নীলা হরিণের দেশে—কৃষণ চন্দর

কথিত আছে ,হিমালয়ের পাদদেশের গভীর অরন্য জংগলে বাঘ ভালুক আর দৈত্য দানাদের রাজত্ব ।এই জংগলে এক বিশেষ ধরনের হরিণ দেখতে পাওয়া যায় বলে একটা জনশ্রুতি আছে ।এই হরিণগুলোর গায়ের রং নাকি চকচকে নীল ।এমন কি এক ডজন শাখা বিশিষ্ট এই হরিণ গুলোর শিং ও নাকি গাঢ় নীল ।কিন্তু অদ্যবধি হিমালয় বা তরাই অঞ্চলের কোন শিকারীই নাকি এ হরিণ শিকার করতে পারেনি ।কারণ ,হরিণ গুলো এতই দ্রুত গামী যে শিকারী তার হাত ঠিক করতে না করতেই হরিণ গুলো হাওয়া হয়ে যায় ।মানুষ তো কোন্ ছার বনের দ্রুততম হিংস্র জন্তুরাও এ হরিণের নাগাল পায়না ।একটা পাতা নড়ার শব্দে চমকে উঠে দ্রুততম গতিতে পালিয়ে যায় ।
ক্রাগপুরে ডাকবাংলোতে বসে ঠাকুর হিম্মত সিং এবং ঠাকুর দিলীম সিং যেদিন মোশতাক শিকারির কাছে এই নীলা হরিণের কাহিনী শুনল ,তখন তারা ঠিক করল এই নীলা হরিণ শিকার করবেই ।ঠাকুর হিম্মত এবং দিলীপ ঠাকুর দুজনেই আপন ভাই ।তরাই এলাকার তাদের বিরাট কৃষি খামার রয়েছ ।দু ভাইয়ের ই শিকার করতে ভারী শখ ।এ যাবত্‍ তারা যে পশু পাখি শিকার করেছে সেই পশুপাখির চামড়া তারা দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছে ।দূর দুরান্ত থেকে মানুষ এসে এগুলো দেখে যায় ।
তাদের এই সংগ্রহে একমাত্র নীলা হরিণের কোন নিদর্শন নেই ।এ জন্যে মোশতাক শিকারিকে সাথে নিয়ে তারা চলল নীলা হরিণ শিকারী ।তকাই গ্রামে একমাত্র নীলা হরিণ দেখা মানুষ এই মোশতাক শিকারী ।

 

ক্রাগপুর থেকে ওরা বিদায় নিয়েছে আজ আঠারো দিন গত হয়ে গেছে ।জন মানবহীন পাহাড় জংগল দিয়ে এগিয়ে চলেছে ওরা ।সবার আগে রয়েছে বূড়ো মোস্তাক শিকারী ।মোশতাকের পিছনে রয়েছে ঠাকুর হিম্মত সিং এবং দিলিপ সিং আর তাদের পিছনে রয়েছে বদলু পালোয়ান ।বদলু যেমন পালোয়ান তেমন পাকা শিকারী । বদলু পালোয়ানের পেছনে রয়েছে রামু শিকারী ।আর রামুর পিছনে রয়েছে চব্বিশ জন মজুর ।মজুরদের মাথায় তাবু ,খাবার জিনিস ,বন্দুক কার্তুজ আরো অন্যান্য মালপত্র চাপনো আছে ।কিছু সংখ্যক ঘোড়া এবং খচ্চর ও নিয়ে এসেছিল ওরা ।সেগুলো শুনপুরে রেখে এসেছে ।শোনপুর ছেড়েও অনেক দূরে এসে পড়েছে তারা ।মোশ্তাক মাঝে মাঝে রাস্তা ভুলে যাচ্ছিল ।কিন্তু পরক্ষণেই আবার সঠিক পথ বের করে নিয়ে বলত , এই যে পেয়ে গেছি ।
একটা বিপজ্জনক নালা পার হবার পর অষ্টাদশ দিনে মোশ্তাক হিম্মত কে বরল , এখানে তাবু খাটাও এটাই হবে আমাদের শেষ তাবু ।ওই যে উচু পাহাড়ের বাঁকটা দেখা যাচ্ছে ,সেখানে পৌছুতে পার মিনাপুর পৌছতে আর মাত্র দুদিন লাগবে আমাদের ।
দিলীপ সিং গোঁফে তা দিয়ে বলল , ওই বাঁকের কাছে পৌছু আর কতখনই বা লাগবে !
