আমাদের পাড়ার বিশিষ্ট সজ্জন পশুপতিবাবু শেষমেশ একঘরে হয়ে গেলেন। খবরটা বেদনার নিঃসন্দেহে, কিন্তু উপশমের পথও যে অজানা। কথায় বলে, দুঃখ ভাগ ক’রে নিলে কমে, অগত্যা
আপনাদের শরণাপন্ন হওয়া…
ব্যাপারটা খুলেই বলি তাহলে…
পশুপতিবাবু আমাদের এলাকার পশুক্লেশ নিবারণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ও একমাত্র সদস্য।
কেন? একমাত্র কেন?
সুধী পাঠক, এমন ভাবছেন কি, যে আমরা সবাই পশুদের ক্লেশ দেওয়া খুব পছন্দ করি? আজ্ঞে না, কখনোই নয়। নিরীহ গরুদের সাথে পিচকিরি নিয়ে দোল খেলা, কুকুরদের লেজ ধ’রে টানা,
অকারণে ঢিলোনো, বিড়ালদের মাথায় ঠোঙা পরানো – এই সমস্ত নৃশংসতার বিরোধী আমরা সবাই। তাই ব’লে পাঁঠার ক্লেশ নিবারণের জন্য রোব্বারের দুপুরে মাংস বাদ? আর যখন ‘নিশীথে নির্ভীক হ’য়ে নিরীহ গর্দভ সুর ভাঁজে?’ চাঁদনি রাতে দুঃশীল নেড়ি কুকুরেরা পরিবর্তন চেয়ে তারস্বরে মিটিং করে? তাদের থামানো তথা নিজেদের ক্লেশ নিবারণের জন্য দু-একটা ঢিল ছোঁড়া যাবে না?
‘না যাবে না। পৃথিবীটা শুধু মানুষের তানবিস্তারের বা চ্যাঁচানির জায়গা নয়।’
‘ও বাবা, তাহলে তো…’
সমিতি প্রতিষ্ঠার দিন সদস্যপদ গ্রহণের জন্য পশুপতিবাবু পাড়ার সবাইকেই আন্তরিক আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সত্যি বলতে কি, শিঙাড়া-জিলিপির লোভে আমিও হাজির ছিলাম।
‘আপনারা যাঁরা সমিতির তথা এই সভার সভ্য হতে চান, তাঁরা সকলেই সভ্য মানুষ, এই আমার বিশ্বাস। চাষ-জমির হাড় জিরজিরে বলদগুলির কথা ভেবে কি আমাদের করুণা হয়না? করুণা হয়না গৃহপালিত অবোধ পাঁঠাগুলিকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিতে? আসুন আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, আজ থেকে বিরিয়ানি বন্ধ, পোলাও বন্ধ…”
”সে কী? তাহলে ভাত রুটি সবই বন্ধ। খাব কী?”…
প্রতিষ্ঠাতার সিংহ-গর্জনে আমাদের সম্মিলিত চিঁচিঁ চাপা পড়ে যায়।
”সভায় যাঁরা ইস্কুল-কলেজের মাস্টারমশাই-দিদিমণিরা আছেন, (আমার দিকে কটাক্ষ করেন ভদ্রলোক) তাঁরা জেনে রাখুন, কোনো ছাত্র-ছাত্রীকে আপনারা গরু-গাধা-ছাগল-বানর ইত্যাদি নামে ডাকছেন ব’লে যদি কোনো খবর আসে, আপনাদের ঘেরাও করতে আমার অহিংস পশুবাহিনী পেছপা হবে না…’
এই প্রসঙ্গে ব’লে রাখা ভাল, স্ত্রী (আমাদের দোলা বৌদি) এবং পুত্র (নাম ভুটু, স্বভাব হাড়বজ্জাত) ছাড়াও ভদ্রলোকের বাড়িতে অগুনতি কুকুর-বিড়াল-খরগোশ-গিনিপিগ-ছাগল-ষাঁড়-ইঁদুর-আরশোলা-মশা প্রমুখেরা আছেন, বহু বচ্ছর যাঁদের সুমারি বা রেশন কার্ড কিছুই হয়নি।
”আর ইয়ু মিস্টার বসাক, আপনি সেদিন ফোনে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাকে কুত্তা, শুয়োরের বাচ্চা ব’লে সম্বোধন করছিলেন? কোনো কুকুর বা শূকরশিশুকে নয় নিশ্চয়ই। প্রথমত তাদের ফোন নেই, থাকা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, ওই দুটি প্রাণী তো এক শরীরে অবস্থান করতে পারেনা।”
বসাক-কাকু খেপে ওঠেন।
”তা নেড়ি কুত্তাদের নেড়ি কুত্তা বলব না তো কী বলব মশাই”?
