জেলেপাড়ার হাড় জিরজিরে কুকুরগুলোর রক্তে আগুন জ্বালিয়ে একনাগাড়ে ডেকে ডেকে কাশবনের হতচ্ছাড়া শিয়ালগুলো ক্লান্ত হলে, ভোঁস-ভোঁস, ফোঁস-ফোঁস, শীৎকার করতে করতে অবশেষে রাত্রি দ্বিপ্রহরে গগনবাবুর রতিপাত হলো! তাতে আমার শুষ্ক নিস্ফলা জঠর ক্ষণিকের জন্য কিছুটা আর্দ্র হলেও নতুন প্রাণের সঞ্চার হলো না।
চৈত্র-বোশেখের তীব্র দাবদাহে আমার বুকটা ভীষণ জ্বলে গো বাবুমশাই। আমি সইতে পারি না। সূর্যদেবের সঙ্গে আমার আজন্মকালের শত্রুতা! বরাবরই তিনি আমার ওপর রুষ্ট! শীত যেতে না যেতেই তিনি আমার কোল খালি করেন। আর চৈত্র-বোশেখ-জ্যেষ্ঠিতে তিনি আমাকে জ্বালান, পোড়ান! কী যে সুখ পান!
অথচ আষাঢ়-শ্রাবণে আমারই বুকের আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে চুলে টেরি কেটে, ধুতির কোঁচা উঁচিয়ে দিব্যি শ্বশুরবাড়ি যান!
তবে বাবুমশাই, আমি সূর্যদেবকে দোষ দেব না। তার স্বভাব তো বরাবরই ঋষি দূর্বাসাসুলভ। আমি দোষ দিই মানুষকে। এই মানুষেরাই তো নানা অনাচারে-অনাসৃষ্টিতে দিনকে দিন তাকে আরও রাগী করে তুলছে। তাছাড়া সূর্যদেব যত রুষ্ট-ই হোন না কেন, আগে কোনদিন তিনি আমার কোল খালি করতে পারেন নাই।
বাবুমশাই, বলতে চোখ ভিজে যায়, গলা আটকে যায়, তবু বলি- আগে কী দিন ছিল আমাদের! আমরা ছিলাম পিঠোপিঠি তিন বোন আর সবার ছোট্ট আমাদের আদরের ভাই নদ। এছাড়া আমরা মা- মাসি-পিসি, মাসতুতো-পিসতুতো ভাই-বোন মিলে ছিলাম অসংখ্য। সংখ্যাটা বলেই দিই-প্রায় বারশো! এখন মরে-ধরে তিশ’র নিচে এসে ঠেকেছে। মানুষের অত্যাচারে আগামী দিনে এও থাকবে না। এক কালের বনেদী নৈ-বংশ নির্বংশ হবে!
সেই ইতিহাস না হয় না-ই বললাম। আমি শুধু আমাদের তিন বোন আর আর এক ভাইয়ের গল্পই আপনাদের বলবো। আগেই বলেছি, নদ আমাদের ভীষণ আদরের ভাই। কার্তিকের মতো চেহারা। আমাদের তিন বোনের মতো স্থুলকায় নয়, চিকন দেহ সৌষ্ঠব তার। আমাদের তিন বোনের মধ্যে আমি-ই ছোট। আমার পরেই নদ। তাই আমার সাথেই তার যোগসূত্র। তার যত চাওয়া-পাওয়া, যত আবদার, সব আমার কাছেই। আমার অন্য দুই বোন ছোট ভাইকে যা দেবার আমার মাধ্যমেই দিতো।
আমরা তিন বোন দয়ালু, পরপোকারী, আবার কখনও কখনও ক্ষ্যাপা পাগলী। রণচন্ডী! ঘাড়ে যেনবা স্বয়ং মা কালী ভর করতো! রুঢ় চিত্তে, রক্তনেত্রে, ক্ষিপ্রহাতে পাড় ভাঙতাম! কাঁথিতে দিতাম লাথি! বাড়ি-ঘর, গাছপালা গ্রাস করতাম একের পর এক। তবু যেন ক্ষুধা মিটতো না, পেট ভরতো না। পাড়া-গাঁয়ের বুড়িরা বলতো, ‘সর্বনাশী, রাক্ষুসী মাগি!’ তবে এক কূল ভাঙলেও আমরা আরেক কূল গড়ে দিতাম। এই আমাদের ধর্ম। কিন্তু আমাদের ভাই নদ যেমন ছিল পরপোকারী, তেমনি ছিল ধীর-স্থির, শান্ত আর কী দারুণ স্বচ্ছ!
