
২০ বছর বিদেশে থেকে অনেক নতুন জিনিস শিখেছি, তার মধ্যে একটা বিদ্যা হল গলফ খেলা। আমার ছেলেবেলা থেকে খেলাধুলার শখ, কিন্তু দেশে থাকতে কোনদিন গলফ খেলবার সুযোগ হয় নি। কোলকাতায়ে গলফ খেলা হয় মাত্র দুটি ক্লাবে, এবং সেই ক্লাবের সদস্য না হলে গলফ খেলা সম্ভব নয়। আমি গত বিশ বছর সিডনি শহরে বাস করছি। বিদেশকে এখন স্বদেশ বলে গ্রহণ করেছি।তার সাথে গ্রহণ করেছি সেই দেশের কিছু আদব কায়েদা। সিডনি-তে আমরা চার পাঁচ জন বন্ধু মিলে শুরু করেছি গলফ খেলা। এটা আমাদের নিত্য শনিবারের নিয়ম হয় দাঁড়িয়েছে। সিডনির পাড়ায়ে পাড়ায়ে ছোট বড় প্রচুর গলফ কোর্স। এই কোর্স গুলর বেশির ভাগেই সাধারণ মানুষ অল্প নগদ টাকা দিয়ে গলফ খেলতে পারে। আমরাও তাই করি, সুবিধে মত এক একবার, এক একটা আলাদা গলফ কোর্স বেছে খেলতে হাজির হয় যাই।
আমরা কেউয়ই খুব একটা ভাল গলফ খেলি না, মটা মটি ক্রিকেট খেলার ধরনটা গলফ মাঠে প্রয়োগ করার চেষ্টা। তবে এটা বুঝেছি যে গলফ খেলার একটা নেশা আছে – যাকে সাহেবরা বলে “Golfing Bug”। একবার এই গলফের পোকা মাথায়ে ঢুকলে ছাড়ানো মুশকিল। এইবার কলকাতা বেরাতে গিয়ে প্রচুর পুড়ন বন্ধুদের সাথে দেখা হয় গেল। তার মধ্যে এক বন্ধু তন্ময় এখন ডাক্তার। তার হিন্দুস্থান পার্কের চেম্বারে রমরমা ব্যবসা।ওই পারাতেই তন্ময়দের বড় চার তলা পৈতৃক বাড়ি। বন্ধুদের মধ্যে ওই এখন বিয়ে সাধি করে নি। কাজেই ওর বারিতেই হপ্তায়ে একবার করে আড্ডা বশে বন্ধুদের। একদিন অরওর ফোন এলো – “বিকেলে কি করছিস? সেরকম কিছু না। তাহলে চলে আয়ে ডাক্তারের বাড়ি – সবাই থাকবে – আড্ডা মারা যাবে চুটিয়ে”। আমাদের বাড়ি হিন্দুস্থান পার্কের লাগোয়া – পউছে গেলাম ৭টা নাগাত এক বোতল ডিউটি ফ্রি বগলে করে। গুচ্ছের আড্ডা হলও অনেক রাত পর্যন্ত। এক সময়ে গলফের প্রসঙ্গটা উঠল। “তুমি কি গলফ খেলো নাকি”? জিগ্যেস করল তন্ময় “খেলি বলা চলে না – বলতে পার সপ্তাহে একদিন গিয়ে মাটি কুপোই” আমি বিনয় করলাম। “খেলবে নাকি এখানে এক রাউন্ড – তাহলে আমি কিশেনলাল কে বলি সেট-টা গ্যারেজ থেকে ধুল ঝেরে বার করতে” ডাক্তারের বেশ উৎসাহ। আমি ত এক পায়ে খারা – কোলকাতায়ে আশার আগে থেকেই ইচ্ছে এখানকার ক্লাব গুলতে গলফ খেলবার। বিশেষ করে রয়েল কলকাতা গলফ ক্লাব পৃথিবীর দিতিয় তম পুরাতন গলফ ক্লাব – বহু পুড়নো ইতিহাস – সেই সাহেবি আমল থেকে রমরমা ব্যাপার। তন্ময়ের রয়েলে মেম্বার-শিপ আছে। গলফ খেলার শখটাও আছে ভরপুর। এক কালে নিয়মিত গিয়ে ক্যাডির সাথে খেলে খেলে গলফটা রপ্ত করেছিল, এখন কাজের চাপে আর উপযুক্ত বন্ধুর অভাবে আর তেমন খেলা হয় না। এবার আমাকে পেয়ে আবার একটু খেলা যাবে।আমাদের কথা বার্তা শুনে বিক্রম এসে যোগ দিল। আমরা খেলার প্ল্যান বানাচ্ছি শুনে বিক্রম বলল – “আমিও আছি তদের দলে – নেভি ছাড়বার পর খেলাই হয় নি। সূর্য আসাতে ভালই হলও – জমিয়ে এক রাউন্ড খেলা যাবে – কিন্তু এমনি এমনি ডাল ভাত চলবে না – বাজি ধরে খেলা চাই”। বিক্রম আমার কলেজের বন্ধু।
