পর্ণমোচী— ঝর্না চট্টোপাধ্যায়

দোকানে কাউন্টারের উপরে নানান রঙের উলের গোলা। তার উপরে ঝুঁকে পড়ে রঙ বাছছিল তৃণা। হাতে বোনা সোয়েটার কেউ আর পরে না এখন। সে সব আগে পরত। শীত এলেই মা-কাকির দল উলের গোলা নিয়ে দুপুরে খাবার পরে রোদে বসে উল ছাড়ানো, কিংবা সন্ধ্যেয় রেডিওতে খবর শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে সোফায় বসে উলবোনার একটা রেওয়াজই ছিল বলা যায়। আজকাল নানা ধরণের সোয়েটার, জ্যাকেট বেরিয়েছে । ছেলেমেয়েরা সেসবই পছন্দ করে। তৃণা পুরনো দিনের এতসব গল্প জানে না, মায়ের কাছে শুনেছে । তবে এখন সত্যিই কার্ডিগান পরতে দেখে না খুব একটা। শুধু মা’কে কোন শীতের জায়গায় বেড়াতে গেলে তৃনা দেখেছে, শাড়ির উপর কার্ডিগান পরে তার ওপরে শাল জড়িয়ে নিতে।
কিন্তু স্কুলে সেলাই ক্লাসে এখনও শেখানো হয় কার্ডিগান বোনা। স্কুলে একটা রঙেরই বোনার নির্দেশ থাকে, সেটা হল নেভি ব্লু, আর ওটাই এখানে তৃণাদের স্কুলের ইউনিফর্ম। কিন্তু বছরের পর বছর একই রং…কাঁহাতক আর ভালো লাগে! প্রিন্সিপ্যাল মিস্‌, সেলাই মিস্‌, স্কুলবোর্ড মেম্বারদের কাছে অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর কয়েকবছর হল যে কোন রঙের কার্ডিগান বোনার অনুমতি মিলেছে। কিন্তু কড়া নির্দেশ, স্কুলে নেভি ব্লু ছাড়া অন্য কোন রঙ নয়। তা স্কুলের মেয়েরা সেটা মেনে নিয়েছে। স্কুলের ডিসিপ্লিন তারাও নষ্ট করতে চায় না। সে কারণেই আজ মায়ের সঙ্গে মার্কেটে আসা, তৃনা নিজের হাতে উলের রঙ বেছে নিতে চায়।
মাও এসেছেন। এই ছোট্ট শহরে কতটুকুই বা মার্কেট। এক ছাতের তলায় খান পঁচিশেক ঘর নিয়ে মার্কেটপ্লেস। চারটে শাড়ির দোকান, দুটো বাসনের দোকান, গোটা পাঁচেক ওষুধের..এমনি সব। নিচের তলাটা মার্কেট। দোতলায় বড় বড় ফ্ল্যাট। একটা বেশ ভালো হোটেল আছে তিনতলায়। কোম্পানীর লোকজন সব আসেন, নানান মিটিং-এ, তাঁরা সব থাকেন। কিছু অফিসার এখানে ফ্ল্যাটভাড়া নিয়েও থাকেন। তৃণারা থাকে অফিসের কোয়ার্টারে। কোম্পানীর অনেক কোয়ার্টার আছে, যার যেমন চাকরি, তার তেমন কোয়ার্টার। তৃণাদের কোয়ার্টার বেশ বড়, বাংলো টাইপের। তার বাবা এখানকার অফিসের দু-নং অফিসার। এক শর্মা আঙ্কল বাদ দিলে এখানকার বাকি সবাই বাবার অধস্তন কর্মচারী। শর্মা আঙ্কলরা থাকেন প্রথম বাংলোয়, পরেরটাই তৃনাদের।
পর্ণা ওদিকে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল আরো কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে। পর্না, তৃণার দিদি, এখন কলেজে পড়ে। তৃণার এবার ক্লাস নাইন। মেয়েগুলোর সঙ্গে দুটো ছেলেও আছে, একটু তফাতে দাঁড়িয়ে। দিদির ছেলে বন্ধুও আছে নাকি, কই বলেনি তো…অবাক হল তৃণা। সেদিকে একবার তাকিয়ে উলের রঙ বাছায় মন দিল তৃণা। দোকানের দরজার বাইরে মা মানে মিসেস বসু কথা বলছেন শেলী আন্টির সঙ্গে। এখানে বাবার কর্মসূত্রে ওইভাবেই সবাইকে ডাকতে হয়। কেন, শেলী কাকিমা, পলাশ কাকা …এমন করে বললে কি হয়! শেলী আন্টির ছেলেমেয়ে– নিনি, তাপুরাও ওর মা-বাবাকে বলে বোস আঙ্কল, গীতু আন্টি। এখানে ওইরকমই। একবার শেলী আন্টির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি কমলা রঙের গোলাটা পছন্দ হল তার । কমলার উপরে একটা হালকা সবুজের আভা, যেন নতুন পাতার মতো কচি সোনালী রঙ। ভারী ভাল লাগল তৃণার। উলের গোলাটা হাতে তুলে ডাকল তৃণা—মা, এটা নিই?
