পান্তা বুড়ি রোজ পাতিল ভরিয়া ভাত রাঁধে।তাঁর কতকটা খায়, আর কতকটায় পানি ঢালিয়া পান্তা করিয়া রাখে।পানির ঠাণ্ডাই ভাত পচিয়া যায় না। রোজ সকালে উঠিয়া সে
সেই পান্তা ভাত খায়।
এক চোর টের পাইয়া রাত্তে বুড়ী ঘুমাইলে ঘরে ঢুকিয়া তাঁহার পান্তা খাইয়া যায়।
বুড়ী সকালে উঠিয়া সোরগোল করে,। চোরের চৌদ্দ পুরুষ তুলিয়া গাল দেয়। শুনিয়া চোর মনে মনে হাসে। রাতের বেলা বুড়ী ঘুমাইলে সে আবার ঢুকিয়া আগয়ের মতোই তাঁহার পান্তা ভাত খাইয়া যায়।কাঁহাতক আর সহ্য করা যায় না ।
বুড়ী সকালে উঠিয়া রাজার বাড়ি চলিল নালিশ করিতে ।
যাইতে যাইতে বুড়ী দেখতে পাইল পথের উপর সিজ্ঞিমাছ নড়িতেছে । সে বুড়ী কে বলিল, “ বুড়ীমা, আমাকে পুকুরে ছাড়িয়া দিয়া যাও এখানে থাকলে আমি মরিব ।
বুড়ির বড়ই দয়া হইল। সে মাছটিকে উঠাইয়া পুকুরে ছাড়িয়া দিল।
তারপর হনহন করিয়া সে পথে যাইতে লাগিল।খানিক যাইয়া
দেখিতে পাইল পথের মধ্যে এক খানা ছুরি পড়িয়া আছে। ছুরিখানা বুড়িকে বলিল, “বুড়ীমা এই পথ দিয়া কত লোক যাইবে, অসাবধানে আমার কেহ উপর পা ফেলিলে পা কাটিয়া যাইবে, আমাকে ঐই কাঁটা গাছের মধ্যে ফেলিয়া যাও।”
বুড়ী ছুরি খানা হাতে লইয়া কাঁটা গাছের মধ্যে ফেলিয়া দিল।
আরও খানিক যাইতে বুড়ী দেখতে পাইল একটি গাই লাতাপাতার মধ্যে জড়াইয়া আছে। গাইটি বলিল। বুড়ীমা, আমি লাতাপাতার মধ্যে জড়াইয়া আছি।আমাকে ছাড়িয়া দাও।”
শুনিয়া বুড়ির দয়া হইল, সে দুই হাতে লাতাপাতা ছাড়িয়া দিল।
গাইটি খুশি হইয়া এদিকে ওদিকে ঘুরিয়া ঘাস খাইতে লাগিল।
আরও খানিক যাইতে পথের ধারে একটি বেল গাছ বুড়ীকে ডাকিয়া বলিল,বুড়ী মা একটু শুনিয়া যাও।
বুড়ী থামিয়া বলিল “কি বলিবে বাছা! শিগগির বল! আমি রাজার বাড়ি যাইব। রাজসভা ভাজ্ঞিল বলিয়া। শিগগির কি বলিবে।”
বেল গাছ বলিল,আমার চারিধারে এত আগাছা জন্ময়াছে যে, আমি ভালো করিয়া দম নিতে পারিতিছি না। আর মাটির ভিতর যা কিছু রস আছে, আগাছারা খাইয়া ফেলে। আমার জন্য কিছু থাকেনা। দিনে দিনে আমি শুকাইয়া যাইতেছি।”
শুনিয়া বুড়ির দয়া হল। সে বহু কষ্টে বেল গাছের চারিধারের আগাছাগুলি টানিয়া উপড়াইয়া ফেলিল। বেল গাছ ভালো করিয়া নিঃশ্বাস লইয়া বুড়িকে দোয়া করিতে লাগিল।
সেখান হইতে বুড়ী আরও তাড়াতাড়ি পথ চলিতে লাগিল।
রাজসভা তখন ভাঙ্গে ভাঙ্গে। বুড়ী আগাইয়া যাইয়া বলিল,“এক চোর রাতে আসিয়া রোজ আমার পান্তাভাত খাইয়া যাই। তুমি ইহার বিচার কর।”
রাজা বলিল “ তুমি জদি চোর ধরিইয়া আনিতে পার।, আমি তাঁহার বিচার করিতে পারি।
কে তোমার পান্তাভাত খাইয়াছে না জানিলে কাহার ওপর বিচার করিব।”
রাগিয়া-মাগিয়া বুড়ী বলিল, “তবে তুমি কেমন রাজা হে?চোর ধরিতে পারনা? তোমার আশিগণ্ডা পাহাদার কি নাকে শরষের তেল দিয়া রাতে ঘুমাই?
তাহারা থাকিতে আমার বাড়ীতে কেমনে চোর ঢোকে?