মোশ্তাক বলল , বড় জোড় দুপুর নাগাদ পৌছে যাব ।
দিলিপ বলল , দেখতে তো খুবই কাছে মনে হয় ।তাইনা ?আসলে কিন্তু অনেক বিপজ্জনক রাস্তা ।
মোস্তাক এই কথা শুনে বলল ,সেখানে পৌছুতে আরেকটা ঘন জঙ্গল পার হতে হবে ।চলো এখানেই আজ রাতটা কাটিয়ে দেই ।
অবশেষে সেই নালাটির তীরেই তার রাত কাটাল ।রাতে দুটো ভয়াল সবুজ চোখ ঘুমের মাঝে আবছা আবছা দেখা গেল ।ভোর বেলা দুজন মজুরের কোন হদিস পাওয়া গেলনা ।যাদের পাওয়া গেলনা তাদের নাম জিনু আর ঘিনু ।দুই আপন ভাই ।অনেক খুজাখুজি করা হল কিন্তু তাদের পাওয়া গেলনা ।সবাই অনুমান করল ,নিশ্চয় পালিয়ে গেছে ।কিন্তু ঘিনুর জুতো আর জিনুর পাগড়ি যখন আশেপাশে পাওয়া গেল তখন সবাই মনে করল ,বাঘে টাগে হয়ত নিয়ে গেছে ।আশ্চর্যের বিষয় কোথাও কোন বাঘের পায়ের ছাপ পাওয়া গেলনা ।অবশেষে তারা আবার রওনা দিল ।হাটতে হাটতে একটা কুয়োর পাড়ে এসে রাত হল ।তখন ওরা তাবু খাটিয়ে ঘুমাবার বন্দোবস্ত করল ।দিলিপ আর বদলুকে পাহাড়া দিতে বলল ।রাতের অন্ধকারে বদলু আর দিলিপ দুটো সবুজ চোখ এক পলকে জন্য দেখা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলনা ।
সকালে আবারও আরো দুজন লোকের সন্ধান পাওয়া গেলনা ।কাছের কুয়ার পাড়ে কাদায় লম্বা লম্বা দুটো পায়ের ছাপ পাওয়া গেল ।

দ্বিতীয় দিন সবাই কান্ড জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ।যে যেদিকে পথ দেখল পালাবার চেষ্টা করল ।হিম্মত সিং এবং দিলীম সিং তাদের অনেক বুঝাল ।কিন্ত মজুরদের মনে বদ্ধ মুল ধারনা হয়ে গেছে ,পিছল পা নামের একটা পিছন থেকে মানুষ মারার জন্তু তাদের পিছনে লেগেছে ।এমন বিপজ্জনক পথে তারা মোটেই অগ্রসর হবেনা ।অবশেষে মজুরেরা যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল ।বদলু পালোয়ানের ও ছুটে পালাবার ইচ্ছা ।সে কাপা কাপা গলায় বলল ,আসলে আমাদের ও ফিরে যাওয়া উচিত্‍ ।
মোশ্তাক বলল , তুমি পালোয়ান হয়েও ভয় পাচ্ছ ?
বদলুঃ আমি আবার কাকে ভয় পাব তবে পিছল পা কি পিছন দিক থেকে মারে তার সাথে কেউ এটে উঠতে পারেনা ।
মোশ্তাকঃ কেন আমি পিছল পার লড়তে প্রস্তুত আছি ।সাহস দেখিয়ে বলল মোশ্তাক । বদলুঃকিন্তু পিছল পা তো পিছন দিক..
