১.
-স্যার, চাকরিটা আমার খুবই প্রয়োজন, না হয় অসুস্থ মা-বাবাকে নিয়ে পথে বসতে হবে।
-চাইলে তো আর চাকরি দিতে পারি না আমি, তার জন্যতো কিছু করা লাগবে।
-প্লিজ স্যার, আপনি চেষ্টা করলে অবশ্যই পারেন।
-চেষ্টাতো করতে পারি কিন্তু …।
-আপনার পায়ে পড়ি স্যার, চাকরিটা না হলে আমার সব শেষ হয়ে যাবে।
– থাক থাক আর পায়ে ধরতে হবে না।
মনে মনে একটা হিসেব কষলাম। এই মাসের কামাইটা অনন্ত ২০ এর উপরে। আগামী ছয় মাস পায়ের উপর পা তুলে বসে খেলেও চেলবে। আজকের পাখিটাকে দিয়ে দেখছি জব্বর কাজ হবে। ছোটলোক গুলো কেবল পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে চায়। বিষয়টা দারুণ লাগে আমার কাছে। হাতে বিশেষ ভঙ্গিতে একটা অংকের মাত্রা দেখিয়ে বললাম-‘এতটুকুতে পারবেনতো ? নইলে কিন্তু চাকরিটা’। প্রথমে কিছুটা কাকুতি মিনতি করলেও পরে অবশ্য রাজি হলো-‘পারবো স্যার, অবশ্যই পারব। আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দিই?’। আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বিদায় দিলাম তাকে। মনটা আজ ভিষণ হালকা হালকা লাগছে। আরও ফুরফুরে করতে শরীরটা এলিয়ে দিলাম ইজি চেয়ারে। আজকের ক্ষেপটা দারুণ।
২.
আমি এমনই এক উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা, যেখানে একটু কায়দা করে চললেই পায়ের উপর পা তুলে খাওয়া যায়। আমার অবশ্য এখন গাড়ি বাড়ী নারী কোন কিছুর অভাব নেই। বুদ্ধিটা একটু সবার চেয়ে বেশী খাটালাম আর কী! অফিসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে কলোনীর সবাই আমাকে সমীহ করে চলে। অবশ্য কলোনীর উঠতি বয়সী পোলাপান গুলো একটু বেশীই সম্মান করে আমাকে। কারণ ওদের দানা পানি ও একটু ফূর্তির ব্যবস্থাটা আমিই করিতো, তাই। ছেলে মেয়ে দু’টোকে পড়াশুনোর খরচ বাদ দিয়ে হাত খরচের বাবদ বার্তি টাকা প্রতিমাসেই আমি দিয়ে দিই। যাতে আলাদা করে আমার কাছে চাইতে না হয়। এক্ষেত্রে অবশ্য আমার স্ত্রীর দ্বিমত আছে। ছেলে মেয়েরা নাকি এতে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আরে রাখতো তোমার কথা। আমি ব্যস্ত মানুষ। এদের কখন কি লাগবে না লাগবে, আমার দেখার সময় কই? তা ছাড়া এই বয়সেতো আনন্দ ফূর্তি করবে। কি হয়েছে তাতে? আমার স্ত্রী তখন আর কথা বাড়ায় না। একেবারেই চুপ হয়ে যায়।
৩
-স্যার আপনার সাথে একজন বৃদ্ধ দেখা করতে চায়। পিয়ন এসে বলল।
-পাঠিয়ে দাও।
খুব জরুরী একটা কাজ সারছিলাম। আমার অনুমতি পেয়ে ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। বাবার বয়সী এক বৃদ্ধা। উঠে সালাম করার তেমন প্রয়োজন মনে করলাম না। বরং উনিই আমাকে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি বললাম-বসুন সমস্যাটা কি? বৃদ্ধা কথা বলার আগেই ভেঙ্গে পড়লেন। স্যার, আমার একটা মাত্র মেয়ে। অনেক কষ্টে লেখাপড়া করাচ্ছি। শেষ বয়সে সুখের মুখ দেখব বলে। কিন্তু একটা বদমাশ ভালোবাসার অভিনয় করে আমার মেয়ের সতীত্বটা কেড়ে নিয়েছে। সালিশ বসিয়েছিলাম, কিন্তু ওরা বড়লোক বলে পার পেয়ে গেল। আমার মেয়েটাকে বিয়েও করলনা। আমাকে একটু সাহায্য করেন স্যার। আপনি বললে ওরা অবশ্যই শুনবে।
ওনার কথা শুনে ভীষণ হাসি পেল আমার। কি সব ছাই পাশ ব্যপার নিয়ে আমার কাছে আসে ওরা! ভাবলেই হাসি পায়। ওদের এ ব্যাপার গুলো আমি ভীষণ উপভোগ করি। অবশেষে আর আটকে রাখতে পালাম না
-হা হা হা, কি বলেন, এটা কোন সমস্যা হলো নাকি? চিন্তা করবেন না, ছেলে মেয়েরা একটু আনন্দ ফুর্তি করল আর কি! এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। আপনি বরং বাড়ি গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমান। আমার কাছে মনে হয় এমন কিছু আশা করেনি। চেহারা কালো করে বললেন। আপনারা যে মানুষ, ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে আমার। আপনাদের বিবেক যে এত হীন, ভাবিনি। মুখে হাসির রেখা ধরে রেখেই বললাম- স্যরি, আপনি এবার আসতে পারেন। উঠে যেতে বললেন-‘আল্লাহ অব্যশই আপনাদের এর উত্তম প্রতিদান দিবেন’। যাওয়ার সময় তার চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়তে দেখলাম।
২মাস পর..
