পাস্তুরের দস্তুর ঘনাদা (রামকৃষ্ণভট্টাচার্য)

সন্ধে সাতটা । মোটামুটিভাবে চন্দন ডাক্তারের রোগী দেখা শেষ । খানিক পরেই চেম্বারে, সান্ধ্য আড্ডা শুরু হবে । রথী মহারথীরা এখনও এসে পৌঁছননি । এই অবসরে, সত্য কম্পাউন্ডার জোরে জোরে খবরের কাগজ পড়ছেন । তাঁর বদ্ধমূল ধারণা, জোরে না পড়লে, নিজের কানে ঢোকে না, ফলে যা লেখা আছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় । নোয়াখালিতে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তার এই অভ্যেস ।

ইংরেজি ভাষার ওপর তার দুর্বলতা ভয়ঙ্কর । চান্স পেলেই ইংরেজি বলেন আর সেই ইংরেজি শুনে অনেকেই থরথর করে কাঁপে বলে, তার আর এক নাম সত্য কম্পু ।

খবরের কাগজটা অবশ্য তিনি বাংলাতেই পড়েন । মাতৃভাষার প্রতি টান ভয়ঙ্কর । তার মতে, মাতৃভাষা হচ্ছে মাতৃদুগ্ধ পান করার মতো । বাংলা ভাষা, তাই তিনি কখনো ছাড়বেন না ।

নাটু লাহিড়ী অবশ্য অন্য কথা বলেন । তিনি নাকি স্বচক্ষে দেখেছেন, সত্য কম্পু ইংরেজি খবরের কাগজের ওপর জল ছিটিয়ে পড়ার চেষ্টা করছেন । নাটু লাহিড়ীর কাছে ধরা পড়া গিয়ে বলেছিলেন, আজকালকার ইংরেজি তিনি বুঝতে পারেন না বলে জলে ভিজিয়ে নরম করছিলেন।

ক্ষেতু বাগচী ঢুকেই বললেন :-

– বন্ধ কর হে, সত্য !

– হোয়াট ?

– তোমার অই জোরে জোরে খবরের কাগজ পড়া । তাও আবার ওই বিশাল রাজনৈতিক হানাহানির খবর ।

– আই ফ্রম নুয়াখালি ! আমি ডোন্ট কেয়ার কাউকে । হু কী ডু আমাকে ? ডোন্ট কেয়ার আই ।

– আরে না ! তোমার বাংলাটা বড়ই দুর্বল ।

– আফনে হোয়াট স্ফীক ?

– তখন থেকে ত্রুটিকে ক্রুটি উরুশ্চারণ করছো তো ! তাই আর কী !

তরজাটা হয়তো আরও এগোতো, তবে এর মধ্যে এক বিশালবপু মহিলা দুলকি চালে হেঁটে ঢুকে পড়েছেন চেম্বারে !

– ডাইকতারবাবু আছেন ? মহিলার বিনম্র জিজ্ঞাসা।

– হঃ ! ডাক্তারবাবু ফেজেন ! সত্য কম্পুর উত্তর ।

– কোই আচেন ?

– আসতাচেন । আফনে সিট ।

– কী কোইলেন?

– কোইলাম, বয়েন ।

– হঃ ! তয়, অনার কি দেরি হইবো ?

– নো নো ! আইবেন নাউ !

– আপনে কী ভাষায় যে কথা কন ? বুজতে পারতাম না !

– ওই ভাষা আপনি বুজবেন না – ক্ষেতু বাগচী বললেন ।

– হঃ ! আমার নামটা লিখ্খা লন !

– কী নাম আপনার ?

