পরীরাণী– সুমাইয়া বরকতউল্লাহ্

গভীর রাত। জানালার পাশে বসে একটা গল্প লিখছি। পরীর গল্প।
আমি জীবনেও পরী দেখিনি। তাই বসে বসে ভাবছি, কেমন হতে পারে পরী? দু’টো পাখা আছে জানি। উড়োউড়ি করে, তাও জানি। কিন্তু আরও তো অনেক কিছু আছে, যেগুলো আমি জানি না।
এমন সময় টের পেলাম, আমার চারপাশে পনপন, ভনভন শব্দ করে কি যেন উড়োউড়ি করছে।
আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। ওম্মা! দেখি, কী যেন উড়ছে। অবাক হয়ে বললাম, তোমরা কে গো, এখানে উড়োউড়ি করছ যে! কে তোমরা?
ওরা হাসি হাসি মুখে বললো, আমাদের চেনো না বুঝি। আমরা হলাম পরী। এই বলে ওরা ওদের পাখা দিয়ে জোরে বাতাস দিল আমাকে। আহা কী মজার সুগন্ধি বাতাস, পরাণ জুড়িয়ে যায়।
আমি বললাম, আমি তো তোমাদের নিয়েই ভাবছিলাম। তোমরা যে এতো সুন্দর আর রঙীন, তা তো জানতাম না। এতো সুন্দর সুন্দর পরী দেখে সত্যি আমি অবাক হয়ে গেলাম। অবাক হয়ে ওদের দেখতে লাগলাম।
পরীরা আমাকে বললো, তুমি কী করছ সুমাইয়া?
বললাম, গল্প লিখছি।
ওরা বললো, কীসের গল্প লিখছ তুমি?
পরীর গল্প লিখছি।
ওরা খুশিতে টগবগ করতে করতে আমার কাছে এগিয়ে এসে বললো, আমরা জানি তুমি কী করছ, পরীর গল্প লিখছ তুমি। ইশ, কী মজা! আচ্ছা, কেন লিখছ তুমি পরীর গল্প? একটু বলো না শুনি।
বললাম, কেন জানি আমার খুব মন চাইলো, পরীকে নিয়ে একটা গল্প লিখব। তাই লিখতে বসেছি।
ওরা কুটকুট করে হাসে। পরীরা আনন্দে আমাকে আদর করতে লাগলো। আমি তো ওদেরকে কাছে পেয়ে খুব খুশি হয়ে গেলাম। আমার অনেক ভালো লাগছে। আমিও ওদের আদর করতে লাগলাম। কী সুন্দর সুন্দর পাখা! পাখাগুলো নানারঙে আঁকা। প্রজাপতির পাখার মতো। ওরা যখন পাখা ঝাপটায় তখন বাতাসে ভেসে আসে সুগন্ধ। অনেক মজার সেই গন্ধ।
পরীরা বললো, সুমাইয়া তুমি ওই উঠোনটায় চলে এসো। আমরা ওখানে সবাই মিলে আনন্দ করবো আজ। আমি বললাম, আমাকে নিয়ে আনন্দ করবে তোমরা? আচ্ছা চলো।
আমি উঠোনে গিয়ে বসলাম। চাঁদের আলো ঝলমল করছে উঠোনে। এ আলোতে পরীরা যেন আরো সুন্দর হয়ে উঠলো। ওদের গায়ের রং, পাখার রং বারবার বদলে যাচ্ছে। আমি চাঁদের আলোতে হা-করে দেখছি নানা রঙের পরী।
পরীরা বললো, না, না এভাবে না। তুমি ঘর থেকে শীতলপাটি নিয়ে এসো। আমি শীতলপাটি নিয়ে এলাম। ধবধবে শাদা উঠোনে পাটি বিছিয়ে বসলাম। চারিদিকে জোছনা। গাছের পাতাগুলো হালকা বাতাসে মাথা নাড়ছে। দেখে মনে হয়, ওরাও হাত নেড়ে আমাদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।
লাল, নীল, হলুদ, সাদা, বেগুনী আর টিয়া রঙের পরী। পরীরা নাচতে শুরু করলো। নাচের সাথে তালে তালে ঝুমঝুম ঝুমঝুম শব্দ। সেই শব্দের তালে তালে নাচছে পরীরা। নাচতে নাচতে পরীরা যখন আমার কাছে চলে আসে, তখন আমি হাসি মুখে পরীর পাখা ধরি, হাত ধরি, আদর করি। তখন ওরা হেসে আমার হাত থেকে হাতটা টেনে নিয়ে আবার নাচতে শুরু করে।
পরীদের সাথে আমারও ইচ্ছে হলো নাচতে। তখন ওরা-ই এসে আমাকে ধরে টেনে নিয়ে গেলো ওদের সঙ্গে নাচতে। আর আমিও নাচতে শুরু করলাম। চারদিক থেকে ভেসে আসছে ফুলের গন্ধ। মনে হলো, আমিও ওদের সাথে পরী হয়ে গেছি।
নাচানাচি শেষে ওরা আমার কাছে এসে বললো, আমরা কেন এসেছি জানো?
আমি বললাম, নাতো!
ওরা বললো, আমরা তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি পরীরাণীর কাছে।
পরীরাণীর কাছে! পরীরাণী আবার কে? কোথায় থাকে?
পরীরাণী আবার কোথায় থাকবে, পরীর দেশে থাকে। তোমাকে দাওয়াত করেছে আমাদের পরীরাণী।
কী ভাগ্য আমার! কিন্তু আমি যে এর কিছুই বুঝতে পারছি না। এমন সময় একটা লাল পরী আমার সামনে এসে বললো, আমাদের পরীরাণীর নাম কুমকুম। তিনি-ই তোমাকে দাওয়াত করেছেন। আমরা এসেছি তোমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে। চলো, এক্ষণি চলো।
আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললাম, আমার যে মা-বাবা আর ভাইয়া আছে?