চিরকাল ভীষণ অ্যাডভেঞ্চারস স্বভাব, কোন কাজ অসম্ভব বলে মানা অর ধাতে নেই।কলেজ জীবনে অনেক বেপরোয়া কর্জও কলাপের দরুন আমাদের দলটার বেশ নাম ছিল – আর এই অনেক কীর্তির নায়ক ছিল বিক্রম। যদিয় এসব কথা ২৫ বছর আগের কথা, এখন আমরা সবাই অনেক দায়িত্বশীল, নির্ভর যোগ্য ইত্যাদি… কলেজের ডানপিটে ছোকরা থেকে সমাজের মান্য গণ্যদের দলে যোগ দিয়েছি। তবুও বাঘের ডোরা তো আর পালটায় না। কলেজ শেষ হবার পরে বাকি বন্ধুরা চাকরি নিলো দেশি বা বিদেশি কোম্পানিতে বেশির ভাগেরই ধান্দা যেখানে টাকাটা বেশী। বিক্রম সবার ব্যতিক্রম – ও গিয়ে নাম লেখাল ভারতীয় নেভিতে – শখ জাহাজে চরে পৃথিবী দেখবে। তার কয়েক বছর পর খবর পেলাম যে জাহাজ ছেরে সে সাবমেরিন বিভাগে যোগ দিইয়েছ। শেষ মেষ কয়েক মাস আগে Lt. Commander Bikram Roy ভারতীয় নৌবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে সাধারণ কর্মজীবন সুরু করেছেন। কলেজের সেই বেপরোয়া দিনগুলো অনেক বছর আগের স্মৃতি, কিন্তু বিক্রমের তেজ এখনো কমে ণী। ২ তিন বন্ধু খেলা শুরু করলাম পরের দিন সকাল বেলা ভর হতে না হতে ঘুম থেকে উঠে, মুখ হাত ধুয়ে চটপট প্রস্তুত হলাম। পৌনে সাতটার সময়ে মোবাইলে ডাক্তারের কল এলো, সে গারি নিয়ে বারির নিচে পউছে গেছে। “গুড মর্নিং ডাক্তার”, গারিতে ঢুকে বললাম। “গুড মর্নিং – বিক্রম নিজের গারিতে পউছে যাবে”, জানাল ডাক্তার।পিছনের সিটে ডাক্তারের সেটটা রাখা, আমারটা ভারা করতে হবে রয়েলের প্র-শপ থেকে। ভরের আবছা আলতে গারি ছুটল সাউথারন অ্যাভিনিউ ধরে ঢাকুরিয়া লেকের মধ্যে দিয়ে টালিগঞ্জের দিকে। শীতকালের সকালবেলা – রাস্তাঘাটে এখনো ভীর হয় নি। অল্প সময়ে রয়াল ক্লাবের চওড়া ফটকের সামনে এসে দাঁড়াল গারি। ক্লাবের দারোয়ান ডাক্তারকে চেনে, সেলাম ঠুকে দরজা খুলে দিল। পুরনো সাহেবি আমলের ক্লাব হাউস – তার সামনে গারি দার করিয়ে আমরা গারি থেকে নেমে পরলাম। গারি দেখেই বেশ কিছু ক্যাডি এগিয়ে এসেছে। আমরা দুজন ক্যাডি বেছে নিলাম, আমারটার নাম পদ্মলোচন। এই ক্যাডি সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া দরকার – এই খেলা সর্বদাই বড়লোকের খেলা। যারা খেলেন তারা নিজেদের গলফ সেট বয়ে বেরান না। ওই মাল বওয়ার জন্য রয়েছে ক্যাডি। এই হলও ক্যাডির প্রধান কাজ, এছাড়া অন্য কাজ আছে – যেমন বল ঝোপে হারিয়ে গেলে