– কৃষ্ণ বিনা প্রাণ বাঁচে না দাসী ।

– ক্ষী !!! সত্য কম্পু প্রায় পড়ে যান আর কী, চেয়ার থেকে ।

– হেই দ্যাহেন ! আমরাগো সব বষ্টুম ! আমার হ্যায়ের নাম হুনলে অজ্ঞান হইবেন, মনে লাগে ।

– ও ! ওইজন্য আপনি দুলে দুলে ঢুকলেন ! এত বড় নামের চাপ ! মনে হলো রাধার দোলায় আগমন । ক্ষেতুদা উবাচ ।

– হ্যাঁ ! এবার গজগজ করবেন যেতে যেতে, তাই রাধার গজে গমন হবে । চন্দন ডাক্তার চেম্বারে ঢুকতে ঢুকতে বলল ।

– আফনারা কী যে কন ! কইতে নাই, তয় কইয়া ফ্যালাই ! আমার হ্যায়ের নাম হইলো গিয়া গোপীজন বল্লভো পদরেণু দাস । বমু এহানে ?

– বসুন বসুন ! চন্দন বলল । আ্যতো বড় বড় সব নামের বাহার, না বসলে খুব মুশকিল !

মহিলা একটা চেয়ারে ওই বিশাল চেহারা নিয়ে বসতেই চেয়ারটা মড়াৎ করে ভেঙ্গে গেল । মহিলা পড়ে গিয়ে এক বিশাল চিৎকার করলেন ।

– ওহো ! আফনে দেখতাসি হেলেন অফ ডেস্ট্রয় ! সত্য কম্পু মহিলাকে হাত ধরে তুলতে তুলতে বললেন ।

– হুম ! একই অঙ্গে দুটো রূপ ! হেলেন আর রাধা ! ক্ষেতু বাগচী উবাচ ।

উঃ ! আঃ ! করতে করতে একটা কাঠের চেয়ারে বসলেন মহিলা, সত্য কম্পুর সাহায্যে । দেখা গেল তেমন কিছু হয়নি । খালি, কনুইয়ের কাছটা একটু ছড়ে গিয়েছে । ডেটল দিয়ে ওয়াশ করে, একটা ব্যান্ড এড লাগিয়ে দিলেন সত্য কম্পু ।

মহিলা ধাতস্থ হয়ে বললেন – আমারে একটু দ্যাহেন ডাইকতার বাবু ।

– কী হয়েছে আপনার ?

– কী আর কমু, ডাইকতার বাবু ! ফরশু দিন আমাগো বাড়ি আইসিলো আর এক বষ্টুম । আমাগো বাড়িত্ কলাগাছে বড় বড় পুরুষ্টু কলা হইসে । কলা দেইখ্যা কয়- জয় রাধে ! কয়েকটা কলা দিবা ? সেবা করতাম ।

রাইগ্যা কইলাম, মুই বোষ্টুম, হ্যায় বষ্টুম, বষ্টুম মোর পোলা/ তিন বষ্টুম ঘরে থাইকতে, পরে খাইবো কলা ? কী করসে, কে জানে, তারপর থিকা শরীর তাজ্জিম – মাজ্জিম করত্যাসে ।

– এ যে দয়াল বাবা, কলা খাবা কেস ! চন্দন বলল ।

– একে একটা টেট ভ্যাক পুশ করে দাও আর “পাস্তুর” নামটা দশবার মাথার ওপর জপে দাও হে চন্দন ! ক্ষেতু বাগচীর পরামর্শ ।

– টেট ভ্যাকটা না হয় বুঝলাম, পড়ে গিয়ে কনুই ছড়ে গিয়েছে, কিন্তু “পাস্তুর” নামটা দশবার মাথার ওপর জপ করে দেবো কেন? বড্ড আনসায়েন্টিফিক কতা- বার্তা বলছেন আজকাল ক্ষেতুদা ! তাছাড়া, ওনাকে তো কুকুরে কামড়ায়নি ।

মহিলাও মওকা পেয়ে বললেন-

– হ ! হ ! দাদুয়ে ঠিক কথা কইসেন । আমাগো তো ঝাঁড়ফুকেরি দস্তুর ! অই যে কী কইলেন – পাতুরী না কি, ওইটা জইপ্যা দ্যান । নিরামিষ অইলেই অইল ।

– বুঝলে হে চন্দন ! কেন যে বললাম কথাটা তার একটা ব্যাখ্যা দেবো তোমায় । তবে, হঠাৎ এই মহিলা পাতুরী আর নিরামিষের কথা বললেন কেন ? বৈষ্ণবরা তো নিরামিষই খায় ।

