পাইন-পাতার রূপকথা–৩য় পর্ব- সাত্যকি হালদার

গল্পের চতুর্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

নারিয়ারই একমাত্র কোনো কাজ নেই। সে মনাস্ট্রি থেকে বেরিয়ে এখানে বসে, ওখানে বসে, আধ-ঘণ্টাখানেক চক্কর মেরেই গোটা গ্রামটা ঘুরে নেয়। তারপর কোনো দিন গান গায়, কোনো দিন গায় না। সন্ধে হতে না হতে গ্রাম একদম চুপচাপ। যে যার ঘরে ঢুকে যায়। মনাস্ট্রিতে ঢুকে নারিয়া তখন ধুনো আর ধূপকাঠির ছাইয়ের মেঝেতে কম্বল পেতে টান হয়ে শুয়ে থাকে।

ফুলবা সেই প্রথম দিন বলেছিল, কালিম্পংয়ে দেখা এই লোকটার নাম মনে হয় নারিয়া। তারপর থেকে সে-লোকের মুখে নারিয়াই।

কিন্তু এর মধ্যে একটা ছোট ব্যাপার হয়। নারিয়া মনাস্ট্রিতে থাকলে গাঁয়ের অনেকেই দেখা করতে আসে তার সঙ্গে। দু-চারটে খোশগল্প হয়। নারিয়ার ছোট ঘরটায় উঠে-বসেও কেউ কেউ। কিন্তু এর মধ্যে একদিন দুপুরের পর থেকে বারমিক কুয়াশায় ঢেকে গেলে কে একটা নারিয়ার সঙ্গে কথা বলতে এসে দেখে, জমাট ঠান্ডায় ঘরে বসে ম্যান্ডোলিনে পুরনো একটা লেপচা সুর বাজাচ্ছে নারিয়া, আর ঘরের মেঝেতে ওর সামনে বসে গান শুনছে সাতাশ-আটাশ বছরের একটি মেয়ে। মেয়েটির লম্বা চুল, চেহারাটা ঠিক পাহাড়িদের মতো নয়। মেয়েটিকে আগে কখনো দেখা যায়নি বারমিকে। চুপ হয়ে বসে সে নিচু সুরের বাজনা আর গান শুনে যাচ্ছে।

তারপর বিকেল হলো। কুয়াশা কমে এলো। যে দেখা করতে গিয়েছিল সে-ও ফিরে এলো। মেয়েটি রয়ে গেল মনাস্ট্রি-লাগোয়া ঘরে।

সেদিনও আবার বৃষ্টি হলো সারারাত।

পরদিন রোদ উঠলে বড় গাছের পাতারা যখন রোদে সবুজ, উঁচু গাছের মাথায় বসে খানিক পরপর শিস দিচ্ছে অদৃশ্য মোনাল, ঝরনা লাফিয়ে নামছে নিচের পাথরে, তখন নারিয়ার সঙ্গে গ্রাম ঘুরে দেখছিল সেই মেয়েটি। তার চোখমুখে কেমন ঘোর। যেন রোদের পাহাড়, ছোট-ছোট বাড়ি, মেঘ, আকাশ এসব দেখে সে অবাক। সে কাঁধে ম্যান্ডোলিন নেওয়া নারিয়ার পাশেপাশে হাঁটল, উমাশংকরের দোকানের পাশে এসে বসল একটু, আর যারা এসেছিল অবাক-অবাক চোখে তাদের কথা শুনল, তারপর আবার ফিরে গেল মনাস্ট্রিতে। তার মুখে কখনো একটুও কথা নেই। শুধু দু-একবার একটুখানি হাসি।

লোকেরা খানিকটা অবাক হলো ঠিকই, কিন্তু কেউ জানতে চাইল না হঠাৎ-আসা মেয়েটি কে। কোথা থেকে এসেছে সে। কেনই-বা এসেছে। এরকম প্রশ্ন পাহাড়ি গ্রামের রীতি নয়। মনাস্ট্রি-লাগোয়া ছোট ঘরটায় বছরের নানা সময়ে একটু-একটু করে আসে যারা তাদের কাছে কেউই ঘরবাড়ির খবর জানতে চায় না। কেনই-বা জানতে হবে অত কিছু!

যেমন নারিয়ার কাছেও তো ততদিনে কেউ জানতে চায়নি আরো কত দিন ও বারমিকের এই ছোট মনাস্ট্রিটায় থাকবে। এরপর সে আর কোথাও যাবে কিনা। শুধু সন্ধের পর গরু নিয়ে ফিরে নরবু ওর মেয়ের জন্মদিনের আগের দিন ধূপ জ্বালাতে এসে দেখেছিল কদিন আগে আসা মেয়েটিকে নারিয়া নিজের থাকার ছোট ঘরটি ছেড়ে দিয়েছে। ও নিজে মনাস্ট্রির ভেতরে কাঠের মেঝেতে গালিচার ওপর শুচ্ছে।

প্রথমে একটি লোক গ্রামের হয়ে গিয়েছিল, পরে দুজনেই ওরা বারমিকের হয়ে গেল। উমাশংকরের দোকানের, নরবুর, জুলে শেরপার। তারপর আরো সবার। মেয়েটির বেশ ভাব হলো নরবুর মেয়ের সঙ্গে। সকালে যে গোলগোল চোখমুখের বাচ্চারা পিঠে ব্যাগ নিয়ে পাহাড়ের গা-বেয়ে খানিকটা নেমে ইশ্কুলে যায় তাদের সঙ্গেও ভাব হলো ওর। যদিও মেয়েটি পাহাড়ের ভাষা জানে না, ওর যা ভাষা বাচ্চারাও জানতো না তা। তবু কেমন কথা হতো। অনেক কথা হতো নরবুর মেয়ে রাম্মিতের সঙ্গে। হিমালয়ের ঢালে এসব ছোট গ্রামে কথা তৈরি হতে অনেক কথা লাগে না। অনর্গল শব্দও লাগে না। হাসলে কিংবা হাত বাড়ালে চলে। কিংবা পাশাপাশি হাঁটলে। রাম্মিতের সঙ্গে সে দুপুরের পর ঝরনা দেখতে যেত। অনেক দূরে পেছন-পেছন ম্যান্ডোলিন কাঁধে হেঁটে যেত নারিয়া। মেয়েটি যাওয়ার পথে বারবার থেমে ছোট ছোট গাছে কীসব খুঁজত।
গল্পের চতুর্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!