গীতিকা, মানে মিসেস বসু শেলী আন্টিকে কিছু একটা বলে দোকানের ভিতরে এলেন। বললেন—ক’টা লাগবে, মিস্‌ কি বলেছেন?
মা’কে দেখছিল তৃনা। মুখটা কেমন লাল হয়ে উঠেছে। দিদি কোথায় গেল! মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল তৃণা, —মা জল খাবে?
গীতিকা মাথা নাড়লেন। —কই হল তোর উল কেনা! কখন বেরিয়েছি…তাড়াতাড়ি কর, বাবা এসে বসে থাকবেন অফিস থেকে…অনুযোগের স্বরে বললেন মা।–দিদি কোথায় গেল, ডাকো তাকে—আবার বললেন।
—দিদি, এই দিদি…পর্নার দিকে হাত নেড়ে ডাক দিল তৃনা।
বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে ধীর পায়ে দোকানে হেঁটে এল পর্ণা। –কোনটা নিলি? চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করল পর্ণা। হাতের উলটা তুলে দেখায় তৃণা।
–বাঃ, কি সুন্দর রংটা! মা, আমাকেও একটা এইরকম করে দেবে, এই রঙই কিন্তু…! মায়ের কাঁধের উপর মুখ রেখে আবদার করল পর্ণা, কিন্তু নিচু গলায়।
–নিজেই কোরো, স্কুলে তো তুমিও শিখেছ…’ বললেন গীতিকা।
–সে তো নেভি ব্লু,আমাদের তো অন্য রঙ ছিল না, দিও না মা…প্লিজ…
–আচ্ছা আচ্ছা… সে দেখা যাবে, এখন চল তো, কখন বেরিয়েছি। বাবা এসে বসে থাকবেন…’।
তিনজনে কেনাকাটা সেরে দোকানের বাইরে পা রাখলো।

(২)
হেঁটে হেঁটেই বাড়ি ফিরছিল ওরা তিনজনে। অল্প একটু পথ, বিকেলবেলায় বাজার থেকে ফিরতি পথে বেশির ভাগ সকলেই হেঁটে বাড়ি ফেরে,একটু বেড়ানোও হয়। বিশেষ কোথাও তো যাবার জায়গা নেই! আসা-যাওয়ার পথে দু-চারজন লোকের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, কেউ কেউ মিসেস বসুকে দেখে মাথা নাড়ছেন, নোয়াচ্ছেন। মা’ও কাউকে দেখে অল্প একটু হাসি কিংবা মাথা নাড়াছেন। পিছনের সারির কোয়ার্টারে থাকেন কুমার আঙ্কল, তাঁর মা’কে দেখে দু/একটা কথাও বললেন মা। দাদীজি পর্ণার পিঠে হাত দিয়ে কিছু বললেন, তৃণা দেখল, কিন্তু বুঝতে পারল না। তৃনা কি একটা বলতে বলতে আসছিল। মা নিজের মনে হেঁটে যাচ্ছেন, পর্ণাও চুপ। একবার নিচু গলায় মা’কে বললে পর্ণা—বোনকে চুপ করতে বল না, মা…কি রকম বকবক করে, দ্যাখো…’। ছোট মেয়ের দিকে মুখ তুলে দেখলেন গীতিকা, মিসেস বসু, কিন্তু কিছু বললেন না। উলটে পর্ণাকেই বললেন,
—তুমিই বা এত চুপচাপ কেন? একটু বোনের সঙ্গেও তো কথা বলতে পারো, ও বাচ্চা মেয়ে, সব সময় চুপ করে থাকতে পারে…?’
