নীল হাতি–নুজহাত আয়েশা

 

বড়মামা ফোন দিয়েছেন।  ‘জন্মদিনে তোমার কী চাই মা?’

-‘কিচ্ছু লাগবে না মামা।’

-‘তোমার কী পছন্দ তাই বল।’

-‘আমার তো সবচেয়ে ভালো লাগে গল্পের বই।’

-‘বাহ্‌! এটা তো অনেক ভালো কথা!’

নীতু অনেক খুশি হয়! মা-বাবা ছাড়া অন্য কারও কাছে কিছু চাওয়া ঠিক না, এটা ওকে মা শিখিয়ে দিয়েছেন। নীতু নিজ থেকে কিছু চায় না কারও কাছে। শুধু জানিয়ে দেয় বই তার খুব পছন্দ। মা অবশ্য বেশি বই কিনে দিতে চান না। প্রতি মাসে একটা পিচ্চি বই, যেটা কি না এক বসাতেই শেষ হয়ে যায়! অথচ নীতুর ইচ্ছা করে প্রতিদিন কয়েকটা বই পড়ে ফেলতে। এবার নিশ্চয়ই মামার কাছ থেকে অনেক বই পাওয়া যাবে!

বই যে কত ভালো একটা বন্ধু কেউ বুঝতেই চায় না। বইয়ের মধ্য দিয়ে সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে কত দূরে ঘুরে আসা যায়! ঘরে বসে থেকেই কত শত রাজপুত্র রাজকন্যার সঙ্গে গল্প করে ফেলা যায়। উফ্‌! ঠাকুরমার ঝুলির গল্পগুলো এতো দারুণ! ডালিমকুমার আর ক্ষীরের পুতুল! লম্বা নাকের পিনোকিও আর দুঃখী ভাই বোন হানসেল-গ্রেটেল! চাচা চৌধুরী আর সাবুর গল্প আর টিনটিন! কিংবা সুকুমার রায়ের মজার মজার ছড়া! বন, পাহাড়, সমুদ্র, মরুভূমি, সব দেখে আসা যায় বই এর মধ্য দিয়ে। পাতালপুরীর দৈত্য দানোর সঙ্গে লড়াই করে রাজকন্যাকে উদ্ধার করা যায়! কিংবা চুপি চুপি সেই রাজকন্যা কিংবা ডালিম কুমারের সঙ্গে মনের দুঃখের কথা বলে ফেলা যায়!

অথচ সবাই এই বইগুলোকে আউট বই বলে। মা বলেন, আউট বই পড়তে হয় ক্লাসের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে। কিন্তু মা তো সারাদিন ক্লাসের পড়াই পড়াতে চান। শেষ করে ফেললেও রিভিশন দিতে বলেন। অন্য বই পড়ার সময়টাই দেন না। এখন পরীক্ষা শেষ। এই কয়েকটা দিন কত কত গল্পের বই পড়ে ফেলা যেত! মা অবশ্য এই সময় সামনের ক্লাসের বই এনে জোর করে পড়ানো শুরু করে দিবেন।

হই হট্টগোল করে নীতুর জন্মদিন গেল। বড়মামা একটা বিশাল বড় খেলনা হাতি এনেছেন। তুলতুলে নীল হাতি।

জন্মদিনের পরদিন নীতু মন খারাপ করে তার বিশাল বড় পুতুল হাতিটাকে ধরে বসে আছে। হাতিটা এত্ত বড়! নীতুর সমান প্রায়। হুমায়ুন আহমেদের নীল হাতি গল্পের হাতিটার চেয়েও সুন্দর। যদিও নীতুর হাতিটা কথা বলতে পারে না, তারপরেও। এত সুন্দর উপহার পেয়েও ওর কেন যেন ভালো লাগছে না। নীল হাতিটার দিকে তাকিয়ে নীতু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। এই হাতিটার দামে ৩০টা বই তো হয়েই যেত। ও তো ৫টা বই হলেই খুশি ছিল। মামা কেন জিজ্ঞেস করার পরও বই না দিয়ে এই পুতুল দিল?

