ঢেঁকিপাড়ার কাননের সম্পাদক মহোদয় যখন একটি লেখা লেখা করে আমাকে পাগল করে তুললো, আর লেখার বিষয়বস্ত্ত ভাবতে ভাবতে আমারও পুরোপুরি পাগল হবার যোগাড়, তখন হঠাৎই মনে হলো পাগল নিয়েই তো লেখা যেতে পারে। আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, পাগলরা কিন্তু বেশি ভালো বলেই আমরা তাদের পাগল বলি। এই যে আমরা শিক্ষকরা আধপাগলা বা পাগলা ছাত্র বলি কাদের? যারা ক্লাসে অমনোযোগী তাদের। অথচ মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন অমনোযোগী বলে কোনো ছাত্র নাই। যার ক্লাসে মনোযোগ নাই তার নিশ্চয়ই অন্য কোথাও মনোযোগ আছে। অর্থাৎ শিক্ষকের এক ঘেয়ে ঘ্যান ঘ্যান না শুনে যে ছেলেটা বাইরে তাকিয়ে আছে, সে নিশ্চয়ই ফুলে, পাখিতে, প্রজাপতিতে, রংধনুতে অথবা প্রেমিকাতে মনোযোগ দিয়েছে। তার মানে মনোযোগ তার কোথাও না কোথাও আছেই।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, নিউটন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কার করেছিলেন আপেল বাগানে বসে, বিরক্তিকর ক্লাসরুমে বসে নয়। আর টমাস আলভা এডিসন-যাকে অমনোযোগিতার চূড়ান্ত খেসারত স্বরূপ শ্রবণশক্তি হারাতে হয়েছিল। অথচ মুরগির ডিমের প্রতি তাঁর মনোযোগের বিন্দুমাত্র ঘাটতি ছিলনা। অমনোযোগী এই এডিসনই হতে পেরেছিলেন বিজলি বাতির প্রথম আবিষ্কারক।
একটা স্মরণীয় উক্তি পড়েছিলাম যে, ভালো মানুষেরা দ্রুত বিয়ে করে। কিন্তু জ্ঞানীরা বিয়ে করে বিলম্বে। কথাটা সত্য। কিন্তু এর থেকে আরো একটা সত্য আবিষ্কার করতে পারি যে, তাহলে জ্ঞানী মানুষেরা ভালো মানুষ নয়। তার মানে কথা দাঁড়াচ্ছে যে, পাগলেরাই মানুষ হিসেবে ভালো। আর পাগল কারা তা নিয়েও মতভেদ প্রচুর।
কারো কারো মতে তো সব মানুষই কিঞ্চিৎ পাগল, কেউ ধনের পাগল, কেউ জ্ঞানের পাগল, কেউ মমতার পাগল, কেউ ক্ষমতার পাগল। তবে পরিতাপের বিষয় মমতার পাগল দেশ হতে দ্রুত লোপপাচ্ছে, আর ক্ষমতার পাগল বৃদ্ধি পাচ্ছে পালে পালে। আরো পরিতাপের বিষয় যে মমতার পাগলদের জন্য পাগলা গারদ আছে। কিন্তু ক্ষমতার পাগলদের জন্য কোনো গারদ নেই বলে পুরো দেশটাই এরা গারদে গন্য করে ফেলছে।
ছোট বেলায় শুনতাম যাদের পা লম্বা এবং মাথা গোল, তাদের বলা হয় পাগল। বড় হয়ে দেখলাম প্রায় সব মানুষেরই পা কিঞ্চিৎ লম্বা এবং মাথা কিঞ্চিৎ গোল। এ থেকে এ ধারণা বদ্ধমূল হতেই পারে যে, সব মানুষই কিঞ্চিৎ পাগল। তবে ক্ষমতার পাগলদের দাপটে মমতার পাগলরাই শুধু পাগল বলে সমাজে স্বীকৃত। আমার মনে হয় মমতার পাগলদের কথা যদি আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনি। তাহলে বুঝতে পারবো যে, ক্ষমতার পাগলরাই প্রকৃত পাগল। সেই পুরনো গল্পটা আপনাদের নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেই।
আয়ুব আমলের ঘটনা। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ক্ষমতার পাগল জেনারেল আয়ুব খান মমতার পাগলদের দেখতে গেলেন পাগলা গারদে। জনৈক পাগল আয়ুব খানকে জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম তোমার? আয়ুব খান বললেন, আমি প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান। পাগল বললেন, সবে মাত্র এসেছো তো, তাই অমন মনে হচ্ছে। ভ্যাবাচ্যাকা আয়ুব খান বললেন, তার মানে? পাগলের জ্ঞানপূর্ণ জবাব ছিল, আরে ভাই, আমিও যখন প্রথম এখানে আসি তখন নিজেকে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান মনে হতো।
