ছোট বেলায় আমরা রাতে দাদীর সঙ্গে ঘুমাতাম। আমরা ঘুমাতে দেরী করলে বা ঘুমাতে না চাইলে দাদী আমাদের গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। মাঝে মধ্যে দাদী আমাদের ছড়া কবিতা পাঠ করেও শুনাতেন। না ঘুমিয়ে কি আর থাকা যায়? আমরা গল্প শুনে ঘুমিয়ে পড়তাম। আমরা দাদীর কাছে পরীর গল্প শুনতে চাইতাম। আর দাদী আমাদের পরীর গল্প না শুনিয়ে ভূতের গল্প শুনাতেন।
আমাদের ভয় দেখানোর জন্যই দাদী এই কাজটি করতেন। যাতে করে আমরা দুষ্টুমী না করে সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ি। আমাদের রোজ গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোই ছিল দাদীর প্রতিদিনের রুটিন ওয়ার্ক।
দাদী যেদিন আমাদের ভূতের গল্প শুনাতে চাইতেন সেদিন আমরা আগেই লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। শীতের দিনেতো বটেই। গরমের দিনেও আমরা লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাতাম ভূতের ভয়ে। দাদী আমরা ভূতের গল্প শুনতে চাইনা। আমাদের তুমি পরীর গল্প শুনাও। আজ রাতে নতুন গল্প না শুনালে তোমার সাথে আমাদের আড়ি। তোমার সাথে আমরা কথা বলব না। তোমার সাথে আজ থেকেই আড়ি আড়ি আড়ি। আমাদের পীড়াপীড়িতে অবশেষে দাদী রাজী হলেন। ঠিক আছে। তাহলে শোন। তোমাদের আজ নতুন গল্প শুনাব। নতুন গল্পটির নাম হলো পরী।
দাদী বলল, পরীরা দেখতো খুব সুন্দর হয়। পরীরা নাচতে পারে। দাদীর মুখে পরীর গল্প শোনার পর থেকেই আমার পরী দেখার খুব ইচ্ছে হলো। দাদী আমি পরীর দেশে যেতে চাই। আমাকে তুমি পরীর দেশে নিয়ে চল। দাদী, আমি তোমাকে পান কিনে দিব। তোমাকে পান বানিয়ে খাইয়ে দিব। তোমাকে নতুন চশমা কিনে দিব। সুন্দর একটি লাঠি বানিয়ে দিব। তুমি যদি চাও তবে তোমাকে আরো অনেক অনেক কিছু দিব। তবুও তুমি আমাকে পরীর দেশে নিয়ে চলো।
পরীর দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য দাদীকে প্রায়ই বলতাম। দাদী বলতেন, পরীর দেশে কখনো যেতে নেই। পরীর দেশে মানুষের যেতে মানা। পরীর দেশে মানুষ গেলে আর কখনও ফিরে আসে না। পরীর দেশ কোথায়, দাদু ভাই তুমি কি জানো? আমি মাথা নেড়ে না জবাব দিলাম। পরীর দেশ সেতো অনেক দূরে। পরীর দেশটাতো আর পাশের বাড়ি নয় যে, এক দৌড়ে ইচ্ছে করলেই যাওয়া যাবে। পরীর দেশ অ…..নে……ক দূরে। হাজার হাজার মাইল দূরে। সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে ময়ূরপঙ্খী নায়ে করে যেতে হয় পরীর দেশে। দাদু ভাই, তুমি ময়ুরপঙ্খী নাও কোথায় পাবে? কেন কিনে আনব। এত টাকা তুমি কোথায় পাবে? তোমার বাবাতো একজন দরিদ্র রিক্সা চালক। তার পক্ষেতো এটা সম্ভব নয়।
কিন্তু আমার যে খুব ইচ্ছে পরীর দেশে যাব। এ যে আমার অনেক দিনের স্বপ্ন। একদিনের ঘটনা। আমি জানালার পাশে বসে পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করছিলাম। ক’দিন পরেই বার্ষিক পরীক্ষা। তাই পড়ার চাপটা একটু বেশী। অনেক রাত পর্যন্ত পড়তে হয়। নীরব চারদিক। মানুষের কোন সাড়া শব্দ নেই। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। দু’টি পরী এসে আমাকে বলল- বন্ধু আমরা তোমার স্বপ্নের কথাটি জানতে পেরেছি। আমরা তোমাকে আমাদের দেশে নিয়ে যেতে চাই। তুমি কি যাবে আমাদের সঙ্গে? আমাদের দেশে। আমাদের রাজ্যে।
পরীর দেশে যাওয়ার ছোট বেলার সেই স্বপ্নের কথাটি মনে পড়ে গেল। আজ যে আমার স্বপ্ন পূরনের দিন। আজ যে আমার খুশির দিন। আজ যে আমার আনন্দের দিন। এই সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? আমি রাজি হলাম। আমাকে পরীরা তাদের দেশে নিয়ে গেল। পরীর দেশ সত্যিই খুব সুন্দর। পরীরাও দেখতে খুব সুন্দর।
আমাকে কাছে পেয়ে একটি, দু’টি, তিনটি করে হাজারো পরী এসে জড়ো হলো। পরিণত হলো পরীদের মিলন মেলায়। খুশিতে কেউ বগল বাজাতে লাগল। গায়ক পরীরা গান গাইতে শুরু করল। কেউ কেউ হারমোনিয়াম, তবলা, ঢাক-ঢোল বাজালো। আনন্দে নাচতে লাগল সবাই। আমি মুগ্ধ হয়ে পরীদের নাচ দেখছিলাম।
ততক্ষণে আমি বাড়ির কথা একদম ভুলেই বসে আছি। বাড়ির কথা যখন মনে হলো তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে। এবার ঘরে ফেরার পালা। পরীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো এমন সময় সৎমায়ের ডাক পড়লো।
ভাগ্নি (মেজ দিদির মেয়ে শীলা) কে আমি সৎমা বলে ডাকি। মামা এখন সকাল সাড়ে ৯টা বাজে। ঘুম থেকে উঠুন। টেবিলে নাস্তা দেওয়া হয়েছে। জলদি খেতে আসুন।
পড়ার টেবিলে একটু ঘুম ঘুম লাগছিল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি বুঝতেই পারিনি। সৎমায়ের ডাক শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল।