলেন অনেক দিন! পাক্কা আশি বছর!” “সত্যি? তোমরা এতো বছর বাঁচ?” “ওমা! বাঁচবো না কেন? আমার নিজেরই তো বয়স সাড়ে পঞ্চান্ন! আমরা, কুমিরেরা গড়ে পঁয়ত্রিশ থেকে পঁচাত্তর বছর বাঁচি।” “কিন্তু এরকম বিশাল শরীর নিয়ে তোমরা চলো কিভাবে? নিশ্চয়ই দুগজ যেতেই দম ফুরিয়ে যায় তোমাদের?” “কে বলেছে? গায়ে হয়তো মাংস একটু বেশিই। তাই বলে কী শক্তি নেই, ভেবেছো? সরিসৃপদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষিপ্রদের মধ্যে অন্যতম আমরা।
বড় বড় শিকারকে অতর্কিতে হামলা করে মুহূর্তেই শেষ করে দিতে পারি আমরা। আর জলে তো রীতিমতো ঘণ্টায় বিশ মাইল বেগে সাঁতরাতে পারি।” “হুম। অনেক ভাল সাঁতরাও বটে তোমরা, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তবে মাথায় তোমাদের বুদ্ধি-সুদ্ধি নেই মোটেই।” এবারে একটু রেগেই গেল কুমির। ফোৎ করে আরেকবার রুমালে নাক ঝেঁড়ে গম্ভীর গলায় বললো, “কি দেখে তোমার মনে হলো এ কথা?” “বারে! ওই যে শেয়াল পণ্ডিতের কথা মনে নেই? তোমাদেরই কোন জ্ঞাতিভাইকে বোকা বানিয়ে তার সাত ছানাকে খেয়ে ফেলেছিল সে। মুর্খ সেই কুমিরের গল্প ‘ঠাকুরমার ঝুলি’তে কতো পড়েছি!” কুমির এবারে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, “সে তো অনেক আগের কথা। এখন আর সেই শেয়ালপণ্ডিতও নেই, নেই সেই বোকা কুমিরও।
তবে তোমাকে আমি হলপ করে বলতে পারি, আফ্রিকাতে থাকা আমাদেরই অনেক জ্ঞাতিভাই শেয়ালের চেয়েও বড় বড় প্রাণি শিকার করে খায়!” এবার পিদিমের চোয়াল গেল ঝুলে। “সে কি! আফ্রিকাতেও?” “শুধু কি আফ্রিকায়? আমরা, কুমিরের জাত তো ছড়িয়ে আছি গোটা বিশ্বের প্রায় সব গরম দেশেই। সব মিলিয়ে চৌদ্দ জাতের কুমির রয়েছে বিশ্বজুড়ে।” “বলো কি! তা, অন্য অঞ্চলের কুমিররাও কি একই রকমের হয়?” “কমবেশি আমরা সবাই একই রকম। তবে লোনা পানির কুমিরেরা মিঠা পানির কুমিরদের থেকে গায়ে গতরে বড় হয় অনেক। বড় বড় নদীর কুমিররাও আকারে অনেক বড় হয়। ওদের খাদ্যাভাসও অনেক অন্যরকম। এই যেমন ধর নীল নদের কুমিররা হরিণ, মহিষ, বুনো শূকর ধরে ধরে খায়। ওদিকে অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রের কাছাকাছি প্রণালিগুলোর কুমিররা ভাগ্য ভাল থাকলে মাঝে মধ্যে হাঙরের মতো বড় প্রাণি দিয়েও দুপুরের খাবারটা সেরে নেয়!” এসব শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো পিদিমের। “তোমরা তো তবে মারাত্মক জীব।
আমি তো শুনেছি, তোমরা নাকি মানুষও খাও!” “সে মাঝে মধ্যে খাই বইকি! তবে তা নিতান্তই বাগে পেলে। আর মানুষও তো আমাদের বাগে পেলেই মারে। কুমির শিকার বেআইনি জেনেও অনেকেই আমাদের ধরে নিয়ে যায়। আমাদের চামড়ার তৈরি ব্যাগের নাকি অনেক দাম তোমাদের বাজারগুলোতে?” ভয়ে ভয়ে পিদিম বললো, “ওসব নিশ্চয়ই দুষ্টু লোকদের কাজ। ভাল মানুষরা তো আর বেআইনি কাজ করে না। সে যাই হোক, আমাদের ধরে আবার খেয়ে ফেলবে না তো তুমি?” কুমির এবার একটু হেসে বললো, “না, না। তোমাদের আমি মারবো না। দাঁতের ব্যাথায় মরছি ভাই।
আমার ৮০টা দাঁতের অনেকগুলোই পড়ে গেছে। আবার গজিয়ে যাবে তাড়াতাড়ি জানি। জানো তো, আমাদের দাঁত পড়ে গেলেও গজিয়ে যায়। কিন্তু এই চারটে দাঁত পোকায় খাওয়ায় তো ভারি অসুবিধা। যাও না, তোমার মা কে একটু ডেকে নিয়ে এসো। প্লিইইইজ!!” পিদিমের মনে এবার একটু দয়া হল। বারান্দা দিয়ে চলতে শুরু করলো বাবা-মায়ের ঘরের দিকে। রাত পেরিয়ে কখন ভোর হয়ে গেছে টেরই পায়নি সে। একটু পরেই আবার স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হবে তাকে।
মাকে ঘুম থেকে তুলে ঘরে নিয়ে আসতে বেশি বেগ পেতে হল না। তবে পিদিমের ঘরে এক দাঁতের ব্যাথায় কাতরানো কুমির বসে আছে- এটা কিছুতেই বিশ্বাস করানো গেল না তাকে। কিছুটা বিষ্ময় আর অবিশ্বাস নিয়ে বললেন, “সাত সকালে কি শুরু করলে, পিদিম?” পিদিম কোন কথা বললো না। ঘরে ঢুকে মা তো নিজেই দেখতে পাবেন আসল ঘটনা। কিন্তু, একি! কুমির কোথায়? চেয়ার তো ফাঁকা। ভোরের বাতাসে সেই অদ্ভুত গন্ধটাও মিলিয়ে গেছে। টেবিলে পড়ে রয়েছে শুধু আধখোলা এক বই। ছোট মামা গত সপ্তাহেই দিয়েছেন বইটা। কালকে ঘুমোতে যাওয়ার আগে এটাই পড়ছিল পিদিম। নাম- ‘কুমিরের রাজ্যে’! –সংগৃহীত