পরী বন্ধু — মিশকাতুল জান্নাত মিশু

আমার একটা বন্ধু আছে। পরী বন্ধু। হ্যা, পরী-ই তো! এক্কেবারে পরীর দেশের পরী। অবাক হলে তো! না না, অবাক হওয়ার কিচ্ছু নেই। শুনবেতো আগে, কীভাবে বন্ধুত্ব হলো ওর সাথে? আহ্হা, শুনইনা।
ঠিক আছে বলছি শোন- আমি খুব ছোটবেলা থেকে লেখালেখি করতাম, একটু একটু। লেখালেখি বুঝতো? ঐ যে গল্প-ছড়া-কবিতা ছাপা হয় পত্রিকায়, বড় বড় মানুষের। আমি কিন্তু অত বড় নই, এক্কেবারে ছোট, তাই কখনো আমার লেখা ছাপার অক্ষরে দেখা হয়নি। ছাপবেই বা কীভাবে? আমি তো লেখা পাঠা-ই-ই নি! আমি কিন্তু গল্প লিখতে জানিনা, কখনো লিখিনি। শুধু ছড়া লিখেছি। মজার মজার ছড়া। ফুলের ছড়া, পাখির ছড়া, আরো অনেক কিছুর। ছাপার অক্ষরে না দেখলেও অনেক প্রশংসা ও শুভেচ্ছা পেয়েছি আমার পরিবার, টিচার ও বন্ধুদের কাছ থেকে। কত যে উপহার পেয়েছি তার কোন হিসেব নিই!
ওহ! দেখ, সেই কতক্ষণ থেকে বকবক করেই চলছি, আসল কথাটা-ই বলা হয়নি। আচ্ছা শুন। স্কুলের সবাই আজ ভীষণ খুশি। কেন জানো? আজ টিচার বলেছেন- স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিনের জন্য সবাইকে কিছু লেখা জমা দিতে। গল্প, ছড়া, কবিতা, যার যা ইচ্ছে তা-ই। সবার চেয়ে আমি-ই বেশি খুশি। কারণ এবার হলেও ছাপার অক্ষরে দেখব আমার নাম। ওহ! কি যে আনন্দ লাগছে আমার।
আর একটা কথা বলছি চুপি চুপি, শুন- আমার এ আনন্দের কারণটা হলো- আমার কোন বন্ধু-ই এ পর্যমত্ম ছড়া-কবিতা লিখেনি আমার মতো। টিচার বলেছে- সুন্দর লেখার জন্য পুরস্কারও দেয়া হবে। আমি নিশ্চিত পুরস্কারটা আমি-ই পাবো।
তো, আমরা সবাই টিচারকে বললাম- একটা বিষয় নির্ধারণ করে দিতে। কারণ যা তা নিয়ে তো সুন্দর লেখা হবে না। সব টিচাররা মিলে মিটিং করে একটা বিষয় নির্ধারণ করলেন- ‘পরী’ হ্যা পরী’কে নিয়েই লিখতে পারো। আমি ভীষণ খুশি, এমন একটা মনের মতো বিষয় পেয়ে। টিচার আমাকে বললেন- ‘তুমি একটা গল্প দিও, কেমন?’ আমিও সায় দিলাম- ‘দোয়া করবেন স্যার।’
বাড়ি এসেই ছুটোছুটি শুরু করলাম, খাতা-কলম নিয়ে। আজই লিখে ফেলব গল্পটা। মা আর সবাইতো অবাক! নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে করছেটা কি ও? মা ও সবাইকে বললাম কথাটা। সবাই দোয়া করে দিল, যেন আমি সুন্দর একটা গল্প লিখতে পারি।
সারাদিন ধরে ভাবলাম- কীভাবে লিখব? ভাবতে ভাবতে দিন পেরিয়ে রাত হলো, তবুও লিখতে পারলামনা কিছু। রাতে মা খেতে ডাকলেন, বিষণ্ণ মনে খেতে বসলাম। মা আমার মনটা ভালো করার জন্য একটা গল্প বললেন। তবুও আমার মন খারাপ। ঘুমাতে আসলাম, চোখ বুজে শুয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছেনা। উঠে বসলাম। পায়চারি করলাম কিছুক্ষণ। তারপর খাতা-কলম নিয়ে বসলাম আবারও। একটা গল্প লিখলাম। দুষ্টু পরীর গল্প। স্বসিত্ম পেলাম একটু। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে আমার। শুয়ে পড়লাম, সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম ভাঙ্গল পাখির মিষ্টি কলতানে। দৌড়ে গিয়ে খাতাটা নিলাম। হায় হায়! কী দেখছি এসব? কত কষ্ট করে কাল লিখলাম গল্পটা। কিন্তু এ কী? খাতায়তো কোন লেখা নেই, সব লেখা-ই মুছে গেছে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে আমার। হঠাৎ খাতার মাঝখানে দেখলাম ছোট্ট একটি লেখা- ‘আমাদের নিয়ে এসব বাজে কথা না লিখলে হয় না? আমরাতো খুব ভালো, তোমাদের বন্ধু।’
খুশির ঝিলিক দিয়ে উঠল আমার চোখে, পরী আমাদের বন্ধু। হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল এই ভেবে- ইস! শুধু শুধুই কষ্ট দিলাম পরীকে, আমার বন্ধুকে। সত্যি বলতে কী, পরী সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারণা ছিলনা, তাই ওইভাবে লিখেছিলাম গল্পটা। আমার গল্পের পরীটা ছিলো খুব দুষ্টু। সব সময় কষ্ট দিতো ছোটদের, ভয় দেখাতো, ক্ষতি করত সবার। কিন্তু আমার পরী বন্ধুটাতো অমন নয়, সে জন্যেই বোধহয় কষ্ট পেয়েছে।
নাহ! আর কষ্ট দিবনা পরীকে, আমার বন্ধুকে। এবার ঠিক ঠিক ভাবতে- ভাবতে আমার কল্পনায় এসে গেল সুন্দর একটা গল্প। লিখে ফেললাম ঝটপট। তখন ছিল জ্যোৎস্না রাত। লিখেই ঘুমিয়ে পড়লাম ফুরফুরে মনে। আচ্ছা, তোমাদের কি ইচ্ছে করছে গল্পটা শুনতে? শোন তবে-
‘‘আমি ঘুমিয়ে ছিলাম জ্যোৎস্নার কোলে। হঠাৎ কে যেন ছুঁয়ে দিলো আল্তো করে। তাকিয়ে দেখি- ওমা, এতো পরী! আমি ভয়ে মরি। পরী হেসে বলে- ‘ভয় নেই, বন্ধু হবো তোমার, আসবে কি আমাদের দলে?’ আমিতো খুশিতে আটখানা। পরী হবে বন্ধু? অমনি বাড়িয়ে দিলাম হাতখানা। তারপর অনেকক্ষণ চলল- ওড়াওড়ি- ঘেুারাঘুরি, লাল-নীল পরীর দেশে। পরীর হাতে হাত রেখে রাঙা প্রজাপতি বেশে। সূর্যটা উঁকি দিচ্ছিল পূবের আকাশে। পরী বলে- ‘বিদায় বন্ধু। দেখা হবে আবার, কোন এক জ্যোৎস্না রাতে।’ ভাবলাম- ইস্! আরও কিছুক্ষণ যদি থাকতে পারতাম পরীর সাথে!’’
খুব সুন্দর তাইনা? গল্পটা লিখে ঘুমিয়ে পড়লাম, খাতাটা খোলা রেখেই। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল নূপুরের শব্দে। ঝট করে খুলে ফেললাম চোখ। হঠাৎ জানালায় টোকা পড়লো। ভয়ে ভয়ে জানালাটা খুললাম, অমনি হুমড়ি খেয়ে ঘরে ঢুকল একটা পরী। পরীতো নয়, যেন চাঁদের আলো! সারা ঘর ভরে গেল জ্যোৎসায়। আমি ভয় পেয়ে গেলাম পরীকে দেখে। পরী মিষ্টি করে হেসে বললো- ‘ভয় পেয়োনা, আমি তো তোমার বন্ধু! যাবে আমার সাথে, পরীর দেশে?’ আমি তো অবাক! এযে আমার গল্পের সেই পরী!