নীতুর পুরানো গল্পের বই হলেও চলে, বই জিনিসটা পুরানো হলেও খুব একটা খারাপ লাগে না। কিন্তু মা বেশি পড়তে দিতে চান না। মা বলেন পাঠ্যবই পড়তে হয় বারবার, গল্পের বই একবার পড়লেই হয়। বারবার পড়ে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।

মা আগে গল্পের বই পড়তেই দিতে চাইতেন না। পেরেন্টস ডে তে, ক্লাসের মিস গল্পের বই পড়া নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন। নানান ধরনের বই পড়ার ফলে বাচ্চাদের সাধারণ জ্ঞান বাড়ে, বাচ্চারা অনেক কিছু শিখতে পারে। বাচ্চাদের সুস্থ বিনোদনের অন্যতম উপায় হচ্ছে বই পড়া। এরপরে মা একটু একটু দেন, কিন্তু খুব সাবধানে, যেন বেশি বাইরের বই পড়ে মাথা থেকে পড়ার জিনিস না সড়ে যায়!

নীতু তবুও হাল ছেড়ে দেয় না। প্রায়ই পুরানো বই নিয়ে বসে।

আজকেও ঠাকুরমার ঝুলি নিয়ে বসেছিল। মা বলে গেছেন সামনের ক্লাসের পড়া শুরু করে দিতে হবে এখনই। ক্লাস ফাইভের পড়া নাকি অনেক কঠিন!

নীতুর মন আরও খারাপ হয়ে গেল। ক্লাসের বইগুলোও যে কম মজার তা নয়। কিন্তু মজা নিয়ে পড়ার সুযোগ মা কিছুতেই দেন না। নীতু যদি সেগুলো নিয়ে আলোচনা করে বা বিজ্ঞানের কিছু পরীক্ষা করতে যায় মা খুব রেগে যান। বলেন,

– ‘এইসব করে সময় নষ্ট করো না নিতু, মুখস্থ করে ফেল যেন পরীক্ষার খাতায় হুবহু সব লিখে আসত পারো!’

-‘মা, হাতের গল্পের বই শেষ করে নেই?’

-‘এক বই কতবার পড়তে হয়? পুরনো বই আর পড়া লাগবে না। এখন থেকে নতুন বই পড়বে শুধু।’

দুজনেই জানে সারা বাসায় নতুন বই বলতে শুধুই ক্লাস ফাইভের বই।

মা নীতুকে অংক করতে দিয়ে গেছেন। নীতু বই খাতা খুলে হাতির দিকে তাকিয়ে আছে। এই অংক করার চেয়ে হাতির দিকে তাকিয়ে থাকতেও ভালো লাগছে।

হাতিটা বেশ কিউট! গল্পের বই অবশ্য এর চেয়ে বেশি ভালো। হাতির শুঁড়টা সবচেয়ে কিউট। শুঁড়ে আবার লাইট জ্বলে। হাতির চোখ দেখলে মনে হয় নীতুর দিকে তাকিয়ে হাসছে। কানগুলো এত্ত বড়! কুলার মতো! হাতির চার পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। কিন্তু এটা বসে আছে পেছনের দুই পায়ের উপর। বাকি দুই পা হাতের মতো করে রেখেছে। শুঁড় উঁচু করে রেখেছে।

নীতু হঠাৎ খেয়াল করে হাতির পেটের কাছে একটু কেমন যেন অন্যরকম। একটু সেলাই করার মতো লাগছে।  ধরে দেখল কেমন শক্ত শক্ত লাগছে। অথচ হাতির পুরো শরীর তুলতুলে থাকার কথা! নিশ্চয়ই মামাকে দোকানদার ঠকিয়ে দিয়েছে। এই ভেবে নীতু হাতিটার কাছে গেল। ব্যাগের চেইনের মতো চেইন দেখা যাচ্ছে একটা। চেইন ধরে টান দিতেই খুলে গেল। আর ভেতরে তাকিয়ে নীতুর চোখ ছানাবড়া! হাতির পেটে এত্তগুলো বই! কমপক্ষে ১০টা! আরও বেশি হতে পারে! খুশিতে নিতু ঠিক করে গুনতেও পারছে না! বড়মামাটা আসলেই অদ্ভুত! হাতির পেটে বই ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে অথচ কিছুই বলেনি!

বই নিতে গিয়েই ফাইভের বইগুলোর দিকে তাকিয়ে থমকে গেল।

মা নিশ্চয়ই রাগ করবেন! পর মুহূর্তেই নীতুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো! মা তো নতুন বই পড়ার পারমিশন দিয়েই ফেলেছেন।

আর মামার দেয়া সবগুলো বই একদম নতুন!

 

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!