ন্যায় বিচার ! লিখেছেন: সিকদার

সিরিয়ার একটি শহরের নাম রাকা। সেখান থেকে খলিফা হারুনুর-রশিদের নিকট চিঠি আসলো। চিঠিতে লেখা ছিল: শহরের বিচারক এক মাস যাবত অসুস্থ, বিচার কাজ স্থবির হয়ে আছে। খলিফা যেন দ্রুত ব্যবস্থা করেন। খলিফা চিঠির জবাব পাঠালেন। আগামী সপ্তাহের মধ্যে নতুন বিচারক আসবেন। এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন বিচারক এসে যোগ দিলেন। বিচার কাজ শুরু হয়েছে।

স্থানীয় প্রহরীরা একজন বৃদ্ধা মহিলাকে আসামী হিসেবে দরবারে হাজির করলেন। তার অপরাধ ছিল তিনি শহরের এক রেস্তারাঁ থেকে কিছু রুটি আর মধু চুরি করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন।

বিচারক: আপনি চুরি করেছেন?
বৃদ্ধা: জ্বি।
বিচারক: আপনি কি জানেন চুরি করা কতো বড় অপরাধ ও পাপ?
বৃদ্ধা: জ্বি।
বিচারক: জেনেও কেন চুরি করলেন?
বৃদ্ধা: কারণ আমি গত এক সপ্তাহ যাবত অভুক্ত ছিলাম। আমার সাথে এতিম দু’নাতিও না খেয়ে ছিল। ওদের ক্ষুধারত চেহারা ও কান্না সহ্য করতে পারিনি তাই চুরি করেছি। আমার আর এ ছাড়া কোন উপায় ছিল না হুজুর।

বিচারক এবার পুরো দরবারে চোখবুলালেন। বললেন কাল যেন নগর, খাদ্য, শরিয়া, পুলিশ প্রধান ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ সবাই উপস্থিত থাকেন। তখন এর রায় দেওয়া হবে।

পরদিন সকালে সবাই হাজির হলেন। বিচারক ও যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে রায় ঘোষণা করলেন – “বৃদ্ধা মহিলার চুরির অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৫০টি চাবুক, ৫০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা আর অনাদায়ে এক বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে অকপটে সত্য বলার কারণে হাত কাটা মাফ করা হয়েছে।”

বিচারক প্রহরীকে চাবুক আনার নির্দেশ দিয়ে নিচে নেমে ঐ বৃদ্ধা মহিলার পাশাপাশি দাঁড়ালেন। বিচারক বললেন, “যে নগরে একজন ক্ষুধার্ত বৃদ্ধ মহিলা না খেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় চুরি করতে বাধ্য হয়, সেখানে তো সবচেয়ে বড় অপরাধী সে দেশের খলিফা। আর আমি এসেছি খলিফার প্রতিনিধি হয়ে। আমি যেহেতু তাঁর অধীনে চাকরি করি তাই ৫০টি চাবুকের ২০টি আমার হাতে মারা হোক। আর এটাই হলো বিচারকের আদেশ। আদেশ যেন পালন করা হয় এবং বিচারক হিসাবে আমার উপর চাবুক মারতে যেন কোনো রকম করুণা বা দয়া দেখানো না হয়।”

বিচারক হাত বাড়িয়ে দিলেন। দুই হাতে পর পর ২০টি চাবুক মারা হলো। চাবুকের আঘাতের ফলে হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ঐ অবস্থায় বিচারক পকেট থেকে একটি রুমাল বের করলেন। কেউ একজন বিচারকের হাত বাঁধার জন্য এগিয়ে গেলে বিচারক নিষেধ করেন। এরপর বিচারক বললেন, “যে শহরে নগর প্রধান, খাদ্য গুদাম প্রধান ও অন্যান্য সমাজ হিতৈষীরা একজন অভাবগ্রস্ত মহিলার ভরণ-পোষণ করতে পারেন না, সেই নগরে তারা ও অপরাধী। তাই বাকি ৩০টি চাবুক সমানভাবে তাদেরকে মারা হোক।”

এরপর বিচারক নিজ পকেট থেকে বের করা রুমালের উপর ৫০টি রৌপ্য মুদ্রা রাখলেন। তারপর বিচারপতি উপস্থিত সবাইকে বললেন, “যে সমাজ একজন বৃদ্ধ মহিলাকে চোর বানায়, যে সমাজে এতিম শিশুরা উপবাস থাকে, সে সমাজের সবাই অপরাধী। তাই উপস্থিত সবাইকে ১০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা জরিমানা করা হলো।”

এবার মোট ৫০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা থেকে ১০০ দিণার রৌপ্য মুদ্রা জরিমানাবাবদ রেখে বাকি ৪০০টি রৌপ্য মুদ্রা থেকে ২০টি চুরি হওয়া দোকানের মালিককে দেওয়া হলো। বাকি ৩৮০টি রৌপ্য মুদ্রা বৃদ্ধা মহিলাকে দিয়ে বললেন, “এগুলো আপনার ভরণ-পোষণের জন্য। আর আগামী মাসে আপনি খলিফা হারুনুর রশিদের দরবারে আসবেন। খলিফা হারুনুর রশিদ আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থী।”

একমাস পরে বৃদ্ধা খলিফার দরবারে গিয়ে দেখেন; খলিফার আসনে বসা লোকটিকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে। মহিলা ভয়ে ভয়ে খলিফার আসনের দিকে এগিয়ে যান। কাছে গিয়ে বুঝতে পারেন লোকটি সেদিনের সেই বিচারক।

খলিফা চেয়ারে থেকে নেমে এসে বললেন, “আপনাকে ও আপনার এতিম দু’নাতিকে উপোস রাখার জন্য সেদিন বিচারক হিসেবে ক্ষমা চেয়েছিলাম। আজ দরবারে ডেকে এনেছি প্রজা অধিকারসমুন্নত করতে না পারা অধম এই খলীফাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। আপনি দয়াকরে আমাকে ক্ষমা করুন।”

লিখেছেন: সিকদার

আল্লাহর উপরে ভরসার গুরুত্ব

আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ (রা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *