আপু, আপুরে… এই উঠত! ইংরেজিতে অপিরা মিনি বানান করে কিভাবে একটু বল…।’ গভীর রাতে পিচ্চি ছোট ভাই শিবলীর এমন আজগুবি হুকুম শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগে সে আবারো বলা শুরু করল, ‘তাড়াতাড়ি বল না! নেট থেকে অপিরা মিনি ডাউনলোড করে সেটা দিয়ে গেমস ডাউনলোড করব। বানানটা পারছি না।’ রাত ২টা বাজে আমার ঘুম ভেঙে এমন সস্তা আবদার করায় শিবলীর ওপর মেজাজটা এত গরম হয়েছে, মন চেয়েছে ওরে ভাজি করে আস্ত খেয়ে ফেলি! শিবলী আমার ছোট ভাই। ইংরেজি অক্ষরগুলোও এখনো ঠিকমতো চেনে না। সারা দিন মোবাইলে গেমস খেলে। রাতে আমার সাথে ঘুমায়। ও এতই পুঁচকে, ভোরে ঘুম থেকে জাগলে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও ওর লুঙ্গি খুঁজে পাওয়া যায় না।
যেন ঘুমের মধ্যেও ফুটবল খেলে। কিন্তু তাতে কী, সে ইন্টারনেটের ওস্তাদ। মুহূর্তের মধ্যে ফেসবুকের আইডি খুলে। ব্লক করে। আনকমন সব গেমস ডাউনলোড করে খেলতে থাকে। ডিজিটাল বাংলাদেশের বরকতে পিচ্চি পোলাপানের যা অবস্থা, তাতে মনে হচ্ছে তারা জন্মের আগেই ইন্টারনেটের তালিম নিয়ে দুনিয়াতে আসে। মোবাইল ইন্টারনেট এখন তাদের বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘুমের ঘোরে শিবলীকে অপিরা মিনি বানান বলে বিড়বিড় করে ডিজিটালের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার কাছে ক্লাস ফাইভের একটা ছেলে প্রাইভেট পড়ে। বয়স ১১ বছর। সে দিন দেখলাম কার সাথে যেন লুকিয়ে লুকিয়ে মোবাইলে কথা বলছে।
কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, সত্য সত্য বল কার সাথে কথা বলেছ? সে ঘাড়টা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে ইনিয়ে বিনিয়ে বলল, কারো সাথে না, এমনিতেই একটা ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিলাম। আমি চোখটা তিন গুণ বড় করে গলার ভলিউম সাড়ে চার গুণ বাড়িয়ে দিয়ে কর্কশ ভাষায় ধমক দিতেই তার মুখ থেকে সুড়সুড় করে সত্যটা বেরিয়ে এলো। বলল, তার ক্লাসের একটা মেয়েকে সে ভালোবাসে। মেয়েটাও তাকে পছন্দ করে। মেয়ের বয়সও নাকি এখন দশ পার হয়নি! অথচ একজনের সাথে আরেকজন কথা বলতে তাদের দিল আনচান করে। তার কাহিনী শুনে আমি হাসব নাকি কাঁদব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। গলার সুর নরম করে তাকে বললাম, আচ্ছা মেয়েটার সাথে যখন তুমি কথা বলো তখন তোমার ভেতরে কি কোনো ফিলিংস কাজ করে? সে উত্তরে বলল, ফিলিংস-টিলিংস কিছু বুঝি না।
তবে কথা বলার সময় শরীরে একটু জ্বর জ্বর লাগে। শরীর কাঁপে। গলার আওয়াজ একটু ভাঙা ভাঙা বের হয়। তার উত্তর শুনে আমার মাথা কয়েক হাজার বার চক্কর দিয়ে ভোঁ ভোঁ করা শুরু করল। পুঁচকে ছাওয়াল কয় কী! আমার তখন একটা কথাই বারবার মনে আসছিল, ‘কেউ আমারে মাইরালা…।’ আমার ভাতিজা আবরার। বয়স ৯ বছর। এই বয়সে দুনিয়ার হালহকিকতই তার ঠিকমতো বোঝার কথা নয়, কিন্তু সে এতটাই ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছে যে, সুনীল গাভাস্কার, রবি শাস্ত্রি ও হার্শা ভোগলেরাও তার কাছে ফেল! এই তো সে দিন সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আন্টি বলো তো! অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের মধ্যে মিশেল জনসন বেশি ভালো নাকি, মিশেল স্টার্ক? আমি বললাম মিশেল জনসন। সে মাথা নাড়িয়ে বলল, না আন্টি হয়নি। স্টার্ক বেশি ভালো।
কারণ জনসনের বলে গতি বেশি আর স্টার্কের বলে ভেরিয়েশন বেশি। এ জন্যই তো সে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেট পেয়েছে। আবরারের বিশ্লেষণ শুনে আমি পুরো থ খেয়ে গেলাম। শুধু কি তাই! বিশ্বের কোন ক্রিকেটার বাম হাতে বল করে ডান হাতে ব্যাট করে, কোন ক্রিকেটার ডান হাতে বল করে বাম হাতে ব্যাট করে, কোন বোলারের কী গুণ; সব তার দুইয়ের নামতার মতো মুখস্থ। আর মুস্তাফিজের কাটার, সাকিবের আর্মার, মাশরাফির স্লোয়ার, রুবেলের ইয়র্কার; এসবের ব্যাপারে তার স্পেশাল কমেন্ট্রি তো আছেই। যাক বাবা, আমাদের বিচ্ছু বাহিনীই যখন এতটা ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছে, তখন ভারত-পাকিস্তান টাইগারদের কাছে ধোলাই খাবে না তো কার কাছে খাবে!