”দেশী-কোত্তম বলবেন”…
”হুঁ তাই বলব, গলায় উত্তরীয় আর ল্যাজে মিষ্টির প্যাকেটও বেঁধে দেব…”
”কেন? ল্যাজে কেন? আপনি টিফিন কৌটো ল্যাজে বেঁধে নিয়ে যেতে পারেন। যদিও সেটা ভব্যতা নয়, তবু মানায় আপনাকে। কিন্তু কুকুরদের দিলে প্লেটে সাজিয়ে খেতে দেবেন…”
হাতাহাতি লেগেই যাচ্ছিল প্রায়, মধ্যস্থতা করতে হল কাউন্সিলর দেবাশিসদাকে।
”সেসব তো বুঝলাম পশুপতিদা, কিন্তু আপনি যে কসাইদের শাসিয়ে এসেছেন, মাংস না কাটলে, না বেচলে তারা খায় কী বলুন দেখি? ওইটেই তো পেশা ওদের। নেতাই ময়রাও সকালে এসে কান্নাকাটি করে গেল, আপনি ওকে ছানা কিনতে দিচ্ছেন না, শুধু জিলিপি ভাজার হুকুম দিয়ে এসেছেন। গোয়ালারা রাগারাগি করছে, আপনি তাদের দুধ দুইতে দিচ্ছেন না। এমন করলে তো চলবে না…”
”চলবে না মানে? আলবাত চলবে। ইতর মনুষ্য ছাড়া আর কোন প্রাণী সন্দেশ-রসগোল্লা খায়? বাছুরের প্রাপ্য দুধে কেন তোমার খোকা ভাগ বসাবে? ভোটে জিতেছ ব’লে সাপের, স্যরি, আই মিন, মানুষের পাঁচ পা দেখেছ নাকি?”
দেবাশিসদা প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, এমন সময় শ্রীমান ভুটুর প্রবেশ, হাতে পেল্লায় সাইজের গুলতি। হাফপ্যান্টের পকেট ফুলে ঢোল, বোঝাই যাচ্ছে সেখানে প্রচুর কার্তুজ জমা আছে।
”বাবা, মা জানতে চাইছে মৌমাছি পশু না পাখি…”
”মানে?”
”মানে, আমগাছের ওই বড় মৌচাকটা ভাঙার জন্য লোক ডেকেছিল মা, কিন্তু তোমার হুকুম ছাড়া ওরা ভাঙতে ভয় পেল, কিছুতেই রাজি হলনা… আমি বলছিলাম যে মৌমাছির ডানা আছে, তাহলে পাখি। কিন্তু পাখি তো কামড়ায় না…সেইজন্য…”
”অ…তোর মা কোথায়?”
”আমি আর মা তো মামাবাড়ি যাচ্ছি। মা বলল, মৌমাছি যদি পশু হয়, তাহলে মামাবাড়ি যাবার আগে মৌচাকে গুলতি ছুঁড়তে…”
ভুটুর অব্যর্থ টিপের কথা পাড়ায় অবিদিত নয়। সভার ভিড় অত্যন্ত দ্রুত পাতলা হতে শুরু করেছিল।
মানুষ যূথচারী জীব। একঘরে হয়ে বাঁচা তার পক্ষে অসম্ভব। আর মৌমাছিদের সঙ্গে একঘরে হয়ে বাঁচা?
আরো অসম্ভব…
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।