নেহাৎই কাকতালীয়

ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি রথের দিন ঠিক বৃষ্টি হবেই ! কালিদাস নয় বলেছিল “আষাড়স্য প্রথম দিবসে/ মেঘ যদি জল নামায় /ছাতা ছাড়া ভিজলে পরে / দোষ দিও না আমায় !!” নাহ , কালিদাস কিন্ত বরাহমিহির ছিলেন না যে টিকি গুটিয়ে আকাশ মেপে বর্ষার দিনক্ষন বলে দেবেন । আবার এটা পারস্যও নয় যে ওমর খৈয়ামের মতো দিগ্গজ কেউ দিনে বিরস বদনে কবিতা লিখবে ও রাতে ঘরে বউ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্র দেখে নিরস অঙ্ক কষবে ! আসলে কবি কালিদাসের কবিতায় আছে যে আষাড় মাসের প্রথম দিনে ডিউটি ফাঁকি দিয়ে রামাগিরিতে এক বছরের পানিশমেন্ট পোস্টিং-এ থাকা এক যক্ষ যখন বিরহ বেদনায় কাতর , তিনি দেখলেন হাতির ন্যায় ইয়্যা পেল্লায় মেঘপুঞ্জ জনৈক গিরিশিখরকে জিদানের মতন গুঁতোচ্ছে !!

সেই দৃশ্য তাকে এতটাই আনন্দ দেয় যে সে ভাবে মেঘের গুঁতুনি দেখেই যদি তার এত উত্তেজনা তাহলে এখন বাড়িতে থাকলে বৌকে কাছে পেলে সে কি-ই না করতো ? তখনকার কথা বলতে পারব না কেননা তখন লোকেরা শুনেছি সব খালিগায়ে অলংকার চাপিয়ে নিম্নাঙ্গে ধুতি পড়ে যত্র তত্র ঘুরে বেড়াত আর মেয়েরা কাঁচুলি বেঁধে হরিনশাবকদের সাথে খেলা করত । তবে এখন হচ্ছে গিয়ে ভারী দুঃসময় , বাউন্সার ছাড়া অলংকার পড়লে ছিনতাই হয়ে যাবে আর ধুতি ভিড়ের মাঝে যে কেউ টেনে খুলে নিতে পারে। তাই হলফ করে বলছি কাঁচুলি পরুক বা নাই পরুক , স্থান কাল পাত্র না বুঝে যক্ষ ব্যাটা নিশ্চই বেমক্কা রেপ করে ফেলতো তার বিরহগ্রস্তা বৌটাকে।
যাক সে কথা, সুদিন দুর্দিন ঘুঁটের এপিঠ আর ওপিঠ। সেদিন বৃষ্টি ঠেঙিয়ে ষষ্ঠীতলায় রথের মেলায় গেছি ভাগ্নির জন্য পাপড় ভাজা আর বাদাম তক্তি কিনব বলে। দুম করে বৃষ্টিটা বেড়ে গেল ! কোনরকমে বাস স্ট্যান্ডের শেডের তলায় এসে দাড়ালাম , যথারীতি কিছুক্ষনের মধ্যে আট বাই তিন ফুটের জায়গাটাতে দেদার ঠেসাঠেসি ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেলো। হটাত পেছন থেকে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কে যেন বলল , “বৃষ্টি আরো বাড়বে , সঙ্গে ছাতা আনিসনি নিশ্চই ?” ঘুড়ে দেখি নবুদা মিটমিটিয়ে হাসছে! আমি কিছু বলার আগেই সাইড ব্যাগ থেকে একটা প্লাস্টিক প্যাকেট বার করে বলল, “এতে ওই পাপড় আর তক্তি গুলো ঢোকা,ভিজলে মিইয়ে যাবে। ” তারপর আবার সেই সাইড ব্যাগ হাতড়ে vodafone-এর বিজ্ঞাপন মারা একটা লাল সাদা স্ট্রিপড ছাতা ধরিয়ে বলল, “এটা খুলে দাড়া , বিপদকালে মাগনায় পাওয়া স্টেপনি ছাতার দাম কি তা বুঝবি এখন !” আমি কথা বাড়ালাম না, বিপদকালে আমাকে কালিদাস বা বিক্রমাদিত্য না বাচালেও নবুদা কিন্ত নোয়ার আর্ক নিয়ে স্বয়ং হাজির।

বৃষ্টি একটু কমতেই আমি উসখুস করছিলাম বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য, ভাগ্নি নাহলে কালকে আমার বাকি চুলগুলো ছিড়ে খেলনা বাটিতে শাক রান্নায় ব্যবহার করবে। নবুদাকে বাড়ি যাওয়া ও ভাগ্নির কথা বলতেই কিরকম নির্মম ভাবে ঝাঁঝিয়ে উঠলো ,”রক্তের সম্পর্কতে এতো আসক্তি কেন? তোদের এত বেফালতু মোহ বন্ধন কেন তাই বা কে জানে?” আমি কোনো পাল্টা উত্তর দিলাম না দেখে, এবার সে কিঞ্চিত আবদার মিশ্রিত সুরে বলল ,” আজকে আমার এখানে থেকে যা, পচা বাংলা তুলে আনবে আর হুলোকে বলছি খিচুরী-ডিমভাজা বানাতে।

