এ কাহিনি আমার নয়, আমার পিতৃদেব মাতৃদেবীর। ঘটনা আমার জন্মের কিছুমাস আগেকার। তথ্যগত কিছু ভুলত্রুটি তাই কিছু থেকে যেতে পারে, কারণ গল্পের পুরোটাই পরস্মৈপদী।
পিতৃদেব ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পিডব্লুডির ইঞ্জিনীয়ার। দু-তিন বছর অন্তর অন্তর পোস্টিং বদলাত। চাকরিজীবনের তখন শুরুর দিক, আঞ্চলিক রাজনীতির নিয়ম মেনেই তখন “ভালো’ জায়গায় পোস্টিং পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। এজন্য পিতৃদেবের মনে কোনও বিশেষ ক্ষোভও ছিল না, কারণ তখনও দোষ দেবার জন্য সিপিএমের ঐতিহাসিক জমানা শুরু হয় নি। বঙ্গের গদিতে আসীন ছিলেন মানু রায়। উত্তরবঙ্গের অখ্যাত গ্রাম নক্শালবাড়ি তখন আস্তে আস্তে খবরের কাগজের সামনের পাতায় চলে এসেছে, গ্রামের নাম ধার করে একদল আদর্শের স্বপ্ন চোখেমুখে মেখে কিছু ছেলেমেয়ে কাঁপিয়ে দিচ্ছে দক্ষিণবঙ্গের জেলা, বাদ পড়ছে না কলকাতাও। সেই সময়ে পিতৃদেবের ট্রান্সফার হল উত্তরবঙ্গে, হাল্কা করে পাহাড়ের কোলে।
জায়গাটার নাম আলিপুরদুয়ার। ভূটান পাহাড়ের গায়ে। শিলিগুড়ির সাথে যোগাযোগ বলতে মুখ্যত সড়কপথ, আর দিনে দুটি মিটারগেজের ট্রেন। শহুরে বিপ্লব থেকে তখনকার মত অনেক দূরে। ছোট্ট পাহাড়ি শহর, কাঠের আর টিনের তৈরি বাড়িঘর, খেলনা-বাড়ির মত দেখতে আলিপুরদুয়ার স্টেশন, ঢালু উঁচুনিচু রাস্তা, আর চারদিকে বন আর বন। একদিকে বক্সা পাহাড়, আজ যেখানে বক্সা টাইগার রিজার্ভ তৈরি হয়েছে। আরেকদিকে ভূটান পাহাড়। নিকটবর্তী বিদেশ। পাহাড়ি ফ্লোরা আর ফওনাতে আলিপুরদুয়ারকে সাজিয়ে দিতে কোনও কসুর করে নি প্রকৃতি।
পিডব্লুডিতে তখনও সব জায়গায় গেলেই কোয়ার্টার পাওয়া যেত না। পিতৃদেবও পান নি। ভাড়া নিতে হয়েছিল অফিসের কাছেই একটি কাঠের বাড়ি। পেছনদিকে ছড়ানো ঘাসে ঢাকা উঠোন, একটু দূরেই কমলালেবুর বাগান। বাগান ছাড়িয়ে পেছনের আকাশের দিকে চোখ সরালেই নীল-সবুজের আঁকিবুঁকি। জলপাইগুড়ির পাহাড়-ঘেরা এই জায়গাটা পাহাড়ী উপজাতি-অধ্যুষিত, গারো, খাসি, মদেশিয়া, নেপালী আর ভুটানীতে ভর্তি। ফলে নরুণচেরা চোখ আর চ্যাপ্টা নাক ওখানকার রিলিফের সঙ্গে খুব ভালোভাবে খাপ খেয়ে যেত।
পিতৃদেব মাতৃদেবী হুগলির একান্নবর্তী পরিবার ছেড়েছেন বহুদিনই, বিবাহও করেছেন আট বছর হল, একমাত্র কন্যার বয়েস তখন তিন, পাহাড়ের সৌন্দর্যের মোহময়তা আবার আচ্ছন্ন করল সমতলে-বড়-হওয়া দম্পতির মন। মাতৃদেবীর গর্ভে সঞ্চারিত হল আমার আবির্ভাবের সম্ভাবনা।
সালটা উনিশশো ছিয়াত্তর। তখনও টিভি আসে নি, রেডিও ছিল অতি-মহার্ঘ বস্তু, শনিবারেও সরকারি বাবুদের আপিস করতে হত। সপ্তাহান্তের আনন্দ বলতে ছিল সহকর্মীর বাড়িতে গিয়ে আড্ডা, রান্নাবান্না, নয় তো দল বেঁধে কাছাকাছি কোথাও পিকনিকে যাওয়া।
পিকনিক স্পটের অভাব নেই আলিপুরদুয়ারের আশেপাশে, রাজাভাতখাওয়া, ফাঁসিদেওয়া, কিন্তু পাহাড়ের শীত বড় ভয়ঙ্কর। শীতে সেখানে পিকনিকে যাবার কথা ভাবাও যায় না, গেলেও বেলাবেলি ফিরে আসতে হয়।