পর্না যেন জানত, মা ঠিক বোনের পক্ষ নেবেন। কিন্তু বড় বড় চোখে মায়ের দিকে তাকালেও মুখে কিছু বলল না। তিনজনে প্রায় বাড়ির গেটের কাছাকাছি এসে পড়েছেন, একটা স্কুটার এসে একেবারে আড়াআড়ি ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। এ কি অসভ্যতা! মিসেস বসু কিছু বলতে যাবেন, কিন্তু কিছু বলার আগেই একজন সুন্দর ভদ্র চেহারার প্রৌঢ মানুষ স্কুটার থেকে নেমে হাসি হাসি মুখে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছেন গীতিকা, চেনা লাগছে…কিন্তু, চিনতে পারছেন না, চিনতে চাইছেনও না, যেন মনে করতেও পারছেন না। ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন আরো একটু, তারপর গীতিকার দিকে তাকিয়ে বললেন–গীতু না? আমি অনিমেষ….গিরিডি, সেই যে…আমি সন্তু…’।
আর না বলা যায় না, একটু চোখ উজ্জ্বল করতেই হল গীতিকাকে। বাবা, চিনতেই পারা যাচ্ছে না …এতদিন পর চেনা যায় নাকি সহজে! কিন্তু…এখানে কেন, এতদিন পর! একটু যেন অস্বস্তিতে গীতিকা, মিসেস বসু।
মেয়েদের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করলেন ভদ্রলোক–মেয়ে!
মাথা নাড়লেন গীতিকা। তৃণা ছটপট করে উঠল। সে যেন জানে এর পরের ব্যাপার। ভদ্রলোক এরপর পর্নার দিকে তাকিয়ে বলে উঠবেন—ইশ, কি সুন্দর…একেবারে মায়ের মতো দেখতে হয়েছ!
বাস্তবিক, পর্না মায়ের মতই দেখতে। মায়ের মতো নরম, সুন্দর চেহারা, মায়ের মতো শান্ত, কম কথা বলে…কথা বলার সময় বড় বড় চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে…। তৃণা একেবারে অন্যরকম। লম্বা, শ্যামলা, ছটপটে…সে বাবার মতন, পাপা কা লাডলি বিটিয়া…। যাঃ, বাবা কি তার মত দুষ্টু নাকি! তবে, বাবা যখন এক একদিন মায়ের সঙ্গে খুনসুটি করেন, তখন কিন্তু একটু দুষ্টুই মনে হয়। হি হি…কদিন আগেই তো বাবা মায়ের পিঠে ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। হি হি হি…মা কেমন বাচ্চাদের মতো লাফালাফি করছিলেন…ভাবতেই হাসি পেল তৃণার। মা’কে তখন এত ভাল লাগছিল! কেন যে এত গম্ভীর হয়ে থাকেন মা! তৃনা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
—মা, আমরা ভেতরে যাচ্ছি…’ বলেই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে এগিয়ে যেতেই ভদ্রলোক বললেন, –কই, নাম বললে না তো!
ফস্‌ করে বলে উঠল তৃনা,—জিজ্ঞেস না করলে বলব কেন?
