দিয়া বলল, আমি কখনো যাইনা পাঁচিলের পাশের দিকে, ওদিকে শুঁয়োপোকা আছে না, লেগে যাবে তো। হাতে পায়ে গায়ে, উঃ বাবা। দীপঙ্কর বলল, কেন, শুঁয়োপোকা লাগলে কী হয়? ও খুব একটা জানেনা, শুঁয়োপোকা লাগলে ঠিক কী হয়, লাগেনি কখনো ওর। কিন্তু সেটা তো প্রকাশ করা যায় না, তাই একটু মুখটা বিকৃত করল। উঁ, বিচ্ছিরি। তার চেয়ে তুই শুঁয়োপোকা পুষলেই পারিস। এটা কিন্তু ভালো প্ল্যান, তুই বরং একটা শুঁয়োপোকা পুষে দেখ। হুঁ, কী যে বলো, শুঁয়োপোকা কেউ পোষে নাকি। তুমি সব বাজে বাজে কথা বলো, দীপঙ্কর। ‘বাজে’ বলার সময় ঠোঁটে একটা ভঙ্গীও এল। যেন ওর সামনে ঠিক উচ্ছে না, পাকা কলা খেতে দিয়েছে, আর ও আপত্তি করছে। আর, ‘দীপঙ্কর’ —অত বড় নামটা এক নিশ্বাসে বলতে গিয়ে ওকে বেশ মনোসংযোগ করতে হয়, তাই, একটু ঝুঁকেও আসে সামনে। কেউ তো তোর মত ঠান্ডা পড়তে না পড়তেই দুটো সোয়েটার পরেও ঘোরে না।
কেউ পোষে কিনা তাই দিয়ে কী হবে? তুই পোষ। বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো শুঁয়োপোকাদের সংসার। আবার বাজে বাজে কথা বলছ? এরকম করলে আমি কিন্তু আর কথা বলব না, চলে যাব এখান থেকে। এবার ওর কথায় ভঙ্গীটা তো বটেই, গলার আওয়াজটাও একটা রকমের হয়ে গেল, সেই ভঙ্গীটা চেনে দীপঙ্কর, দিয়ার মায়ের। তুই? কথা বলবি না? সত্যি? কথা দিচ্ছিস? এবার একটু ঘোলাটে হয়ে গেল দিয়ার প্রতিক্রিয়া, ঠিক কী বলবে বুঝতে পারল না। ওকে যে খুব একটা সম্মান করা হচ্ছে না কথাটায়, সেটুকু বুঝতে পারছে, কিন্তু একটু গোলমেলে লাগছে ওর। একটু চেয়ে রইল, খোম্বা মত মুখ করে। তারপর আঙুল তুলে বলল, চুপ চুপ চুপ করো। বললাম তো, আমি শুঁয়োপোকা পুষব না। তাহলে তুই কুকুর পোষ। তার কাজ কিন্তু সব তোকে নিজে করতে হবে। পারবি? নইলে তোর বাবা-মা এসে আমাকে পেটাবে, এই সব বুদ্ধি দিয়েছি বলে। দিয়ার চোখটা একটু অন্যরকম হয়ে গেল। দীপঙ্করের মাথার সামনে, ওর ডানপাশে আলমারিটার দিকে তাকাল। প্রসঙ্গটা ওর ভালো লাগছে, দীপঙ্করের গায়ে একটু ঘেঁষে এল, একটু হেলান দিয়ে। ডান হাতটা উঠে গেল ওর, হাওয়ার গায়ে যেন একটা কাঁচ আছে, ও তার গায়ে ধুলো সরিয়ে ওপাশটা দেখছে, তারপর বলল, মনে আছে আমার, তুমি পুষেছিলে না, কাতুকুতু। একটু বিপন্ন বোধ করল দীপঙ্কর। কাতুকুতুর প্রসঙ্গে কোনো বেদনা উঠে না আসে।
কাতুকুতু একটা বাচ্চা কুকুর। প্রায় বছর দেড়েক আগে, এক বর্ষার রাত্তিরে, বাড়ি ফেরার সময়, কাদামাখা অবস্থায় দীপঙ্কর ওকে তুলে এনেছিল। গোলগাল গাবদা একটা কুকুরছানা। পরের দিন দিয়া এসেছিল। সেদিন সারাটা দুপুর বিকেল সন্ধে দিয়ার একমাত্র ফোকাস ছিল কাতুকুতু। বারবার ওকে নিয়ে কথাও বলছিল দিয়া, দীপঙ্করও বেশ ফূর্তি পাচ্ছিল, ওর নাম দেওয়ার এই সাফল্যে। পরের দিন কাজ থেকে ফিরে আর কাতুকুতুকে খুঁজে পায়নি দীপঙ্কর। আশে পাশের বাড়িরও কেউ কিছু বলতে পারেনি। কেউ খেয়ালই করেনি। সামনে একটা বাড়ি বানানো হচ্ছে, তার এক জন যোগাড়ে বলেছিল, ওই খানে এসে নাকি কাঁদছিল কুকুরটা, ওরা এক জন একটু রুটিও খেতে দিয়েছিল, খায়নি। তারপর আর কেউ জানে না। সেই সময়টায় খুব ভয় পেয়েছিল দীপঙ্কর, দিয়া কী ভাবে নেবে। নিজের মধ্যে খুব খারাপ লাগছিল, সেটাই বোধহয় দিয়ার মধ্যে হওয়ার কথা ভেবে ভয় পেয়েছিল।
তারপর, দিয়া যেই জিগেশ করল, কাতুকুতু কোথায় গেল, এক ঝলকে উত্তরটা মাথায় চলে এল দীপঙ্করের, ওর মার কাছে চলে গেছে। ওর মা ওকে নিয়ে গেছে। ওর মা কোথায়, জানতে চেয়েছিল দিয়া। তার ঠিক কী উত্তর দিয়েছিল মনে নেই দীপঙ্করের। বাচ্চাদের কাছে ‘জানিনা’ গোছের অনিশ্চিত উত্তর দিতে ভালো লাগে না, তাই বোধহয় ‘অনেক দূরে’ গোছের কিছু বলেছিল। আর তখন আরো দেড় বছর ছোট ছিল দিয়া। সেই স্মৃতিটা কী ভাবে কাজ করবে ওর মাথায়, ঠিক কী প্রশ্ন করতে পারে, তার কী উত্তর দেবে, সেটা নিয়ে একটু ঘাবড়াল। তাড়াতাড়ি কথা পাল্টাল। না, কাতুকুতু না, অন্য কুকুর পোষ। কোথাও একটু ফাঁক রয়ে যাচ্ছে, সেই ফাঁকটা তাড়াতাড়ি ভরাট করতে চাইল দীপঙ্কর। তুই একটা সোনালি রঙের কুকুর পোষ। আবার বাজে বাজে কথা বলছ? কী সব বলো, সোনালি রঙের কুকুর। ওসব হয় না। হয় না কী রে? তুই সোনালি কুকুরের গল্প শুনবি? সচরাচর বাঘ বা শেয়াল বা ‘দিয়ার মত একটা মেয়ের’ গল্প শুনতে যতটা আগ্রহ হয় দিয়ার, ততটা দেখা গেল না বটে, ‘সোনালি কুকুর’ জাতীয় একটা বিদ্ঘুটে জিনিসের গল্পের উপর ও বোধহয় খুব ভরসা করতে পারছিল না, তবু, যতই হোক, গল্প তো। মন্দ কী? হালকা গোলাপি ফ্রকের নিচে লাল পায়জামা পরা পা ভাঁজ করে বেশ গুছিয়ে বসল। সে অনেক হাজার বছর আগের কথা। মধ্যমগ্রাম রেল ইস্টিশনের পাশের জায়গাগুলো তখন সব ফাঁকা ফাঁকা। এত গাড়ি নেই, এত লোক নেই, এত বাড়ি নেই। ঠিক ইস্টিশনের প্ল্যাটফর্মের গা ঘেঁষেই স্টেশন মাস্টারের লাল বাড়ি, তারপরে একটা মাত্র দোকান। মেনো পাইকের চা-এর দোকান। শুধু চা না, সেখানে লোক বিস্কুট খায়, ডিমভাজা খায়, সিগারেট কেনে। ওই যে তোমার সিগারেট। হাত দিয়ে দেখাল দিয়া।