– হঃ! হগ্গলই নিরামিষ । আমাগো গুরুদেবও কইতেন, মাচ খাবা তয় কাঁচকলা দিয়া রাইন্ধা । মাচ নিরামিষ হইয়া যাইবো গিয়া । আমরা মাচ খাই, তয় কাঁচকলা দেই মাচের ঝুলে । পুরা নিরামিষ । আঁশ পুরা বারণ আমাগো ।

– এটা আপনি ঠিক বলেছেন । শাস্ত্রেই আছে :- ইল্লিশ, খল্লিস, ভেটকি, মদগুর এব চ / রোহিত রাজেন্দ্র, পঞ্চমৎসানিরামিষাঃ । ক্ষেতু বাগচী একটানা শ্লোক বলে দমনিলেন । মহিলা, কি বুঝলেন কে জানে ? হাত জোড় করে- জয় রাধে বলে চেঁচিয়ে উঠলেন ।

– মিনিংটা কন ! সত্য কম্পুর ক্ষেতুদাকে জিজ্ঞাসা ।

– শাস্ত্রে বলছে- ইলিশ, খলসে, ভেটকি, মাগুর আর রুই মাছ, এই পাঁচরকম মাছই নিরামিষ ।

– আফনে বাউন ? মহিলার জিজ্ঞাসা ।

– খাস আই এস আই মার্কা বারিন্দির বাউন আমি। ক্ষেতুদার বুক চিতিয়ে উত্তর । তারক মোত্তির এর মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন । বললেন,

– পাকিস্তান সরকার কি আপনাকে কি এই সার্টিফিকেট দিয়েছে নাকি, ক্ষেতুদা ?

– বড্ড প্যাঁচ হে তোমার মনে ! ক্ষেতুদা বিরক্ত । এটা পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স নয় । ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউট !

– বারিন্দিরের মনে প্যাঁচ থাকবে না ? কী যে বলেন ! তালে, আর বারিন্দিরদের কী বৈশিষ্ট্য রইল ? তারক মোত্তির কান খোঁচাতে খোঁচাতে উত্তর দিলেন । মহিলা,মনে হলো একটু চাঙ্গা হয়েছেন । বললেন,

– তাইলে ঠাকুরমশাই, অই মাচগুলা রান্না করলে আর কাঁচকলা লাগবো না কইত্যাচেন ?

– আলবাৎ ! মৎস্যপুরাণের শ্লোক বলে কথা ।

– বাঁচাইলেন ! আফনেই কন, কাঁচাকলা দিয়া ইলশা খাইতে ভালো লাগে ? মরিচপোড়া ঝুল আর সরিষা বাটা দিয়ে অয়নে খামু ! আঃ ! আচ্ছা, ঠাকুর মশাই, ইচা মাচ খাইতে পারুম ?

– শ্বেত সর্ষপ সহযোগে চিংড়ি অতি উপাদেয় । কোনো দোষ নাই ।

– কী কইলেন ?

– বলছি, সাদা সরষে বাটা দিয়ে ডাব চিংড়ি মানে ইচা মাছ খান, কোনো দোষ নাই । ডাব থাকলে চিংড়িওনিরামিষ ।

– বাঁচাইলেন ! হ্যায়রে গিয়া কমু অনে ! আমার শরীলটা অয়নে একটু ভাল্ লাগত্যাসে । ঠিক জায়গাত্ আসছি । কত্ত নাম ডাইক্তারবাবুর !

– কিন্তু, ক্ষেতুদা ! চন্দন ভুরু কুঁচকালো ।

– বল হে !

– হঠাৎ, পাস্তুরের নামটা জপ করতে কেন বললেন ?

– সে অনেক কথা ! দাঁড়াও ! একটা সিগারেট ধরিয়ে নিই ! বল- হরিকে বল চা দিতে !

– আমারটা ভাঁড়ে দিতে কইয়েন, মহিলা যোগ দিলেন । হরি হরি বলে একটু জপও করলেন বোধহয় ।

– চিকেন রোল খাবেন, ক্ষেতুদা ?