তো সেই, ছিয়াত্তরের শীতের মুখে এক সপ্তাহান্তে পিতৃদেব সস্ত্রীক তাঁর অফিসের এক সহকর্মীর ফ্যামিলির সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন একবেলার পিকনিকে। ঔচিত্য-অনৌচিত্যের সীমারেখা তখনও সেরকম স্পষ্ট ছিল না, বাহন হিসেবে তাই স্বাভাবিকভাবেই নেওয়া হয়েছিল পিডব্লুডির সারাক্ষণের জীপটা, গন্তব্য রাজাভাতখাওয়া।
অলিপুরদুয়ারের অদূরেই এক গঞ্জ এলাকা এই রাজাভাতখাওয়া। কবে কোন্ প্রাচীনকালে কোন রাজা এখানে ভাত খেয়ে গেছিলেন জানা যায় না, তবে জঙ্গলে ঘেরা ছোট গ্রাম হিসেবে পর্যটকদের তখনও টানত এইসব জায়গা।
গ্রামের কোলেই জঙ্গলের ভেতরে ফরেস্ট বাংলো। গানে তাসে আড্ডায় রান্নায় এবং নুন ভুলে যাওয়ায় … যেমন হত সত্তরের দশকের পিকনিক, সেভাবেই কেটে গেল সারাদিন। হরিণেরও দেখা মিলল, বাঁদরেরও। সব পেরিয়ে ফেরার পথ ধরতে একটু সন্ধ্যেই হয়ে গেল। ফরেস্ট বাংলোর চৌহদ্দি থেকে রাজাভাতখাওয়াতে ফেরার পথে খানিকটা জঙ্গল পেরোতে হয় অবশ্য, তবে তা তেমন বেশি কিছু নয়। জীপ স্টার্ট নিল।
দেড় কিলোমিটার যেতে না যেতেই গাড়ি থেমে গেল হঠাৎ। তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে, জঙ্গলের ভেতর তো সন্ধ্যে নামে আরও আগে। হেডলাইটও নিভিয়ে ফেলা হল। উৎকণ্ঠিত পিতৃদেব কারণ জিজ্ঞেস করতেই ঠোঁটে আঙুল রেখে সবাইকে চুপ করতে বলল নেপালি ড্রাইভার।
কিছুক্ষণ সময় কাটল। অন্ধকারের জঙ্গল বড় নির্জন। চারপাশে কিছু গেছো বাঁদরের কিচমিচ আর ফাঁকে ফাঁকে একটু আগেই পেরিয়ে আসা ঝোরাটার কুলকুল শব্দ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই কোথাও।
ড্রাইভার কথা বলল এবার, ফিসফিসিয়ে। “বাঁদরদের ডাক লক্ষ্য করলেন সাব? ওটা ওদের ভয়ের ডাক। কিছু দেখেছে কাছাকাছি।’
পিতৃদেবের তো হয়ে গেছে এই অবধি শুনেই। কী দেখতে পারে? বাঘ? সিংহ? নাকি গণ্ডার?
“শের হতে পারে, গণেশজীও হতে পারে। গণেশজী হবার চান্সই বেশি।’
ডুয়ার্সের জঙ্গলে বাঘ হাতি দুইই আছে। দুই প্রাণীই দু-ধরণের খতরনাক। যদিও একজন শুদ্ধ ভেজিটেরিয়ান আরেকজন নন-ভেজ, কিন্তু বন্য হাতির পালের সামনে পড়ে সসম্মানে বেঁচে ফেরার নজির খুব কম। পিতৃদেবের সঙ্গে তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী, বন্ধু এবং বন্ধুপত্নী সকলেই নিজ নিজ ভরসাস্থলে প্রার্থনা করতে শুরু করলেন।
কিন্তু বাংলার বুকে তখন কমিউনিস্ট শাসন আগতপ্রায়, প্রার্থনায় তাই আর কেউ সাড়া না দিলেও, সাড়া দিলেন গণেশজী স্বয়ং। … অন্ধকার জঙ্গল ফুঁড়ে আরও অন্ধকার, মূর্তিমান যমদূতের মত সামনে এসে দাঁড়ালো এক বিশাল বড় টাস্কার, একেবারে জীপের সামনাসামনি। পেছনে দুই মাদী হাতি, আর তাদের ঠিক মাঝখানে একটি হস্তীশাবক, মাত্র কয়েকদিন বয়েস হবে তার, গা ভর্তি বড় বড় লোম, দুই মাদীর ঠেলা খেয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে।
হাতির দল এমনিই হয় তো সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছিল স-ফ্যামিলি। কিন্তু পথে এরকম একটা অদ্ভূতদর্শন জিনিসের মুখোমুখি পড়বার চিন্তা তাদের মাথায় ছিল না। ফলে, হাতিসুলভ বুদ্ধি প্রয়োগ করে টাস্কার নিজেই তার সুবিশাল শরীর নিয়ে বাকিদের আড়াল করে ঘুরে দাঁড়াল জিপের দিকে।
নেপালী ড্রাইভার চোখ সরাল না টাস্কারের দিক থেকে, হাত সরল না স্টিয়ারিং থেকেও। পাথরের মূর্তির কেবল ঠোঁটদুটো একটুখানির জন্য ফাঁক হল, ভগ্ওয়ানজীর নাম নিন সাব, আমাদের কিচ্ছু হবে না।
