আমরা একটা মরুদ্যানে তাঁবু ফেলেছি। সঙ্গীরা সবাই ঘুমিয়ে। সাদা আলখাল্লা পরা এক দীর্ঘকায় আরব আমার পাশ কাটিয়ে গেল। লোকটা ওর উট দেখাশোনা করছিল এতক্ষণ। এখন ঘুমাতে যাচ্ছে।
ঘাসের উপর পিঠটা এলিয়ে দিলাম। আমারও ঘুমাতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু পেরে উঠছি না। দূর থেকে মরু নেকড়ের প্রলম্বিত গোঙানির গা-শিউরানো সঙ্গীত ভেসে আসছে। আমি উঠে বসলাম আবার। এতক্ষণ যা কত দূরে মনে হচ্ছিল, সেটাই এখন হঠাৎ খুবই কাছে মনে হচ্ছে। গাদাগাদি করে একটা নেকড়ের পাল আমাকে ঘিরে ধরেছে। অন্ধকারের মধ্যে তাদের চোখগুলি ঘোলাটে সোনালি আভায় দপদপ করে জ্বলছে-নিভছে। তাদের সরু হিলহিলে দেহগুলি যেন কোন চাবুকের তাড়নায় ক্ষিপ্র ছন্দে নড়চড়া করছে।
ওগুলোরই একজন পিছন দিক থেকে এসে ঠেলাধাক্কা দিয়ে আমার বগলের তলায় ঢুকে পড়ল, যেন আমার শরীরে ওম খুঁজছে। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো, আর কথা বলে উঠল চোখে চোখ রেখে।
“বহু বহু যোজন এলাকার মধ্যে আমিই প্রবীণতম নেকড়ে। তারপরও আপনাকে এখানে স্বাগত জানাতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত আজ । প্রায় অনাদিকাল ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমরা প্রায় আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার মা আপনার আগমনের জন্য অপেক্ষা করেছেন, তার মা-ও করেছেন, তাদের পূর্বসূরী সমস্ত মা-রাই আপনার পথ চেয়ে থেকেছেন, একেবারে সমস্ত নেকড়েকুলের সেই আদিমাতা পর্যন্ত। বিশ্বাস করুন!
“আশ্চর্য তো,” নেকড়েদের দূরে রাখার জন্য সামনে রাখা লাকড়ির স্তুপে আগুন দিতে ভুলে গিয়ে বলে উঠলাম, “আমি সত্যি অবাক হচ্ছি একথা শুনে। আমি সুদূর উত্তর গোলার্ধ থেকে নেহাতই ঘটনাচক্রে এক সংক্ষিপ্ত সফরে এসে পড়েছি এখানে। তো, তোমরা নেকড়েরা কি চাও শুনি?”
এই আলাপচারিতায় – যা বোধহয় একটু বেশি বন্ধুসুলভ হয়ে গেছিল –তাতে উৎসাহিত হয়েই যেন নেকড়েগুলি হাঁফাতে হাঁফাতে আর দাঁত খিচাতে খিঁচাতে তাদের বৃত্ত আরও ছোট করে আনল আমাকে ঘিরে।
“আমরা জানি,” বুড়ো নেকড়েটা আবার শুরু করল, “আপনি উত্তরের দেশ থেকে এসেছেন। আমাদের সমস্ত আশা-ভরসা ঠিক এখানেই। উত্তরের মানুষদের মত বোধশক্তি এখানকার আরবদের মধ্যে নাই। এদের শীতল ঔদ্ধত্য ভেদ করে কাণ্ডজ্ঞানের একটা ফুলকি পর্যন্ত দেখা যায় না। এরা পশুহত্যা করে খাওয়ার জন্য, অথচ তারা ঐ পশুর পচা শবের ধারে-কাছেও ঘেঁষে নাএত চেঁচিও না,” আমি বলি। “কাছাকাছি অনেক আরব ঘুমিয়ে আছে।
আপনি আসলেই এখানে নতুন। নয়তো জানতেন, পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোন নেকড়ে কোন আরবকে ভয় পায়নি। আমাদের কি ওদের ভয় পাওয়া উচিৎ? এই ধরণের লোকদের মাঝে আমাদেরকে যে নির্বাসন দণ্ড দেয়া হয়েছে – সেটাই কি যথেষ্ট দূর্ভাগ্য নয়?”