বাবুমশাই, এই মানুষের জন্য আমরা কি না করেছি! আমার বুকের ওপর দিয়ে বৈঠা বেয়ে নাউ নিয়ে মাঝিরা যেতো মোহনগঞ্জের হাটে মাছ বিক্রি করতে-আমারই কোল ছাঁকা মাছ। বেনে বাবুরা বড় বড় পানসী বোঝাই করে ধান, পাট, খাদ্যশস্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যেত। আর রাতেরবেলা ভাটিতে নৌকা ভাসিয়ে মাঝিরা গলা খুলে গাইতো-ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া। সেই গানের সাথে আমার বুকের ছলাৎ ছলাৎ বাজনা মিশে হতো কী যে এক মায়াবী মুহূর্তের দ্যোতনা! তা বলে বোঝানো যাবে না। আর এর সাথে যখন থাকতো দিগন্ত জোড়া জোছনা, আকাশ ভরা নক্ষত্র! আহা! বাবুমশাই, একবার ভাবুন তো!
শুধু কি তাই! আমারই বুকের ওপর দিয়ে নৌকায় ভাসতে ভাসতে বর যেতো বিয়ে করতে। মহা উল্লাসে ঢাক, ঢোল, সানাই বাজাতে বাজাতে নতুন বউ আর বরকে নিয়ে ফিরতো বরযাত্রীগণ। আর বারো মাস মানুষের আত্মীয়-কুটুম্ব বাড়ি যাওয়া-আসা তো ছিলই। বারুইপুরের রথের মেলা, উদয়পুরের দূর্গাপূজার মেলা, শ্যামনগরের ঈদমেলা, সখিপুরের বাউলদের মচ্ছবে হাজার হাজার মানুষ ছুটতো আমারই বুকের ওপর দিয়ে। আর আমার কোমরের কাছে বসন্তপুরের নৌকা বাইচ! সে কথাই বা ভুলি কী করে! কী বিশাল ছিল তার আয়োজন! কী বিপুল ছিল লোক সমাগম!
বাবুমশাই, ঐ যে শুরুতে জেলে পাড়ার কথা বললাম, যেখান থেকে কুকুরগুলো হুঙ্কার ছাড়ে শিয়ালের ডাক শুনে। কষ্টিপাথরে খোদাই করা মূর্তির মতো ওখানকার ঐ পরিশ্রমী, সৎ জীবনযোদ্ধারা দুধে-ভাতে, মোটা কাপড়ে, বারো মাসে তোরো পার্বণে, উৎসবে-আমোদে কাটাতো তাদের দিন। আর এখন? ফাল্গুনের বাতাস আমার কাছে নিয়ে আসে তাদের হাহাকার আর ক্ষুধার্ত শিশুর চিৎকার!
মা-খুড়ীদের কাছে শুনেছি, আমাদের ধারে-কাছে যাদের বাস অর্থাৎ নদী পাড়ের মানুষ, সরল আর উদার মনের হয়, নদী পাড়ের মানুষ দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত হয় পর্যাপ্ত আমিষের কল্যাণে। কিন্তু এখন দেখছি নদী পাড়ের মানুষ নিষ্ঠুর আর কু-বুদ্ধিসম্পন্নও হয়!