খুঁজে দেওয়া, পাটের লাইন বলে দেওয়া আর অনেক কিছু। যাই হোক এসব করতে করতে দেখলাম বিক্রম আগে থেকেই এসে প্রস্তুত, ওর সঙ্গে চকচকে নতুন গলফের সেট। ডাক্তার আর আমি প্রো-শপে ঢুকে আমাদের গ্রিন ফিস চুকালাম আর আমার জন্য একটা গলফ সেট ভারা করলাম। ঠিক হলও আমরা প্রতি হোল ১০০ টাকার বাজি ধরে খেলব। এতে খেলাটা বেশ জমে উঠবে। আমরা তিন বন্ধু প্রথম টি থেকে খেলা শুরু করলাম। কলকাতার রয়্যাল গলফ ক্লাব এক আশ্চর্য জায়গা। ক্লাবের পাচিলের বাইরে বেরলে টালিগঞ্জের ভীর আর হট্টগোল। চার পাশে গারি বাসের আওয়াজ আর রাস্তার ভীর।চায়ের দোকান আর হকারের ঠেলায়ে আর ফুটপাথে হাটার জায়গা নেই। ক্লাবের পাচিলের মধ্যে কিন্তু একটা অন্য জগত। সুন্দর করে ছাটা ঘাস, মাঝে মাঝে বালির বাঙ্কার আর বেশ কিছু ছট বড় পুকুর। যেখানে গলফের গর্ত করা তাকে বলে গ্রিন। এই গ্রিনের ঘাস অন্য ঘাসের তুলনায়ে আর বেশি মসৃণ। পা ফেললে মনে হএ জেন কন দামি সবুজ মখমলের গালিচার উপরে পা ফেলেছি। সেই গর্ত গুল আবার পতাকা দিয়ে ইঙ্গিত করা, জাতে দূর থেকে বোঝা জায়ে। সারা কোর্সটা মট ১৮টা হলের।অনেক জমি দখল করে এই বিশাল গলফ কোর্স, পুরটা হাঁটলে প্রায়ে ৫-৬ কিলোমিটার হাটা হয়ে।খেলতে খেলতে লক্ষ করলাম অনেক গাছের তলায়ে শেয়াল বশে আছে। মাঝে মাঝে দেখলাম ক্লাবের মেম্বার ঘোড়ার পিঠে চরে ঘুরছে। এক জায়গাতে পুকুরের পাশে একটা খেজুর গাছের ডালে বসে মাছরাঙ্গা পাখি শিকারের অপেক্ষায়ে বশে। সব জায়গাতে জেন প্রকৃতির শোভা উপচে পরছে। মনে হল আমাদের পুড়নো বিধ্বস্ত কলকাতা শহরে এত সুন্দর জায়গা আর নেই। জানুয়ারি মাসের কুয়াশা ঢাকা সকাল কেটে গিয়ে ক্রমশ সূর্য মধ্য গগনে উঠতে লাগল। কলকাতার শিতের হাল্কা রোদ, তার তেজ নেই, পিঠের উপর পরলে বেশ আরাম লাগছিল, পুকুরের জলে পরে সেই রোদ চিকমিক করছিল। আমরা তিন বন্ধু মনের সুখে গলফ খেলতে খেলতে, আর নিজেদের মধ্যে খেজুর গল্প করতে করতে এগচ্ছিলাম। আমাদের খেলা বেশ হাড্ডা-হাড্ডি জমে উঠেছিল। একটা হোল একজন জেতে তো পরেরটা অন্য কেউ। প্রায়ে দশটা হোল খেলা হয়ে গেছে আর বিক্রম এগিয়ে আছে ১ হোলে। এই জাগাতে গলফের একটা নিয়ম নিয়ে প্রিয় পাঠক কে একটু জানানো দরকার। আপনারা হয়ত আঁচ করেছেন যে এই আজব খেলার অজস্র নিয়ম কানুন।সব বলতে গেলে একটা বই লিখতে হবে – কিন্তু এই একটা নিয়ম নিয়ে একটু না বললেই নয়, কারণ এই নিয়মটা রক্ষা করতে গিয়েই গণ্ডগোলটা শুরু হয়েছিল। ৩ হোল্টার নাম দেওয়া হয়েছে Hydrophobia ১১ নম্বর হোল্টার নাম দেওয়া হয়েছে “Hydrophobia” অথবা জলাতঙ্ক। হোল্টার এক ধার রয়েছে ক্লাব সীমানার উঁচু ইটের পাচিল, আর “Fairway-এর” মাঝখানে একটা বেশ বড় মাপের পুকুর। অর্থাৎ খেলোয়াড়ের পক্ষে দুই দিকেই বিপদ। বাজে মারলে বল পাচিল টোপকে বেরিয়ে যাবে ” Out of Bounds”, আর বেশি ভাল মারলে গিয়ে পরবে পুকুরের মধ্যে আর হয়ে যাবে “Lost Ball” । একেই বলে ডাঙায়ে বাঘ – জলে কুমির। এই হোলে প্রথম মার হতে হবে ঠিক মাপা জাতে বল পুকুরে ধারে এসে থেমে যায়ে। দ্বিতীয় মার হতে হবে নিশানা বরাবর গ্রিনের ছট ঘাস তাক করে। এর পর ছোটো চিপ কিম্বা পাট করে আস্তে হবে গর্তের খুব কাছে – এই ধরুন ৪-৫ ফুটের ভেতরে। চতুর্থ শট হবে পাট একেবারে গর্তের মধ্যে। এই তারিকায়ে চার বার মেরে বলটা হোলে ধুকতে পারলে বলা যাবে যে পার বজায়ে রেখেছে “Kept par on the par 4″। গলফের নিয়ম মাফিক প্রতিটি শট গুনেই খেলার হিসাব হয়ে। যার সবচেয়ে কম শটে খেলা শেষ হবে তাড়ই জিত। যাই হোক জলাতঙ্ক হোলে আমার কপাল জোরে কয়েকটা বেশ ভাল শট লাগার ফলে, সেই হোলটা আমি জিতে বিক্রমের সাথে বরাবর হলাম।
আগের হোলটা ভাল খেলে হয়ত একটু আত্মতুশটিতে ভুগছিলাম। যে কাড়নেই হোক ১২ নম্বর হোলে আমার দ্বিতীয় মারটা জঘন্য রকম ডান দিকে কেটে, মাঠ ছেরে ঢুকল একটা জঙ্গলা জাগার ভিতর।বলের গতিবিধি লক্ষ্য করে আমার ক্যাডি পদ্মলোচন একটু আপসোস করে বলল – “ঈসস – বাবু একেবারে স্লাইস করলেন। এইবার অই জংলার মধ্যে বলটা খুঁজে পেলে হয়ে”। আমরা দুজন হাটতে থাকলাম ওই দিক লক্ষ্য করে। কাছে পউছে পদ্মলোচন আবার বলল – “বাবু মনে হচ্ছে আপনার বল গিয়ে ঢুকেছে পাগলা মোল্লার পীরের পাশে। আপনাকে তো জুতো খুলে খেলতে হবে”। তার কথার মানে ঠিক বুঝতে পারলাম না। “পীর আবার কি? আর জুতই বা খুলতে হবে কেন”? ক্যাডি আমায় বোঝাল – “পীর জানেন না? পীর হল আপনার মুসলমানদের সমাধি, আর ওখানে জুত পরে গেলে আপনার অমঙ্গল হবে”। আমি জাগাটা ভাল করে দেখলাম। পীরের চারি পাশে আগাছা আর ঝোপরা বেশ ঘন। জাগাটা দেখলেই মনে হয় শাপ খোপের আরোদ।আমার জুত খোলার কন শখ হল না। পদ্মলোচন কে বললাম – “আমার বলটা নিয়ে এস, আমি একটু পরিষ্কার জায়গা থেকে মারব”। এতে আমার একটা শট লোকসান হবে তা হোক। আমি ঝোপরা থেকে একটু তফাতে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম একটা সিগারেট জালিয়ে। বিক্রম আর ডাক্তার দুজনেই এসে মজা দেখছে। পাঁচ মিনিট পরে পদ্মলোচন বেরিয়ে এলো মুখ কাঁচুমাচু করে। “কি ব্যাপার বল কই”? তাকে প্রশ্ন করলাম। “বাবু – আমার ভয় করছিল, ও জাগা থেকে আমি বল খুঁজতে পারব না”। অল্পক্ষণ থেমে থেকে সে আবার বলল – গলার শরে বেশ লজ্জিত – “ভয় করছিল স্যার – ও জাগাটাতে ভুত আছে”। “ভুত আছে! কি আবোলতাবোল বকছ”, আমি লোকটার কথায় অবাক। পদ্মলোচন গরিব লোক – পড়াশুনাও হয়ত কিছুই নেই। বুঝতে