তুমি সেদিন বাথরুমে ফেলে এসেছিলে না, আমি নিয়ে এলাম। নিয়ে এলি আর এমন জল লাগালি যে ওগুলো আর খাওয়াই গেল না। তারপর বলো, সেই ডিমভাজা, সিগারেট — ডিমভাজা খায়, সিগারেট খায়, গল্প করে, চা খায়, অফিস থেকে নেমে। তারপরে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে তো। তখন তো এত ভ্যান, অটো এসব নেই। রাস্তাটা পুরো ফাঁকা, দুপাশে মাঝে মাঝে বিরাট বিরাট ঝাঁকড়া গাছ। বেশিরভাগই তেঁতুল গাছ। তাতে বড় বড় সব বাঘ থাকে। সে অবশ্য অন্য গল্প। দিয়া হেলান ছেড়ে উঠে বসল, বাঘের গল্পটা বলো। দীপঙ্করের আগেই মাথায় এসেছিল কেলেঙ্কারিটা। কিন্তু বলতে বলতে আর সামলাতে পারেনি। বাঘের কথা বললেই ও বাঘের গল্প শুনতে চাইবে। তাড়াতাড়ি, বেশ একটু কর্তৃত্ব গলায় এনে বলল, এখন আগে কুকুরের গল্পটাই শোন। মন্দের ভালো গোছের মুখ করে দিয়া আবার হেলান দিল দীপঙ্করের গায়ে। তা, লোকগুলো তো রোজ মেনো পাইকের দোকানে এসে বসত, থাকত অনেকটা সময়। ওদের যাতে ভালো লাগে, সেই জন্যে, ছটা সোনালি কুকুর করল কী, মেনো পাইকের চায়ের দোকানের ঝুলবারান্দায় বসে গানবাজনা শুরু করল। সবাই মিলে। লোকেও বেশ পছন্দ করত। সময়টা ভালোই কেটে যেত তাদের। কিন্তু ছটা কুকুরের ছটাই তো আর গান গাইতে পারত না। দু-তিনজন গান গাইত, আর প্রত্যেকেই কিছু না কিছু বাজাত, হয় গিটার, নয় ড্রাম, বা অন্যকিছু। সব মিলিয়ে গানবাজনাটা চলত। এই ছটা কুকুরের মধ্যে একজনের ভাগে পড়েছিল একটা টিঙটিঙে তারের বাজনা। সেও অন্য কুকুরগুলোর মত একই রকম সোনালি। তারও চারটে পা, একটা লেজ আর একটা মুখ। কিন্তু অন্যদের যখন লোকে অবাক হয়ে দেখত, ওই দেখ গিটার বাজাচ্ছে, ওই দেখ, কেমন দুমদুম করে ড্রাম বাজাচ্ছে, বা, ওই দেখো কি সুন্দর গান গাইছে, তার দিকে কেউ ফিরেও তাকাত না। খুব মন খারাপ থাকত তার। তার দুঃখের চোটে তার টিঙটিঙে বাজনাটাও যেন আরো সরু হয়ে বাজত। মাঝে মাঝে, লোকজন ফাঁকা হয়ে এলে, বিশেষ করে চাঁদনি রাতে, চাঁদের আলোয় ঘুম আসত না যখন, ওউ ওউ করে তখন কাঁদত টিঙটিঙে বাজনার সোনালি কুকুর। তার আরো খারাপ লাগত এই ভেবে যে তার কিছু করারও নেই। কিছু করার থাকলে সে নয় করে দেখত।
সবাই তো গানও গায় না, সবাই তো ড্রামও বাজায় না, সত্যিই তো, কী করার আছে তার? শেষে, অনেক দিন এমন দুঃখের সময় যাওয়ার পর, একদিন এক জন বাদামওয়ালা তাকে বুদ্ধি দিল, তুই বরং নিজের পিঠে চড়ে দেখ। দিয়া বলল, সে আবার কি? আবার বাজে কথা বলছ তুমি, দীপঙ্কর? দীপঙ্কর বলল, সেই টিঙটিঙে কুকুরটাও ওই একই কথা বলেছিল, তুই যা বললি। তখন বাদামওয়ালা তাকে বলল, দেখ, আমরা ট্রেনে ট্রেনে বাদাম বিক্রি করি, সারাদিন শুধু ঘুরে বেড়াই, সব ইস্টিশন সব লোককে চিনি আমরা। আমরা অনেক খবর রাখি যা সব লোকে রাখে না। সবাইকে এসব খবর আমরা চাইলেও দিই না। নেহাত তোমার বাজানোর