কথায় কথা বাড়ে, বেলা যায় বয়ে। তা বাবু মশাই, যে কথা বলছিলাম-আমাদের আদরের ভাই নদের কথা। যে নদ মানুষের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে পারতো না। চৈত্র-বোশেখে ওর বুকে জল কমে গেলে মাছও কমে যেতো। তখন ও আমায় বলতো, ‘ ও দিদি আমার দিকে একটু স্রোত বাড়াও, কিছু মাছ দাও। জেলেপাড়ার চুলোগুলো যে বন্ধ হতে চললো! মাছ না পেলে ওরা নিজেরা খাবে কী, আর ছেলেপুলেদেরকেই বা খাওয়াবে কী? খিদের জ্বালায় ছেলেপুলেগুলো রাতভর কাঁদে। আমার ঘুম আসে না। ছেলেপুলের কষ্ট যে আর সইতে পারিনে!’
এমনই দরদী আমাদের ভাই। আর আমাদের তিন বোনের আগে সেই ভাই-ই মানুষের লোভের প্রথম বলি হলো! কিছু লোভী মানুষ একটু একটু করে ওর বুক ভরাট করে গড়ে তুললো মসজিদ-মাদ্রাসা। ভাবছেন, এই মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করেছে বলে ওরা খুব ধর্মপরায়ণ! তাহলে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন! এটা ওদের একটা কৌশল মাত্র। আমাদের মতো ধর্মভীরু মানুষের দেশে ধর্মানুভূতি-ই ওদের পুঁজি! মসজিদ-মাদ্রাসাকে ঢাল হিসেবে সামনে রেখে পরবর্তীতে ওরা গড়ে তোলে বাজার, কল-কারখানা, জনবসতি। আমাদের ভাই নদকে একটু একটু করে খেতে খেতে ওর পুরো শরীরটাই গ্রাস করে ফেললো লোভী মানুষগুলো। মাটিচাপা পড়ে গেল আমাদের আদরের ভাই নদ। নদের জীবনের শেষ দিনগুলো আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না, এখনও আমার কানে বাজে ওর বাঁচার আকুতি-হাহাকার। নদের বুকের ওপর এখন মসজিদ-মাদ্রাসা, হাট-বাজার, কল-কারখানা, জনবসতি। নদ আজ কেবলই ইতিহাস!
নদের পর মানুষেরা খেতে শুরু করলো আমাদের তিন বোনকে। আমার শরীরের উপরের অংশে পড়েছে শহর, আর নিচের অংশে গ্রাম। বাবুমশাই, আমার কোমরটা ক্রমেই বেঁকে আসছে। দিন দিন আমি হয়ে যাচ্ছি কুঁজো বুড়ি! আমার কোমরে, উরুতে গড়ে উঠছে কল-কারখানা। আর তার আবর্জনা ক্রমাগত কলঙ্কিত করছে আমাকে। শীত আসার আগেই আমার বুকের স্থানে স্থানে জেগে ওঠে বিরান বালুচর। চৈত্র বোশেখে ধু ধু করে আমার বুক। একসময় যেখানে শীতল বাতাস বইতো, এখন সেখানে তপ্ত বাতাস দাপিয়ে বেড়ায়। বালুকনার সাথে গোল্লাছুট খেলে বাতাস। তৃষ্ণায় আমার বুক ফেটে যায়। জেলেপাড়া থেকে ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না ভেসে আসে। মায়ের বুকে দুধ না পেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় সারারাত ধরে কাঁদে শিশুগুলো। আমি তাদের জন্য কিছুই করতে পারি না। আমারও যে কোল খালি! আমার কোল ভরলে তবেই না জেলে শিশুদের পেট ভরবে। আমার বুক ফেটে যায় বাবুমশাই। আমি যে কাঁদতেও ভুলে গেছি!