পারলাম যে লোকটা সত্যি ভয় পেয়েছে। কিছুটা চাপে পরেই জাগার গল্পটা আমাদের শোনালো। সংক্ষেপে কাহিনীটা এই: কয়েক বছর আগে এই ক্লাবেরই এক হোমরা চমরা – মজুমদার সাহেব ঠিক এই পীরের কাছেই তার বল হারিয়েছিল। হাজার টাকা প্রতি হোল পিছু বাজি ধরে খেলা। বল হারিয়ে মজুমদার সাহেব রেগে খাপ্পা। রেগে মেগে আর কিছু না করতে পেরে সে পীরের গায়েই দু চার লাথি কষান। খেলা শেষ হবার পর সবাই ক্লাব হাউসে গিয়ে একটা ড্রিংক নিয়ে বসে। মজুমদার সাহেবের খেলা হেরে আর বন্ধুদের সাথে বসতে চাইলেন না। একাই চলে গেলেন আবার ৯টা হোল খেলবার জন্য – ক্যাডি ছাড়া। পরের দিন সকাল বেলা তার মৃত দেহ পাওয়া যায় ১৩ নম্বর টি এর সামনে – হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু। এর পর থেকেই কাঁদিরা জাগাটাকে অভিশপ্ত বলে বিশ্বাস করে। চট করে কেউ আর ওই পিরটার ধারে কাছে ঘেঁসতে চায় না। গল্প শুনে আমরা তিনজন চুপ করে কিছুক্ষণ হজম করলাম। তারপর বিক্রম হটাত হো-হো করে হেসে উঠল। “যত সব ফালতু গাজাখুরি গল্প। ব্যাটা ক্যাডি তোকে একটা ঢপের চপ খাইয়ে বলটা ঝেঁপে দিল। তোকে পুরো মুর্গি করল, আর তার উপর তুই একটা শট খোয়ালি – লস্ট বল – মনে হয় এই হোলটা আমিই জিতবো” – বিক্রম বেশ উত্তজিত। তন্ময় ডাক্তার সাবমেরিন ফেরতা বিক্রমের মত বির পুরুষ নয়, একটু ভয় পেয়েছে। সে বলল “তোমার সব ফুকো বরাই। তুমি কি বলতে চাও যে গল্পটা শোনার পরেও জাগাটার প্রতি তোমার মনে একটু …ইয়ে… মানে ভয় হয় নি”? “ভয় হবে! কখনোই না।তাও আবার ওই চোলাই খোর ক্যাডিটাোর ন্যাকামি শুনে”। বিক্রম মুখ দিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের শব্দ করল। “তোমার মত ভিতু আমি নই ডাক্তার”। কাপুরুষ আখ্যাটা মেনে নিতে তন্ময়ের মর্মে বাঁধল। সে একটা একশো টাকার নোট বার করে বশ নাটকীয় ভাবে বিক্রমকে আরও উশকে দিল, ” তোমার যতো মুখের বরাই। সাহস থাকে তো জাও দেখি জুতো পরে ওই পীরের উপরে। এই আমি একশো টাকা বাজি ধরছি তোমার অত বুকের পাটা নেই”। বিক্রমের সঙ্গে এরকম চ্যালেঞ্জ ধরা একটা ষাঁড়ের সামনে লাল গামছা ধরার সমান। একে তো তার রক্ত গরম – তার উপর ১০০ টাকা জেতবার সুযোগ, সে ডাক্তারকে পালটা উত্তর দিল – “বেশ কথা ডাক্তার, তাহলে তোমার টাকায়ে আজ লাঞ্চ সারা যাবে, এবার দ্যাখো আমি কি করি”। এই বলে বিক্রম সটান ঢুকে পরল ঝোপড়ার ভিতর পীরের কাছে। পীরের পাশে দারিয়ে জোর গলায়ে আমাদের শুনিয়ে সে বলল, “সকাল থেকে বাথরুম যাই নি – সাংঘাতিক জোর চেপে গেছে”। এই বলে আমাদের কিছু বোঝবার আগেই সে প্যান্টের বোতাম খুলে বেশ অনেকটা পেচ্ছাপ করে নিলো পীরের গায়ে। বিক্রমের কাণ্ড দেখে তন্ময় আর আমি