– আনাবে ? আনাও ! কি দিদি, আপনিও খাবেন নাকি ?

– কি খামু ?

– ওই যে চিকেন রোল ! মানে, মুরগীর মাংস ঝাল ঝাল করে কষে, পরোটা দিয়ে জড়ানো !

– কাঁচকলা থাকবো তো !

– না না ! কাঁচকলা থাকলে টেস্ট খুলবে না !

– তাইলে বাদই দ্যান । হরি, হরি ! জিভের জলটা বোধহয় পড়ল শাড়িতে ।

বল হরি চা দিয়ে গেল । শব্দ করে চুমুক দিলেন ক্ষেতু বাগচী । মহিলাও, শাড়ির আঁচল দিয়ে চায়ের গ্লাসকে ধরে চায়ে ফুঁ দিয়ে একটা চুমুক দিলেন । সিগারেট ধরিয়ে ক্ষেতু বাগচীর কথকতা আরম্ভ হলো –

– গত বছরের শীতকাল ! প্রচণ্ড ঠান্ডা । বোয়েচ ? একটা জরুরী কাজ সেরে ফিরতে রাত বারোটা হয়ে গেছে । ট্যাক্সিটা বড় রাস্তায় ছেড়ে দিতে হয়েছে ড্রাইভার গলিতে আসবে না বলে। হেঁটে পাড়ায় ফিরছি । ঠিক, গলির মোড়ের একটু আগে আমাকে চারধার দিয়ে ঘিরে ধরল, গোটা কয়েক নেড়ি । আমাকে দেখে গোঁ গোঁ করে মাটি আঁচড়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে । চারদিক দরজা জানলা বন্ধ । দৌড়ে গিয়ে যে কারও বাড়িতে উঠবো, তারও উপায় নেই । চট করে, মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল । নেড়ীদের অনেক কমন নাম থাকে । কালু, ভুলু, লালু,হেগো- এরকম আর কি ! আমি জোরে জোরে ওইসব নামগুলো বলে তু-তু করতে লাগলাম । তিনটে নেড়ি দেখি গোঁ গোঁ ছেড়ে, ল্যাজ নাড়তে লাগল । বাকিদেরও গোঁসা দেখলাম কমের দিকে । এই অবসরে আমি গলিতে ঢুকে পড়লাম । পাড়ার নেড়িগুলো আমায় চেনে । ওই নেড়িগুলোকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে তাড়িয়ে নিয়ে গেল ।

– এর সঙ্গে, পাস্তুরের সম্পর্ক কী? তারক মোত্তির বললেন ।

– সেটাই তো বলছি । এইসব নেড়িদের চিৎকার শুনে একটা ফ্ল্যাট বাড়ির পোষা অ্যালসেশিয়ান জলদ গম্ভীর স্বরে বকতে লাগল । নামটা জানতাম । বললাম- টাইগার, পাস্তুর ! বকাটা থেমে গেল । শিক্ষিত কিনা ! নেড়ি হলে বুঝতে পারতো না ।

মহিলা মন দিয়ে শুনছিলেন । তার প্রতিক্রিয়া

– তাইলে ডাইকতার বাবু, আফনে আমার মাথার উফরে লালু নামটাই জইপ্যা দ্যান । ওই বোষ্টুমের লগে একটা নেড়ি আইসিল । তারে, লালু কইরা ডাকতাছিল অই মিনষা । পাতুরীতে কাম নাই ! বাড়ি গিয়া ইলশা মাছের পাতুরী খামু অনে ।

চন্দন বলল- আচ্ছা দিদি আমি সাধু নই ! ডাক্তার ! আপনি বরং ওই ঠাকুরমশাইয়ের কাছ থেকে মাথায় জপ করিয়েনিন । সেরে গেলে, ভালো হয়ে যাবেন । তারক মোত্তিরও সায় দিলেন ।

ক্ষেতু বাগচী রেগে বললেন- এইজন্যই আমি আড্ডায় আসি না ! যত্তসব ফাতরা কথা ! বলে তীর বেগে চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলেন ।

দুঃখিত!