অফিসের কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং চলাকালীন সময়ে একটা ফোন আসে। বিরক্ত বোধ করলাম। বিসিভ করে জানতে পারলাম-কলেজের পাশে কয়েক জন বখাটে একটা মেয়েকে ধর্ষণ করেছিলো। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় হাসপাতালে নেয়া হয়। প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে মেয়েটি মারা যায়। আশ্চর্য্যের ব্যাপার হলো মেয়েটি নাকি হুবহু আমার মেয়েটার মতোই। তড়িঘড়ি মিটিং শেষ দ্রুত গেলাম হাসপাতালে। যা ভাবছিলাম তাই। আমার ইংলিশ মিডিয়ামে পড়–য়া মেয়েটা। পরনে সেই চির চেনা জিন্স প্যান্ট ও গেঞ্জি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আমার সেই সোনার ছেলেরা, যাদেরকে আমি ফূর্তির জন্য টাকা দিতাম ওরাই আমার মেয়েটাকে নিয়ে ফূর্তি করেছে। কু-প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায়। সমাজের মুরব্বিরা আমাকে ধিক্কার জানাতে লাগলো। আমার তখনও বোধোদয় হচ্ছিল না এটা আমার কোন পাপের ফল?
৪.
কয়েকদিন আগে আমার সাধের চাকরিটা চলে গেল। অতিরিক্ত উপরি নেওয়ার কারণে। কোনমতে জমানো টাকা দিয়ে দিন পার করছিলাম, ড্রাইভার ও গাড়িটা নিয়ে চলে গেল কয়েক মাসের বেতন না পেয়ে। কিন্তু তবুও নাইট ক্লাবে যাওয়ার সু-(!) অভ্যাসটা বদলাতে পারলাম না কিছুতেই। একদিন রাত একটায় বাসায় ফিরে দেখলাম আমার অন্তসত্ত্বা স্ত্রী প্রসব ব্যথায় কাতরাচ্ছে। কি করব বুঝতে পারছিনা। মাথাটা কিছুতেই কাজ করছেনা। হঠাৎ ড্রাইভারের কথা স্বরণ হলো। কল করে সময় নষ্ট হলো শুধু, রিসিভ করছেনা। উপায় না পেয়ে কলোনীর ভ্যানচালক রমিজকে ডেকে নিয়ে আসলাম বাড়ি থেকে। যার সাথে কিনা জীবনে একটা কথা বলারও প্রয়োজন মনে করিনি। অবশেষে ৩০ মিনিটের পথ ২ঘন্টায় শেষ করে পৌছালাম হাসপাতালে। দেখি হাসপাতালের গেইট বন্ধ। অনেক কষ্টে চেষ্টার পর একজন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগের পর জানাল-এখন কোন কিছু করা সম্ভব নয়। যে আমি কখনো কারো হাত ধরিনি, সে আমি পায়ে ধরতেও দ্বিধাবোধ করিনি সেদিন। কিন্তু কাজ কিছুই হলো না। আমার স্ত্রীটা বিনা চিকিৎসায় মারা গেল হাসপাতালের গেইটের বাহিরে। এই প্রথম বারের মত দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। আমার চোখ থেকে। যা সেদিন দেখিছিলাম বৃদ্ধর চোখে। অবাক হলাম আমি এই মনে হয় তারই শাস্তি। প্রায় ফজরের দিকে অনেক কষ্টে স্ত্রীর লাশ নিয়ে ফিরলাম বাসায়। ঘরে ঢুকতেই দেখি আমার ইন্টার পড়–য়া ছেলেটা মেয়ে-ছেলেদের নিয়ে ফূর্তি করছে। স্ত্রীর শোকে পাগল প্রায় আমার মাথায় খুন চড়ে গেল। তরকারি কাটার ছুরিটা দিয়েই শেষ করে ফেললাম আদরের ছেলেটাকে।
৫.
প্রায় বছর হয়ে এল আমি জেলে। ফাঁসির রায় হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। নিজ হাতে ছেলেকে খুন করার অপরাধে। শুনেছি বাড়িটা ও নাকি বাজেয়াপ্ত করেছে সরকার। সেই সাথে আমার সারা জীবন অবৈধ ও পাপের পথে অর্জন করা সঞ্চিত অর্থ সম্পদগুলো। এখন শুধু দিন গুনছি ফাঁসিটা কখন হবে? কোথায় ছিলাম আর কোথায় এলাম। পুরো দিনটাই আমার পার হয় কেঁদে কেঁদে। কাঁদলেও কি পাপের প্রায়শ্চিত্য হয়। বৃদ্ধটার সাথে একটু দেখা হলে ভালো হত ক্ষমা চেয়ে নেয়া যেত। জানিনা তিনি আমায় ক্ষমা করবে কি না ?
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।