তাঁর নাম দেয়া হল নীল। আকাশের গাঢ় নীল। লোকজন বলাবলি করত- বেদনার রঙ নাকি নীল। অথচ! এই নীলেই তাকে বেশী মানায়। আর মানায় আকাশের গায়ে। আকাশগাঙে যখন পাখি ওড়ে, বর্ণিল মেঘেরা ঘোরাঘুরি করে তখন নীলের বেশ লাগে। আচমকা কালো হয়ে যাওয়া আকাশে ভীষণ ঝড় ওঠে, বেসামাল হয়ে খসে পড়ে একেকটা স্বপ্ন। কিন্তু নীল! সে থেকেই যায় আকাশবুকে। পরম আদরে আকাশটা তাকে যত্নে রাখে। তাদের নাম হয়ে যায় নীলাকাশ!
যখন ঝকঝকে তারাদের হাট বসে পুরো আকাশজুড়ে, তখন সেই ছায়া পড়ে অবাক নদীতে। নদীর জলে নীলাকাশটা তাদের প্রতিবিম্ব চেয়ে দেখে আর নানান গল্পকাব্যের ছবি আঁকে। গল্পের উপকরণ ব্যতিক্রম। যেমনঃ পদ্মদিঘী, শাপলা, পায়রার ঠোঁট, নীল আর নীলে ঠাসা সব। এভাবে পৃথিবীটার বয়স বাড়তে থাকে, এগুতে থাকে সময়। উদাসী বাতাস কেড়ে নেয় সময়ের আবেগী নদী। ধূলিকণার মত উড়তে থাকে সবকিছু। নীলের গায়ে তার ছিটেফোঁটা আঁচ এসে পড়ে। তার রঙ পাল্টে যায়, হয়ে যায় গাঢ় বেগুনি। অনেকটা জারুল দুপুরের মত…..নীল হয়ে যায় জারুল আর সোনালুর আবেগী মিশ্রণ।
শুরু হয় জীবনের আরেক আয়োজন। সবুজ চূড়ায় ছোট্ট মাটির ঘর। এখানে স্বপ্ন হাঁটে ধূলির পথে। নীলাকাশের ব্যস্ত ছায়ায় প্রশস্ত পথের বাঁক ছেয়ে থাকে গোলাপকাঁটায়। উদার প্রকৃতি হয়ে যায় কাঠখোট্টা। নানান বৈপরীত্য ছুঁয়ে থাকে জীবনের কোমল অংশ। এরই মাঝে দিন গড়ায়। ছোট্ট সাপের মত শরীর ঘষে চলে জীবন। দিনশেষে আধখানা সরু চাঁদ ঘরখানাকে স্বর্গীয় করে তোলে। ঐ দূরে ঘুমিয়ে থাকা সবুজ বনটাকে নিমিষেই ছুঁয়ে যায় আকাশগাঙ। ঘুমন্ত গাঙ থেকে ভেসে আসে শেয়াল-কুকুরের বিরামহীন আর্তনাদ। সেই আর্তনাদের সাথে নীলের একাকী আর্তনাদ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
এমনি এক বিপরীত মেরুতে বসে থাকা নীলের গায়ে আছড়ে পড়ে ঈর্ষণীয় সূর্যের চকমকে আলো। স্বপ্নের পথে এগুতে থাকে স্বপ্নময়ীর স্বপ্নিল ছায়া। দিনের অভিধান ক্রমশ মুখরিত হতে থাকে রঙধনুর সাতরঙে। এখানে বজ্রমেঘের অন্ধকার নেই, আকস্মিক স্তব্ধতা নেই। আছে শুধু এক চিলতে পৃথিবীর বুকে শব্দহীন কিছু বুদবুদ। বুনো লতার মত কিছু মাধবীলতা আচমকাই জড়িয়ে নেয় বন্ধনহীন মনের মুকুর। হাত বাড়িয়ে দেয় প্রকৃতি। ভাবালুতার কাল গড়িয়ে যায় সম্ভাবনার স্বচ্ছ নদীতে। লম্বা আর আর্দ্র দিনগুলো ফুলতে থাকে সফেদ সমুদ্রের মত।
সকালের বিশুদ্ধতা গায়ে মেখে সে বেরিয়ে পড়ে ফাঁকা উদ্যানে। পেছনে সবুজ পাহাড় আর সামনে নদী। রাশি রাশি শিমুল তুলায় সেজে আছে পুরো আকাশ। কুসুমরঙা সূর্যটার বুঝি আর তর সইলোনা। দস্যুর মত পুরো নদীটাকে গ্রাস করে ফেলল তার সোনালি আভায়। সেই আভায় জলের সর ছাড়িয়ে নীল দেখে তার ঢেউভাঙা মুখ। আলোর বন্যায় কম্পিত মুখে খেলে যায় অদ্ভুত জলতরঙ্গ। আকাশ,নদী, পাহাড় আর নারীর মাখামাখি এক অপরূপ সময়। এভাবেই আলোর ছায়া একসময় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। টগবগ করে ফুটতে থাকে ভোরের পৃথিবী। টুপটাপ করে ঝরতে থাকে হলদে পাতার দল। এই পাতার দলে নীল যেন তাকেই খুঁজে পায়। কোনো এক বিকেলের মরা রোদ মনের কোণে পেতে রাখে বিষণ্নতার ভারি চাদর।