ওহ্‌, সরি! জিজ্ঞেস করিনি না? কি নাম, তোমার …হেসে ফেলে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।
–তৃণা।
পর্নার দিকে তাকালেন। পর্ণা মায়ের ঠিক পিছনে মায়ের কাঁধের কাছে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকেই বড় বড় চোখ তুলে মৃদু স্বরে বললে–পর্ণা। তার ভাল লাগছিল না ভদ্রলোককে। কেন, সে জানে না…।

(৩)
আজ সকাল থেকেই বেশ একটা শীতের আমেজ। এদিকে শীতকালে একেবারে হু-হু ঠান্ডা। হাত-পা কনকনিয়ে যায়। ঘরে আগুন রেখে অনেকেই ঘর গরম করে রাখেন। গরমকালটা আবার একেবারেই অন্যরকম। রোদের তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক একেবারে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বেশি গরম পড়লে লু বইতে থাকে। বিকেলের পর থেকে একটু একটু করে আবার সব ঠান্ডা হয়, সন্ধ্যের পর থেকে পরদিন সকাল পর্য্যন্ত আরাম।
আজ ছুটির দিন, রবিবার। এখন বেলা প্রায় দশটা। শীত পড়লে ছুটির দিনে খানিক বেলা হলেই ছেলেমেয়েরা সব বাড়ির বাইরে খেলার মাঠে বেরিয়ে পড়ে। এখানে দুটো ব্যাডমিন্টনের কোর্ট আছে, ক্রিকেট খেলার জায়গাও আছে। ফুটবল খেলার ঠিক মাঠ নেই, কিন্তু ছেলেরা সেটাও কোনরকমে করে নিয়েছে, সেখানেই বিকেলে, ছুটির দিনের সকাল-বিকেল ফুটবল খেলা চলে। এই তিন জায়গাতেই ভাগাভাগি করে কোয়ার্টারের ছেলেমেয়েরা খেলা করে। আজকেও নানা রঙের জামাকাপড়ে রঙ্গিন হয়ে ছেলেমেয়েরা মাঠে খেলা করছিল।
ব্যাডমিন্টনের কোর্টে তৃণা, শেলী আন্টির মেয়ে নিনি আর বি-কোয়ার্টারের কান্তা একসঙ্গে খেলা প্র্যাক্টিশ করছিল। ওদের সামনে দিয়ে বাইক চড়ে হাজির হল মন্নু, কুমার আঙ্কলের ছেলে। ভাল নাম মনোজ কুমার, বাড়িতে সকলে ডাকে মন্নু বলে। মন্নুও দিদি মানে পর্ণাদের কলেজেই পড়ে কিন্তু উপরের ক্লাসে। মন্নুর হাতে একটা বড় বল, সেটা দেখিয়ে সে ডাক দিল তৃনাকে—আ…তৃণা…’
মন্নুর সঙ্গে মাঝে মাঝে ফুটবল খেলে তৃনা। এখানে মেয়েরা ফুটবল কেউ খেলে না। কিন্তু তৃনার খুব ফুটবল খেলার ইচ্ছে। তাই মন্নু ভাইয়াকেই তার ইন্সট্রাকটর মেনে নিয়েছে। মাঝে মাঝে মন্নুর সঙ্গে বল খেলার মাঠে পায়ে বল নিয়ে ছোঁড়া ছুঁড়ি করে তৃণা।
মাথা নেড়ে মুখ কাঁচুমাঁচু করে বলল তৃণা… আভি নহী। মা এক্ষুণি ডাকবেন, বাড়িতে কে আসবেন, যেতে হবে।
মন্নু ভুরু কুঁচকে বলে উঠল—আরে, আভি তো খেল্‌…তব যা না…
না, ওইরকম পায়ে বল নিয়ে লাগাতে না লাগাতেই চলে যেতে হবে, তৃণার একেবারেই পছন্দ নয়। তার চেয়ে বিকেলে…ভেবে নিয়ে উত্তর দিল—ভাইয়া, সামকো…ঠিক হ্যায়?
মন্নু একেবারে ফুটবল কোচের মত মুখ গম্ভীর করে বলল— তুঝসে নেহি হোগা…চল্‌ যা…’বাইক ঘুরিয়ে নিল মন্নু।
ঠিক তখনই কোয়ার্টারের দিক থেকে আওয়াজ এল…তুনতুন……। বাবা ডাকছেন। বাবা এই নামেই আদর করে তৃনাকে ডাকেন। তৃনা মন্নুর দিকে হাতের বুড়ো আঙ্গুল তুলে বললে—সামকো, পক্কা…ভাইয়া!