আমাদের ক্ষমতার পাগলেরাও যে যখন সংসদ নামক গারদে ঢুকছে, তারই তখন মনে হচ্ছে আমিই বুঝি প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান। তাহলে কথাটা কি? যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ হবে, নাকি যে যায় গারদে সেই হয় আয়ুব হবে? যে যায় লঙ্কায় সেই সেই হয় রাবণ কথাটা কিন্তু ঠিক নয়। কারণ রামচন্দ্রও লঙ্কায় গিয়েছিলেন কিন্তু রাবণের ন্যায় লম্পট হয়ে ওঠেন নাই। এমনকি স্বয়ং রামচন্দ্রের ছোট ভাই বিভীষণও ছিলেন একনিষ্ঠ ধার্মিক। তাহলে শুধু শুধু লঙ্কাকে দোষ দিয়ে লাভ কী। দোষ তো ললাটের। ললাটের দোষেই রাবণরা বার বার ফিরে আসে। রামচন্দ্র আর ফিরে আসেন না।
এইরে, ভুল করে রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছি। লঙ্কায় বারণই যাক আর রামই যাক তাতে তোমার মতো চুনোপুঁটির কী হে বাপু। তুমি পাগল নিয়ে লিখছো, পাগল নিয়ে লেখো। এ গল্পটা আধুনিক। এক পাগল পাগলাগারদের দেয়ালের এক ছিদ্র দিয়ে প্রতিদিন তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার ভাবলো ও কী দেখে প্রতিদিন? ডাক্তার তাকিয়ে দেখলো কিচ্ছু দেখা যায় না। কৌতুহলী ডাক্তার জিজ্ঞেস করলো। এই, তুমি কী দেখো প্রতিদিন? আমি তো কিছুই দেখলাম না। পাগল তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো, হুঁহ্, আমি প্রতিদিনে দেখি তা কিছু দেখলাম না, আর উনি একদিন দেখেই দেখবার চায়। গাধা কোথাকার।
এই গল্পটা শুনলেই আমার কেন জানি মনে হয় আমরাও ওই পাগলটার মতো একচল্লিশ বছর ধরে স্বাধীনতা নামের এক ফুটো দিয়ে তাকিয়ে আছি কী যেন দেখবার আশায়, কিন্তু কিছুই দেখা যাচেছনা। মাঝে মাঝে এক একজন নতুন ডাক্তার দেখাবার চায়, কিন্তু পারে না। ডাক্তাররা সুস্থ কী না তা নিয়েও পাগলদের মধ্যে আছে বিশাল সংশয়।
একটা ঘটনা বলি-
পাগলা গারদে এক পাগল বসেছে পত্র লিখতে। ডাক্তার জিজ্ঞেস করলো, কী করছো তুমি? পাগল বললো- পত্র লিখছি। ডাক্তার বললো, কাকে? পাগল বললো, আমাকেই। ডাক্তার বললো, কী লিখছো? পাগল বললো, সেটা এখনই বলবো কী করে? পোস্ট হবে, পিওন এসে দিয়ে যাবে, তারপর না বলতে পারবো। পাগল যথারীতি পত্রটা শেষ করে ডাক্তারের হাতে দিয়ে বললো, যাও, পোস্ট করে দিয়ে এসো। ডাক্তার দেখলো পাগল লিখেছে-
ডাক্তার জানে তারা ভালো আমরা পাগল
আমরা জানি তারাই পাগল আমরা ভালো,
কে বলো এই মতভেদের ভাঙবে আগল
অাঁধার কেটে আনবে আলো।
সত্যি এই মতভেদের আগল ভেঙে আলো আনার কেউ নেই। তাই গারদের অাঁধারেই যুগের পর যুগ থেকে যেতে হচ্ছে আমাদের। তবে সান্ত্বনার কথা এই যে, আহাম্মকেরা যতই বলুক- পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়। আমরা তো জানি যে পাগলে আর যাই বলুক, মিথ্যা কথা বলেনা। এবং ছাগলে আর যা-ই খাক, ঘুষতো খায় না। এখানেই পাগল-ছাগলের শ্রেষ্ঠতব।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।