রথের রাতে এক্কেবারে বল-রাম বলে জগন্নাথ মোচ্ছব! ” এমন অনাবিল খিস্তির সাথে এরকম প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় মিক্স করা নবুদার ডেইলি কা মামলা। অগত্যা রাজি হলাম , বাড়িতে বললাম মেলায় যাওয়া হয়নি, হুট করে রাতে ক্লাবের পিকনিক ঠিক হয়েছে , তাই কাল সকালে ফিরব। নবুদার সেই রেশন অফিসের পেছনে ৮ ফুট বাই ৮ ফুটের subaltern ডেরা, তার সিংহভাগ দখল করেছে পায়া ছাঁটা এক তক্তপোষ তাতে নবুদা, আমি, পচা বসে। বাকি এলাকায় হুলো দুপা কুঁকড়ে সামনে স্টোভে বসানো খিচুরীর দিকে নজর রাখছে। আর এর পরেও যে কয়েক স্কয়ার ফুট জায়গা বাঁচে তাতে খালি বোতলের ডাঁই ,হাফ ডজন ডিম, পেয়াঁজ, লঙ্কা কুঁচি,তেলের শিশি,ছুরি, একটা চিমনি ভাঙ্গা লম্ফো, গুচ্ছ পুরোনো খবরের কাগজ ও পত্রিকা এঁটে আছে কোনরকমে।এত ভিড় কিন্ত ওই বাসস্ট্যান্ডের মতন গাদাগাদি নেই !ও হ্যাঁ, বাইরে মুশুলধার বৃষ্টি পড়ছে বলে দরজার কাছে রাখা চটের বস্তায় নবুদার পেয়ারের দুই আশ্রিত কুত্তা মমো ও নমো চুপচাপ শুয়ে খিচুরির ঘ্রাণ উপভোগ করছে!

ওদের নামের ইতিহাস নিয়ে আশা করি নতুন করে আর বলবার কিছু নেই, তবে এবার প্রথম ওদের নামের সাথে জেন্ডারটা ঠিক ঠিক মিলে গেছে, ব্যাপারটা যদিও নেহাতই কাকতালীয়। মোটের ওপর Intriguing ambiance, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দের মাঝে টিমটিম করা বাল্বের আলো। একবার ভাবলাম গাজাপট্টির পাশে ইহুদি ঘেটোতে বুঝি আচমকা আটকে পরেছি আবার মনে হলো এটাই বুঝি জার্মান lebensraum, এবং সেই utopian মুক্তাঞ্চলে হটাত করেই নিজের মত নিশ্বাস নিচ্ছি ! হুলো খিচুরিটা বেড়ে রেঁধেছিল , আমরা হাত চেটে সাঁটালাম আর কুত্তাদুটোও গোঁফ চেটে খেলো ।

নবুদা শেষ পাতে খিচুরী , বাংলা, ডিম ভাজা , লঙ্কা কুচি সব মিলিয়ে মিশিয়ে একটা শিশু বিষ্ঠার মতন সেমি সলিড কিম্বা সেমি লিকুইড পদার্থ বানিয়ে , তা ঘিপঘাপ গিলে বলল , ” শীত বাড়ছে , গরম বাড়ছে আর বৃষ্টি তো আরো বাড়বে !” আমি বললাম , “বসন্ত আর হেমন্ত তো উবে যাচ্ছে !” ভুস করে দেশলাই দিয়ে বিড়ি জালিয়ে নবুদা আবার শুরু করলো, ” উব্বেই তো, আলবাত উবে যাবে, বসন্তে তোমরা বজ্র নির্ঘোষ মারাবে , হেমন্তকে দিয়ে রাণার গাওয়াবে , তো তারা কিসের জন্য এ পোড়া দেশে পড়ে থাকবে হে ? আমি আবার বললাম, “আরে ঋতুর কথা হচ্ছে, এরা এতদিন তো ছিল , দুম করে উবেই বা যাবে কেন?” “ঋতুও বা থাকবে কেনো ? সৃজিত কি কম নাকি, জাতিস্মর দেখিসনি ?” বুঝলাম নবুদা বগ্লে গিয়ে উলঝুল বকছে, তাই পাত্তা না দিয়েই বললাম , “মাতলামি করতে হলে আর আমাকে ডাকলে কেন , দিনের বেলায় সুস্থ অবস্থায় তো দিব্বি জ্ঞান ঝাড় !!” নবুদা এবার সোজা হয়ে বসলো , একটা ঠান্ডা দৃষ্টি দিয়ে বলল , ” ওহে ডিজিটাল নাগরিক, দিনের বেলা আমি যা ভাটিয়ে বেড়াই তা মূর্খদের জন্য। আর এখন যা বলছি তা বুঝতে পারলে তোর খিচুরী টা হজম হবে , তফাৎই বুঝিস না আবার পেল্লায় ইগো পোদে বয়ে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াস !” আমিও সামলে উঠে বললাম , “না বুঝতে পারলে সেটা যে বোঝাচ্ছে তার সমস্যা। ” নবুদা, “আমি তোকে বোঝাচ্ছি কে বলল , আমি তো কেবল ভাবাচ্ছি। ভাব ভাব, এনট্রপি কোন দিকে যাচ্ছে ?