হয়তো… হতে পারে…” আমি বলি। “আসলে এ বিষয়ে আমি এত কম জানি যে এ ব্যাপারে কোনরকম মতামত দেয়ার যোগ্যতাই আমার নেই। তবে এটা মনে হচ্ছে খুব পুরনো একটা ঝগড়া – যা বোধহয় রক্তের মধ্যেই আছে – আর এর শেষও হবে হয়তো সেই রক্তেই।
আপনি দারুন বুদ্ধিমান,” বুড়ো নেকড়েটা বলে উঠে, আর তারপর তারা সবাই মিলে একযোগে আরও দ্রুত হাঁফাতে লাগে, ফুসফুস থেকে ফোঁস ফোঁস করে বেরুতে থাকে শ্বাস। একটা বিশ্রী দুর্গন্ধ ভুর ভুর করে বেরিয়ে আসতে থাকে ওদের খোলা মুখ দিয়ে – যা একেক সময় স্রেফ দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হয়েছে আমাকে। “আপনি ভীষণ বুদ্ধিমান। আপনার কথা আমাদের পুরাণের সাথে মিলে যায়। সুতরাং এখন আমাদের কাজ হল – ওদের রক্ত নেয়া। ব্যস্, তাহলেই সব দ্বন্দ্বের অবসান।
উঁহু,” যতটুকু চেয়েছিলাম তার চেয়েও তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে উঠি, “ওরা আত্নরক্ষায় বিন্দুমাত্র পিছপা হবে না। ওরা ওদের বন্দুক দিয়ে তোমাদের পালে-পালে গুলি করে মারবে।
আপনি আমাদের বুঝতে পারেননি,” বুড়ো নেকড়েটা বলে উঠে, “অবশ্য এটা মানুষ প্রজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যা থেকে তারা আজও মুক্ত হতে পারেনি। এমনকি সুদূর উত্তরের মানুষরাও না। আমরা আরবদের মারতে যাচ্ছি না! তাহলে আমাদের ধুয়ে পরিষ্কার করার জন্য নীলনদের সমস্ত পানিও যথেষ্ট হবে না। ওদের জীবন্ত দেহগুলির স্রেফ দর্শনটুকুই আমাদের ঊর্ধ্বশ্বাসে বিশুদ্ধ বাতাসে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে, বাধ্য করে মরুভূমির ভিতর চলে যেতে। ঠিক এই কারনেই তো মরুভূমি আমাদের ঠিকানা।” আমাদের ঘিরে থাকা সব নেকড়েগুলি – আর ইতিমধ্যে আরও অনেকগুলি দূর থেকে এসে হাজির হয়েছে – তাদের মাথা সামনের দু’পায়ের ফাঁকে নামিয়ে এনে নিজেদের থাবা দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগল। মনে হচ্ছিল ওরা এত প্রচণ্ড একটা বিতৃষ্ণা লুকাতে চাচ্ছে যে, যা দেখলে আমি হয়তো বিশাল একটা লাফ দিয়ে ওদের ঘেরাওটা টপকে পালিয়ে যেতাম।
তো, তোমরা কি করতে চাও?” আমি জানতে চাই। আমি উঠে দাঁড়াতে চাইলাম, কিন্তু পারলাম না। দু’টি যুবক নেকড়ে আমার জ্যাকেট আর শার্ট কামড়ে ধরে আমাকে পিছন থেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। বসে থাকতে বাধ্য হলাম আমি।
ওরা আপনার পিছন দিকে মাটিতে লুটানো পোশাকের প্রান্ত তুলে ধরে আছে,” গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে ব্যাখ্যা দিল বুড়ো নেকড়ে, “এটা সম্মান প্রদর্শনের একটা কেতা।
ওদের বল আমাকে ছেড়ে দিতে,” বুড়া আর ছোড়াগুলির মধ্যে মোচড় খেতে খেতে আমি চেঁচিয়ে উঠি।
অবশ্যই ওরা ছেড়ে দিবে,” বুড়ো নেকড়ে আবার বলে, “আপনি যদি তাই চান। কিন্তু তাতে একটু সময় লাগবে। কারন আমাদের যেমন স্বভাব, ওরা ওদের দাঁত অনেক গভীরে বসিয়ে দিয়েছে। ফলে এখন ওদের চোয়ালগুলি আগে ধীরে ধীরে খুলতে হবে। তো, ততক্ষণে বরং আমাদের আর্জিটা একটু শুনে নিন।