একাকী পথ যেমন ছুটে বেড়ায় স্বপ্নের পশরা সাজিয়ে, স্বপ্নগুলো মোমের মতো গলে যায়, নিভে যায় আবার জ্বলতে থাকে আশার ভেলা ভাসিয়ে। ঠিক তেমনি এই আশা থেকেই মনের কোণে ইট-কাঠের দালান ওঠে। অলিন্দজুড়ে মাধবীলতা আর কৃষ্ণচূড়ার লাল-নীল সংসার সাজে। অবাক পৃথিবী ডাগর চোখে চেয়ে থাকে সেই সংসারের মায়াবী উঠোনে। ভাবনার অতলে খুঁজে ফেরে জীবনের শেকড়। তার একটা সংসার ছিল, আদিম উল্লাসে কেঁপে উঠত সেই সময়ের ঘর। কচি কোমল মুখে খেলত চাঁদের মায়াবী হাসি।
পাখির পালকের মত নরম ছিল সম্পর্কের মায়াজাল। ভারি মোজার মত ঝুলে থাকা স্বপ্নগুলোর মাঝে আচমকাই বয়ে যায় মরুঝড়। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসে অনিবার্য পতন। বেলাভূমির বালিতে লাল কাঁকড়ার স্বপ্নকে নিজের স্বপ্ন করে ছুটতে ছুটতে খেই হারিয়ে ফেলে সে। যুঝে চলা একরত্তি পৃথিবীর বুকে রোপণ করে জীবনের ছোট্ট চারাগাছ। বেছে নেয় প্রকৃতিকে। বিরূপ প্রকৃতি এবার বাড়িয়ে দেয় তার মধুরঙা আবেগী মন। চিত্রার্পিত আকাশজুড়ে খেলতে থাকে অনাদিকালের সুখ।
উচাটন মনের কোণে ভিড় জমায় দুর্বিনীত সবুজের হাত। নীলের কানে ভাসে প্রাচীন কদমের ফিসফিস গুঞ্জন। দূর পাহাড়ের চূড়ায় তার ছোট্ট বাড়ির ছাদ দেখতে পায় সে। প্রশস্ত পথের ধারে এইটুকুন একটা শরীর নিয়ে সে ভেবে যায় কত কি! দূরের বাড়িটাকে তার মনে হয় কানঢাকা টুপির মত। আচমকাই শীত এসে তার গায়ে শিহরণের ঝড় তোলে। আসবাবপত্রহীন সেই বাড়িটা তাকে ফুসলে নিয়ে যায় উঁচু চূড়ায়। উজ্জ্বল সূর্যের নিচে সবুজ ঘাসের সাথে তার বিনিসুঁতোর সম্পর্ক পিতলের মতই ঝকঝক করতে থাকে।
কঠিন পাহাড়ি জীবনে নীলের সাথে প্রকৃতির অন্যরকম সম্পর্ক। শুরুর প্রকৃতি ছিলো কৃমি-চোষা ঠুনকো শরীরের মতই। শারীরিক গড়ন দেখে তার বড্ড মায়া হত, চোখে শ্রাবণ নামত। খুব সহজেই অনুমিত হত যে, কিছু দানবের আবির্ভাব হয়েছিল প্রকৃতির রূপরাজ্যে। যারা আধো-আলোতে চষে বেরিয়েছে সবুজ জমিনের সর্বত্র। এরই মাঝে জলচর পাখির ঠোঁটে স্থির এক আকাশ এসে ভর করে। গাঙচিল ওড়া আকাশটাকে দেখে নীলের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। দু’চোখ বেয়ে নেমে আসে শীতকালীন চিনিগুড়া বৃষ্টির আদুরে পশরা।
অনেকগুলো বছর আগে সংসারের অধিপতি যখন বিনাকারণে একের পর এক ভুলের বোঝা চাপিয়ে চপেটাঘাত করেছে মনের দেয়াল, তখন সেখানে শ্রাবণ ছিলোনা। সেখানে পাথরের মূর্তি রূপে বসবাস করত, সময় নামক রেলগাড়ি। এ রেলে চেপে নীলের খেয়ালী মন ভেসে যেত নামহীন কোনো এক অচিন নক্ষত্রের দেশে। এখন তার বুকের মাঝে আদিগন্ত আকাশের বলিরেখা। জারুল-সোনালুর মিশ্রণে অদ্ভুত রঙটা এখনও তেমনি আছে। খই ফোটা তপ্ত রোদেলা দুপুরও এ রঙের তেজটাকে ধূসর করতে পারেনি। কোনো মরুঝড় মনের মেরুদণ্ড গুড়িয়ে দিতে পারেনি। সময়ের টানাপোড়নে একেকটা লতাগুল্ম হয়ে গেছে মহীরুহ।
দূর পাহাড়ের চূড়ায় মাটির ঘরে থেকে আকাশের ঘ্রাণ মেখে কেটে যায় নীলের বহুমুখী জীবন। যে জীবনে আকাশ তার নিত্যসাথী। যার ছায়ায় কেঁপে ওঠে নীলের অলিন্দ-নিলয়। পরম ভালবাসায় যাকে নিয়ে মেতে ওঠে নেশার মরণ খেলায়। সেই আকাশই তার দূরের বাতিঘর। যাকে পৃথিবীর অবস্থানিক বণ্টনে বিভাজন করা যায়না। কেবল পঞ্চ অঙ্গুরির ভাঁজে ছুঁয়ে থাকা হয় আদিগন্ত আকাশের সবটুকু নীল!
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।