নেমামা ভাগনে

তিমকড়ি পাল আর ভজহরি দত্ত মামা ভাগনে।মামা ভাগনে হলে ওদের বয়সের বেশী তফাৎ বেশী নয়। ছেলাবেলা থেকে এক বাড়িতে মানুষ।এক সঙ্গে শোয়া-বসা।তিনকুলে কেউ নেই । আপনার বলতে মামার ঐ ভাগনে,আর ভগনের ঐ মামা।তিন কড়ির বাবা হাজার কয়েক নগদ টাকা রেখে গিয়াছে;আর ভজ হরির বাবা দিয়া গেছেন কয়েক বিঘা ধানের জমি।দুটো মিলে ওদের এত দিন চলে যেত।এখন আর চলতে চাই না।ভজহরির ইচ্ছা কলকাতায় গিয়া চাকরি-বাকরির চেষ্টা করা।তিনকড়ির মন সায় দেয় না।ভজহরি সেটা জানে,মাঝে মাঝে বলে-যেতে কি আমার ইচ্ছে,মামা?কিন্তু কি করি? বসে বসে খেলে ঐ টাকা আর কদিন?তার পর ক্ষেতগুলোতে ফসল ভাল হচ্ছে না।দুটো পেট তো চালাতে হবে।তিনকড়ি ভাবতে থাকে।অনেকক্ষন ধরে তামাক টানে।তার পর জবাব দেয়-যাবি যা!আমার আর আপত্তি কি?সন্ধেবেলা একহাত দাবা না হলে যে রাত্তিরে ঘুম হয় না।এই যা মুস্কিল।বদ অভ্যাস হয়ে গেল কি না।ভজহরি বলে-কেন,বিপিনদাকে বলে দেবো।রোজ এসে বসবে তোমার সঙ্গে।তিনকড়ি রুখে উঠল-কি বল্লি।বিপণে খেলবে দাবা!দ্যাখ ভজা,অনেক কষ্ট করে তোকে খেলাশিখিয়েছিলাম।এবার বুঝতে পারছি সে সব টাই আমার পশুশ্রম।কাজেই ভজহরির আর চাকুরি করা চলে না।শেষটায় দু,জনে মিলে অনেক পরামর্শ করে স্থির হল-একটা ব্যাবসা করা যাবে।কিন্তু ব্যাবসা মানেই তো ছোটাছুটি ঘোরাঘুরি।বাজারে ঘুরে ঘুরে মাল কেনা।চাপাও গাড়িতে,রেলে বুক কর।আবার আসে ডেলিভারি দাও।দেখবে আর্দ্ধের পথেই উড়ে গেছে।ঝকমারির একশেষ।কাজেই এমন ব্যবসা বেছে নিতে হবে যেটা ঘরে বসে চলে।ভজহরি বলল,একটা পল্টি ফার্ম করা যাক মামা।একবার শুধু গিয়ে কতগুলো হাঁস-মুরগী এনে মাঠে ছেড়ে দেওয়া।ব্যস তার পর আর ভাবনা নেই।ডিম আসতে থাকবে ঘরে বসে বিক্রি কর।
পোল্টী খোলা হল।দুটো বড় লেগহর্ণ মোরগ এল।তিন কড়ি তাদের নাম রাখল ভৈরব আর রুদ্র।মুরগী এল একপাল।তাদের ও নাম করন হল,কালী তারা,গৌরি কল্যাণী ইত্যাদি।খাটা পত্র লিখবার জন্য কেরানি এল দুজন,আর মুরগী চালনার জন্য ছোকরা চার জন চারেক।মালের ঘর তৈরি হল সারি সারি।মুরগীর খাবার মজুত করার জন্য তৈরি হল গুদাম।মাসের শেষে দেখাগেল,হিসাবের খাতায় ডানদিকের অংকের খাতা গেছে ভরে।বা দিক টা প্রায় ফাঁকা,অথ্যাৎ মুরগীগুলো বামুনের গরুর ঠিক উল্টো।চরে খুব,খায় তার চেয়েও বেশী।ডিম ডেয় কম।আর দেখাগেল ওগুলোকে খাওয়ানোর চেয়ে খাওয়ার দিকেই চাকরদের ঝোঁক বেশী।আরও মাস খানেক পড়ে এল এক মহামারি।পল্টি ফাম করে বারে ফর্সা।রইল শুধু ভৈরব,ভৈরব হুঙ্কার ছাড়ে সকাল সন্ধ্যা মামা-ভাগনে কান ঝালাপালা করে দেবার জন্য।তিনকড়ি বলল-তোর কথা শুনেই তো এত গুলো টাকা জলে গেল।হিন্দুরা ছেলে,মুরগী পুষবি।ধর্মে সইবে কেন?তার চেয়ে এক কাজ করো শুয়ারের ব্যাবসা কর।
ভজহরি অবাক হয়ে বলল-শুয়র!
হ্যাঁ,শুয়র।বছরে তিন বার বাচ্চা দেবে,ফিরে বারে এক ঝাক।কথায় বলে শুয়ুরের পাল।
তার পর সে শুয়িরের পাল দয়া কি করব?