রাজি হয়ে গেলাম সাথে সাথেই পরীর প্রসত্মাবে। এমন সুযোগ কে হেলায় হারায় বলো? হাতটা বাড়িয়ে দিতেই- একটা মেঘের ভেলা চলে এলো সামনে, দু’জন উঠলাম তাতে। পরী বললো- ‘বন্ধু, চোখটা বন্ধ করো।’ পরীর কথায় চোখ বন্ধ করলাম। একটু পর চোখ খুলতেই বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। এ আমি কোথায়? এযে স্বপ্নরাজ্য! চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে লাল-নীল পরীগুলো, রঙিন পাখা মেলে। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি উপহার দিলো এবং আমার গালটা আলতো করে ছুঁয়ে আদর করে দিলো। হঠাৎ খেয়াল করলাম- আমারও পাখা গজাতে শুরু করলো ওদের মতো, আমিও ওদের সাথে ঘুরতে লাগলাম প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে। যতো দেখি ততোই অবাক হই, আমার গল্পের সাথে সব মিলে যাচ্ছে দেখে। পরীর দেশে সব স্বপ্নের দালান ঘর। সবকিছুই যেন স্বপ্নে গড়া! ঘুরতে ঘুরতে ভুলে গেলাম আমার বাড়ির কথা, আমার মায়ের কথা।
পূর্বাকাশ ফর্সা হয়ে উঠল। খেয়াল করলাম- লাল টুকটুকে সূর্যটা পূর্বের আকাশে মিষ্টি হেসে আলো ছড়াচ্ছে আর আমার পাখা গুলো দেখি উধাও হয়ে গেলো। পরী বললো- ‘বন্ধু বিদায়, ভালো থেকো।’ আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছিলো ওদের ছেড়ে আসতে। ভাবলাম- ইস্, আরও কিছুক্ষণ যদি থাকতে পারতাম? কি মজা টা-ই না হতো। পরী আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বললো- ‘ভেবনা বন্ধু! রোজ জ্যোৎস্না রাতে তোমাকে নিয়ে ঘুরব। আমিতো তোমার বন্ধু! এবার চোখটা বন্ধ করো।’ আমিও সাথে সাথে কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো চোখ বন্ধ করলাম।
ঘুম ভাঙল মায়ের ধাক্কাধাক্কিতে- ‘এ্যাই, উঠ্, উঠ্না। দেখ্ এসব কী তোর রুমে?’ আমার চক্ষুতো ছানাবড়া! এ কী! এ যে স্বপ্নপুরী! সেই পরীর দেশের মতো, সারাটা ঘর ভরে আছে ফুলে ফুলে, আর নানা রকম খেলনায় ভরপুর। আমি কি এখনো পরীর দেশেই আছি? না তো, আমি বাড়িতেই, মায়ের কাছে। মা তখনো বলেই যাচ্ছে ওই কথাগুলো। আমি দৌড়ে গিয়ে খাতাটা হাতে নিলাম। দেখি-আমার গল্পের নিচে সুন্দর করে লেখা- ‘‘বন্ধু, তুমি সত্যিই অনেক ভালো। খুব সুন্দর একটা গল্প লিখেছ আমাদের নিয়ে, তাই উপহার গুলো দিলাম। ধন্যবাদ তোমাকে।- তোমার পরী বন্ধু।’’
আমি তো আনন্দে আত্মহারা। মা’কে জড়িয়ে ধরে বললাম- ওমা, দেখনা, এসব আমার পরী বন্ধু-ই দিয়েছে্ মা চোখ কপালে তুলে বললেন- ‘‘পরী বন্ধু?’’ হ্যা মা হ্যা, পরী-ই তো বন্ধু। দৌড়ে গিয়ে মা’কে খাতাটা দেখালাম। মা খুশি হয়ে চুমু এঁকে দিলো আমার কপালে।’’
আনন্দে নাসত্মা সেরে সকাল সকালই রওনা দিলাম স্কুলে। আজ আমি সবার আগে জমা দিব আমার গল্পটা। অনেকটা হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছালাম স্কুলে। টিচারকে দিলাম লেখাটা। টিচারতো দেখে অবাক, কী চমৎকার গল্প লিখতে তুমি! অনেক বাহবা দিলেন আমাকে।
এক সপ্তাহ পর। এক জমকালো অনুষ্ঠানে আমাকে পুরস্কার দিলেন টিচাররা। সারা স্কুলে আমি ফার্স্ট হলাম। সে কী উচ্ছ্বাস সবার। একে একে সব টিচার রা-ই আমাকে উপহার দিলেন এবং দোয়া করে দিলেন। এক পর্যায়ে হেড টিচার জানালেন- আমার গল্পটা উপজেলা পর্যায়ে প্রথম হয়েছে। সাথে সাথে সবাই উল্লাশ করে উঠল।
এক রাশ খুশি নিয়ে ফিরলাম বাড়িতে। পরিবারের সবাই আজ আনন্দিত। সবাই শুভেচ্ছা জানালো আমাকে। এখন আমি প্রতি জ্যোৎস্না রাতে ঘুরতে যাই পরীর দেশে। আমার পরী বন্ধুর সাথে। ধন্যবাদ পরী বন্ধু।
আচ্ছা, তোমরাও কি বন্ধুত্ব করতে চাও পরীর সাথে? শোন তবে, চুপি চুপি বলি- তোমরাও পরীকে নিয়ে আমার মতো মজার মজার গল্প লিখ। দেখবে, পরীও তোমাদের বন্ধু হয়ে গেছে। সত্যি বলছি্ বিশ্বাস হচ্ছেনা তো? লিখেই দেখো…..

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!