বাড়ির দিকে দৌড় লাগাল তৃণা।

(৪)
বাড়িতে বসার ঘরে পা দিয়েই দ্যাখে, সেদিনের সেই ভদ্রলোক অনিমেষ বাবু, বসে আছেন। দেখা হওয়ার পর থেকে কয়েকদিনই এবাড়িতে দেখেছে তাঁকে। কি ব্যাপার, তৃনা ঠিক বুঝতে পারে না। কিন্তু বাড়িতে যে কিছু একটা হয়েছে সেটা বুঝতে পারে। সবাই কেমন যেন চুপুচাপ। মা আরো গম্ভীর। দিদি এমনিতেই কথা কম বলে, এখন বলেই না। পর্ণা, যাকে বাবা আদর করে ডাকেন পর্ণমোচী বলে, বাবার খুব কাছে ঘেঁষে না। জরুরী যা কথাবার্তা সব মায়ের সঙ্গেই হয় পর্নার। তৃণার মত পর্ণার অত বাবার সঙ্গে ভাব নেই। খুব কাজের কথা, যা বাবা নাহলে চলবে না, সেইরকম কিছু হলেই সে বাবার কাছে যায়। বাবা দিদিকে পর্ণমোচী বলে ডাকেন কেন? একদিন মা’কে জিজ্ঞেস করেছিল তৃণা। মা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন—মানে আবার কি! তোকেও তো তুনতুন বলেন, কিছু মানে ভেবে কি…!
—ওই কথাটার মানে কি মা? কেমন শক্ত কথা…
–মানে যে পাতারা ঝরে যায়।
ঝরে যাওয়া মানে কি, মরে যাওয়া! দিদিকে বাবা এমন নামে ডাকেন কেন?
মা দিদিকে এত ভালবাসেন, এবং তৃনার ধারনা মা দিদিকে তার চেয়েও বেশি ভালবাসেন, সেই মা এমন একটা বিচ্ছিরি নাম মেনে নিলেন? বাবা তো দিদিকে পুনপুন নামেও ডাকতে পারতেন, তুনতুনের সঙ্গে মিলিয়ে!
–মা, তুমি দিদির নাম…শেষ করার আগেই বিরক্ত হলেন গীতিকা।
—মেয়েরা তো তাইই— অন্য বাড়িতে যেতে হয় তো…তুমি এত কথা বল, এবার চুপ কর তো……কথাটা শেষ হয়নি সেদিন। আজকে ভদ্রলোককে বসে থাকতে দেখে কেন জানে না, মনে হল মায়ের কথা। কেন এসেছেন, ইনি? দিদিকে অন্য বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য? নাকি অন্য কিছু? মা, বাবা এত চুপচাপ! তৃনা ঠিক বুঝতে পারে না। তাকে কেউ কিছু বলে না কেন? কি হয়েছে দিদির?
ঘরে ঢুকতেই বাবা তৃনাকে জড়িয়ে ধরে বসালেন নিজের পাশে। তৃনা দেখল ভদ্রলোক বসে আছেন বড় সোফার এক ধারে। মা একটু পাশে একটা ছোট মোড়ায় বসে আছেন, হাতে সেই একই কমলা-সোনালী রঙের উল, দিদির জন্য সোয়েটারটা শুরু করেছেন মা। ক’দিন আগে নিজেই বাজার থেকে নিয়ে এসেছেন। তৃনারা তখন বাড়িতে ছিল না, স্কুলে-কলেজে গিয়েছিল। না, তৃনার জন্য তিনি করে দেবেন না, স্কুলের কাজ তৃনাকে নিজেই শিখতে হবে, করতে হবে। মা এইসব ব্যাপারে খুব কড়া। দিদির স্কুলের সেলাইও মা করে দেননি। এটা স্কুলের হলে মা করে দিতেন না।
বাবা সকলকে অবাক করে ডাকলেন—পর্ণমোচী…
আরো যেন কিছু অবাক হওয়ার মত ছিল। পর্না ছুটে এসে বাবার কোলে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করল——আমায় কোথাও যেতে দিও না বাবা, আমি তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারব না বাবা…গেলে আমি মরে যাব, বাবা…আমি যাব না ওনার সঙ্গে…আমি কেন যাব, বাবা…আমি তো এখানেই থেকেছি বাবা…তুমি আমায় ছেড়ে দিও না …আমি যাব না…বাবা.. আমি ওনাকে চিনি না, জানি না…কোনদিন দেখিনি…সেই লোক কি করে………বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদতে লাগল পর্না। যে দিদির গলা কোনদিন শোনা যায় না, কান্নার সঙ্গে কত কি–ই যে বলে যেতে লাগল…!