তোমাদের আচরণ আমার মধ্যে তোমাদের প্রতি খুব একটা সহানুভূতি জাগাচ্ছে না,” আমি জবাব দেই।
আমাদের আনাড়িপনার জন্য আমাদের শাস্তি দিবেন না দয়া করে,” এই প্রথমবারের মত বুড়োটা তাদের স্বাভাবিক কণ্ঠের মিনতিমাখা ভঙ্গিটা কাজে লাগায়। “আমরা অসহায় প্রাণী – দাঁতই আমাদের একমাত্র সম্বল। আমরা যা-ই করতে চাই না কেন – ভাল কিম্বা মন্দ – দাঁত ছাড়া আমাদের আর কোন গতি নাই।
তো, তোমরা চাচ্ছটা কি?” একটুখানি আশ্বস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করি।
হে মহাত্নন,” বুড়োটা চেঁচিয়ে উঠে, আর তার সাথে তাল মিলিয়ে বাকিগুলিও সব কোরাসে ডাক ছাড়ে। ওদের ডাকে খুব সুক্ষভাবে হলেও কোথায় যেন একটা সু্রের ছায়া খুঁজে পাই আমি। “হে মহদাশয় মহামহিম, পৃথিবীটাকে যে বিবাদ দু’ভাগে বিভাজিত করে রেখেছে আপনি সেই বিভেদ শেষ করে দিন। আমাদের পূর্বসুরীরা আপনার মতই এক মানুষের কথা বলে গেছেন যিনি এই মহান কর্মটি সম্পন্ন করবেন। আমরা আরবদের থেকে মুক্তি চাই – যাতে নিঃশ্বাস নেয়ার মত নির্মল বাতাস পাই, আমাদের চারপাশে আরবমুক্ত পরিষ্কার দিগন্তের দৃশ্য দেখতে পাই। আর যেন কোন আরবের ছুরির পোঁচে কোন ভেড়ার মরণচিৎকার শুনতে না হয়। প্রতিটি পশু যেন শান্তিপূর্ণ ভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার অধিকার পায়। তাদের অস্পর্শিত মৃতদেহ যেন নির্বিঘ্নে পড়ে থাকার সুযোগ পায় – যাতে আমরাও তাদের হাড়গোড় থেকে সমস্ত রক্তমাংস নিখুঁত ভাবে পরিষ্কার করে ফেলার সুযোগ পাই। পরিচ্ছন্নতা – হ্যাঁ, এটাই আমাদের আদর্শ – নিষ্কলুষ পরিচ্ছন্নতা।
এই পর্যায়ে এসে নেকড়েগুলি সব কাঁদতে থাকে, ফোঁপাতে থাকে। “আপনি কি করে এসব সহ্য করেন, হে মহান হৃদয় সুমিষ্ট নাড়িভুড়িবান? এই আরবগুলির পোশাক-আশাক কি ভীষণ নোংরা, কি বিকট তাদের দাড়ি। ওদের চোখের কোনগুলি দেখলে মুখ ভরে থুতু আসে। আর ওরা যদি ওদের হাত উপরে তুলে – ওদের বগলের তলায় তখন দোযখের দরজা খুলে যায়। আর সে জন্যেই, হে মহাত্না, সেজন্যেই জনাব, আপনার সর্বশক্তিমান দু’টি হাতের সহায়তায় এই কাঁচিটি দিয়ে ওদের কণ্ঠনালি ছিন্ন করে ফেলুন।”
বুড়ো নেকড়েটা তার মাথা ঝাঁকাতেই আরেকটা নেকড়ে পুরনো মরচে পড়া একটা ছোট কাপড় কাটার কাঁচি তার শ্বদন্তে ঝুলিয়ে হাজির হয়।
আচ্ছা! অবশেষে কাঁচি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তাহলে। যথেষ্ট হয়েছে – এখন থামানো দরকার!” আমাদের কাফেলার আরব নেতাটা উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল। বাতাসের উল্টোদিক থেকে কোন ফাঁকে যেন ও চুপিসারে আমাদের কাছে চলে এসেছে। কথা বলতে বলতে সে তার বিশাল চাবুকটা সপাং সপাং করে ঘুরাতে শুরু করল।
