পড়শী হলেই পরশ্রীকাতর হতে হবে, এমন কোন কথা নেই। যেমন ভাই ভাই হলেই ঠাঁই ঠাঁই লাঠালাঠি হবে, তারও কোন মানে নেই। তবুও আমাদের বহু উজ্জ্বল ঐতিহ্যের পাশাপাশি এমন দু’একটা ট্রেডিশন বহু জেনারেশন থেকে চলে আসছে, যার কোন ব্যতিক্রম আজো তেমন একটা চোখে পড়ে না।
প্রতিবেশীর প্রতি আমাদের সহানুভূতির অন্ত নেই। আমরা হয় নিদারুণভাবে প্রতিবেশীপরায়ণ, না হয় অধিকতর প্রতিবেশীকাতর। প্রতিবেশীদের সাথে আমাদের মেলামেশি ঘেষাঘেষী এতো বেশী যে, শেষমেষ তা মন কষাকষি রেষারেষিতে পরিণত হয়। শুধু পরিণত হয় তাই নয়, তারপর কথা কাটাকাটি থেকে মাথা ফাটাফাটি পর্যন্তও চলে।
আসলে ‘প্রতিবেশী’ শব্দটাই বোধ হয় একটু গোলমেলে। ধ্বনির ধ্বনি যেমন প্রতিধ্বনি, দানের দান যেমন প্রতিদান, জবাবের জবাব যেমন প্রতি-জবাব, ঠিক তেমনি বেশীর বেশী হলো প্রতিবেশী। আরো সহজ করে বলা যায়, যেখানে সবকিছু বেশীর বেশী, সেখানেই প্রতিবেশী অর্থাৎ প্রতিবেশীদের মধ্যে মেলামেশিও বেশী, রেষারেষিও তেমনি বেশী। গলাগলিও যেমন বেশী বেশী, গালাগালিও তেমন বেশী বেশী। অর্থাৎ আরো সংক্ষেপে বলা যায়, বেশী বেশী মানেই প্রতিবেশী।
এই জন্যেই বোধ হয় প্রতিবেশীদের সম্বন্ধে আমাদের কৌতুহলও খুব বেশী। প্রতিবেশী না খেয়ে থাকলে অবশ্য বলার কিছু নেই, কিন্তু খেয়ে থাকলেই আমাদের যত কৌতুহল। প্রতিবেশীকে কোনদিন বাজার থেকে মুরগী কিনে আনতে দেখলে বলি, এই দুর্মূল্যের দিনে প্রতিদিন এতো মুরগী কেনার পয়সা জোটে কোত্থেকে। আবার যখন শুধু একটা লাউ আর কিছু শাকসবজি হাতে করে বাজার থেকে ফিরতে দেখি, তখন বলি, এমন হাড় কিপটে কন্জুস্ আর দেখিনি।
কোন এক প্রতিবেশীর ছেলে নাকি স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। এ দুঃসংবাদ পেয়ে প্রতিবেশী বললো, ভর্তি হলে কি হবে পাশ করতে পারবে না। ছেলেটি যখন পাশ করলো, প্রতিবেশী বললো, পাশ করলে কি হবে, চাকুরী পাবে না। চাকুরীও যখন পেলো, তখন প্রতিবেশী বললো, চাকুরী পেলে কি হবে, প্রমোশন পাবে না।
ছেলেটি এরপর প্রমোশন পেয়েছিল কিনা আমাদের জানা নেই। পেয়ে থাকলে প্রতিবেশী তার জন্য আরো কি দোয়া-খায়ের করেছিল, তাও জানা নেই। তবে সত্যি সত্যি যদি ছেলেটির প্রমোশন না হয়ে থাকে, তাহলে প্রতিবেশী যে মহানন্দে নৃত্য করেছে, তা আমাদের বেশ জানা আছে।
প্রতিবেশীর মুরগীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এক ভদ্রলোক এক ফন্দি অাঁটলো। একদিন তার বাগানের ঝোঁপ ঝাড়ে কয়েকটি ডিম লুকিয়ে রাখলো এবং বাগানে পায়চারী করতে করতে ডিমগুলি হঠাৎ সন্ধান পেয়ে গেছে এমনটি দেখিয়ে প্রতিবেশীদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলো, ‘‘আল্লাহ্র কি মেহেরবানী, আজকাল আর আমাকে ডিম কিনতে হয় না। কারো মুরগী এসে প্রতিদিন আমার বাগানে ডিম পেড়ে যায়।’’ বলা বাহুল্য এরপর আর কোন দিন ও বাড়ির মুরগী এ বাড়ির চৌহদ্দিতে পা দেবার অনুমতি পায়নি।
আমাদের দেশের এহেন প্রতিবেশী পরায়ণতার হাজারো গল্প শুনে এক বিদেশী সাংবাদিক খুব আকৃষ্ট হলো। সরেজমিনে এর প্রমাণ সংগ্রহের জন্য একদিন ঢাকায় এসে হাজির হলো। রাস্তায় বের হতেই এক ফকির তার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো, ‘‘বাবা কিছু ভিক্ষা দিন।’’ বিদেশী সাংবাদিক দেখলো এইতো মওকা। ফকিরকে ডেকে বললো, তুমি যা চাও তাই দিবো। কিন্তু একটা শর্ত। শর্ত হলো, তোমাকে যা দেবো, তোমার প্রতিবেশীকে তার ডবল দেবে। বলো রাজী? ফকির একটু চিন্তা করে বললো, হ্যাঁ রাজী। তখন সেই সাংবাদিক জানতে চাইলো, ‘তাহলে এখন বলো তুমি কি চাও।’ ফকিরটি অকপটে বললো, ‘আমার একটা চোখ কানা করে দিন।’ ফকিরের উদ্দেশ্য, তার এক চোখ কানা হলে, তার প্রতিবেশীর দু’চোখ কানা হবে। এক চোখ কানা হলে তার ভিক্ষার বরং সুবিধে হবে, কিন্তু দু’চোখ কানা হলে দেখি চেরাগ আলী ভিক্ষা করে কি করে!
বিদেশী সাংবাদিক ভিক্ষুকটির কথায় হক্চকিয়ে উঠেছিল কিনা এবং তার কথা শেষমেষ রক্ষা করেছিল কিনা, আমাদের জানা নেই। তবে ভিক্ষুকের এই অদ্ভুত ভিক্ষার পেছনে তার প্রতিবেশী পরায়ণতার যে অদ্ভুদ মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছিল তাতে সাংবাদিকটি নিশ্চয়ই অভিভূত না হয়ে পারেনি। নিজের একচক্ষুর বদলে প্রতিবেশীর দুই চক্ষু নেওয়ার কি আনন্দ, কি তৃপ্তি, তা বিদেশীরা বুঝবে কি করে!
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।