পরীটা বললো, তোমার সাথে ওরাও যাবে, চলো চলো।
আমাদের বড়ো উঠোনে ইয়া বড়ো এক পরী এসে বিমানের মতো উপুড় হয়ে বসল। বলল, এই হলো পরীজাহাজ। এ জাহাজে করেই তোমাদের নিয়ে যাবো পরীর দেশে।
মা-বাবা আর ভাইয়া একথা শুনে তো খুশিতে টগবগ করছে। আমরা বসে পড়লাম পরীজাহাজে। জাহাজ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করলো। আমাদের চারপাশে শত-শত পরী। আকাশপথে চলেছে পরীজাহাজ। পরীরা হুনহুনাহুন গুনগুনাগুন করতে করতে শোঁ শোঁ করে উড়ে চলেছে। যেতে যেতে যেতে যেতে এক আজব রাজ্যে গিয়ে নামলো পরীজাহাজ। বললো, এই হলো পরীরাজ্য।
অনেক সুন্দর পরীরাজ্য। আমরা আনন্দে ছটফট করতে লাগলাম। আমরা চারদিকে তাকিয়ে দেখি, সুন্দর আর সুন্দর। পরীর পাখার মতো রঙিন আর নকশা করা গোটা রাজ্য। নিচে মখমল বিছানো। নরম তুলতুলে এক সুন্দর রাজ্য। আমি বললাম, আচ্ছা তোমাদের পরীরাণী কুমকুম থাকেন কোথায়?
পরীরা বললো, ওই যে রঙিন দালান দেখছ, ওটাই হলো রাণীর বাড়ি। চলো যাই।পরীর পেছনে পেছনে হেঁটে চলেছি আমরা সবাই। অনেকগুলো দরজা। সামনে যেতেই একটা টুপি পরা পরী কি সব বলে, আর অমনি পটাপট খুলে যায় দরজা।
রাণীর প্রাসাদে গিয়ে বসলাম আমরা। বসার সঙ্গে সঙ্গেই চলে এলো নানান খাবার। মুখে দিতেই হাওয়ার মতো মিশে যায় খাবার। আমরা খাই আর পরীরা আনে। ফুলের খাবার, ফলের খাবার, বাতাসের খাবার, আরো কতো কী! পেট ভরে খেলাম আমরা।
একটা পরী চোঙ্গার মতো কি একটা মুখে নিয়ে বলছে, আলতা-মালাতান-ফিলাতুন কুমকুমা। মানে হলো, আমাদের মহামান্য রাণী কুমকুমা আসছেন। সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম।
রাণী এলেন। কিন্তু আমরা এই যে পরীরাণীর দিকে তাকিয়ে আছি, আর চোখ ফেরাতে পারছি না। এতো সুন্দর পরীরাণী! এভাবে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর একটা পরী এসে বললো, দয়া করে আপনারা বসুন।
আব্বু বিনয় করে পরীরাণীকে বললেন, আমাদের এতো বড় সৌভাগ্য যে কেন হল, ঠিক বুঝতে পারছি না পরীরাণী। দয়া করে যদি বলতেন।
পরীরাণী কুমকুম বললেন, আমরা হলাম পরী। আমরা দেখতে যেমন সুন্দর, কাজেও তেমন সুন্দর। কিন্তু আফসোস, সবাই শুধু ভূতের গল্পই লেখে। ভয়ংকর ভয়ংকর ভূতের গল্প লেখে, বোকা বোকা ভূতের গল্প লেখে। কিন্তু আমাদের গল্প কেউ লেখে না।
তবে আপনার মেয়ে কিন্তু আমাদের নিয়ে গল্প লিখতে যাচ্ছে। ওর লেখা গল্পটি যখন প্রকাশিত হবে, তখন সেই গল্প পড়ে মানুষ আমাদের সম্পর্কে জানবে। আমাদের ভালোবাসবে। এরচেয়ে আনন্দের আর কিছুই নেই। সে আমাদের বন্ধু হয়ে গেলো। সেই সাথে তাঁর পরীবারের সবাই-ও আমাদের বন্ধু। এ পরীরাজ্যের সবার পক্ষ থেকে আপনাদেরকে অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা জানাই।
আমি আনন্দে ছটফট করতে করতে বললাম, আমি জানতাম না, পরীরা যে এতো সুন্দর, এত্তো ভালো। পরী সম্পর্কে তো আমরা অনেক কিছুই জানি না। আজ নিজের চোখে দেখলাম। আমি আপনাদের এ সম্মান, এ আপ্যায়ন, এ ভালবাসার কথা কোনোদিন ভুলব না পরীরাণী। কথা দিলাম, আমি মানুষকে জানিয়ে দেবো আপনাদের কথা। আপনারা থাকবেন আমাদের কাছে, অনেক কাছে। আপনারা হবেন আমাদের প্রিয় বন্ধু।
পরীরাণী খুশি হয়ে আমাদের হাতে একটা করে ফুলের তোড়া আর কিছু উপহার তুলে দিলেন।
আমরা হাসিমুখে চলে এলাম পরীরাণীর দেশ হতে। এবার কিন্তু আমার বসে থাকলে চলবে না। পরীদের নিয়ে আমাকে গল্প লিখতে হবে। মিষ্টি একটা গল্প লিখতে হবে। যে গল্প পড়ে শিশুরা জানবে, পরীরা কত্তো ভালো, কত্তো মিষ্টি, কত্তো সুন্দর।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!