তৃণা কিছুই বুঝল না, কিন্তু কি যেন একটা না-বলা কথা ঘুরপাক খেতে লাগল ঘরের মধ্যে।
তৃনা একবার এর দিকে, একবার ওর দিকে তাকায়, মাথায় ঢোকে না। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল উলের গোলাটা মা শক্ত করে ধরে আছেন, তার উপরে টপটপ করে চোখের জল পড়ছে। কান্না পেয়ে গেল তৃণারও। বাবা জোর করে পর্ণাকে তুলে ধরে আর এক পাশে বসালেন। তারপর দুহাতে দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সেই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললেন——অনিমেষ বাবু, আমি খুব সাধারণ মানুষ। আমার অনেক কিছুই খুব সাধারণ। আমি দুহাত দিয়েই সব কিছু সামলাতে পারি, এতদিন ধরে তাইই সামলেছি। একহাতে সামলানোর মতো ক্ষমতা আমার নেই। এতদিন পর এখন এসে একটা হাত কেটে নিয়ে যেতে চাইলে কি করে পারি বলুন? প্রথম থেকে সে অভ্যাস থাকলে অন্য কথা ছিল…অত কষ্ট করার ক্ষমতা আমার নেই। আপনি আমায় ক্ষমা করুন…।‘
তারপর দিদির দিকে তাকিয়ে বললেন—আমি ওর নাম রেখেছিলাম পর্ণমোচী। পাতা ঝরে গিয়ে আবার নতুন পাতা জন্ম নিল আজ। ওর নাম দিলাম……’ বাবার কথা শেষ হবার আগেই তৃনা বলে উঠল,
—বাবা, দিদির নাম পুনপুন, আমি তুনতুন।
বাবা আবার অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বললেন—দেখলেন তো, ওরা নিজেরাই ঠিক করে নিল, আমি-আপনি আর কি করতে পারি, বলুন? আপনি গীতুর সঙ্গে কথা বলুন, আমরা বাইরে যাই…’ দুদিকে দুই মেয়ের কাঁধে হাত দিয়ে উঠে পড়লেন বাবা। বাইরে বেরোবার আগে একবার মায়ের কাঁধে হাত রাখলেন তারপর মেয়েদের সঙ্গে বাইরে এলেন।
কি যেন এক রহস্য! কে ইনি, দিদি জানে? দিদিকে একথা জিজ্ঞেস করতে হবে। বাবা যেন বুঝতে পেরে তুনতুনকে বললেন—তুমি এখনও ছোট মা, আরো একটু বড় হও। বলেই হেসে বললেন–ছোট না হলে যে ফুটবল খেলা শেখা যাবেনা লুকিয়ে লুকিয়ে… পুনপুন বড় হয়েছে বলে লুকিয়ে শেখে না…জিজ্ঞেস কর পুনপুনকে।’ বাবা দিদিকে সেই প্রথম পুনপুন বলে ডাকলেন। বাবাকে জড়িয়ে ধরল দিদি।
ভাল লাগছিল তৃণার। দিদি কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে…একেবারে নতুন, খুব ভাল লাগছিল তৃনার, না তুনতুনের…!

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!