নেকড়েগুলি সব দৌঁড়ে পালালো, তবে কিছুদূর গিয়ে আবার গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে রইলো। তাদের অনেকে পরস্পরের সাথে এতই লেপ্টে আর আড়ষ্ট হয়ে ছিল যে মনে হচ্ছিল তারা যেন একটা ছোট্ট খাঁচায় আটকে আছে আর চারপাশে আলেয়া উড়ে বেড়াচ্ছে।
তা, আপনিও শেষ পর্যন্ত নাটকটা দেখলেন,” আরবদের মিতভাষিতার মধ্যেই যতটুকু সম্ভব সানন্দে হাসতে হাসতে বলল আমাদের আরবটা।
তাহলে তুমিও জান নেকড়েগুলি কি চায়?” আমি জিজ্ঞেস করি।নিশ্চয়ই স্যার। এটা সবাই জানে। যতদিন আরবরা আছে, এই কাঁচিটা আমাদের পিছে পিছে মরুভূমিময় ঘুরতে থাকবে – একদম কেয়ামত পর্যন্ত। প্রতিটি ইউরোপীয়কে তাই ওরা এই একই মহৎ কাজ করার প্রস্তাব দেয়। ইউরোপীয় দেখামাত্রই ওরা মনে করে ঠিক সে-ই এই কাজ করার জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি। এই জানোয়ারগুলির এটা এক উদ্ভট আশা। আস্ত গাধা এগুলি। আর এজন্যেই তো এদের এত পছন্দ আমাদের। এরা আমাদের কুত্তা, আপনাদেরগুলির চেয়েও অনেক ভাল। এখন এটা দেখেন। রাতে একটা উট মারা গেছে – আমি ওটাকে এখানে আনিয়েছি।
চারজন বাহক উটের ভারি শবটা বয়ে নিয়ে এসে ঠিক আমাদের সামনে ছুঁড়ে ফেলল। শবটা মাটিতে পড়তে না পড়তে নেকড়েগুলির গলার আওয়াজ চড়ে গেল। কোন এক অপ্রতিরোধ্য দড়ির টানে যেন প্রত্যেকটা নেকড়ে গুড়ি মেরে, মাটি ঘষটে এগিয়ে আসতে থাকল। তারা ভুলে গেছে আরবদের, ভুলে গেছে তাদের ঘৃণা। প্রচণ্ড দুর্গন্ধময় একটা শবের উপস্থিতি তাদের সবকিছু ভুলিয়ে দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছে। এদের মধ্যে একটা নেকড়ে ইতিমধ্যে উটটার কণ্ঠনালি ধরে ঝুলে পড়েছে আর প্রথম কামড়েই দাঁত বসিয়ে দিয়েছে ধমনিতে। বেসামাল আগুন নেভাতে ব্যর্থ আক্রোশে গর্জানো একটা ছোট্ট পাম্পের মতই তার শরীরের প্রতিটি পেশী কিলবিলিয়ে উঠছে। তারপর দেখা গেল বাকিগুলিও সব চোখের পলকে শবটার উপর চড়াও হয়ে একই কাজ শুরু করে দিয়েছে – যেন একটা ছোট-খাটো পাহাড় গজিয়ে গেছে উটটার উপর।
কাফেলার আরব দলনেতা এবার তার ধারালো চাবুকটা সপাং সপাং করে নেকড়েগুলির উপরে চারপাশে চালাতে লাগল। মাতালের মত অর্ধচেতন অবস্থায় নেকড়েগুলি মাথা তুলে, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আরবটাকে দেখে, মুখের উপর চাবুকের বাড়ি টের পায়, তারপর লাফ দিয়ে নেমে এক দৌড়ে কিছুটা দূরে সরে যায়। কিন্তু উটের রক্তে ওখানে ততক্ষণে একটা পুকুর জমে গেছে, দুর্গন্ধে ডুবিয়ে দিয়েছে বিশ্বচরাচর। মড়িটা বেশ কয়েক জায়গায় ছিড়ে বিশাল ফাঁক করে ফেলা হয়েছে। নেকড়েগুলি আর লোভ সামলাতে পারে না। তারা আবার এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আরব দলপতিটা আবারও তার চাবুক তুলে। এবার আমি তার হাত ধরে ফেললাম।
আপনার কথাই ঠিক স্যার,” সে বলে। “ওদের জীবনের যা লক্ষ্য তাই ওরা করুক গে। তাছাড়া, আমাদের তাঁবু গুটিয়ে ফেলারও সময় হয়ে গেছে। আপনি ওদের দেখেছেন। চমৎকার প্রাণী, তাই না? আর কি ঘৃণাই না আমাদের করে!