chaos কতখানি বাড়ল সেটা মাপবি কি দিয়ে ? আমি, “তোমার কথার গতিপ্রকৃতিটাই বড় জটিল ধাঁচের, বোঝা না বোঝাটা তো আদপে রিলেটিভ ! ” নবুদা, “শালা গতিও বোঝো না প্রকৃতিও বোঝো না , এদিকে দিন দুপুরে রিলেটিভিটি আর ইভোল্যুশন কপচালে হাততালি দাও , না বোঝাটা আর না বুঝে বোঝার ভান করাটা তোমাদের বদ অভ্যেস হয়ে দাড়াচ্ছে হে !” পচা চুপচাপ শুনছিল, কিছু না ভেবেই ভাবের গতিতে দুম করে বলে উঠলো ” হ্যাঁ ঠিকই, তেলের, গ্যাসের, পেয়াজের আর রেল ভাড়াও বেড়েছে নতুন সরকার মার্কেটে আসার পর থেকে !” হুলো অমনি তাতে আরো জুড়ল , “এর পর শুনছি রাস্তার কলে আর্সেনিক যুক্ত জল বিনামূল্যে পাওয়া যাবে আর কর্পরেসানের আর্সেনিক ফিল্টার লাগানো কলের থেকে নিলে, সেই জলের দাম হবে লিটার প্রতি ২০ টাকা ! ” আমি কথা না বাড়িয়ে হালকা করে ঘাড় কাত করে শোবার চেষ্টা করলাম।

মমো আর নমোও দিব্য একটা চটে জায়গা ভাগাভাগি করে শুয়ে পড়েছে। হুলো ঝিমুচ্ছে আর পচা হুলোর কোলে মাথা রেখে ওর মোবাইলে গেম খেলছে ! আর নবুদা এক মনে বকেই চলল , “রোমুলাস হাওয়ায় উবে গিয়ে রোম কে বিশ্ব-রাজধানী বানাবার আকাশবাণী করলে ঠিক আছে কিন্ত কলকাতাকে লন্ডন করার স্বপ্ন দেখাটা পাপ, শালা দুমুখো সাঁপ ! মাদার টেরেসা নিল সাদা লাগালে সাধ্বী আর আমরা করলে বৈধব্য , বাহ্ ! ভুলে যেওনা , জোসেফ স্তালিন থেকে সারাহ পালিন সবারই গণতান্ত্রিক অধিকার আছে , আর তোমরা বাঙালি গান্ডু এতই স্পর্শকাতর যে কিছু বোঝার আগেই হুরমুরিয়ে হল্লা করো আবার টোকা মারলেই লজ্জাবতীর মতন ঝুপঝুপিয়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলো , শালা বেজম্মা স্বার্থপর কোথাকার ! খাদ্য আন্দোলনের নজরুল কে ভুলে গেছো , ভুলে গেছো ভিকারী পাসওয়ান কেও ! নন্দীগ্রাম ভুলিয়ে দিতে কতদিন লাগলো ? কামদুনি আরো তাড়াতাড়ি ভুলবে, হ্যাঁ। এত আত্ম্যহত্যা গাপ করে দিলে, হুঃ , সত্তরের এত যুবকের লাশ গুম করে দিলে আর এই রেপ্ড হওয়া মুখগুলো ভোলাতে পারবে না , আলবাত পারবে। ওই দেখো কাতারে কাতারে রোমান সেনারা ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে এগিয়ে আসছে।

গোটা শহর বিশ্বকাপ দেখতে মশগুল আর ওদিকে বাড়ির আইবুড়ো কিম্বা এয়রা রাস্তার সৈনিকদের হাতে ধর্ষিত হচ্ছে । ধর্ষিতা মেয়েটিকে সমাজ বলছে যে সব ঠিক হয়ে যাবে , সময়টাই এরকম, কটা দিন যাক দেখবি সব্বাই কেমন ভুলে গেছে ! ” নবুদা ঘুমিয়ে পড়েছে।দেখলাম সত্যি সত্যি ভোর হচ্ছে , পূব দিকে আলো আস্তে আস্তে ফুটছে। ইতিমধ্যে প্লাস্টিকে রাখা বাদাম তক্তিতে পিপড়েরা রোমান সৈনিকদের মতন আধিপত্য বিস্তার করেছে আর পাপড়ভাজা গুলো কিরকম রেপ্ড হওয়া ফেসলেস জীবেদের মতো নেতিয়ে পরে আছে !!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

আবিষ্কার

১ ‘ টুবলু, টুবলু, টুবলু উ উ উ ‘ মার গলা, অনেকক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছি। …

সরল ও হাতি

সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে…

পুষুর দুঃস্বপ্ন

আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো মধুভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে পুষুর দু চোখ চকচকিয়ে উঠলো। ‘কি…