কথা শেষ করবার আগেই ধমকে উঠল হিম্মত সিং ,রাখো এসব বাজে কথা । ধমক শুনে বদলু পালোয়ান চুপসে গেল ।কিছুখন পর সবাই মিলে পরামর্শ করল ।এখন কি করা যায় ?বদলু পালোয়ান কিছুতেই এগোতে চাচ্ছিলনা ।বদলুর সাথে তলে তলে রামু শিকারী ও ফিরে যাবার মনস্তাব করছে ।আর কেউ না এগুলেও হিম্মত সিং আর দিলিপ সিং এগোবেই ।মোশতাক শিকারীও তাদের মতে সায় দিয়ে বলল , এতদূর এসে ফিরে যাবার মত কাপুরুষ আমরা নই ।
অবশেষে সিদ্ধান্ত হল মাল সামান এই কুয়ার পাড়েই পড়ে থাকবে শুধু দুদিনের পরিমাণ কিছু খাবার বন্দুর আর কার্তুজ নিয়ে আবার রওনা দিবে ।
মিনাপুরে পৌছলে একটা না একটা হিল্লে হবেই ।
নতুন উদ্যমে আবার রওনা দিল তারা ।দুপুর নাগাদ তার প্রবীণ কতগুলি বৃক্ষরাজীর কাছে গিয়ে পৌছল ।
সেখান থেকে মিনাপুর আর মাত্র দুদিনের পথ ।
সেখানে গিয়ে মোশতাক শিকারী হতভম্ব হয়ে দেখতে লাগল যে ,সামনে এগোবার কোন রাস্তা নেই ।মোশতাক শিকারীর মতে যেখান দিয়ে রাস্তাটা হবার কথা সেখানে বিপজ্জনক একটা খাঁদ ।শুধু সেদিকে কেন ,তিন দিকেই খাঁদ ,প্রবীন বৃক্ষরাজী শুধু একটা টিলার মত । কি আশ্চর্য এখানে হাজার ফুট গভীর খাদ এল কি করে ?
খাদের ওপারে পাহাড় ।
রামু শিকারী বলল ,আমরা ভুল পথে এলাম না তো ?
মোশ্তাকঃ না এটাই তো মিনাপুরের রাস্তা ।তবে পাহাড়টা দুই খন্ড হল কি করে ?
দিলীপ সিং ,এখন তাহলে কি হবে ?
মোশ্তাকঃ আল্লাহই বলতে পারেন ।
দিলীপঃ এ টিলা আর ওপারের পাহাড়ের মাঝে মাত্র শ গজের ব্যাবধান আমরা যদি একটা সাঁকো তৈরী করে নেই তবে পেরোনো যাবে ।
হিম্মত কারো কথায় কান না দিয়ে কিছুখন কি যেন ভাবল ।তারপর বলল ,আমার মনে হয় এ অঞ্চলে কিছুকাল আগে প্রচন্ড একটা ভুমিকম্প হয়েছে ।এর ফলে পাহাড় টা ফেটে গেছে ।
মোশ্তাক শিকারী বলল ,চল পিছন দিক দিয়ে ঘুরে যায় ।ওরা পাঁচজন আবারও কোমর বেঁধে যে পথে এসেছিল সে পথেই ফিরে চলল ।তারা দুর্গম পথে জঙ্গল কেটে কেটে যেতে লাগল ।অবশেষে তারা খাঁদে নামল ।তারপর পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে রাস্তা বাতলে চলতে লাগল ।
মিনাপুর যেতে এখন আর কষ্ট হচ্ছে না ।ঢালু পথ প্রন্তরের মাঝখান দিয়ে স্বচ্ছন্দে যেতে যেতে তারা মিনাপুর যেয়ে পৌছল ।মিনাপুর পৌছে তারা দেখল ব্স্তিতে কোন লোকজন নেই ।তবে লোকজন যে এক কালে ছিল একথা মিথ্যা নয় ।ভাঙ্গা ঘরবাড়ি ,মানুষের হাতে লাগানো নানা ফলফলাদীর গাছ আর পথঘাট দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে এককালে মানুষজন এখানে ছিল ।তারা একটি ভাল বাড়ি দেকে তা সাফ করে ঘুমিয়ে পড়ল ।তিন দিন তিন রাত তাদের ঘুম ছিলনা তাই শোয়া মাত্র তারা ঘুমিয়ে পড়ল ।হিম্মত সিং এর গায়ে সূর্যের আলো সুড়সুড়ির মত লাগল ।উঠে দেখল সবাই অঘোরে ঘুমোচ্ছে ।তার পাশে দিলিপ দিলিপের পাশে বদলু আর বদলুর পাশে রামু আর রামুর পাশে আরে ! মোশ্তাক শিকারী গেল কোথায় ।