গল্পের শেষ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
কথা হচ্ছিল না ঠিকই। আবার একটু-একটু কথা হলো। সে-কথাও হাত বাড়ানোর, কাছে টানার। এই গ্রামের যে-মাথা সেই সিজো লেপচার অনেকখানি বয়স হয়ে গেছে। বুড়ো আর আগের মতো প্রতিদিন ঘর থেকে বেরোয় না। উমাশংকরের দোকানে তো আসেই না। তবু বুড়ো খবর রাখত সবই। ঘরে বসেই রাখত। একদিন সারারাত হাড়-কাঁপুনি ঠান্ডার পর কয়েকজন যখন সকালে রাস্তার ধারে উমাশংকরের দোকানের পাশে এসে রোদে দাঁড়িয়ে বা বসে ছিল তখন আবার বুড়ো এলো। তার গায়ে মোটা কম্বল। গাল আর কপালের চামড়া ভাঁজপড়া। সে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এসে উবু হয়ে বসল। তারপর বলল, পাহাড়ের ঢালে এখনো এতো জমি, ওদের দুজনকে কোথাও একটা জায়গা দেখিয়ে দিলেই তো হয়। একটা ঘর তুলে পাকাপাকিভাবে না হয় বারমিকেই থাকুক।
তা থাকুক…
তা থাকুক…।
জুলে শেরপা বলে, তবে ওরা মনে হয় থাকবে না।
থাকবে না কেন?
জুলে বলে, ঘরে থাকার কথা তো আমি আগেই ওদের বলেছি। আমার ছেলেটা মাসছয়েক কাজ নিয়ে শিলিগুড়িতে চলে গেছে। ওর ঘর খালি। নারিয়াকে বলেছিলাম মনাস্ট্রি ছেড়ে দুজনে মিলে এখানে এসে থাকতে। ও হেসেছিল, পরে আর কিছু জানায়নি।
কম্বল জড়ানো সিজো লেপচা কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, নারিয়াকে বরং একদিন আমার সঙ্গে দেখা করাও। আমিই ওকে যা বলার বলি। ও যদি চাষ করতে চায় খানিকটা জমিও না হয় দেওয়া যাবে।
পরপর বেশ শীত গেল কয়েকটা দিন। রাতে ঠান্ডা, বারমিকের দিনগুলোও কনকনে। ভোরবেলা থেকে একটানা হাওয়া প্রায় সন্ধে পর্যন্ত। সন্ধে থেকে চারপাশ পরিষ্কার, তখন বাইরে এলে আকাশ দেখা যায়। শীতের সময় দিনের বেলাতেও আকাশ ঝকঝকে। প্রায় সারাদিন ধরে দূরে দেখা যায় বরফ-পাহাড়ের সারি। শীত কম হলে একদিন ডাকা হলো নারিয়াকে। সেদিন সকাল থেকেই হাওয়া।
শীত আর শীতের শেষে পাহাড় ঢেকে থাকে বুনো ফুলে। বাতাসে পাইনের শুকনো পাতা ছড়ায়। রডোডেনড্রনে কুঁড়ি আসতে থাকে। ঝরনার শব্দটা দিনেরাতে একই রকম শোনায়। নারিয়া এলো একা। কাঁধ থেকে খুলে ম্যান্ডোলিনটা কোলের ওপর নিয়ে বসল। বলল, জমি নিয়ে আমি কী করব!
কেন, চাষ করবে, ঘর তুলবে। সংসার।
নারিয়া হাসে। এদিকে অনেক দিন হলো। এবার চলে যাব অন্য কোথাও।
কেন যাবে! বারমিকের মতো ভালো জায়গা পৃথিবীতে আর নেই। জমি নাও। চাইলে তিনটে গরুও দিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।
উত্তরে ম্যান্ডোলিনটা কয়েকবার আঙুল টেনে বাজাল নারিয়া। ওর সেই চেনা হাসিটা ঠোঁটে। পুরনো একটা পাহাড়ি গান ধরল নিচু গলায়, যে-গানে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিক থেকে মানুষের পৃথিবীতে নেমে আসার কথা। মানুষের সঙ্গে এসেছিল পাখি আর বুনো শিয়াল। আর এসেছিল মস্ত এক সাপ। পাহাড় ছাড়িয়ে বেশিদূর যাওয়ায় তখন মানা ছিল মানুষের। প্রথম দিকের সেই মানুষেরা বনে ঘুরত আর পুজো করত পাহাড়ের। আর ওই কাঞ্চনজঙ্ঘার।
নারিয়া গান গাইলেই সকলে চুপ। কথা ভুলে যায় সবাই। কত দিনের পুরনো সব কথা আছে নারিয়ার গানে। পাহাড়ের হারিয়ে যাওয়া দিনের নানা রকম কাহিনি। কোথা থেকে ও এসব গান শিখতে পেরেছে কে জানে!
তবু বুড়ো সিজো লেপচা গানের শেষে চোখের পাশটা একটু মুছে নিয়ে বলে, তোমরা ঘর করে বারমিকে থাকলে খুশি হতো এদিকের সবাই। কোথাও না কোথাও তো থাকতে হবে তোমাদের।
নারিয়া বলল, আমাদের বলে তো কিছু নেই। আমি একলা মানুষ। একা মানুষের ভাবনা কী অতো!
পাশ থেকে জুলে শেরপা বলল, কিন্তু যে এসে মনাস্ট্রিতে রয়েছে? নরবুর মেয়ে রাম্মিত আর সব বাচ্চার সঙ্গে যার ভাব!