নীতিই উর্ধ্বে স্থান পেলো —আমরা সেই সে জাতি –– আবুল আসাদ

মক্কার কিছু দূরে হুদাইবিয়া গ্রাম। বিরাট এক বৈঠক বসেছে। বৈঠকে রয়েছেন মহানবী (সাঃ) এবং উল্লেখযোগ্য সব সাহাবি। মুশরিক কুরাইশদের পক্ষ থেকে রয়েছেন কয়েকজন প্রভাবশালী সরদার। হুদাইবিয়ার শর্তাবলি চূড়ান্ত হয়েছে, কিন্তু তখনও লেখা শুরু হয়নি। এমন সময় মক্কা থেকে আবু জান্দাল এসে সেখানে হাজির হল। তাঁর হাতে-পায়ে শিকল, সারা গায়ে নির্যাতনের চিহ্ন। মুসলমান হওয়ার অপরাধে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল। পুনরায় পৌত্তলিক ধর্মে ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁর আত্মীয়স্বজন তাঁর উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে। কত দিন আর নির্যাতন সইবে সে?

মুক্তির আশায় সে পাগল হয়ে উঠেছিল। এই সময় সে জানতে পারে, মহানবী (সাঃ) তাঁর চৌদ্দ শ’ সাহাবাসহ হুদাইবিয়া পর্যন্ত এসে যাত্রাবিরতি করেছেন। অনেক আশা তার মনে—একবার কোনো ক্রমে যদি মহানবীর (সাঃ) কাছে গিয়ে সে পৌঁছতে পারে, তাহলেই তার জীবনে এসে যাবে চিরমুক্তির সুবহে সাদিক। আবু জান্দাল হুদাইবিয়ার সেই বৈঠকে হাজির হয়ে মহানবীকে (সাঃ) তাঁর সব কথা জানিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করল। আবু জান্দালের নির্যাতনের কাহিনি শুনে উপস্থিত মুসলমানদের মনে বেদনার তরঙ্গ বয়ে গেল।

আবু জান্দাল হুদাইবিয়ার বৈঠকে পৌঁছার পরপরই আবু জান্দালের পিতা সুহাইল তার মুখে কয়েকটি চপেটাঘাত করল এবং আবু জান্দালকে তার হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য মহানবীর (সাঃ) কাছে দাবি জানাল। সে বলল, ‘হুদাইবিয়া সন্ধির শর্তানুসারে আবু জান্দালকে আপনারা রাখতে পারেন না। তাঁকে আপনারা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য।’ (হুদাইবিয়ার সন্ধির একটি শর্ত ছিল—মক্কার কোনো লোক মুসলমান হয়ে কিংবা অন্যভাবে মুসলমানদের আশ্রয়ে গেলে তাকে মক্কাবাসীদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে।)

সুহাইলের কথা শুনে মহানবী (সাঃ) বললেন, ‘সন্ধি এখন লিখিত হয়নি, স্বাক্ষর তো হয়ইনি। সুতরাং এর শর্ত এই মুহূর্তে মেনে নেওয়া কি খুবই জরুরি?’

সুহাইল কিন্তু নাছোড়বান্দা। সে বলল, ‘সন্ধি লিখিত ও স্বাক্ষরিত না হলেও কথা তো পাকাপাকি হয়ে গেছে। সুতরাং আবু জান্দালকে আমি অবশ্যই ফিরে পাব।’

মহানবী (সাঃ) সুহাইলের কথার জবাব দিলেন না। সুহাইলের কথা যে অমূলক নয়, তা তিনি জানেন। যা উভয় পক্ষে স্বীকৃত ও নির্দিষ্ট হয়ে গেছে, তা অস্বীকার করা যায় না। চিন্তিত হলেন তিনি। মহানবীকে (সাঃ) নীরব থাকতে দেখে মুসলমানরাও আশঙ্কিত হয়ে পড়লেন। কি জানি, তাদের এক ভাইকে নাকি আবার কাফিরদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হয়! মহানবী (সাঃ) অত্যন্ত নরম ভাষায় আবু জান্দালকে ফেরত না চাইবার জন্য সুহাইলকে অনুরোধ জানালেন। কিন্তু মহানবীর (সাঃ) বিনীত প্রার্থনাতেও সুহাইলের মন গলল না।

মহানবীর (সাঃ) সামনে তখন উভয় সংকট—একদিকে সন্ধির শর্ত রক্ষা, অন্যদিকে একজন মুসলমানকে কাফিরদের হাতে ফেরত না দেওয়া। সন্ধির শর্ত যেহেতু আগেই নির্ধারিত হয়েছে, তাই সন্ধির শর্ত পালনই তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠল। আবু জান্দাল যখন বুঝল যে, তাকে পুনরায় কাফিরদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তখন সে করুণভাবে কেঁদে উঠল। বলল, “আমি মুসলমান হয়ে আপনাদের কাছে আশ্রয় নিলাম, আর আপনারা আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। কত অত্যাচার, কত যন্ত্রণা যে আমাকে ভোগ করতে হয়, তা তো আপনারা জানেন না।”

আবু জান্দালের কথা শুনে উপস্থিত প্রতিটি মুসলমানের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। মন তাদের বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চায়—না, আমাদের ভাইকে আমরা ফিরিয়ে দেব না। দরকার হলে, তাকে রক্ষার জন্য যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করব। কিন্তু মহানবীর (সাঃ) সৌম্য শান্ত ভাবনার গভীরে নিমজ্জিত মুখের দিকে চেয়ে তারা কিছুই বলতে পারলেন না।

ব্যথা-বেদনার রাজপথ বেয়ে আবু জান্দালকে বিদায় দেওয়ার সময় মহানবী (সাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “আবু জান্দাল, আল্লাহর নামে ধৈর্য ধর, আল্লাহই তোমার মুক্তির ব্যবস্থা করে দেবেন।” চোখ মুছে আবু জান্দাল আবার ফিরে চলল মক্কায়। ন্যায়বিচার ও স্বীকৃত নীতিবোধকে এভাবেই মুসলমানরা সব সময় সবার ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!