আবার একজন গাযেব হয়ে গেল ।মোশ্তাক ছাড়া তারা নীলা হরিণের দেশে যাবে কি করে ? পথ তো চিনত একমাত্র মোশ্তাক শিকারীই ।হিম্মত সিং চিন্তায় পড়ে গেল ।এরপর থেকে তারা চারজন বিপন্ন পথভ্রষ্ট শিকারীর মত নীলা হরিণের সন্ধানে সারা দিনমান বনে বনে ঘুড়ে বেড়াত এবং রাতের বেলা সেই ভাঙ্গা বাড়ীটাকে এসে রান্না বান্না করে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত । তবে সকলে ই একবারে ঘুমিয়ে পড়ত না একজন পিছল পার ভয়ে জেগে পাহাড়া দিত ।তারা এভাবে নীলা হরিণের তালাশে দশদিন কাটিয়ে দিল ।কিন্তু একবার ও তারা নীলা হরিণের কোন হদিশ পেলনা ।
রোজকার মত নীলা হরিণ খুঁজতে খূঁজতে মিনাপুর ছেড়ে অনেকদূর এসে রাস্তা হারিয়ে ফেলল ।পথ ভুলে অন্য রাস্তায় চলে এসেছে এরা ।চলতে চলতে তার একটা খোলা প্রান্তরে এসে পড়ল ।উচু নিচু টিলাময় পথ ।পথ দিয়ে মোটেই এগুনো যাচ্ছেনা ।ধারে কাছে কোন রাস্তাঘাট এমন কি একটা গাছ ও নজরে পড়ছে ।চলতে চলতে তারা বহুদুর চলে এল ।হঠাত্‍ সামনের দিকে টিলামত একটা উচু পাহাড় দেখতে পেল তারা ।এবায় ভাবলো যাক পাহাড়টায় উঠতেপারলে ওপারে হয়ত ভাল একটা এলাকা দেখা যাবে ।পাহাড়ে উঠে তারা একটি মনরোম মাঠ দেখতে পেল ।তারা পাহাড় থেকে মাঠটায় নেমে পড়ল ।বহ্ বেশ সুন্দর তো ।প্রাণ টা জুড়িয়ে গেল তাদের ।
হঠাত্‍ হিম্মত সিং বলল ,চুপ চুপ চু ।
সবাইকে ইশারায় ডেকে একটা গাছের আড়ালে লোকোতে নির্দেশ করল সে ।একটা নীলা হরিণ দেখতে পেল ওরা ।
কত কষ্ট কত তিতিক্ষার পর আজ তারা একটা নীলা হরিণ দেখতে পেল ।হরিণ টা হাওয়া শুকতে শুকতে এগোতে লাগল ।সৌভাগ্য ক্রমে হাওয়া ছিল বিপরীত দিকে তাই হরিণ টি তাদের গায়ে র গন্ধ পাচ্ছিল না ।তারা শিকার করবার বন্দোবস্ত করল এমন সময় কোথা থেকে একটা সোনালী রঙের ঘোড়া ছুটে চলে গেল ।তার পিছু পিছু হরিণ গুলো ও হাওয়া হয়ে গেল ।তাদের হা হুতাশ ছাড়া আর কিছুই করার থাকলো ।রাতে তারা একটা কুয়োর কাছের গুহায় ঘুমোতে গেল ।
আজ হিম্মত সিং একটু আগেই জেগে গেল ।আশ্চর্য সবাই কোথায় গেল ।পুরো গুহাটা খা খা সে ছাড়া আর কেউই নেই গুহায় ।ভয়ে আতংকে চোখে সরষে ফুল দেখতে লাগল সে।

সারাদিন হিম্মত সিং একা একা বনে জঙ্গলে তার সাথীদের খুজেও পেলনা ।সন্ধ্যা হতে না হতে সে আবার ঘুরে ফিরে কূয়ার কাছে চলে এলো ।রাত কাটানোর জন্য সে নানা উপায় উদ্ভাবন করছিল ।এমতবস্থায় অন্য কেউ হলে পালিয়ে যেত ।কিন্তু হিম্ভত সিং ছিল পুরনো অভিজ্ঞ শিকারী ।গুহাতে বসে হেলান দিয়ে রাইফেলটার মুখ সামনের দিকে করে সে ঘুমিয়ে পড়ল ।ঘুমিয়ে পড়ল বলা ঠিক হবেনা ।বলতে হবে চোখ বুজে রইল ।যখন রাত গভির হল ,কি মনে করে সে সন্তরপনে গুহা থেকে নেমে কুয়াটার কাছে এল ।কুয়ার অপর দিকে একটা ঘন পাতা ওয়ালা গাছ ।সে আস্তে আস্তে গাছের উঠে ঘন পাতার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখল ।কাঁধের বোচকা গুলো ঠিকঠাক করে বন্দুকটা সামনের দিকে আরামসে বসে চারদিকে দেখতে লাগল ।কোন কিছুর আওয়াজ শুনবার জন্য সে উম্নুখ হয়ে রইল ।রাত তৃতীয় প্রহরে কুয়োর কাছে কিসের একটা ছায়া দেখে সে চমকে উঠল ।ছায়াট ঠিক বুঝা যাচ্ছেনা কিসের ছায়া ।হিম্মত সিং শ্বাস রোধ করে ফেলল ।তারপর সে দেখতে লাগল ছায়াটা আস্তে আস্তে পাহাড়ের গা বেয়ে ক্রমশঃ গুহার দিকে যাচ্ছে ।বিড়ালের মত নিঃশব্দে হিম্মত সিং গাছ থেকে নেমে পড়ল ।ছায়াটার পিছনে নিঃশব্দে যেতে লাগল ।ছায়াটা গুহার ভিতরে মুখ দিয়ে কি যেন একটা খুজছিল ।হিম্মত সিং পিছন থেকে ছায়াটাকে ঝাপটে ধরল ।ছায়াটাকে বেধে সে ব্যাগ হাতরে দেয়াশলাই বের করে জ্বালাল ।দেখল এক অপরুপ সুন্দর একটা মেয়েকে সে ঝাপটে ধরে আছে ।
হিম্মত সিং ব্যাগ থেকে একটা পাউরুটি মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিল ।মেয়েটি মাথা নেড়ে বললঃ আনি তিরকিট ধানি আচ্চি কাচ্চি ।
হিম্মত সিং দাঁত খিচিয়ে বললঃ আহাম্মকের বাচ্চি ।তোর বাড়ি কোথায় ।মানে ঘর ।
হিম্মত সিং বাতাসে একটা ঘর একে দেখাল ।মেয়েটি কিছুনা বলে হঠাত্‍ হেচকা টান দিয়ে একটা দৌড় দিল ।হিম্মত সিং এর হাতে দড়িটা শক্ত করেই ধরা ছিল তাই ছুটাতে পারলনা ।হিম্মত সিংকে নিয়ে দৌড়তে লাগল ।হিম্মত সিং মেয়েটিকে একটা পাহাড়ের গিয়ে দাড়াতেই হেচকা টানে আটকিয়ে ফেলল ।আরেকটু হলেই মেয়েটি হাজার ফুট গভির খাদে গিয়ে পড়তো ।হিম্মত সিং মেয়েটিকে বলল , মরতে চাস তবু বাড়ির কথা বলবি না ।যাহ তোকে মরতে হবেন ।মেয়েটির বাঁধন তিনি খুলে দিলেন ।তারপর বললঃ যা যা চলে যা ।দড়ির টানে হিম্মত সিংএর হাত কেটে গিয়ে ছিল ।বসে খত স্থানে এক মুঠো মাটি চেপে ধরল ।তারপর উঠে দাড়িয়ে পিছনে তাকালেন ।মেয়েটা নেই পালিয়েছে ।একটা সুত্র ছিল তাও হারিয়ে গেছে ।
কিছুখন পর হিম্মত সিং কুয়োর পাড়ে এসে দেখতে পেলেন মেয়েটি বসে আছে ।মেয়েটি ইশারায় তার পিছু আসতে বলে চলতে লাগল ।চলতে থাকল তার ।পথে একটু জিরিয়ে নেবার জন্য হিম্মত সিং একটা ঝুকে পড়া মোটা গাছের ঢাল ধরে দাড়ালেন ।হঠাত্‍ ডালটা তাকে পেচিয়ে ধরল ।আসলে সে যে ডাল মনে করে যেটা ধরেছিল সেটা একটা অজগর সাপ ।মেয়েটি দৌড়ে এসে অজগর সাপের মুখে একটা গাছের পাতা ধরল ।অবশেষে সাপের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে নেতিয়ে পড়লেন । ।।।।।।৮।।।।।
হিম্মত সিং এর যখন জ্ঞান ফিরে এল সে দেখল , সে এবং মেয়েটি লোহার শিকলে বাঁধা অবস্থায় হাতির পিঠে চড়ে কোথায় যাচ্ছে ।তাদের আগে দুটো হাতি এবং পিছনে তিনটি হাতি রয়েছে আরো ।হিম্মত সিং এর হাতির মাথায় যে মাহুত (হাতি চালক )টি বসে আসে তার পরনে একট ছোট কাপড় ছারা আর কিছুই নেই ।মাথায় মড়া মানুষের খুলি ।হিম্মত সিং মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল , আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি ?
মেয়েটি উত্তর দিল ,আমরা এখন মানুষ খেকোদের কবলে পড়েছি ।
হিম্মত সিং অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ,একি তুমি দেখি আমাদের ভাষা জান ।অথচ আলুং বালুং করে এতখন ধোকা দিয়েছ কেন ? মেয়েটি তেমনি ভাবে বলল ,সে সময় তুমি ছিলে নতুন লোক ।বলতে গেলে তুমি ছিলে আমার দুশমন ।
হিম্মত সিং মুচকি হেসে বলল ,এখন আবার বন্ধু হলাম কেমন করে ?
মেয়েটি তেমনি দৃঢ় ভাবে বলতে লাগল ,যেহেতু এসময় আমরা তৃতীয় শত্রুর কবলে পড়েছি এসময় আমাদের শত্রুতাকে আপাতত বিদায় করে দেয়া ভাল ।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম ,কিন্তু আমরা এই হাতির পিঠে এলাম কি করে ?আমার যতটুকু মনে আছে আমাকে একটা অজগড় সাপ পেচিয়ে ধরেছিল তারপর আর কিছু মনে নেই ।মেয়েটি বলল ,আমি তোমাকে বাঁচাবার জন্য জংগল থেকে তামের ঝাড়ির একটা ডাল নিয়ে এসে অজগড়ের মুখে দিলাম ।অজগড় টা তোমাকে ছেড়ে দিল ।
হিম্মত সিং আবার প্রশ্ন করল ,তারপর ?
মেয়েটি আবার বলতে শুরু করল ,তারপর তুমি বেহুশ হয়ে গেলে ।তারপর আমি তোমাকে কাঁধে তুলে নিলাম ।আমি অবাক চোখে মেয়েটির দিকে তাকালাম ।তাতে মেয়েটি কি বুঝল কে জানে ।মেয়েটি বলতেই থাকল ,আমি তোমাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতে এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম আর এতেই ওদের হাতে ধরা খেলাম ।তারপর একটু থেমে মেয়েটি আবার বলতে লাগল জান এরা শুধু মেয়েদের মাংস খায় ।আমাদের নিয়ে হাতিগুলো একটা গ্রামের মত জায়গায় থামল ।আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম ,তোমার নাম কি ?
মেয়েটি ঊত্তর দিল ,শিনা ।
হিম্মত সিং ,আচ্ছা আমরা বাচতে পারবনা ?
মেয়েটি বলল ,সম্ভবত আমরা বেচে যেতে পারি ।আমার ভাই বলরাজ বোধ হয় আমাদের বাচিয়ে নেবে ।
জংলিদের কোলাহল ক্রমশ বেড়ে গেল ।

হিম্মত সিং আর শিনা কে একটা গাছের সাথে বেধে আটকলরা নাচানাচি করছিল ।তাদের ঢোল আর হৈ হুল্লোরের আওয়াজে সারা বন গন্জন করে উঠল ।শিনা শেষ বারের মত উপরে তাকিয়ে বলল , ভাইয়া এ সময় তুমি কোথায় ?