হতবাক – সাহসের একটা মাত্রা আছে – এটা তো রীতি মত বেয়াদপি। দুই মিনিট পরে বিক্রম বেরিয়ে এলো প্যান্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে, “কি বুঝলে ডাক্তার – এবার টাকাটা ছার। ও সব পাগলা ফকির টকির আমার বাল বাঁকাতে পারবে না”। ডাক্তারের হাত থেকে টাকার নোটটা নিয়ে নিজের পকেটে গুজে নিলো বিক্রম। ৪ খেলার পরে ক্লাভাউসের শামিয়ানা এই ঘটনার পর খেলার মজাটা জেন কিছু কমে গেল। তবুও বাকি হোল গুল খেলে আমরা শেষ করলাম। খেলার পরে ক্লাব হাউসের শামিয়ানার তলায় বসে আমরা খেলার হিসাব মেটাচ্ছি। দেখা গেল বিক্রম জিতেছে, আমি আর ডাক্তার দুজনেই হেরেছি – তবে বেশি নয় এই ২০০ টাকার মত। ইতি মধ্যে উর্দি পরা বেয়ারা আমাদের টেবিলে খাবার নিয়ে এসেছে। সারা সকাল খেলা আর হাটার পর খিদেটা বেশ জমিয়ে চেপেছিল। তিনজন বন্ধু মিলে স্যান্ডবিচ আর কফি সাটাতে লাগলাম। টেবিলে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। বিক্রমের ফোন – ব্ল্যাক-বেরি – বিক্রম হাত বারিয়ে ফোনটা তুলে নিলো। “বিক্রম স্পিকিং” ওদিকের কথা আমরা শুনতে পেলাম না, কিন্তু বিক্রমের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। ফোন নিয়ে টেবিল ছেরে উঠে দাঁড়ালো। আমাদের বসবার জাগা থেকে একটু সরে দারিয়ে কিছুক্ষণ চাপা গলায়ে কথা বলল। আমারা কথা শুনতে পেলাম না। যখন ফিরে এলো তখন বিক্রমের চোখে মুখে একটা থমথমে ভাব। “কি রে – কি ব্যাপার”? আমি প্রশ্ন করলাম – কেন জানি মনে হল কিছু একটা ঘোটে গেছে। বিক্রম উদ্ভ্রান্ত – একটু যেন দিশেহারা – টেবিল থেকে গারির চাবি নিতে গিয়ে হাতে লেগে কফির পেয়ালা উল্টে গেল, সেদিকে তার হুস নেই – “অনিল…অনিলের অ্যাকসিডেন্ট…আমাকে এখুনি জেতে হবে…।আমরি হাসপাতাল…”, বিক্রমের এইসব ছন্নছাড়া কথা বলতে বলতে দরজার দিকে দউরতে শুরু করল। আমরা বুঝতে পারলাম ওই ফোনে কোন খারাপ খবর পেয়েছে বিক্রম। আমরা ওর পিছনে টেবিল ছেরে উঠে পরলাম। খাবার বিল দেওয়া হয় নি – সে ডাক্তার পরে চুকিয়ে দেবে। বিক্রম ক্লাভাউস থেকে বেরিয়ে গারির দিকে দৌরতে শুর করেছে। আমরা দুজনে ওর পিছু ধাওয়া করলাম। আমি জোরে চ্যাচালাম – “বিক্রম দারা – কি হয়ছে – আমাদের বল”। বিক্রম থামল না – সেই দউরন অবস্থায় সামনে থেকে ভাঙা ভাঙা উত্তর এলো – “অনিল…সকালের টিউশন…।
বাইক…।মিনিবাসের সাথে ধাক্কা…।রাশ বিহারির মোরে…।” আমার পাশে ডাক্তার হাঁপাতে শুরু করেছে, এসব দউর ঝাপের অভ্যাস নেই। “অনিল কে”? প্রশ্ন করলাম। “বিক্রমের ছেলে। কলেজে পরে ফার্স্ট ইয়ার। আগের পুঁজতে বাইক কিনে দিয়েছে”। ডাক্তার হাপাচ্ছে। বিক্রমকে কোন মতেই এই অবস্থায় গারি চালাতে দেওয়া চলে না।