হাতটা খুব ভালো, তোমার বাজনা শোনার পরই মনটা টনটন করে, তাই। টিঙটিঙে কুকুর বলল, তোমার তো বাজনার পরে হয়, আমার বাজনার আগেই মনটা টনটন করে, বাজনার পরেও করে। বাদামওয়ালা বলল, তা করুক, আসল কথাটা হল, নিজের পিঠে যদি চড়তে পারো, যা চাইবে তাই হবে। আমাদের সঙ্গেই এখন বাদাম বিক্রি করে বনগাঁ লোকালে, বলাই নাম, ও আগে পুরো পাগল ছিল, লোকের বাড়ির বেড়ায় উঠে বসে থাকত। তারপর নিজের পিঠে চড়ল বলেই সবটা বদলে গেল। ও চেয়েছিল বাদামওয়ালা হতে, হয়ে গেল। টিঙটিঙে কুকুরের আরো কত কিছু জিগেশ করার ছিল। বলাই আরো বিরাট, সত্যিকারের বিরাট কিছু হতে চাইল না কেন, বাদাম বিক্রি না-করে বাদামচিট বিক্রি করতেও তো চাইতেই পারত। বাদাম আর কি, বাদামের চেয়ে বাদামচিট অনেক ভালো খেতে, সবাই অনেক ভালো খায়। তুইও তো ভালো খাস বাদামচিট? না, আমি ওসব খাই না। দিয়ার মুখ দেখেই বোঝা গেল, বাদামচিট ও চেনে না। খাবি কি, তুই তো চিনিসই না। যাকগে, যা বলছিলাম। টিঙটিঙে কুকুরের আরো কত কী জিগেশ করার ছিল। নিজের পিঠে চড়বে কী করে, তার কায়দাগুলো যদি জানে বাদামওয়ালা, কিন্তু তার আগেই ট্রেন এসে গেল। লাস্ট ট্রেন। গানবাজনা চলতে চলতেই অনেকটা রাত হয়ে গেছিল। কিন্তু সেদিন রাতে খুব শান্তিতে ঘুমোলো টিঙটিঙে। দু দুবার চাঁদ উঠল সেই রাতে, কিন্তু তার ঘুম একবারও ভাঙল না। সারা রাত ঘুমের মধ্যে একটা হালকা হাসি লেগে রইল মুখে। তোর মুখে যেমন থাকে, তুই যখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বাঘকে বিয়ে করিস, বাঘ তোকে মাছের ঝোল রেঁধে খাওয়ায়। নাকি বাঘ তোকে বিয়ে করে, আর তুই বাঘকে মাছের ঝোল রেঁধে খাওয়াস? তুই রোজ তোর পিসিকে গুল মারিস, না রে দিয়া? স্বপ্ন দেখা কাকে বলে, জানিস তুই? স্বপ্ন দেখা তো নয়ই, দিয়া বোধহয় গুল-মারা ব্যাপারটাও বোঝে না, তাই কথা ঘোরাল, তুমি একদিন একটা বাচ্চা বাঘের গল্প বলেছিলে। একটা ঝর্ণা, হারিয়ে গেল … হ্যাঁ, তারপর, পরের দিন সকাল থেকে টিঙটিঙের এক মাত্র কাজ হয়ে দাঁড়াল, কী করে নিজের পিঠে ওঠে, সেটা বার করা। নিজের পিঠ আর ঘাড় আর গলা আর পেট, সবকিছু বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে কসরত করতে করতে একেবারে নাজেহাল হয়ে গেল।