সহসা গাছের উপরে পাতা নড়ে উঠল ।একটা লোক ধাড়া ধাড়া ধামামা বলে আমাদের কে নিয়ে বানরের মত গাছ বেয়ে বেয়ে জংলিদের নাগালের বাইরে চলে এল ।
একটা খোলা মত জায়গায় এসে লোকটি নেমে একটুকরো নীলা হরিণের চামড়া দিয়ে হিম্মত সিং এর চোখে বেঁধে দিল ।লোকটি তারপর ঘোড়ায় উঠে আগে চলতে লাগল ।হিম্মত সিং কে হাতে ধরে শিনা নিয়ে যেতে লাগল ।প্রায় এক ঘন্টা চলার পর হিম্মত সিং কে দাঁড় করানো হল ।হিম্মত সিং দু হাতে চোখ রগরে চারদিকে তাকাল ।দেখল সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ ।হিম্মত আরো এগিয়ে যেতেই দেখল এক ঝাক নীলা হরিণ ।সামনে চেয়ে দেখল তার ছোট ভাই শিনার হাত ধরে বসে আছে ।কিন্ত আমার পিছন ও তো শিনা ।আশ্চর্য শিনা দুটো দেখছি ।শিনা আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল ,ও আমার যমজ বোন রাজিন ।হিম্মত বলল , তোমাকে চিনব কি করে ।শিনা তার কপালে একটা তিল দেখিয়ে বলল , এই দেখে ।

শিনা দরজার কাছে এসে বলল,পানি রাখ আছে স্নানটা সেরে নিন ।হিম্মত সিং স্নান সেরে দেখল তার নোংরা কাপড় গুলি যথাস্থানে নেই তার বদলে সেখানে নীলা হরিণের চামড়ার তৈরী জমকালো পোশাক।হিম্মত সিং কাপড় পড়ে ঘুমোতে গেল ।দীর্ঘ কয়েক ঘন্ট ঘুমোবার পর দেখল অন্ধকার নেমে এসেছে ।এক কোনে এক খন্ড হিরা রাখা আছে যা থেকে আলো নির্গত হচ্ছে ।এমন সময় শিনা ঘরে প্রবেশ করল ।শিনা ও একটা নীলা হরিণের চামড়ার তৈরী পোশাক পড়ে আছে ।শিনা কে খুব সুন্দর লাগছে ।শিনা এসে হিম্মত সিং এর পাশে বসল ।একটা হাত বুলিয়ে দিল হিম্মত সিং এর মাথায় ।হিম্মত সিং তার হাতটা ধরে বলল ,আমি তোমাকে ভালবাসি শিনা । শিনা কিছুখন চুপ করে রইল তারপর বলল ,আমি ও ।বলেই লজ্জায় মুখ ঢাকল ।

বলরাজের বাবা প্রকৃতি প্রেমি ছিলেন ।আর এই প্রকৃতি প্রেমের ফসল এই বন ।বলরাজ আর শিনা রাজিনা সবাই এই বনেই জন্ম গ্রহন করে ।৫ বছর বিগত হয়েছে বলরাজের বাবা মা মারা গিয়েছে ।এই বনে একমাত্র নীলা হরিণের মালিক বলরাজ ।তবে নীলা হরিণ সারা পৃথীবিতে আছে মাত্র ৪০টি যার সবকটিই বলরাজের ।আর সোনালী মাত্র একটি ।তাও প্রায় বুড়ো ।কথা গুলি বল রাজ কাছ থেকে শুনে হিম্মত সিং লিখে রাখল ।প্রায় বহুদিন এই বলরাজের রাজ্যেফূর্তি আমোদ করা হল ।বলরাজের দুই বোনকে বিয়ে করল হিম্মত সিং আর দিলিপ সিং ।যাবার সময় বলরাজ সবার চোখ বেধে তার রাজ্যের বাইরে নিয়ে এল ।এই জায়গাটা উচু পাহাড় মতন ।বলরাজ বলল , এই পথ বেয়ে তোমরা নিচে চলে যাও ।যেতে হলে তোমাদের এই পথটায় সবচেয়ে নিরাপদ ।আর আমিই তোমাদের সঙ্গিদের ধরে এনেছিলাম বলে দুঃখিত ।কান্নায় ভেঙ্গে পড়া বোন দুটোর মাথায় হাত রেখে আর্শিবাদ জানালো বলরাজ । হাত ধরে শিনাকে হিম্মত সিং এর হাতে এবং রোজিনাকে দিলিপ সিং এর হাতে ।বলরাজ তার সোনালী ঘোড়ায় চেপে বসল ।নিমেষেই সোনালী ঘোড়াবলরাজকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ।হিম্মত সিং এবং তার দলবলে লোকেরা তার চলে যাওয়া পথের ধূলোর দিকে তাকিয়ে রইল ।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!