কেন দেশ বিদেশে চালান দেব।ইংল্যান্ড,ফ্রান্স,জার্মানি।ওরা যে সব হ্যাম বলতে অজ্ঞান।হ্যাম মানে জানিস তো?শুয়রের মাংস।
শ,পাচেক টাকা পকেটে করে ভজহরি বেরোল হরিজন পাড়ায় শুয়রের খোঁজে।রাস্তায় এক যায়গায় তার রিকস গেল থেমে।ভীষন ভিড়।কি ব্যাপার?মস্ত বড় জ্যোতিষী এসেছেন একজন।হাত দেখে কিংবা ঠিকুজিতে চোখ বুলিয়ে তার ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে।কিসে কার কপাল খুলবে,আর কবে কার কপাল পুড়বে,সব তার ঠোটের ডগায়।ভজহরি ঢুকে পড়ল।শুয়রের কারবার টা তার পছন্দ কি না।কি জানি কি হয়।হাতটা একবার দেখানোই যাক না।জ্যোতিষী মামা-ভাগনের আগাগোঁড়া ইতিহাস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলেন,আর শুনলেন তাদের নতুন প্ল্যান।তার পর হাত দেখে বললেন কিছু করতে হবে না।পড়ে জাওয়া ধন লেখা আছে তোমার কপালে।রাতারাতি বড়োলোক হয়ে যাবে।তোমার মামাকে একদিন নিয়ে এস।তিনকড়ি কিন্তু আসটে রাজি হল না।অনেক বলা কবার পর ঠিকুজিটা পাঠিয়ে দিল।জ্যোতিষী অনেকক্ষণ ধরে সেটা দেখলেন, কি সব অঙ্ক কষলেন, তার পর আস্তে আস্তে গুটিয়ে,ফিরিয়ে দিলেন ভজহরির হাতে।
কি দেখলেন ঠাকুর?
বড় খারাপ খবর-শুকনো মুখে বললেন জ্যোতিষিকে।
খারাপ খবর? ভজহরির মুখে আর কথা শুনল না।জ্যোতিষী গভীর ভাবে বললেন-মৃত্যযোগ রয়েছে তোমার মামারএক বছরের মধ্যে উনি মারা যাবেন।
ভজহরি চলে যাচ্ছিল।ইশারা করে পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন জ্যোতিষী ঠাকুর।অনেকক্ষন ধরে দুজনের মধ্যে কি আলাপ হল,মামার খবর শুনে যে রকম দূরচিন্তা ফুটে উথেছিল ভজহরির মুখে,জাবার সময় দেখা গেল,তার কোন চিহ্ন নেই।এক বছরের মধ্যে মৃত্য।খবর শোনার পর তিনকড়ি দিন কয়েক মনমরা হয়ে উঠল।তারপর হঠাৎ বেপরোয়া ফুত্তি শুরু করে দিল।আজ গানের জলসা কাল নাচের জলসা পরশু ভোজন,তার পর দিন তুবড়ি কমপিঁটিশন কি হবে টাকা দিয়ে?এক বছর তো পরমায়ু।ভজহরি ভাবনায় পড়ল।অনেক ভেবে চিনতে শেষটায় একদিন সন্ধ্যেবেলা দাবার ছক পেতে বসল-একটা কথা বলব,মামা।বল না কি বলবি।তুমি তো মরতে চলেছ,আমাকে মেরে রেখে দিয়ে কি লাভ?
একটা উপকার করে যাও।বছরে বছরে ঘতা করে তোমার শ্রাদ্ধ করব।আত্নার তৃপ্তি হবে।
কি করিতে বলিস।
একটা লাইফ ইনসিওর করে যাও তমার নামে,-বলে ভজহরি মামার হাত দুটো জড়িয়ে ধরল।তোমার তো আর কেউ নেই।মামার পর টাকাটা আমিই পাব।কথাটা তিন কড়ির মনে লাগল।সত্যিই ভজাটার চলবে কেমন করে?একটু উপকার তার করা উচিৎ।
ইনসিওরেসের দালাল জ্যোতিষীর জানা লোক।খবর পাওয়া মাত্র তিনকড়ির নামে পঞ্চাশ হাজার টাকার জীবন বিমা করে গেল।প্রিমিয়ম দিতে হবে তিন মাস অন্তর সাত শ টাকা করে।ভজহরির চোখদুটো জল জল করে উঠল।আত-ন মাস যায়।তিনকড়ি বলল-আর কদিন?চল ভজা,একটু তীর্থধর্ম্মো করে আসি। তাই চল মামা,
অনেক তির্থঘোরা হল।হৃষীকেশ, লছমণঝোলা হরিদ্বার থেকে আরভম্ভ করে পুরী,রামেরশ্বর পর্যন্ত।মতো বড় একটা চক্কর দিয়ে ওরা ফিরে এল এবং গয়ায় এবং বাড়ি ভাড়া করে ঐখানে রয়ে গেল।
তিনকড়ি বলল- এখানেই থাকি,কি বলিস ভজা?সব হয়ে টয়ে গেলে পিণ্ডীটা বাড়ি চলে যাস।