রাজাকে গাল পাড়িতে পাড়িতে চলিল। বেলগাছের কাছে আসিলে, বেলগাছ জিজ্ঞাসা করিল, “বূড়ীমা!যে বেরাজ হইয়া ফিরিয়া চলিয়াছ,খবর কি?”
বুড়ী উত্তর করিল “এক চোর আসিয়া রোজ আমার পান্তাভাত খাইয়া যাই। রাজার কাছে গিয়েছিলাম বিচার চাহিতে। রাজা বিচার করিল না।”
বেল গাছ বলিল, আমার একটা বেল নিয়া যাও, রাতে চুলার মধ্যে পোড়া দিয়া রাখিও।”একটি বেল লইয়া ঝোলার মধ্যে পুরিয়া হনহন করিয়া বুড়ী পথ চলিতে লাগিল।
খানিক যাইতে গাই জিজ্ঞাসা করল,বুড়ীমা, বড় যে বেরাজ হইয়া চলিয়াছ!”
বুড়ী বলিল,এক চোর রাতে আমার পান্তাভাত খাইয়ে যাই। রাজার কাছে এর বিচার চাহিয়াছিলাম। রাজা বিচার করিল না।”
গাই বলিল “আমার এক দানা গবর নিয়া যাও।তোমার দরজার সামনে রাকিয়া দিও।”
কলাপাতা করিয়া এক দানা গোবর লইয়া বুড়ী আবার পথ চলিতে লাগিল।
খানিক যাইতে ঝোপের ভিতর থেকে ছুরি জিজ্ঞাসা করল, “ বুড়ীমা, তোমার মুখখানি যে বেরাজ বেরাজ?”
বুড়ী বলিল, এক চোর আসিয়া রোজ আমার পান্তাভাত খেয়ে যাই, রাজার কাছে এর বিচার চাহিতে গিয়েছিলাম। রাজা এর বিচার করিল না।
ছুরি বলিল, “ বুড়ীমা! আমাকে লইয়া যাও। গোবর দানার মধ্যে আকমাকে লুকাইয়া রাখিও।”
বুড়ী ছুরিখানা ঝোলার মধ্যে লইয়া আবার পথ চলিলে লাগিল।
আরও খানিক যাইতে পুকুরের ভিতর হইতে সিজ্ঞিমাছ বলিল, “বুড়ীমা!আমাকে লইয়া যাও।আমাকে তোমার পান্তা ভাতের হাড়িতে রাখিয়া দিও।
বুড়ী সিজ্ঞিমাছটি তাঁহার ঝোলার মধ্যে পুরিয়া লইল। দুপুরের বেলা তখন গড়িয়ে পড়িয়াছে। এত পথ চলিয়া ক্ষুধাই বুড়ির বুড়ির পেটে আগুন জ্বলছে। সে আরও জোরে জোরে পথ চলিতে লাগিল।
বাড়ি আসিয়া বুড়ী এক পাতিল ভাত রাঁধিয়া কতক খাইল আর কতক সেই হাড়ির মধ্যে রাখিয়া পানি ঢালিয়া পান্তাভাত করিল। পানি সমেত সেই পান্তাভাতের মধ্যে সিঙ্গিমাছটিকে ছাড়িয়া দিল। তাঁরপর দরজার সামনে গোরর দানা রাখিয়া তাঁহার ভিতরে ছুরিখানা লুকাইয়া রাখিল।
বেল টি আখার মধ্যে পোড়া দিয়া কাঁথা-কাপড় মুড়ি দিয়া বুড়ী নাক ডাকিয়া ঘুমাইতে লাগিল।
এদিকে রাতে চোর আসিয়া যেই পান্তাভাতের হাঁড়িতে হাত দিয়াছে, অমনি সিঙ্গিমাছ তাঁহার হাতে কাঁটা ফুটাইয়াছে।
ব্যাথার জ্বালাই চোর লাফ দিয়া পালাইবে আর গবর নাদায় পিছলাইয়া পড়িয়া গিয়াছে গবর নাদায় পড়িয়া য়াইতেই ছুরি লাগিয়া পা কাটিয়া গেল!পায়ের আঘাতে গোবর ছিটিয়া চোখে মুখে আসিয়া লাগিল।
চোর সামনের পুকুরের হাত পা ধুইয়া ভাবিল, বুড়ির আখার উপর যাহাতে হাত-পা গরম করিয়া লই। যেই সে আখার উপর হাত-পা গরম করিতে গিয়াছে,অমনি বেলটি ফাটিয়া চোরের চোখে-মুখে লাগিয়া ফোস্কা করিয়া দিয়াছে।
সেই হইতে চোর আর বুড়ির ত্রিসীমানাই আসে না। মজা করিয়া বুড়ী পান্তাভাত খায় আর সারাদিন বসিয়া ছেঁড়া কাঁথায় জোড়াতালি দেয়।