আমার অন্য দুই বোনেরও একই রকম দূরাবস্থা। বড়বোনটার কপাল পোড়া! তার উর্ধাঙ্গ ভোগ করছে এক দেশ, নিন্মাঙ্গ ভোগ করছে আরেক দেশ। কী লজ্জা! ক্ষমতার লোভে মানুষ আমাদেরও ভাগ করে নিল। বড়বোনের গলায় ফাঁস দিয়েছে। শুকনো মৌসুমে সে হাঁস-ফাঁস করে মরে। আমরাও মরি।
মেজো বোনটাও মৃতপ্রায়। কুষ্ঠ রোগগ্রস্থ। ওর দুই পাড়েও গড়ে উঠেছে কল-কারখানা। কারখানার বর্জ্যে ওর রুপালি শরীরটা এখন কালো আর দুর্গন্ধময়। পোকা থিক থিক করে। নিদারুণ কষ্টে বোনটা আমার ছটফট করে।
বাবুমশাই, আমরা সবাই মানুষের লোভের জাঁতাকলে আটকে পড়েছি। বাঁচার আর আশা নাই। মানুষের অত্যাচারে আমাদের রোগ হয়। কিন্তু রোগ নিরাময়ের কোন ব্যবস্থা মানুষেরা করে না। তাই মৃত্যুই আমাদের অমোঘ নিয়তি!
বাবুমশাই, আমরা সুখে-দুঃখে সবসময় আপনাদের পাশে থেকেছি। তাইতো কিছু উদার মানুষেরা আমাদের নিয়ে লিখেছেন কত গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস! মানিকবাবু আমার মাকে নিয়ে লিখেছেন, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়কে নিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মন লিখেছেন, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। আমার আরেক দূরসম্পর্কের পিসতুতো ভাইকে নিয়ে মাইকেল মধুসুদন দত্ত লিখেছেন কবিতা, ‘কপোতাক্ষ’। আর আমার এক দূসম্পর্কের মাসতুতো বোনকে নিয়ে কবি জীবনানন্দ লিখেছেন কী অসাধারণ কবিতা- আবার আসিব ফিরে! এই কবিতাটি শুনে আমার চোখে আজও জল চলে আসে। কী অভিলাষের কথা-
‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হব-কিশোরীর-ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারাদিন কেটে যাবে কলমির গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে;’
আহা! চোখের জল ধরে রাখতে পারিনে বাবুমশাই। কবিতাটি শুনেছিলাম আজ থেকে বহু বছর আগে এক তরুণের মুখে-গোধূলিবেলায়। আমার কূলে বসে জলে পা ডুবিয়ে সেই তরুণ এই কবিতাটি আবৃত্তি করছিল, আর ওর দু’চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছিল আমার বুকে।
একবার ভাবুন তো বাবুমশাই, জীবনানন্দ বাবু যদি সত্যি সত্যিই হাঁস হয়ে আসেন, তবে তিনি কলমির গন্ধভরা জল কোথায় পাবেন! কোথায় ভাসবেন! যদি আমরাই বেঁচে না থাকি! তখন তিনি এই মরুময় দেশ দেখে কী এই বাংলায় আবার ফিরে আসতে চাইবেন? তখন তিনি লিখবেন-‘আবার আসিব না ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই মরুবাংলায়!’
বাবুমশাই, আপনারা পয়সা খরচ করে সমুদ্দুরে যান। কিন্তু নদীর ভালবাসা কি সমুদ্দুরে পান! নদী হলো ঘরের বউয়ের মতোন-সুখে, দুঃখে সর্বদাই পাশে থাকে। আর সমুদ্দুর হলো লাস্যময়ী বারবণিতা। সমুদ্দুরে ফুর্তি মেলে, প্রশান্তি মেলে না। প্রশান্তির জন্য আবার চান করতে হয়। আর নদী সব সময় প্রশান্তি দেয়, শরীরের জ্বালা জুড়োয়। সেই নদীর ওপর আপনারা অত্যাচার করছেন!
মানুষেরা যা শুরু করেছে, উত্তরকালে মানুষের উত্তরপুরুষেরা এই পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিতাস, ধানসিঁড়ি, ব্রহ্মপুত্র, কীর্ত্তণখোলা, কপোতাক্ষকে কোথায় খুঁজে পাবে বলুন তো? ইতিহাসের পিঙ্গল পাতায়! তাই এই মরণাপন্ন-সংকটকালে শুধু একটাই প্রশ্ন আপনাদের কাছে, আমাদের তো মেরে ফেলছেন, কিন্তু আমাদের মেরে আপনারা বাঁচবেন তো বাবুমশাই?
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।