দিন রাত, দিনের পর দিন, শুধু এই করেই চলেছে। ওর বাজনার দলের আর কুকুরেরা, মেনো পাইকের দোকানের সবাই, ট্রেনের লোকজন সবাই ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে। দেখো সোনালি কুকুরটা পুরো ক্ষেপে গেছে। ওর গানবাজনার দল থেকেও ওকে বার করে দিল। পাগলা কুকুর আর কে চায় গানবাজনার দলে। টিঙটিঙে কিন্তু লেগেই রইল। অত কসরত করতে করতে তার বাজনার মত শরীরও গেল টিঙটিঙে হয়ে। কিন্তু সে লেগেই রইল। এই রকম সময়ে হঠাৎ করে একদিন তার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। ইস্টিশনের পাশেই মধ্যমগ্রাম বয়েজ ইসকুল তখন তৈরি হচ্ছে। মিস্তিরিরা কাজ করছে। দেওয়াল ছাদ তখনো হয়নি, শুধু বেঞ্চি, ব্ল্যাকবোর্ড আর চকগুলো তখনো বানানো হয়েছে তাদের। সেই চকের থেকে একটা নিয়ে এল টিঙটিঙে। এসে, মেনো পাইকের দোকানের ঝুল বারান্দায় চকের দাগ দিয়ে একটা বড় জায়গা ঘিরে নিল, তার মধ্যে বড় বড় ঝকঝকে অক্ষরে লিখল “আমার পিঠ”। এবার আর তার নিজের পিঠে চড়ে বসার কোনো অসুবিধা রইল না। এত দিনের চেষ্টার পর উপায়টা পেয়ে গিয়ে এত ফূর্তি হল টিঙটিঙের যে সেদিন সারাটা দিন নিজের পিঠের উপর সে তিড়িং তিড়িং করে লাফিয়েই চলল। কিন্তু গানবাজনার দলে ভালো জায়গা আর কোনও দিনই হল না সোনালি কুকুর টিঙটিঙের। ভালো কেন, কোনও জায়গাই হল না, কারণ, দলটাই ততদিনে উঠে গেল। এর মধ্যে আসলে অনেক হাজার বছর কেটে গেছে। নিজের পিঠে চড়ার চেষ্টায় টিঙটিঙে কোনোদিন খেয়ালই করেনি। মেনো পাইকের দোকানটাই উঠে গেছে, মানে উঠে কোথাও যায়নি, কোথায় বা যাবে একটা দোকান আর তার জমি, দোকানটাই উবে গেছে কত শো বছর হল। এখন সেখানে অটোস্ট্যান্ড। শেষদিকে মেনো পাইকের দাড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছিল, বাড়ির দাওয়ায় শীতকালে রোদে আর গরমকালে ছায়ায় বসে থাকত, মনে আছে টিঙটিঙের, কসরত করতে করতে দেখেছে কতবার।
সেই বাড়ি ভেঙে এখন ফ্ল্যাটবাড়ি। এখন অটোস্ট্যান্ডের যে মালিক সে আর মনেই করতে পারে না মেনো পাইকের নাম। যদিও তার নামও পাইক দিয়ে, পানু পাইক। শোনা যায় তার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা নাকি মনে করতে পারত, হ্যাঁ, ঠিকই মেনো পাইক বলে ছিল বটে একজন, তাদের বংশের পূর্বপুরুষ, তারই জমি বটে এটা, সে নাকি এখানে চায়ের দোকান করেছিল, ইতিহাস বইয়ে সেরকমই আছে বটে, ছেলে মেয়েরা পড়া মুখস্থ করে, তা থেকেই শুনেছে। তারই পত্তন করা এই দোকান। এখন চারদিকে কত ভিড়, গাড়ি, ফ্লাইওভার। দোকানে বসে গানবাজনা শোনার আর লোক কই? টিঙটিঙেও কোথায় চলে গেল একদিন, অন্য সব সোনালি কুকুরের মত। ওর একটা সেলফোন আছে, কিন্তু তার নম্বর কেউ জানে না। গল্পটা কেমন লাগল এটা দিয়াকে জিগেশ করার আগেই ওর পিসি ওকে খেতে ডাকল। তবে পরের দিনে সকালে ওকে টেবিলের সামনের চৌকো জায়গাটায় ঘুরে ঘুরে তিড়িং তিড়িং করে লাফাতে দেখে দীপঙ্করের মনে হল, বোধহয় টিঙটিঙের কথা মনে পড়ছে ওর।