‘-” জানিস, আমি আর চারদিন পর দেশে ফিরছি” -” তো?” -”…….” -” তুই ভুল আশা করছিস। আমি আর কোনো কিছুতেই উত্তেজিত হই না…রাখলাম।” বিপ বিপ শব্দ আর বাইরের অঝোর ধারার বৃষ্টি কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। ফোনটা রেখে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ায় তিতাস। প্রত্যেক মেয়ের জীবনে এমন একটা সময় আসে যখন সমস্ত আপনজনের থেকে এক বিশেষ অপরিচিতের চাওয়া পাওয়া তার কাছে বড় হয়ে দাঁড়ায়। বৃষ্টির তেজটা বাড়ছে। “কিন্তু ইমন কি আমার অপরিচিত?” আরো দু পা এগোয় তিতাস।
“ও কি বোঝে না অনাঘ্রাতা ফুলের পরম আকাঙ্খার স্থান প্রার্থিত দেবতার পায়ের তলায়”। সামনের সাজানো পাম গাছের সারি তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল অনেক অনেক দুরের কিছু সারিবদ্ধ তাল-সুপুরি গাছ গুলোকে। বারান্দা পেরিয়ে সামনের লনে নামল তিতাস। পরিচিত ঘাস গুলো দিশা হারিয়ে ফেলতে শুরু করলো তার ছন্দবদ্ধ মুদ্রার তালে। একে একে খসে পড়ল মাথার ক্লিপ, দোপাট্টা। সবুজ ঘাসের মধ্যে মেরুন কুর্তি পরা তিতাস অবশেষে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল রজঃস্রাবের এক ঝলক টাটকা তাজা রক্তের মত। বৃষ্টি তখনও পড়ে চলেছে, অবিন্যস্ত ভাবে। পঁচিশ বছর পর: -” মা, ও মা। কোথায় যে যাও?”… -” আমি পুজোর ঘরে রে রঞ্জু। কি হয়েছে?” -” একটু শাড়ীটা পরিয়ে দেবে এসো।
” -” আজ আবার শাড়ী কেন? কোথায় যাবি?” -” আঃ তুমি খালি ভুলে যাও। পরশুই তো বললাম। আজ অরুন আসছে মিশিগান থেকে। নীল শাড়ী না পড়ে এয়ারপোর্ট গেলে বাবুর মুখ ফুলে টং হয়ে যাবে। উফফ আমি এখন এত বকতে পারছি না। তুমি তাড়াতাড়ি পুজো শেষ করো। আমি গা ধুয়ে আসছি।” সাজি থেকে শেষ ফুলটা নিয়ে দেবী লক্ষ্মীর পায়ের দিকে হাত পড়িয়েছিলেন শ্রীমতি ইমন মুখার্জী। পঁচিশ বছর আগের এক মেঘলা সকালে তাঁকেও সুদুর আমেরিকার টেক্সাস থেকে একজন আর্তি জানিয়েছিল নীল শাড়ী পড়ে এয়ারপোর্ট যাওয়ার। ছদ্ম অনুত্তেজিত কন্ঠে তাকে নিরস্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন তিনি। “সমাজ কি বলবে” এ চিন্তা কোনদিনই ছিল না সেই উচ্ছল মানুষটির মনে। শুধু সেই জুলাই মাসের বর্ষণমুখর দিনটায় যখন তাঁর মা তাঁকে নীল শাড়ীটা পরিয়ে দিচ্ছিলেন, দূরদর্শনের খবরে ভেসে এসেছিল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস এর প্লেনটার পাটনার কাছে ভেঙ্গে পরার খবরটা। ছিঁড়ে ফেলার বদলে যত্ন করে তুলে রেখেছিলেন তিনি অনাঘ্রাতা নীল শাড়ীটা।
রঞ্জু অনেকবার জানতে চেয়েছিল নীল রঙের প্রতি এত অনীহার কারণ। নীল শাড়ীটা রঞ্জনা অনেকবার পড়তে চেয়েছে কিন্তু প্রতিবারই উনি এড়িয়ে গেছেন নানা ছুতোয়। যেমন এড়িয়ে গেছেন পারিপার্শ্বিক ও সমাজের অবধারিত অমোঘ প্রশ্ন -” বিয়ে না করেও নিজেকে মিসেস ইমন মুখার্জী কেন লেখেন আপনি?” -” কই হলো তোমার?” চোখ বন্ধ করে মেয়ের কণ্ঠস্বরের দিকে ফিরলেন উনি। এর কোনো মানে হয়না। তবুও শত হলেও, নিজের প্রচ্ছন্ন অপ্রাপ্তির ভয় ওনাকে অনুমতি দিচ্ছিল না নিজের আত্মজার দিকে তাকাতে।
“কি করে? কি করে আজ আমি ওকে বারণ করব ওই নীল শাড়ীটা না পড়তে? ওই অলুক্ষুনে নীল শাড়ী কেড়ে নিয়েছে আমার থেকে আমার…” -” মা…আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।” ধীরে ধীরে চোখ খুললেন মিসেস ইমন মুখার্জী। ছটপটে রঞ্জনা যেন পঁচিশ বছর আগের উচ্ছল তিতাস। অনাথ আশ্রম থেকে ছ-মাসের শিশুটিকে পছন্দ করে বাড়ি নিয়ে আসার একমাত্র কারণ ছিল তার ঠোঁটের পাশের বিন্দুসম তিলটি। ঠিক যেমন ছিল তিতাসের অথবা বলা ভালো ইমনের ভালবাসার অত্যাচারের উৎস। ঝাপসা চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে উনি দেখলেন, ময়ুরকন্ঠি রঙের একটা শাড়ী হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সদ্যস্নাতা রঞ্জনা, যেন পবিত্রতার পরাকাষ্ঠা। চব্বিশ বছরের একটি তাজা অনাঘ্রাতা ফুল। চোখে চোখ পরাতে সে বলে উঠলো, -” তোমার ভয়ের কারণ আমি জানি মা। এবার এসো। আমাকে তৈরী করে দাও। আমাকে যে যেতেই হবে। ” (শেষ)