কিন্তু এ কি হল।বছর পার হয়ে চৌদ্দমাস কেটে যায়।মৃত্য যোগের কোনো লক্ষন তো দেখা যাচ্ছে না।বরং শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে তিনকড়ি দিব্যি শশিকলার মতো দিন দিন বেড়ে উঠতে লাগল।তিনকড়ির ওসব খেয়াল নেই।রোজ মন্দিরে যায়,জপতপ করে সাধু-সন্ন্যাসির কাছে বসে দুটো ধর্মের কথা শুনি।
এমনি সময় একদিন ফলগুনদীর ঘটে জ্যোতিষীর সঙ্গে ভজহরির দেখা।ভজহরি ছুটে গিয়ে তার গলা ধরে গর্জ্জে উঠল-তোমাকে পুলিশে দেব যোচ্চর কোথাকার।
জ্যোতিষী কোনরকমে নিজেকে ছাড়িয়ে নরম হয়ে বলল,আহা চটছ কেন?একটু ফাকায় চল।সব বলছি।
ভজহরি চোখ পাকিয়ে বলল-বলবে আমার মাথা আর তোমার মুণ্ডু।পনেরো মাস কেটে গেছে।খরব রাখ হাতে একটা পয়সা নাই।জ্যোতিষী বলল-কি করব,ভাই!একটুখানি হিসবের ভুল হয়ে গেছে।আর দেরি নেই।তিন চার দিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
সপ্তাহ এক দিন করে তিনকড়ি বুদ্ধগয়ার মন্দ্রিরে যেত।সকালে গিয়া ফিরত সন্ধ্যায়।এবার সে গেল, আর ফিরল না।তার বদলে এল তার মৃত্য সার্টিফিকেট-পাশ করা ডাক্তারের সই করা।তাতে লেখা আছে-বৃদ্ধগয়ার পাশে ধ্যান করতে গিয়ে হঠাৎ
সন্ন্যাসি রোগে তিনকড়ি পালের মৃত্য হয়েছে।জন চারেক সাক্ষি পাওয়া গেল যারা বলল,শব তারাই গিয়া দাহ করেছে বুদ্ধগয়ার শ্বশানে।
মফঃস্বল সহর।তার মধ্যে সব চেয়ে যেটা সেরা বাড়ি,তার ফটকের দেয়ালের বা দিকে লেখা-ভজহরি দত্ত জ্যোতিষীর সঙ্গে ভাগে কারবার চলেছে ভজহরির একখানা রেশনের দোকান,দুখানা বাস আর খান তিনেক মাল-লরি।সন্ধ্যার পড়ে আগেকার মতো দাবার আসর বসে।অনেক রাত পর্যন্ত তামাক-সিকারেট পোড়ে।কেটলি কেটলি চা আর ঝুড়ি ঝুড়ি চপ-কাটলেট উড়ে যায়।বছর খানেক পরের কথা।দাবার আড্ডা জমে উঠেছে।সদর দরজায় কার গলা শোনা গেল-ভজহরি আছে?
সবাই চমকে উঠল।সারা দেবার মতো সুর ফুটল না।একজন গেরুয়া পড়া সন্ন্যাসি ধীরে ধীরে বাড়ির ভিতরে এসে দাঁড়াল।পলকের মধ্যে যে যেখানে ছিল একে বারে সাফ,শুধু রইল ভজহরি।আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,একি,তুমি।

সন্ন্যাসীর মুখে হাসি ফুটে উঠল-বড্ড অবাক হয়ে গ্যাছ না?একটু থেমে আবার বলল, মনে করে ছিল গুণ্ডার হাত থেকে লোকটা ফিরে এল কি করে?কিন্তু গুন্ডাগুলো তোর চেয়ে অনেক ভাল।তারা আমাকে মারেনি।এক বছর খাইয়ে পরিয়ে বাছিয়ে রেখেছে।ভজহরি বলল,-কিন্তু মামা,তুমি তো বেঁচে নেই।তার মানে?গর্জে উঠল তিনকড়ি।
তার মানে,তুমি মরে গ্যাছ।আইনের চোখে ইনসিওর কোম্পানির কাগজে পত্তরে লেখা তুমি মৃত। মৃত!আছ,দেখি তুমি জিবিত থাক কি করে?
হনহন করে বেরিয়ে গেল তিনকড়ি।ভজহরি পেছন পেছন ছুটল-শোনো মামা,শোনো মামা।তিনকড়ি ততক্ষণ থানার পথে।
তিনকড়ি পাল আর ভজহরি দত্ত।এক কালে তারা এক বাড়িতে মানুষ হয়ে ছিল।আজও তারা এক বাড়িতে বাশ করে।সে বাড়ির নাম জেলখানা।ভজহরি ডাল ভাঙ্গে,আর তিনকড়ি চালায় তাঁত।জ্যোতিষী ঠাকুর ফেরার।পুলিশ এখনও তাদের খোঁজ করছে।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!