কত মুহূর্ত, কত মিনিট কেটেছিল, তা আর মনে করতে পারেন না পিতৃদেব। সঙ্গে সদ্যোজাত বাচ্চা থাকলে হাতির পাল আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে, সামনে গাড়ি-জাতীয় কোনও অচেনা বস্তু দেখলে তারা প্রথমেই সেটাকে তাদের পোটেনশিয়াল আক্রমণকারী ভেবে নেয়, এবং সেটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আছড়ে পিষে চেপটে শেষ করে দিতে পারে আস্ত একটা জীপ, যদি হাতি মনে করে এর থেকে বাচ্চার কোনও ক্ষতি হতে পারে।
টাস্কার তখনও পর্যন্ত সেরকম কিছু অ্যাটিট্যুড দেখাল না। কেবল তাঁর লম্বা শুঁড় বুলিয়ে গেল একবার জীপের সারা গায়ের ওপর দিয়ে, বোধ হয় বুঝে নিতে চাইল জিনিসটা তাদের কোনও ক্ষতি করতে পারে কিনা। জিনিসটার ভেতরে বসা পাঁচজন তুচ্ছ মানুষ-প্রাণীর তখন নিশ্বাসও বন্ধ।
অবশেষে গণেশজীর বোধ হয় সত্যিই দয়া হল। দাঁতাল তার সামনের দুটো পা দিয়ে উঠল জীপের বনেটের ওপর, ঠিক সার্কাসে টুলের ওপর যেমন পা তোলে তারা। শুঁড়টা আকাশে তুলে “কাঁ-ক্ কাঁ …’ করে একটা হাড় হিম করা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ল অচেনা গাড়িটার দিকে, তারপর সামনের পা দুটো নামিয়ে কয়েক পা পিছন ফিরে দাঁড়াল। পেছন ফিরে কিছু একটা ইশারা করল হস্তিনীদ্বয়কে। দুই মাদী হাতি ঠিক তেমনিভাবে বাচ্চার গায়ে গা লাগিয়ে এসকর্ট করে দাঁড়িয়ে ছিল। ইশারা পাওয়ামাত্র সেইভাবেই বাচ্চাকে গার্ড করে রাস্তা পেরিয়ে তারা ঢুকে গেল পাশের জঙ্গলে। সম্পূর্ণভাবে জঙ্গলে ঢুকে যাবার পরে তবে দাঁতাল চোখ সরাল জীপের থেকে। আবার একটা চেতাবনী দিল শুঁড় তুলে। তারপরে নিজেও ধীরে ধীরে সরে গেল রাস্তা থেকে। ধরে নিল জঙ্গলের পথ।
হাতির দল চলে যাবার পরও আরও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করে তবে জীপে স্টার্ট দিল ড্রাইভার। আশ্চর্যের ব্যাপার, বনেটে দু-পা তুলে দাঁড়াবার পরেও তেমন কিছু ক্ষতি হয় নি জীপের, বনেট কেবল একটু তুবড়ে গেছিল কেবল। গাড়ি স্টার্ট নিল একবারেই।
রাজাভাতখাওয়ার লোকালয় খুব একটা আর দূরে ছিল না। গঞ্জে পৌঁছে তবে মুখ খুলল ড্রাইভার, “বাচ্চাটার জন্যেই বেঁচে গেলাম সাব। বাচ্চাটা ওদের সাথে না থাকলে ও আমাদের পিষে ফেলত। ঐ দুটো মাদী হাতির একটা ওর মা, আরেকটা ধাই-মা। হাতিদেরও ধাই-মা থাকে।’
এর পর পিকনিক পার্টির আলিপুরদুয়ার প্রত্যাবর্তন খুব ঘটনাবিহীনভাবে শেষ হয়। এর চার মাস বাদে আমি ভূমিষ্ঠ হই, এবং তারও প্রায় এক বছর বাদে আলিপুরদুয়ারের পাট পাকাপাকিভাবে চুকিয়ে আমার পিতৃদেব বদলি হয়ে আসেন বর্ধমানের গুশকরা গ্রামে। গল্পটা বড় হবার মুখে কোনও এক সময়ে শোনা, আমার পিতৃদেবের কাছ থেকে। ততদিনে আমরা গুশকরাও ছেড়ে এসেছি।
এর পর আরেকবার বন্য হাতির মুখোমুখি হয়েছিলাম আমি নিজেই। কিন্তু সে আর জঙ্গলের কাহিনি নয়, দলমা পাহাড় থেকে হাতির পাল ঢুকে পড়েছিল খোদ হুগলি শহরের মধ্যে। সে-আরেক গল্প। অন্য কোনওদিন করা যাবে। অন্য কোনও অবসরে। এখন আমি মেয়ের স্কুলের জন্য হাতির মুখোশ বানাতে ব্যস্ত, তাদের ওয়াইল্ডলাইফ চেনার সেশন চলছে স্কুলে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।